প্রবন্ধ : আন্তর্জালে ফোক মটিফ; অচিনের পরিচয় : প্রদিতি রাউত প্রমা

0

অলংকরণ:ফারিনা আহমেদ

লোকশিল্প হচ্ছে লোকসমাজের সংস্কৃতি যার মধ্য দিয়ে একটি দেশের লোকায়ত ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি দীর্ঘদিন ধরে একই আঙ্গিকে ও প্রকাশভঙ্গিতে প্রচলিত হয়ে আসছে। ফোক মটিফও তার ব্যতিক্রম নয়। লোকশিল্প শাখাতে এই মটিফের পদচারণা। লোকশিল্প বস্তুগত ফোকলোরের অন্যতম অনুষঙ্গ। সকল সংস্কৃতির মধ্যেই কিছু ঐতিহ্যনির্ভর উপাদান থাকে যেগুলো কালের বিবর্তনের সঙ্গে নতুন করে নতুন আঙ্গিকে রূপান্তরিত হয়। নগরায়নের সাথে সাথে এই মটিফগুলো ছড়িয়ে পড়ে। নতুন ঢঙে, নতুন রঙে এ মটিফগুলো শহুরে মধ্যবিত্তের রুচিকে অত্যন্ত আকর্ষণ করে। গ্রামীণ লোকশিল্প থেকে মটিফগুলো উঠে এসেছে শহরে, আর শহর থেকে আন্তর্জাল বা ইন্টারনেটে। আন্তর্জালের কল্যাণে প্রায় সারাদিন আমরা বিভিন্নভাবে ফোক মটিফ দেখছি, ব্যবহার করছি। কিন্তু জানতে পারছি না যে এগুলো ফোক মটিফ। জানা হচ্ছে না এগুলোর ঐতিহ্যিক বাস্তবতাও! গ্রাম থেকে শহর, দৈনন্দিন জীবন কার্যে দুই বাস্তবতায় বাহিত হচ্ছে।

১. ব্যবহারিক বাস্তবতা ও ২. ভার্চুয়াল বাস্তবতা/ আন্তর্জালিক বাস্তবতা।

শহুরে মধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ গ্রাম থেকে এসেছে। ফলে তাদের সঙ্গে তাদের সংস্কৃতি, শিল্পও শহরে উঠে এসেছে। লোকসমাজের পরে শহুরে মধ্যবিত্তের পরিশীলিত সৌন্দর্যবোধে (নকশিকাঁথা, শাড়ি, গহনা) ফোক মটিফ ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহুদিন। নতুন মাধ্যম হিসেবে যোগ হয়েছে ইন্টারনেট। ক্ষেত্র বিস্তৃত হওয়ার কারণে মূল আধার থেকে মটিফগুলো বিচ্যুত হওয়ায় এদের পরিচয় শনাক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেটে বহুল ব্যবহৃত দৃশ্যমান এই মটিফগুলোর পরিচয় অন্বেষণই এই লেখার উদ্দেশ্য।

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে জেনে নেওয়া প্রয়োজন মটিফ কী? ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা কিছু স্থায়ী ফর্ম বা ডিজাইন হলো মটিফ। এ প্রসঙ্গে গবেষক মেহেদী উল্লাহ বলেন, “যেকোনো লোক-আঙ্গিকে মটিফ চিহ্নিতকরণ কাঠামোবাদী তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণের ফল।” (পৃ-২১, ২০২০)

এগুলো গড়ে ওঠে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনকে কেন্দ্র করে। ঐতিহ্য, সংস্কার, বিশ্বাস, নান্দনিকতা ইত্যাদি বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। মটিফ কোন উপাদানের ক্ষুদ্রতম অংশ। ইহা মূলত ঐতিহ্য আশ্রিত প্রতীক বা চিহ্ন। যেমন: পদ্ম, কলকা, সূর্য, সজীব গাছ, নদী, মাছ, নৌকা, হাতি, ঘোড়া, মুখোশ, ময়ূর, মকর, পুষ্পিত লতা, স্বস্তিকা, জ্যামিতিক বিন্যাস, কলসি, ঘট, হরিণ ইত্যাদি। এই মটিফগুলোর আলাদা আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। যেমন: ধান ছড়া ধন-সমৃদ্ধির, পদ্ম পবিত্রতার, স্বস্তিকা সৌভাগ্যের প্রতীক। এই মটিফগুলো খুঁজে পাওয়া যায় একাধারে আলপনা, নকশি কাঁথা, শাড়ি, জামা, পাঞ্জাবী, রুমাল, শৌখিন পুতুল, মুখোশ, দেয়ালচিত্র, অলঙ্কার, কার্ড, ম্যাগাজিন, মাটির জিনিষপত্র, শীতল পাটি, র‍্যাপিং পেপার, শো-পিস, গহনার বাক্স, ভিউ কার্ড ইত্যাদিতে। লৌকিক পরিবেশে গড়ে ওঠা মটিফের গঠন শৈলীতে সরলতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা প্রধান বৈশিষ্ট্য। হাতের কাছে পাওয়া মাটি, কাঠ, কাপড়, সুতা, শোলা, বাঁশ, বেত ইত্যাদি দিয়ে তৈরি জিনিষপত্রে মটিফগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। অর্থাৎ মটিফের আধার হচ্ছে লোকশিল্প। আর লোকশিল্পের আধার লোকসমাজ। লোকশিল্প চিরায়ত ও ঐতিহ্যকেন্দ্রিক এসব ফোক মটিফকে ধারন করে হয়ে ওঠে নগর ফোকলোরের অংশ। মটিফগুলো দৃষ্টিনন্দন, মধ্যবিত্তের রুচিকে আকৃষ্ট করছে। তাই ফোক মটিফ ব্যবহৃত শৌখিন লোকশিল্প মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন ব্যবহৃত পণ্য বা ড্রয়িং রুমের শো-পিস সামগ্রী রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে।

গ্রামীণ লোকশিল্প থেকে উঠে আসা ফোক মটিফগুলোকে এতদিন বিভিন্ন ফ্যাশান হাউজ (যেমন- রঙ, আড়ং) তাদের পোশাক, ব্যাগ, গহনায় ব্যবহার করত। কাঁচ বা মেলামাইন দিয়ে তৈরি গ্লাস, প্লেটসহ নানা বাসনপত্রেও চোখে পড়ত এসব মটিফ। আলমারি, সোফাসহ নানা আসবাবপত্রের ডিজাইন হিসেবে এগুলো যেমন দেখা গেছে তেমনি ব্যবহৃত হয়েছে বিয়ে, জন্মদিন বা যে কোনো সামাজিক উপলক্ষ্যে করা কার্ডে বা বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পে। জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শো-পিস, ওয়াল ম্যাট তৈরি, প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ সজ্জায়, দেওয়াল রাঙানোর কাজে। এসব পণ্যের সম্প্রসারণের ফলে ফোক মটিফগুলো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে নগরে। বিস্তৃতি লাভ করেছে লোকসমাজ থেকে মধ্যবিত্ত সমাজে।

মানুষের জীবনের একটি বড় অংশ এখন ইন্টারনেট নির্ভর। আন্তর্জালের সঙ্গে নিত্য বসবাস করায় এই মটিফগুলোর সঙ্গে অনলাইন/আন্তর্জালে নিয়মিত দেখা হয় আমাদের। কারণ এই মটিফগুলোকে ব্যবহার করা প্রতিটি ফ্যাশন হাউজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজস্ব পেইজ ছাড়াও রয়েছে ওয়েবসাইট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ফ্যাশান হাউজগুলোর মনোগ্রাম তৈরি হয় ফোক মটিফ দিয়ে। আবার ব্যক্তিগত চেষ্টাতেও বেশ কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন পণ্যে ফোক মটিফ ব্যবহৃত হচ্ছে। চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা জানছি না এগুলোই চিরায়ত বাংলার ফোক মটিফ। যেগুলোর আলাদা ঐতিহ্য এবং অর্থবাচকতা রয়েছে। আন্তর্জাল প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন পণ্যে ‘ফোক মটিফের’ বহুল ব্যবহারের কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো-

পোশাক ও অলংকারে ফোক মটিফ:

ফেসবুকে চোখ রাখলে দেখা যায় নানা নামে শাড়ি, জামা, কাপড়ের পেইজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তারা বিভিন্ন শাড়ি, জামা সংগ্রহ করে। আবার অনেক সময় নিজেরাও হাতের কাজে ফুটিয়ে তোলে বহুরূপী ডিজাইন। মটিফ ডিজাইনে গাছপালা, জোড়া পাখী, কলকা, জোড়া ফুল, নৌকা, বৃত্ত, হরিণ ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলে। এমব্রয়ডারি, ব্লক, ডলার, স্ক্রিন প্রিন্ট, সুতা ইত্যাদি হাতের কাজের মাধ্যমে তারা ফোক মটিফগুলোকে তুলে ধরে। কিন্তু হয়তো তারা এগুলোকে শুধুমাত্র সৌন্দর্য্যের প্রতীক বা বহুল প্রচলিত ডিজাইন হিসেবে ফুটিয়ে তোলে। এই ডিজাইনাররা, বিক্রেতা বা ক্রেতা কেউই জানতে পারে না এগুলো আসলে ঐতিহ্যকে ঘিরে গড়ে ওঠা ফোক মটিফ। তাদের কাছে এগুলো অচেনা। যেমন- শাড়ি, পাঞ্জাবী বা কামিজে খুব প্রচলিত একটি ডিজাইন ফর্ম হচ্ছে ‘কলকা’। এটি মূলত কাঁথায় ব্যবহৃত একটি মটিফ। অনেকেই বলে এটি ইরান থেকে এসেছে। জাতিতাত্ত্বিক স্তরবিন্যাসে অস্ট্রিকদের পরে আসে মঙ্গোলিয়ানরা। ধারনা করা হয় তখন থেকেই এই মটিফটির উৎপত্তি। একে নারী-পুরুষের মিলন চিহ্নের অন্তর্গত বলে অনেকে মনে করেন। যেমন: ‘Andrila Boutique’ এর অনলাইন পেইজে (https://www.facebook.com) শাড়ি, কামিজে কলকা, জীবনবৃক্ষ এই মটিফগুলো দেখা যায়। এই পেইজের এডমিন ঐন্দ্রিলাকে এই মটিফগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “এই ডিজাইনের জামা, শাড়িগুলো ভালো চলে তাই আমরা এগুলোই সংগ্রহ করি। ডিজাইনের ইতিহাস জানি না।”

আবার প্রজাপতি শাড়ির অনলাইন পেইজে যে শাড়িগুলো রয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগেই প্রজাপতি, কলকা, জীবনবৃক্ষ, পান পাতা ইত্যাদি মটিফের ব্যবহার দেখা যায়। ‘পান পাতা’ মটিফটিও অস্ট্রিকদের অবদান বলে অনেকে মনে করেন। এই অনলাইন পেইজে দুই রকমভাবে পণ্য সংগ্রহ করা হয়। একটি হচ্ছে শপিং হাউজ থেকে সংগ্রহ করা, আর অন্যটি নিজেরা কাপড়ে নকশা ফুটিয়ে তোলা। তাদের নকশাগুলোর প্রত্যেকটিই ফোক মটিফকেন্দ্রিক। প্রতিষ্ঠানের পেইজের এডমিনের কাছে ডিজাইন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “হাতের কাজে তৈরি হওয়া শাড়িগুলো বেশি বিক্রি হয়। যারা কেনে না তারাও এই ডিজাইনগুলোই পছন্দ করে।”

অর্থাৎ ফোক মটিফ ব্যবহৃত পণ্যের কদর বেশি। কিন্তু ক্রেতা বা বিক্রেতা কেউই জানে না যে এগুলো ফোক মটিফ। এগুলো বহুদিনের লালিত ঐতিহ্য!! অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো বহুদিনের লোকজ ‘কলা’কে আজ পরিশীলিত শিল্পের সঙ্গে একই কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। লোক মটিফ শুধু অন্ত্যজদের থাকেনি, হয়ে উঠেছে সার্বজনীন।

এই ধরনের পেইজগুলোতে শুধু শাড়ি নয় বিছানার চাদর, হ্যান্ড ব্যাগ, বালিশের বা সোফার কুশন, পাঞ্জাবী, ফতুয়া, টি-শার্ট, সালোয়ার কামিজও বিক্রি হয়। কালো, লাল, সাদা, নীল, হলুদ, ইত্যাদি রঙয়ের ব্যবহার বেশি করা হয়। কিন্তু ফুল, লতা-পাতা, ময়ূর, পান পাতা, স্বস্ত্বিকা ইত্যাদি মটিফের ব্যবহার বেশি হয়। সবসময় এই পণ্যগুলোর চাহিদা থাকলেও পহেলা বৈশাখ, পূজা বা পহেলা ফাল্গুনের মতো বাঙ্গালি সংস্কৃতির উৎসবে এসব পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এ থেকে এই পর্যবেক্ষণ সহজেই হয়, পণ্যে ব্যবহৃত মটিফগুলোর ঐতিহ্যিক পরিচয় জানা না থাকলেও এই পণ্যগুলোতে যে বাঙ্গালিয়ানা ষোলোআনা তা ভোক্তারা ঠিকই বুঝতে পারছে। নইলে দেশীয় উৎসবে, ঐতিহ্য নির্ভর উৎসবে এগুলোর বিক্রি বেড়ে যেত না। যেমন: স্বস্তিকা মটিফটিকে বহু প্রাচীনকালে সতী মায়ের চিহ্ন রূপে ভাবা হতো। এখন একে ‘মাঙ্গলিক’ চিহ্ন রূপে ধরা হয়। সূর্য যেহেতু সৌভাগ্য, সৃষ্টি, জীবনের প্রতীক তাই অনেকেই সূর্যের সঙ্গে এর মিল টানতে চেয়েছেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের অনুসারীদের কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ। ধনাত্মক স্বস্তিকা বিষ্ণু এবং ঋণাত্মক স্বস্তিকা কালীর প্রতিনিধিত্ব করে বলে হিন্দু মিথোলজি মনে করে। ভারত ছাপিয়ে গোটা এশিয়ার প্রাচীন সংস্কৃতিতেই প্রতীকটি প্রবলভাবে অস্তিত্বমান।

এই হলো অনলাইন পেইজে কাপড়ের ডিজাইনে ঘুরে ফেরা স্বস্তিকার ইতিহাস! এটির চিরায়ত মটিফ হয়ে ওঠার কাহিনি। আন্তর্জালিক প্ল্যাটফর্মে যারা এই মটিফের ধারক এবং বাহক, তারা হয়ত কেউই জানে না এই ইতিহাস। কিন্তু লক্ষ্য করতে দেখা যায় পূজা উপলক্ষ্যে তৈরি পোশাকে এই মটিফ বেশি ব্যবহার করা হয়। এর অর্থ কোথাও একে হিন্দু মিথোলজির সঙ্গে ঠিকই মেলানো হচ্ছে। কিন্তু মূল স্বস্তিকার ধারনা অচেনাই রয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে পোশাকে ব্যবহৃত মটিফগুলোর বেশিরভাগই নকশিকাঁথা, আল্পনার মটিফ থেকে আসে। মটিফগুলো কিছু ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হচ্ছে, অর্থাৎ হুবহু ডিজাইন রক্ষিত হচ্ছে না। এছাড়া টিপ, গলার হার, চুরি, কানের দুল সহ নানারকম অলংকারে ময়ূর ও পানপাতা বহুল ব্যবহৃত মটিফ। সুতা দিয়ে সাধারনত তারা এগুলো বানিয়ে থাকে। বিভিন্ন অনলাইন পেইজ ঘুরলেই এগুলো দেখা যায়। আর অনলাইন ক্রেতাদের মধ্যে এই ডিজাইনের চাহিদাও প্রচুর।

শুভেচ্ছাবার্তা ও লোগোর ডিজাইনে ফোক মটিফ:

একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার নিজস্ব ফোক মটিফগুলো জড়িয়ে থাকায় উত্তরাধিকার সুত্রে এগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয়। সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার প্রশ্নে আশ্রয় নিতে হয় এসব মটিফের। আন্তর্জালের সহজলভ্যতার ফলে সৃষ্টিশীল কাজে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বেড়েছে বহু গুণে। জনবহুল দেশে চাকরির পেছনে না ছুটে যারা উদ্যোক্তা বা স্বাবলম্বী হতে চান তাদের অনেকেই আন্তর্জালে ফ্রি-ল্যান্সিং করে উপার্জন করছে। ফ্রি-ল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশের তরুণদের বড় অংশ কাজ করছেন ওয়েবসাইট তৈরি, লোগো ডিজাইন, ব্র্যান্ডিং, বিজ্ঞাপন প্রস্তুতের মতো গ্রাফিক্স ডিজাইনের নানা শাখায়। তারা নিজেদের অজান্তেই নান্দনিকতাকে ফুটিয়ে তুলতে আশ্রয় নিচ্ছেন ফোক মটিফের।

এমন সব ওয়েবসাইট বা পেইজগুলোতে চোখ রাখলেই আমরা বুঝতে পারি ফোক মটিফ কিভাবে প্রভাবিত করছে শহরের উঠতি তরুণ ডিজাইনারদের। এছাড়া জন্মদিন, বিয়ের মতো পারিবারিক ও সামাজিক উৎসবগুলোতে বাড়তি রঙ যোগ করতে যেসব কার্ড বা উপহার তৈরি করা হয় তাতেও ভালোভাবেই জায়গা করে নিচ্ছে এসব মটিফ। জন্মদিন, বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী ইত্যাদি অনুষ্ঠানে ফেসবুক উইশ এখন প্রায় বাধ্যতামূলক জীবনের অংশ। এতে গিফট বক্স, ভিডিও ক্লিপিং, উইশিং কার্ডে বৈচিত্র‍্য আনার চেষ্টায় নতুন নতুন আঙ্গিক যোগ করলেও তাতে ঘুরে ফিরে জায়গা করে নিচ্ছে চিরায়ত সব ফর্মই। ফেসবুকেই বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে এই উইশিং কার্ড বা ভিডিও ক্লিপগুলো বানানো হয়। অদ্ভুতভাবে সেই ডিজাইনের প্রধান অংশ জুড়ে থাকে জোড়া পাখি, জীবন বৃক্ষ, কলকা, পান পাতা, ময়ূর, ফুল বা জ্যামিতির নকশা। এই মটিফ গুলোর অর্থ না জেনেও শুধুমাত্র নান্দনিকতার খাতিরে এগুলো ব্যবহার হচ্ছে। টাইমলাইন থেকে টাইমলাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এছাড়া বাস্তবিক জীবনেও বাংলাদেশের অন্যতম দুটি কার্ড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আইডিয়াল কার্ড হাউজ ও আজাদ প্রোডাক্টসের ফেসবুক পেইজ বা ওয়েবসাইটে তার নজীর পাওয়া যায়।

বিশেষত পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুনের মতো বাঙ্গালি উৎসবে ফেসবুক উইশিং কার্ডে ফোক মটিফের ব্যবহার চোখে পরার মত। মুখোশ, মাছ ছাড়া পহেলা বৈশাখের কোন আন্তর্জালিক ভিউ কার্ড কেউ দেখেছে বলে মনে হয়না। মেসেঞ্জার থেকে মেসেঞ্জার এই ভিউ কার্ডগুলো ঘুরতে থাকে। আমরা দেখি, কিন্তু চিনিনা!! মটিফের একটি বড় দিক নান্দিকতা। নান্দনিকতার জন্যই এগুলো ব্যবহার হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এর বর্ষপূর্তি, শিক্ষা সমাপনী র‍্যাগ ডে বা কোন শিক্ষা ভ্রমণ বা বনভোজন উপলক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের তৈরি স্যুভেনিয়ার, টি-শার্ট বা লোগোতে ফোক মটিফের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। তখন দেখা যায় তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচারে নানা রকম ফ্রেম যোগ করে। সেগুলোতেও প্রায়ই ফোক মটিফের আদল লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশের ব্যান্ড দলগুলি নিজেদের ব্র্যান্ড ডিজাইনিংয়ে যেমন লোকজ ঐতিহ্যের আশ্রয় নিচ্ছে, তেমনিভাবে তাদের গানের প্রচারণা বা পোশাকেও ফুটে উঠছে এসব মটিফ। তাদের ব্যক্তিগত বা দলের পেইজেও বাঙালিয়ানা আনার চেষ্টায় ফোক মটিফ ব্যবহৃত হচ্ছে।

এছাড়াও আন্তর্জালিক প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত পর্যায়ে হোক বা ব্যবসায়িক স্বার্থে, ফেইসবুকের পেইজ হোক বা ওয়াল ম্যাট, ড্রয়িং রুমের দেয়ালচিত্র, রঙ বেরঙের সোফার কুশন, টেবিল ম্যাট, ফোন কভার, ল্যাপটপ ব্যাগ অর্থাৎ সার্বিক শ্রী বৃদ্ধির জন্য সুতা, ব্লক বা রঙ বেরঙের যে ডিজাইন গুলো ফুটিয়ে তোলা হয় তার

প্রায় সবগুলোই ফোক মটিফ বা ফোক মটিফ থেকে অনুপ্রাণিত। এগুলোতে বেশি ব্যবহৃত হয় হাতি, ঘোড়া, ফুলের নকশা। লাল, নীল, হলুদ জাতীয় উজ্জ্বল রঙ প্রাধান্য পায়।

আসলে যে সংস্কৃতি যত বেশি ঐতিহ্য নির্ভর, সে সংস্কৃতি তত বেশি মজবুত। সময়ের সঙ্গে তার প্রতিবেশ পাল্টায়। তাই হয়ত কিছুটা রূপান্তরিত হয়। কিন্তু পুরোপুরি হারিয়ে যায় না।লোক সমাজ ছাড়াও নাগরিক সমাজে পোশাক সহ নানা মাধ্যমে উঠে আসতে শুরু করে মটিফগুলো। এখন দেখা যাচ্ছে আন্তর্জালের কারণে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ তৈরি করছে। এক প্ল্যাটফর্ম এ চলে এসেছে মটিফগুলো। আরো বেশি লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।ক্ষেত্র বিস্তৃত হওয়ার কারণে এবং মূল আধার থেকে মটিফগুলো বিচ্যুত হওয়ার কারণে এদের পরিচয় সনাক্ত করা আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। ব্যবহারের পাশাপাশি আমাদের

জানা উচিত এগুলোর মূল ফর্ম! জানা উচিত এগুলো শুধু অচেনা কিছু ডিজাইন নয়। এগুলো আমাদের খুব চেনা! এগুলো আমাদের ঐতিহ্য!

তথ্যসূত্র:

১. মেহেদী উল্লাহ (২০২০), ফোকলোর তত্ত্বপ্রয়োগচরিত, দেশ পাবলিকেশন্স, ঢাকা।

২.তোফায়েল আহমদ, লোক ঐতিহ্যের দশ দিগন্ত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

৩. https://www.facebook.com/ProjapotiSaree/

৪. https://www.facebook.com/AndrilaBoutiques/

৫. https://www.weddingcardwholesale.com/sh

৬. https://www.facebook.com/azadproductsltd/

৭. https://bdwedding.com/vendor/invitation_cards/azad_products/?fbclid=IwAR1bOd

-B9BvTkQW0vbOcxfNql4Z7sPpmXrK-JPlP1QzJDT7zTeXJNCmHKvo

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন