আর্টওয়ার্ক: নগরবাসী বর্মন
মানব জন্মলগ্ন থেকেই চলে শিক্ষা গ্রহণ। সত্যিকার অর্থে, আমরা চারপাশের পরিবেশ থেকে যা
শিখছি তাই শিক্ষা। ‘মানুষ সামাজিক জীব- এরিস্টটল’ প্রাকৃতিক শিক্ষার বাইরেও সামাজিক জীব
হিসাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও আমাদের জন্য নির্ধারিত। আর এই সামাজিক রীতিনীতি চলে
আসছে বহু যুগ ধরে। সমাজের নিয়মের বহির্ভূত আমরা কেউ না। এসব সঠিক নিয়মে মেনে চলার
মাধ্যমে সম্ভব হয় সমাজকে সাথে নিয়ে সুন্দর সুষ্ঠু ভাবে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
“মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্ত সর্বত্রই তাকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া
যায়”- রুশো।
আর কেউ বা কোন গোষ্ঠী এই নিয়মের তোয়াক্কা না করে জীবন অতিবাহিত করার চেষ্টা করলে
তখন তাদের গুণতে হয় ভয়াবহ মাশুল। এমন দৃষ্টান্তও কম নেই আমাদের ইতিহাসে। প্রকৃতির ও
সমাজের নিয়ম-কানুনের বাহিরে যাওয়ার সাধ্য যে কারোর থাকে না তারই এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত
দেখা যায় আবুল মুনসুর আহমেদর ছোট গল্প ‘আদুভাই’-এ। মূলত সামাজিক রীতিনীতি অর্থাৎ
শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপারটাই ফুটে উঠে এই ছোট গল্পে।
কঠিন জীবন বোধের রসিক শিল্পী আবুল মুনসুর আহমদ। তাঁর ব্যঙ্গ-রসিকতার আড়ালে উদ্ভাসিত
হয়ে ওঠে জীবনের কঠিন সত্য। মূলত সমাজের তথা-কথিত প্রথার বিরোধিতা করেন তিনি। সেই
প্রথা, যে প্রথা সমাজের ঘাড়ে চেপে বসে সমাজকে এগিয়ে যেতে দেয় না। তাকেই বর্জনের দৃঢ়
সংকল্প ছিলো লেখকের।
তবে মানুষের বোকামোর দন্ড যে মানুষকে এগিয়ে যেতে দেয় না। শিক্ষা জীবনে ও যে এধরনের
বোকামো শিক্ষিত তথা সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে বাধা দেয় তাই প্রকাশিত হয় ‘আদুভাই’ গল্পের আদু ভাই চরিত্রের মাধ্যমে।
আবুল মুনসুর আহমেদ একাধারে বাংলা সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং খুবই বিদ্যানুরাগী
মানুষ ছিলেন। ফলে বিদ্যা গ্রহণ ও সফলতার জন্য কঠোর পরিশ্রম বিহীন উপায়-অন্তঃ নেই তাই
প্রকাশ পায় তার লেখা ছোট গল্প ‘আদুভাই’-এ।
আদুভাই সপ্তম শ্রেণীতে পড়তেন। ঠিক পড়তেন না বলে পড়ে থাকতেন বলা যায়। ক্লাস রুমের ন্যায়
তিনিও নিতান্ত অবিচ্ছেদ্য এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক অঙ্গে পরিণত হয়েছিলেন। অর্থাৎ আদুভাই
যে সপ্তম শ্রেণী ব্যতিত আর কোন ক্লাসে কখনও পড়েছেন কিনা শিক্ষক বা ছাত্র অনেকের তা
অজানা। মূলত তিনি যে ইচ্ছাকৃতভাবে সপ্তম শ্রেণীতে থাকেন তা নয় আবার পাসের জন্য বা জানার
জন্য কোন পরিশ্রম করেন তারও কোন নজির পাওয়া যায় না অবশ্য। তার সাথের অনেক বন্ধু-
বান্ধব এই স্কুলের শিক্ষক হয়ে আবার অন্য জায়গায় বদলিও হয়েছেন। অথচ এই আদু ভাই পড়েই
রইলেন একই শ্রেণীতে। তিনি কখন শিক্ষকদের কাছে বিশেষ বিবেচনায় পাস করে দেওয়ার জন্য
অনুরোধও করেননি কিংবা কখন জানতেও চাননি কোন কোন বিষয়ে তিনি কম নম্বর পেয়েছেন। তার
বক্তব্য অনুযায়ী সকল বিষয়ে পাকা হয়ে উঠা আবশ্যক। কোন বিষয়ে নম্বর কম বা বেশি পেয়ে
নয়। অথচ এই জন্য যে তাকে অধ্যবসায়ী হতে হবে কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশুনা করতে হবে তা
আদু ভাইয়ের কখন করে ওঠা হয়নি।
বস্তুতঃ “স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা,মানুষকে
ঘুমাতে দেয় না- এ.পি. জে আবুল কালাম”।
হ্যাঁ, এটাও সত্য জানার বা শেখার জন্য কোন সীমাবদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝে থাকলে হবে না,
জ্ঞান চর্চার পরিসরটি বাড়াতে হবে। কিন্ত একটি ধরা-বাঁধা নিয়ম শৃঙ্খলাকে উপেক্ষা করে তা
নয়। সপ্তম শ্রেণী অর্থাৎ, ১১-১২ বছর বয়সের শিশুদের জন্য নিজস্ব পাঠ্যবই অন্তর্ভুক্ত
পড়াশুনার সঠিক চর্চা এবং পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞান আহরণ যথেষ্ট হয়ে থাকে। সেই ব্যবস্থাকে
ভাঙতে গেলে পরিণতি ‘আদুভাই’ এর ন্যায় হয়। ছোট গল্পে উল্লেখ্য, আদুভাই সপ্তম শ্রেণীর
বার্ষিক পরীক্ষায় গণিত প্রশ্নপত্রকে মানসম্মত মনে করেন নি তার কাছে মনে হয়েছিলো এরও
বাইরে অনেক অংক কষার আছে তা পরীক্ষায় শিক্ষক দিতে পারতেন। এবং এসব অংকের বিপরীতে
তিনি নিজের মনগড়া অংক করে রাখেন খাতায়। তবুও সেই অংক কিন্ত সঠিক হয়নি। একইভাবে
ভূগোল জানা একজন শিক্ষার্থীর জন্য কতোটা প্রয়োজনীয় তা সে বুঝে উঠতে পারে না বা নিজেও
বোঝার প্রয়োজন বোধ করেননি।
ঠিক সে ভাবেই ফার্সী ভাষা শেখার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে অপমান ও অবমাননা করা হয় বলে তিনি
ধারণা করতেন। ফলে তিনি কোন বিষয়ে নূন্যতম নম্বর পেয়ে পাশ করেই উঠতে সক্ষম হননি। এই
ধরনের চিন্তা-ভাবনাকে কোনভাবে নৈতিক বা যোগ্য ভাবনা বলে গণ্য করা যায় না। শুধু তাই নয়
আদুভাই সপ্তম শ্রেণীর পূর্বের ক্লাস সমূহ আদৌ পড়েছেন কিনা বা তা তিনি কী করে কৃতকার্য
হয়েছেন এ সম্পর্কে কোন ধারণাই তার আশে-পাশে কারোর জানা নেই।
বহু বছর এই সপ্তম শ্রেণীতে থাকতে থাকতে একদিন জীবনের তাগিদে নিজের সন্তান স্ত্রীর
সম্মান রক্ষার্থে তিনি ব্যকুল হয়ে উঠেন সপ্তম শ্রেণী পাশ করতে কারণ এবার তার ছোট্ট
ছেলেটি সপ্তম শ্রেণীতে প্রমোশন পেয়েছে। যদিও তার নিজস্ব কোন অপরাধ বোধ ছিলো না তবুও
পারিপার্শ্বিক ও স্ত্রীর সিদ্ধান্তে বিচলিত হয়েই প্রিয় বন্ধুর কাছে ছুটে যায় (যার জবানিতে
গল্পটি লেখা) যদিও তিনি বয়সে ছোট আদু ভাইয়ের, তবুও তাকেই তিনি সবচেয়ে কাছের বন্ধু ভাবেন
এবং তার কাছে নিজের ভেতরকার দহনকৃত ঘটনা খুলে বলেন। তার যে এবছর সত্যি প্রমোশন
দরকার তা তার বন্ধুটিও বুঝতে পারে এবং আদুভাইকে বিশেষ বিবেচনায় কৃতকার্য করার জন্য
শিক্ষকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে অবশেষে ব্যর্থ হয় কারণ কোন শিক্ষকেরই সম্ভব হয়নি তার
উত্তরপত্রে নম্বর বসানো, এই জন্য যে আদুভাই খাতায় কিছুই সঠিকভাবে লেখেননি। হতাশ হয়েই
আদুভাইয়ের বন্ধু ফিরে আসে এবং আদুভাইকে জানায়, এতে আদুভাই বেশ হতবিহ্বল হয়। পরদিন
আদুভাই বিদ্যালয়ে এসে অন্যান্য ছাত্রদের নিয়ে সমাবেশ করেন। সেখানে আদুভাইয়ের কন্ঠে
ক্ষোভের প্রকাশ পায়। তিনি জানান, তিনি কখনো কোন শিক্ষকের শরণাপন্ন হননি তাকে পাশ
করিয়ে দেওয়ার জন্য, এমনকি কখনোও অন্যায়ভাবে দাবীও করেন নি। সবসময় বিদ্যালয়ের নিয়ম-
শৃঙ্খলা এবং স্বচ্চরিত্র বজিয়ে রেখে চলেছেন। এর ফলপ্রসূ তাকে শিক্ষকদের যোগ্য সম্মান
দেওয়া উচিৎ ছিলো। শুধু তাই নয় এই শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন নেতিবাচক দিক ও তিনি তুলে
ধরেছিলেন। অথচ তার এই অবস্থার জন্য সে নিজের অপারগতা ও বোকামোকে কোনভাবেই খুঁজে বা
বুঝে উঠতে পারেননি।
মাঝে অনেক সময় কেটে যায়। তার বন্ধু (যার জবানিতে লেখা) তিনিও আদুভাইয়ের কোন খবর
রাখেন নি। হঠাৎ একদিন তার কাছে লাল খামে মন্ডিত একটি চিঠি আসে যদিও চিঠিটি বেশ অনেক
সময়ের ব্যবধানে এসেছে তার কাছে। খুলে দেখে চিঠিটি আদুভাইয়ের কাছ হতে এসেছে যা একটি
নেমন্তন্ন পত্র।এই চিঠিটি আদুভাইয়ের পুত্রের হাতে লেখা চিঠিতে উল্লেখ যে ‘বাবার খুব অসুখ।
আপনাকে দেখবেন তার শেষ সাধ’। এ কথা শুনা মাত্রই তিনি ছুটে যান আদুভাইয়ের বাড়ি এবং
সেখানে গিয়ে দেখা হয় আদুভাইয়ের পুত্রের সাথে, পুত্র তাকে জানায়, তার বাবা আর নেই সেই বার
ওই চিঠি পেয়ে যারা এসেছিল সবাই বাবার জানাযা পড়ে যান। জীবনের শেষ সময় এসে আদুভাই
নিজের ভুল বুঝতে পারেন নিজের একগুঁয়েমী ও নির্বোধতাকে বিসর্জন দিয়ে নিজের অপারগতাকে
ঘুচানোর জন্যই কঠিন অধ্যবসায়ের ব্রতী হোন। তার ফল স্বরূপ সেবার তিনি অষ্টম শ্রেণীতে
প্রমোশন ও পান। তার এই কঠিন প্রচেষ্টাকে সম্মান জানিয়ে বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার ও তাকে
প্রমোশন এর আশ্বাস দেন। তবে সফলতা পেলেও শরীর ও বয়স কোনটাই তার সঙ্গ দেয় নি আর।
শয্যাশায়ী হয়েই তিনি পড়াশোনা করেন ও পালকি চড়েই বিদ্যালয় গিয়ে পরীক্ষা সম্পূর্ণ করেন।
আমাদের সমাজ জীবনের বহুল প্রচলিত গান ‘সময় গেলে আর সাধন হবে না- লালন গীতি’ ঠিক
এভাবেই লালন সাইয়ের বিখ্যাত উক্তির মতই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আর চলা হলো না
আদুভাইয়ের। সময় স্রোতে জীবনে আরও অনেকটা দূর এগিয়ে যাওয়া হলো না তার। সবকিছু শুনে
নিজের চোখের পানি মুছে আদুভাইয়ের বন্ধুটি যেতে চাইলো কবরের কাছ। কবর দেখিয়ে দিয়ে তার
পুত্র বলল, “বাবার শেষ ইচ্ছাই তার কবরে খোদাই করে লেখা হয়েছে:
“Here sleeps Adu Mia who
promoted from class VII to VIII”.
এই ছোট গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক সমাজের একটি প্রতিবন্ধকতাকে এবং একজন ব্যক্তির
অপারগতা ও অসচেতনতাকেই উত্তোলন করেছেন সকলের সামনে যা কিনা শুধু সাহিত্যে নয়, ঠিক
এভাবেই আমাদের সমাজের একাংশ মানুষ নিজেদের অপারগতা ও নিজের অসচেতনতাকে জীবনের
পিছিয়ে পড়ার জন্য অভিশাপ না মনে তারা নিজেদের অবস্থার জন্য সমাজ ব্যবস্থা ও
শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করে থাকে। অথচ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে তার সার্টিফিকেটের
তকমা লাগিয়ে নিজেদের সুশিক্ষিত ভেবে থাকে পক্ষান্তরে সেই শিক্ষা তারা নিজেদের বাস্তব
জীবনে প্রয়োগ করতে অক্ষম এবং মনে করতে থাকে এসব পাশ করার ফলেই তাদের জন্য
কর্মব্যবস্থা করে দেওয়া একমাত্র স্বীয় দেশের সরকারের দায়িত্ব। তারাও আদুভাইয়ের মতো
কখনো চেষ্টা করে না নিজেকে সৃজনশীল কাজে উপনীত করার মাধ্যমে দেশের বোঝা না হয়ে দেশের
জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠতে। দেশের বেকারত্ব বৃদ্ধির জন্য যে শুধু সরকার ব্যবস্থা দায়ী নয়
নিজেদের ভুল চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্ত সবার অন্তরায়, তা তাদের মনে কখনও কড়া নাড়ে না। শুধু
সরকারি চাকরি বা পড়াশোনা নয় ব্যবসা, বাণিজ্য, উদ্যোগ, গবেষণা সকল ক্ষেত্রে কঠোর
পরিশ্রম, সঠিক সময়ানুবর্তিতা, অধ্যাবসায় যে বেকারত্ব অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে
এবিষয়ে তাদের কোন আগ্রহ বা সচেতনতা নেই।
কিন্ত মুক্ত জ্ঞান চর্চা এবং কঠোর পরিশ্রম দিয়েই তারা নিজেদের তথা দেশকে এগিয়ে নিয়ে
যেতে পারে এবং আদুভাই যেমন নিজের পরিশ্রম দ্বারা হেডমাস্টার থেকে সাহায্যের আশ্বাস
পেয়েছিল একই ভাবে নিজেদের দেশের জন্য মহৎ উদ্যোগ এবং দেশের উন্নয়নের জন্য সরকার
কর্তৃক সাহায্যের হাত পেতে পারে যা কি না আমাদের সমাজ ও জীবনের জন্য সোনার কাঠি
স্বরূপ।।।