গল্প : তিনটি মানব : শাকিব হাসনাত

0

অলংকরণ: নাহিদুল ইসলাম

আজ শুক্রবার। আজিমপুর গোরস্তানে এখন রাত ১০টা বেজে ১৫ মিনিট। পোস্টমর্টেম শেষে দ্রুতই দাফন করা হলো লাশটাকে। মাত্র বারো ঘন্টা আগে একটি মেয়েকে সমাহিত করা হয়েছে এই কবরস্থানে। মেয়েটির খুনি কল্পনাও করতে পারে নি মাত্র বারো ঘন্টা পরে তাকে-ও একই জায়গায় কবর দেয়া হবে।    

ঘটনাটা দুই দিন আগের। বুধবার সন্ধ্যার। অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে নুসরাত। বাস থেকে নেমে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয় ও-কে। কেউ একজন তাকে ফলো করছে, খেয়াল করল নুসরাত। ভয়ে তাঁর বুক ধকধক করছে। কিছুদূর যেতেই পেছন থেকে একটা হাত এসে তার তার মুখ চেপে ধরল। অনেক জোরাজুরি করেও নিজেকে ছাড়াতে পারল না নুসরাত। লোকটা নুসরাতকে একটা প্রাইভেট গাড়িতে তুলে নিল। ভয়ে, উত্তেজনায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলল নুসরাত।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন নুসরাত হাসপাতালের বেডে। ওর সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। অসংখ্য ব্যান্ডেজে মোড়ানো ওর সমস্ত শরীর। নুসরাতকে ঘিরে রয়েছে ওর মা-বাবা এবং আত্মীয়স্বজন। রুমের এক কোনায় দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে আছে মুহিব।

নুসরাতের রক্তাক্ত দেহ রাস্তায় পড়ে থাকাবস্থায় মুহিব-ই প্রথম  দেখেছিল। এবং একটা সিএনজি ডেকে পাঁজাকোলা করে কোনো রকমে ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে সে।

ছোটবেলা থেকেই নুসরাতকে চেনে মুহিব। সম্পর্কে চাচাতো বোন। একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া আসা করত তারা। পড়াশোনা শেষ করে দুইজনই চাকরি করছে। এইতো তিন-চার মাস আগেই বিয়ে করেছে মুহিব। নুসরাতের বিয়ের কথাও পাকা হয়ে গেছে, আগামী মাসে-ই। 

নুসরাত খুব-ই শান্ত শিষ্ট, শৈশব থেকেই। কখনো কারো সাতে-পাঁচে থাকে নি। তার সঙ্গে কেউ এমন পাশবিক আচরণ করতে পারে তা মুহিবের কল্পনাতীত।  যতই দিন যাচ্ছে পৃথিবীটা আরো নৃশংসরূপে উদ্ভাসিত হচ্ছে তার চোখে।।    

বৃহাস্পতিবার রাত। নুসরাতের অবস্থা খুবই গুরুতর। বিচলিত হয়ে পড়ে ওর আত্মীয় স্বজনরা। একজন নার্সকে পাঠানো হলো ডাক্তারকে খবর দিতে। ডাক্তার এসে তাড়াহুড়ো করে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে যায় তাকে। প্রায় দুই ঘন্টা ধরে ডাক্তাররা প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল নুসরাতকে বাঁচাতে। শেষ রাতে ডাক্তারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে, সবার সঙ্গে সকল সম্পর্ক চুকিয়ে নুসরাতের আত্মা চিরবিদায় নিল পৃথিবীর বুক থেকে। বিশাল এই পৃথিবীর কারও সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই নুসরাতের।   

পরদিন বিকেল। বুড়িগঙ্গার স্থানীয় জেলেদের মধ্যে খুব হাঁক ডাক শোনা যাচ্ছে। একটা লাশ খুঁজে পেয়েছে তারা। খুব বাজেভাবে খুন করা হয়েছে লোকটাকে। কেউ একবার তাকানোর পর দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস পায় না লাশটার দিকে, এত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। জেলেদের মধ্য থেকে একজনকে পাঠানো হলো পুলিশকে খবর দিতে। পরে পুলিশের কর্মীরা এসে লাশটাকে পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যায়। 

কিছুক্ষণ আগে এই লাশটাকেই কবর দেয়া হয় আজিমপুর গোরস্থানে।

কিছুদিন পর। ‘আমাদের জীবনটা হলো ঘড়ির কাটার মতো। অনবরত ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একদিন কাটাগুলো থমকে দাঁড়ায়’, ওসি সাহেবের ডান হাতের তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুলের মাঝখানে ধরে থাকা ছোট্ট ঘরিটার দিকে তাকিয়ে ভাবছে মুহিব। আর মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড পর তার জীবন ঘড়িটাও থেমে যাবে।

-ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে আপনার কী কোনো শেষ ইচ্ছা আছে? কারো সঙ্গে দেখা করতে চান?

-আমার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়ে গেছে ওসি সাহেব, হাসিমুখে জবাব দিল মুহিব। যদি কিছু মনে না করেন, আমাকে কি একটা সিগারেট দেয়া যাবে? 

নিজ হাতেই সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন ওসি সাহেব। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে মহাপুরুষ সমতুল্য মনে হচ্ছে ওসি সাহেবের। এক জীবনে অনেক আসামিকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন, কিন্তু কারও জন্যেই এমন মায়া অনুভব করেননি তিনি।

মায়া জিনিসটা বড় অদ্ভুত। সৃষ্টিকর্তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন এই বস্তুটিকে। একজন আসামির জন্য পুলিশের মায়া হয়, রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা একজন ভিক্ষুকের জন্যে আমাদের মায়া হয়, মায়া হয় একটি নিম্ন শ্রেণির প্রাণীর জন্যেও।  

আয়েশ করে সিগারেটে টান দিচ্ছে মুহিব। ওকে দেখে মোটেও বিচলিত মনে হচ্ছে না। যেন ফাঁসির মঞ্চে নয় বিরাট কোনো মুক্ত মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো হাসির দৃশ্য দেখছে সে।  এই মুহূর্তে যে জিনিসটা ভেবে মুহিব সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাচ্ছে, ‘অন্তত একটা ধর্ষণের উপযুক্ত বিচার করতে পেরেছি আমি। লাশটার দিকে তাকালে অন্য যেকোনো ধর্ষকের পিলে চমকে যাবে। কাউকে ধর্ষণের কথা চিন্তা করার আগে অন্তত একবার হলেও বুক কাঁপবে তার।’

দড়িতে দোল খেতে খেতে হাসি মুখে মহাকালের অনন্তযাত্রায় রওনা হয়ে গেছে মুহিব। একইসাথে আকাশ থেকে খসে পড়ল আরও একটি নক্ষত্র।

ছোট্ট একটা ভুল, যার মাশুল গুনতে হয়েছে তিনটা প্রাণকে। কিন্তু শুধুই কী তিনটা প্রাণ? হয়তো তিনটি পরিবার। তিনটি জননী। কিংবা তিনটি নবজাতক, পৃথিবীর দূষিত বাতাস যাকে এখনো স্পর্শ করেনি। 

বিচিত্র এক সংখ্যা ‘তিন’, তার থেকে বেশি বিচিত্র আমাদের এই মানব জীবন… 

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।  

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন