আবু হিমু।। গল্প।। পীর ছাহেবের ইজ্জত ও নায়ুজুবিল্লাহ

0

আর্টওয়ার্ক: নগরবাসী বর্মন

এক

মেঘনার বুকে আস্তে আস্তে বয়ে চলছে ছোট্ট একটি ডিঙ্গি নৌকা। বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা শুরু হয়ে গেলো খানিক আগে। মাঝ নদীতে কিছুটা মাঝারি মাপের ঢেউ থাকায় নৌকোটিকে সামান্য তীর ঘেঁষে যেতে হচ্ছে। সামনে-পিছনে দু’জন মাঝি সমানে বৈঠা বেয়ে যাচ্ছে। বাতাসের হুহু শব্দ আর নদীর ঢেউ উত্তোলিত স্রোতের কলকল ধ্বনী। নৌকোর ভেতর কেবল মাত্র দু’জন যাত্রী। তাদের একজন কাপড়ে মুখ লুকিয়ে গুমরে-গুমরে কাঁদছে। আরেকজন শান্তির ঘুমে আবিষ্ট। ঘুমের মধ্যে নাক ডাকার প্রকান্ড আওয়াজ হচ্ছে। এতো আওয়াজ যে সাহিদার কান্নার শব্দ সে নিজেও শুনতে পাচ্ছে না। ঘুমিয়া থাকা পাশের মহিলা সাহিদার মা। সারাদিনের অনেক হাটাহাটির ফলেই বুড়ো মানুষ ঘুমিয়ে পরেছেন। সাহিদা কেঁদে চলছে। নৌকো যত এগিয়ে যচ্ছে, সাহিদার কান্নার তীব্রতা ততই বাড়ছে। কম দামি ময়লা ছেড়া কাপড়ের আঁচল তার কান্নার আওয়াজ যেনো আর নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারছে না। পিছন থেকে মাঝি নাসির উদ্দিন হেঁকে উঠলো। মামিজান, কাঁন্দেন কেন? সাহিদা নিচু স্বরে উত্তর দিলো, না মামা কানতেছি না। সামনে থেকে আরেক মাঝি নাসিরের ছোট ভাই ছগির চিৎকার করে বলতে লাগলো, ভাইজান আমিও আওয়াজ পাইতেছি অনেকক্ষণ ধইরা মামিজান কানতেছেন। মাঝি দু’জন সাহিদার স্বামীর একমাত্র বড় বোনের দুই ছেলে। তাদের নিজদের নৌকো। যাত্রীও নিজেদের লোক। তাই আস্তে আস্তে বাইছে। নাসির আবার ডেকে উঠলো, মামিজান, পীর ছাহেব কি খারাপ কিছু কইছে? খুব বেশী দেরি অইবো নাকি? কত দিন লাগবো কইছে পীর ছাহেব?

সাহিদা উত্তর দেবার আগেই তার মা শমলা বেগম জেগে উঠলো। তাঁরা দীর্ঘ পথ হেটে  পীর ছাসেবের বাসা থেকে নৌকো পর্যন্ত পৌঁছেছে। সাথে বেশ কয়েকজন পীর-ভাই ঘাট পর্যন্ত তাদের সাথে এসেছে। সে কারণে মেয়ের সাথে তার আর কথা বলা হয়নি। পীর সাহেব কী বলেছেন সেটাও জিজ্ঞেস করতে পারেননি। ঘুম থেকে উঠেই তিনি সাহিদার কপালে একটা চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মাগো কান্দো কেন? পীর বাবা কী বলেছেন? খারাপ কোন সংবাদ?

সাহিদা এবার উচ্ছস্বরে কাঁদতে শুরু করলো। মায়ের কোলে লুটিয়ে পরলো সে। শমলা বেগম মেয়ের মাথাটা কোল থেকে তুলে বুকের কাছে নিয়ে মেয়ের মুখটা উচিয়ে ধরলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন, মাগো পীর বাবা ছাহেব কী বলেছেন আমারে খুইলা কও। বাবা হুজুরের মুখ দেইখা আমার শুভ সংবাদ মনে হইছে। সাহিদা একটু চুপ থেকে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের হাত চেপে বললো, আম্মা পীর সাহেব আমারে কু-প্রস্তাব দিয়েছেন?

এতটুকু শুনে শমলা বেগম অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। চেচিয়ে উঠে বললেন, “তোর এতো বড় সাহস! মাগি, তুই বলছ বাবা হুজুর তরে কু-প্রস্তাব দিছে?’ এই বলে মেয়ের গালে সর্বশক্তি দিয়ে এক থাপ্পর বসিয়ে দিলেন শমলা বেগম। তাতে তার মন ভরলো না। আরেক গালে আরেক থাপ্পর দিয়ে সাহিদের চুলের মুঠি ধরে রাগে ফোঁপাতে থাকলেন। “বেহায়া মেয়েছেলে। বাবা ছাহেবেরে নিয়া তুই খারাপ কথা কস। তোর মতো বান্দিরে বাবা হুজুর এতো বড় রহমত করলো আর তুই বলছ কু-প্রস্তাব। জাহান্নামেও ঠাই অইবো না তোর। খোদায় তোরে জাহান্নামের লাকরিও বানাইবো না। ব্যাশ্যা মাইয়া। এতো দিনে বাবার সুনজর তোর উপর পরলো। আর তুই হুজুররে অপবাদ দেছ। কিছু যদি হয় তাইলে বাবার দয়ায়ই অইবো। গত তিন বছরে তো একটা পোলা-মাইয়াও বিয়াইতে পারলি না। দুই বছর ধইরা বাবার দরবারে যাই। আজ এতো দিন পর বাবার রহমত হইলো তোর উপরে। এখন যদি তোর তালাকটা আটকান যায়।  বলতে বলতে কোন এক অজানা কারণে কেঁদে উঠলেন শমলা বেগম।

এরপর বেশ কিছুক্ষণ নীরব ছিলো দু’জনেই। সাহিদা লজ্জা আর অপমানে দিশেহারা হয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবলো, মেঘনায় ঝাঁপিয়ে পরবে। তার মনে হচ্ছিলো তার মায়ের সবগুলো কথা নাসির আর ছগির শুনতে পেয়েছে। আর যদি তা-ই সত্যি হয়, তবে সে আর বাড়িতে ফিরে শশুর বাড়ির লোকদের মুখ দেখাতে পারবে না। এই কথাগুলো নিশ্চয়ই ছগির তার বউকে বলবে। আর তার বৌকে বলা মানে হলো সাহিদার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই জেনে যাওয়া। অনাগত এই লজ্জা থেকে মুক্তি কীভাবে পাওয়া যায় তা-ই ভাবছিল সাহিদা। এর মধ্যে আচমকা তার পিঠে একটা স্পর্শ পেয়ে চিন্তার জগত থমকে গেলো। হাতটা শমলা বেগমের। এবার তিনি অত্যন্ত শান্ত। সুমিষ্ট গলায় মেয়েকে বলতে লাগলেন, “মাগো, বাবা হুজুর হইলেন মহাপবিত্র। তেনাদের কোন পাপ নাই। তিনি যা বলছেন তোমার মঙ্গলের জন্যই বলছেন। নিশ্চয়ই এর মইধ্যে আল্লাপাকের ঈশারা আছে। তুমি মা খাছ দিলে তওবা পড় ২১ বার। ভুল করে যা বলছো তার জন্য নাউজুবিল্লাহ বল। মনে মনে বাবা কেবলা হুজুরের কাছে ক্ষমা চাও। তোমার হইয়া আমিও বাবার কাছে তওবা করমু; ক্ষমা চামু।”

এরপর তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করললেন, “বাবা হুজুর তোমারে কবে যাইতে কইছে মা?”

সাহিদাঃ আগামী চান্দের পূর্ণীমার দিন।

শমলাঃ কয়দিন থাকতে বলছেন বাবা?

সাহিদাঃ শুধু চান্দের রাইত। ঈশাড় আজান থাইকা ফজরের আজান পর্যন্ত।

শমলাঃ ঠিক আছে মা। আমি তোমারে নিয়া যামু। ঐদিন খুব ভালো কইরা ঈমানের সাথে বাবার খেদমত করবা। মনে রাখবা, বাবার সাথে যেনো কোন বেয়াদবী না হয়; ভুল-ত্রুটি না হয়। বাবা খাইতে বললে খাবা। দাঁড়াইতে বললে দাঁড়াইবা। আরেকটা কথা, কোন ভাবে ঐ রাইতে দুই চউক্ষের পাতা এক করবা না, যত কষ্টই হোক। সয়তান তোমার ধোঁকা দিবো। সয়তানের ধোঁকায় পরবা না মা।

সাহিদাঃ নীরবে বিড়বিড় করে কী যেনো একটা বললো।

শমলাঃ বলো মা, আলহামদুলিল্লাহ।

সাহিদাঃ নিশ্চুপ হয়ে নদীর ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে। সে যেনো অফুরন্ত ঢেউগুলোকে গুনতে শুরু করেছে ১,২,৩………৫১………………১০১……

দুই

আব্দুর রহিমের বয়স প্রায় ২২। নামি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সকালে বাবা-মা আর  ছোটবোনকে সাথে নিয়ে মামার বাসায় বেড়াতে এসেছে। তারা কয়েদিন থাকবে। সাথে তার একমাত্র ছোটবোন রহিমা। ওর বয়স এখন ১৬। দেখতে শুনতে খুব সুন্দর হয়েছে বোনটি তার। এখনি বিয়ের সম্বোন্ধ আসছে প্রতিদিন। রাতে খেয়েদেয়ে মামাতো ভাই আজাদের সাথে নিচে ফ্লোরে শুয়ে পরলো সে। খাটের উপর শুয়েছিলো তার মা, মামি, রহিমা আর মামাতো বোন। অন্য ঘরে তার বাবা আর মামা। ভালো ঘুম আসলো। শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পরলো। ঘুমের মাঝেই সে ফজর নামাজের আজান শুনতে পাচ্ছিলো। সাধারণত ফজরের আজানে তার ঘুম ভাঙ্গে না। আজ হয়তো খুভ ভালো ঘুম হবার ফলেই এমন হয়েছে। সে তার মা এবং মামির বিড়বিড় করে কথা বলার ধ্বনি খেয়াল করলো। তাদের স্বর খুব নিচু হলেও আব্দুর রহিম স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো কথাগুলো। এতোটুকু বলেই দীর্ঘক্ষণ থেমে ছিলো তার মা। মামিও কোন আওয়াজ করছিলো না। রহিম সব শুনলো। একদম শুরু থেকে। শুনতে শুনতে তাঁর মনে প্রচন্ড এক ক্ষোভ আর ঘৃণা দানা বাঁধতে থাকলো। খানিক থেমে আবার গল্প বলতে শুরু করলো সাহিদা বেগম। রহিম আবারও নীরব শ্রোতা হয়ে শুয়ে থাকলো।

আজ থেকে চার বছর আগে যখন রহিম মেট্রিক পরিক্ষার্থী তখন তাকে দূরের এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো। সে সময় এখনকার মতো এতো কাছে কাছে পরীক্ষার সেন্টার পরতো না। পুরো এক মাস তাদেরকে সে বাসায় থাকতে হয়েছিলো। মাঝে মাঝে তার বাবা গিয়ে তাদের বাজার সদাই করে দিয়ে আসতো। ঐ বাসার ঠিক কয়েকঘর পরেই ছিলো একজন কামেল পীরের দরগা। আব্দুর রহিমরা যে বাসায় থাকতো সে বাসার বাড়িওয়ালি পীর-ফকির খুব মানতো। মহিলার ভাষ্যমতে, তার জীবনে যত সুখ, তার স্বামীর যত ধন-সম্পদ, সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত হওয়া সবই পাশের বাড়ির দাঁড়ি বাবার রহমত আর দয়ায়। দাঁড়ি বাবার পুরো মুখ দাঁড়িতে ঢাকা। সেই দাঁড়ি আবার নিচের দিকে পা পর্যন্ত লম্বা। তাই এমন নাম। রহিমরা এখানে এসে অপরিচিত অনেকের কাছে এই অধভুত গল্পটা শুনেছে। দাঁড়ি বাবা এক সময় বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরুর ঔষধ বিক্রি করতেন। সাথে গরুর চিকিৎসাও জানতেন টুকটাক। একদিন কোন এক মূমূর্ষু গরু চিকিৎসা করতে গিয়ে পরেলেন বিপাকে। গরুকে চিকিৎসা দেবার সাথে সাথে অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলো। গরুর মালিক তাঁকে কয়েক ঘন্টা বেঁধে রেখেছিলো। হাল্কা উত্তম-মধ্যমও দিয়েছিলো। গরু মরমর অবস্থা। কিন্তু অলৌকিকভাবেই আসরের আজানের “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি হবার সাথে সাথে গরু উঠে দাঁড়ালো। তাই দেখে গরুর ডাক্তারের অহংকার আর যায় কোথায়? গরুর মালিকও এক রকম সরমিন্দা হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিলে। ডাক্তার সাহেব বিদায় নেবার আগে গরুটার মাথায় হাত দিয়ে একটু আদর করে দিতে গেলেন। আর তখনই গরুটা তাকে কামড়ে দেয়। তারপর দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন বাবা। ছয়মাস অসুস্থ থাকার পর বাবা যখন প্রায় মারা যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই একদিন আধ্যাতিক ক্ষমতা পেয়ে সুস্থ হয়ে উঠেন তিনি। সেদিন সকালে গ্রামে হৈচৈ পরে যায়। বাবার থাকার ঘরে জেগে উঠেছে বিশাল এক কবর। বাবাও সুস্থ হয়ে উঠেছেন সেদিন। কবরের পাশেই বসে আছেন তিনি। মুখ ভর্তি দাঁড়ি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিস্তৃত চুল। সে অলৌকিক কবর দেখতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন দূর-দুরান্ত থেকে। কেউ কেউ সেদিনই এসে বাবার ভক্ত হয়ে যান। তারপর গত এক দশকে বাবার দুচালা টিনের ঘরের জায়গায় কয়েকটা আধুনিক ভবন গড়ে উঠেছে। পুরো বাড়িতে এক রাজকীয় ভাব। সবই করে দিয়েছে তার গুনমুগ্ধ ভক্তরা। কয়েকশ গরু-ছাগল-হাস-মুরগি সব সময় এই বাড়িতে অবস্থান করে।ভক্তরা বাবাকে ভালোবেসে নিয়ে আসেন। আর বাবা প্রতি হাটে লোক পাটিয়ে সেগুলো বিক্রী করেন। এগুলো আবার দাঁড়ি বাবার দরগার প্রাণী আর বিশেষ রহমত হিসেবে বিক্রি হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি দামে । একবার নাকি একটা মুরগী বিক্রি হয়েছিলো ২০০০০ টাকায় যদিও তখন সাধারণ একটা মুরগির দাম ৫০-৭০ টাকা। আব্দুর রহিম একবার গ্রামের ওয়াজে এমনটা দেখেছিলো। একটা সিদ্ধ ডিম সেদিন মাদ্রাসার বড় হুজুর ৩ টাকা দিয়ে কিনে এনে ওয়াজে ১২৫০০ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। হুজুর ডিমের মধ্যে বিশেষ দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেই ফুঁ দেয়া ডিম কিনতে লোকের মধ্যে এক রকম মারামারি। শেষ পর্যন্ত গমচোরা চেয়ারম্যান বলে এলাকায় পরিচিত সাত্তার চেয়ারম্যান সর্বোচ্চ দাম দিয়ে কিনে নিয়েছিলো।  

বাড়িওয়ালি প্রায় প্রতিদিন সন্ধায় দাঁড়ি বাবার দরগায় যেতেন এটা সেটা নিয়ে। বেশিরভাগই নিজের হাতে রান্না করা খাবার। দাঁড়ি বাবা নাকি ওনার হাতের রান্না খুব আরাম করে খান। যাবের আগে খুব সুন্দর করে সাজেন তিনি। গায়ে গহনার বাড়াবাড়ি রকমের আধিক্য দেখা যায়। বিদেশ থেকে ছেলেদের পাঠানো একাদিক পারফিউমের মিশ্র উদ্ভট এক গন্ধ পাওয়া যায় তার শরীর থেকে।  তিনি প্রতিদিনই যাওয়ার সময় আব্দুর রহিমের মা সাহিদাকে ডাকেন সাথে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সাহিদা বেগম এটা সেটা বলে পাশ কাটিয়ে যান। এভাবে তাদের প্রায় ২০ দিন কেটে যায় সেখানে। একদিন সন্ধ্যায় বাড়িওয়ালী এসে সাহিদা বেগমকে খুব জোর করে ধরে। দাঁড়ি বাবার দরবারে সাহিদাকে যেতেই হবে। অন্তত একবারের জন্য। তিনি বলেন, দাঁড়ি বাবার দোয়া পাইলে তোমার ছেলে ভালা নাম্বার পাইয়া পাশ করবো, বইন। লও আমার লগে আইজ। তোমার ভালো লাগলে পরে যাইয়ো আর ভালো নাগলে না যাইয়ো। এই কথা শুনে সাথে সাথে মন গলে যায় সাহিদার। কারণ, সেদিনের পরীক্ষা শেষ করে এসে আব্দুর রহিম মন খারাপ করে আছে। তার নাকি পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। যাইহোক, সাহিদা বেগম একটা ভালো কাপড় পরে দাঁড়ি বাবার দরবারে গেলেন।

দাঁড়ি বাবার দরগায় ঢুকে সাহিদা অবাক হয়ে গেল। এতো মানুষ এক সাথে সে কোনদিন দেখেনি। বাবা হুজুরের দরগায় এতো মানুষ হয়নি কোনদিন। হঠাত করেই তার সেই অতীত মনে পরে গেলো। একটু কেপে উঠলো সাহিদা। চোখের সামনে সেই বীভৎস স্মৃতি যেনো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাড়িওয়ালি সাহিদাকে হাতে ধরে সামনে নিয়ে গিয়ে একদম দাঁড়ি বাবার কাছে গিয়ে বসলেন। ঘরের কিছু লাইট অফ করে দেয়া হলো। সবাই একদম চুপ হলো। যাকে বলে পিনপতন নীরবতা অথবা গ্রামের ভাষায় “মরার বাড়ির মতো চুপ”। দাঁড়ি বাবা কথা বলতে শুরু করলেন। বাবার কোমল স্বর সাহিদার মনে একটু নাড়া দিয়ে গেলো। এর পর যতই সময় যাচ্ছিলো বাবার প্রত্যেকটা কথায় সাহিদা ততি মুগ্ধ হতে থাকলো। এমন সুন্দর কথা সাহিদা আগে কখনো শোনেনি। বাবার কথাগুলো  তাকে মোহিত করে ফেললো। এর মাঝে টানা ৩টা ঘন্টা চলে গেলো। হঠাত বাবা থেমে গেলে সাথে সাথে লাইটগুলো জ্বলে উঠল। সব যেনো আধ্যত্মিকভাবেই হচ্ছে। সবাই বসা থেকে উঠে বাবাকে সিজদার মতো করে সালাম করে যার যার মতো চলে গেলো। এরপর থেকে প্রতিদিন সন্ধায় বাবার দরবারে যাওয়া সাহিদার অভ্যাসে পরিণত হলো। আব্দুর  রহিমের পরীক্ষা শেষ হয় যাচ্ছে। মাত্র আর ২ টা পরীক্ষা বাকী। ৪ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যবে। এরই মধ্যে একদিন ওর বাবা ছোটবোন মরিয়মকে নিয়ে আব্দুর রহিম আর তার মাকে দেখতে এলো। মরিয়ম খুব বায়না ধরলো এই কয়টা দিন সে মা আর ভাইয়ের সাথে থেকে যাবে। সাহিদাও স্বামীকে বললো মরিয়মকে রেখে যেতে। অগত্যা, বেচারা বাবা মেয়েকে রেখে যেতে বাধ্য হলো। মরিয়ামের বয়স তখন ১২। ধীরে ধীরে সে যেনো শিশু থেকে মেয়েতে পরিণত হচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যায় মরিয়মকে সাথে নিয়ে সাহিদা বেগম তার বাড়িওয়ালির সাথে দাঁড়ি বাবার দরবারে গেলো। ঠিক প্রতিদিনের মতোই পরিবেশ। সবাই বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। বাবা ঘরে ঢুকতেই সবাই দাঁড়িয়ে গিয়ে জোড়-হাতে বাবাকে শ্রদ্ধা জানালো। দাঁড়ি বাবা তার গদিতে বসে চোখ বন্ধ করে আবার কী মনে করে চোখ খুলে  পুরো ঘরটা এক পলকে দেখে নিলেন। তারপর তিনি আবার চোখ বন্ধ করে প্রতিদিনের মতো বয়ান করলেন। ভক্তরা সবাই চোখ বন্ধ করে মুগ্ধ হয়ে বাবার কথা শুনতে লাগলেন। কেউ কেউ আবার আরামে ঘুমিয়ে পরেছেন। আবার কারো কারো নাক ডাকার মৃদু আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বাবার বয়ান চলছে। এরই মাঝে মরিয়াম তার গায়ে কেনো একজন মানুষের হাতের স্পর্শ খেয়াল করলো। একজন পুরুষের হাত মনে হলো। আকস্মিক এক ঘটনায় সে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। তাদের আশেপাশেতো কোন পুরুষ বসেনি। এক পাশে মা আরে পাশে বাড়িওয়ালি। পেছনের সবাই মহিলা। আর কিছুদূর সামনে বসে দাঁড়ি বাবা বয়ান করছেন। তার কাছে মনে হতে থাকলো দাঁড়ি বাবার স্বরটা খুব কাছে চলে এসেছে। সে চোখ খোলার সাহস পাচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত মরিয়ম ভয়ে মায়ের হাত চেপে ধরলো। সাথে সাথে ঘরের সকল বাতিগুলো জ্বলে উঠলো। আগের মতো ভক্তরা সবাই বাবাকে সিজদার মতো ভক্তি করে চলে গেলো। সাহিদা বেগম চলে যাওয়ার জন্য যখন ঘাড় ফেরাবেন, তখন বাবা তাকে ঈশারা দিয়ে বসতে বললেন। একইভাবে ঈশারায় বাড়িওয়ালিকে বাহিরে গিয়ে বসতে বললেন। সবাই চলে গেলো সাহিদা বেগমের উদ্দেশ্যে দাঁড়ি বাবা বলতে থাকলেন, “মা জননী, তোমার এই মেয়েটা বড়ই লক্ষী। বড়ই ভাগ্যবতী। সাত রানীর ভাগ্য একা নিয়া জন্মাইছে। তার হাতে জগত আলোকিত হইবো।“

এসব কথা শুনে জননী সাহিদার বুক গর্বে ভরে গেলো। মেয়ের অনাগত সুখের কথা জেনে মায়ের চোখের কোণে অশ্রু জমে গেলো। সে বাবার সামনে আবার নতজানু হলো।

দাঁড়ি বাবা বললেন’ “তোমার মেয়েটাকে দরগার খেদমতে লাগাও গো মা। ও এইখানে রাজত্ব কইরা বেড়াইবো।”

সাহিদাঃ বাবা, ওতো অনেক ছোট। ও দরগার এতো পবিত্র আর ভারী কাজ কীভাবে করবো?

দাঁড়ি বাবাঃ তোমার চিন্তা করা লাগবো না মা। এইখানে ওর থাকা লাগবো না। ওরে শুধু প্রত্যেক পূর্ণিমার দিন আমার দরগায় নিয়া আসবা। আমি ওরে তালিম দিয়া শিখাবো। আমার বিবিদের সাথে ওরে রাখবো। ভয়ের কিছু নাই।

হঠাত মেয়ের দিকে চোখ গেলে মা সাহিদার। মেয়ের গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে তা সাহিদার চোখে পরলো।

২৩ বছর আগে তার মা শমলা বেগমের কথা তার মনে পড়লো। একপলকে সব চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সে ভাবলো, তবে সেও কী তার মা শমলা বেগমের মতো হতে যাচ্ছে?

না। আমার মাইইয়ার এমন ক্ষতি আমি করতে পারি না। মনে মনে চিৎকার করে উঠে মেয়ের হাত চেপে ধরে সাথে সাথে দৌড়ে বের হয়ে গেলো সাহিদা। সে রাতেই সাহিদা, আব্দুর রহিম আর মরিয়াম নিজেদের বাড়িতে পালিয়ে চলে এসেছিলো। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলো, দাঁড়ি বাবার বেশ কিছু ভক্ত সেদিন মধ্যরাতে মরিয়মের খোঁজ করতে এসেছিলো।

তিন

মামার বাড়ির সেদিনের সেই ঘটানাগুলো মায়ের মুখে শুনার পর থেকে আব্দুর রহিম একরকম পাগলের মতো হয়ে যায়। এক সপ্তাহের মধ্যে সে বাবা হুজুরের ঠিকানা জোগাড় করে চলে যায় বাবা হুজুরের দরগায়। বয়সের ভারে একদম নুয়ে পরেছে বাবা হুজুর। তার আসে পাশে শতশত ভক্ত। কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউ পুরুষ, কেউ মহিলা। সবাই আলাদা আলাদা মানত নিয়ে বাবা হুজুরের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে। বাবার চোখ শুধুই মাটির দিকে। আব্দুর রহিম সব দেখে বুঝে লোক ঠেলে বাবা হুজুরের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো।

আব্দুর রহিম বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা হুজুর, এই যে হাজার হাজার মানুষ আপনাকে বাবা ডাকে, আপানার নিজের ছেলে-মেয়ে সবাইকে আপনি চিনেন? জানেন তাঁরা কে কোথায় আছে?”

বাবা হুজুর চোখ তুলে তাকালান। তার চোখ নিমিষেই রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। জোরে চিৎকার করে সে বলে উঠলো নায়ুজুবিল্ললাহ……মোট ২১ বার বললো। সাথে সাথে তার ভক্তরাও ২১ বার নায়ুজুবিল্লাহ বললো। আস্তে আস্তে মজলিস থেকে বেরে হয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো আব্দুর রহিম। তার বুকটা অজানা এক ব্যাথায় ভারি হয়ে আছে। পা দুটো অবশ হয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে এক আম গাছে নিচে বসে পরলো সে। পাশ থেকেই একজন বলে উঠলো, “নায়ুজুবিল্লাহ…এইখানে কেউ বসে না। বিড়বিড় করে লোকটা ২১ বার নায়ুজুবিল্লাহ পড়লো।”

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন