অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

অপেক্ষায়, করতোয়া নদী পাড়ের মানুষগুলো, সে আসবে তাই। কে আসবে? মনে প্রশ্ন জাগছে― মোটর বাইক চালিয়ে যাওয়া দূর গাঁয়ের মানুষগুলোর, পাশের গাঁয়ের বাইসাইকেল আরোহীর, খবরটা যারা এখনও শোনেনি তাদের। মানুষের ভিড়—রাস্তায়, বটগাছের নিচে, আম গাছের তলায়। সাপের মত এঁকে-বেঁকে দাঁড়িয়ে, আঁকাবাঁকা করতোয়ার কাঁধ ধরে হেঁটে চলা মেটে রাস্তাটি জুড়ে, উজান পাড়ার ছেলেরা বুড়ো-বুড়িরা। কারও চোখে বিস্ময়, গোধূলির লাল আলো চিকচিক করছে কারও সজল চোখে। অসতর্ক শাড়িতে ঠকঠক করে কাঁপছে বাঁশতলায়, পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠা মহিলাটি, যার শীর্ণ হাতে শুকনো ডালের লাঠি, মাথার চুলগুলো ছড়ানো পেঁয়াজ-মূলের মতো। বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে পৌঢ়েরা, যুবকেরা, শিশুরা— শিশুবাগানে থরে-বিথরে। যার বেড়ে ওঠার, মানুষ হবার গল্প শুনে কিশোরেরা স্কুলে যায়, পড়তে বসে— সে আসবে। মানুষের ভিড়ের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে তার শৈশবের, কৈশোরের রূপকথার মতো সেইসব কথা, গল্প যেগুলো সন্তানদের শুনিয়ে শুনিয়ে অনুপ্রাণিত করে এগাঁয়ের মায়েরা, বাবারা। ঘুরপাক খাচ্ছে একটি সাদা বক, এপার থেকে ওপারে, নদীর জলের সমান্তরালে। শহরমুখী রাস্তার দিকে তাকিয়ে, ওরা অপেক্ষায়— গল্প বলছে, কেউ, শুনছে চোখের জল মুছতে মুছতে।                   

মোঃ আনারুল ইসলাম; আনার, আনার জেলে ডাক নাম; মাছ ধরা যার প্রধান কাজ, পৈতৃকসূত্রে পাওয়া পেশা। উজান পাড়া গ্রামের দক্ষিণে করতোয়া সবচেয়ে বেশি বাঁক নিয়েছে যে জায়গাটিতে সেখানে পাড়ের উপর তার বাড়ি। বাড়ি মানে ধানের বিচালি দিয়ে ছাওয়া, পাট কাঠির বেড়া দেওয়া যে ঘরটি চোখে পড়ে ওটাই। একটি ডুমুর, কয়েকটি কলা আর সেই গাছটিও, এই বাড়ির উঠোনের উপরে, যে জাম গাছটি আকাশ ছোঁয়ার দৌড়ে গ্রামের আর সব গাছগুলো থেকে এগিয়ে। যদি দেখেন সকালের রোদে কিছু শ্যাওলা, শামুক আর ছোট-ছোট চিংড়ি-পুটি নিয়ে একটি খ্যাপলা জাল মরা বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে জাম গাছটির ডালে তবে নিশ্চিত হতে পারেন এটিই আনার জেলের বাড়ি। করতোয়া তার পূর্বপুরুষদের বাঁচিয়েছে, উত্তরপুরুষদেরও বাঁচাবে সে ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত আনার জেলে। স্ত্রী আয়েশা খাতুনেরও সেই বিশ্বাস, কালক্রমে জল কমে কমে ছোট হয়ে আসছে করতোয়া, তবুও। নদীর জল শুকিয়ে যাবার সাথে সাথে তাদের আর্থিক অসচ্ছলতার স্বাস্থ্য বেড়েছে সমানগতিতে। মেদযুক্ত অসচ্ছলতা, বছরের পর বছর, তাদের সেই বিশ্বাসের দেয়াল টপকাতে বাধা দিয়ে আসছে। বাবার কাছ থেকে প্রথমে কলা গাছের ভেলা তার পর তাল গাছের ডিঙি চালাতে শিখেছিল ছোটবেলাতেই, আনার জেলে, শিখিয়েছিল নিজের দশ বছরের ছেলে শরিফকেও।                         

উজান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুলটি গ্রামের একেবারে মাঝখানে, বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে, বিশ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে। বেশ খুশি মনে ক্লাস থ্রিতে পড়ত শরিফ; মোঃ শরিফুল ইসলাম। অর্ধেক বেলা স্কুলে, বাকি অর্ধেক করতোয়া নদীর জলে ভেসে বেড়াত বাবার মাছ ধরায় সাহায্য করতে। ইংরেজী পড়াগুলো কিংবা গণিত বইয়ের অংকগুলো বেশ সরসর করে কষে ফেলতে পারত সে, যেমনটা পারত জলের উপর তাল গাছের ডিঙি চালাতে।

‘আনার জালের ছোল!’ বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন গণিতের শিক্ষক মোজাম্মেল হক, যেদিন ক্লাসে বইয়ের জটিল অংকটি করে দিয়েছিল খুব সহজে। স্নেহ-দৃষ্টি ফেলেছিলেন লিকলিকে চেহারায়― অগোছালো চুল, শুকনো ঠোঁট, ঘামে ভেজা ধুলিমলিন শার্ট আর ঘর্মাক্ত মুখমন্ডল ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়া মেটে উঠোনের মতো।    

তেল চিটচিটে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘ভালো করা পড়ালেকা করবি। বাপ-দাদার লাকান তোক মাছ ধরা খাওয়া লাগবি না। বড় আপিছার হওয়া লাগবি।’         

শেষ বিকেল। ছাই রঙা একটি বক অতি সন্তর্পণে পা ফেলছে জলের কিনার ধরে। বিরোধে জড়িয়েছে দুটো ছাগল, নদীর ঢালুতে, ঘাস খাওয়াকে কেন্দ্র করে। ইতস্তত উড়ছে কিছু বক, মাছরাঙা। শরিফ মাছ ধরতে গেছে বাবার সাথে। অফিসার হলে কী হয়, কী পরে, তারা কি মাছ ধরে— সারি বেঁধে ভেসে বেড়ানো একদল পাতি হাঁসের রেখে যাওয়া টেউয়ের দিকে তাকিয়ে জানার চেষ্টা করল। নদীর জলে যেন ডুব দিল জিজ্ঞাসাগুলো, উত্তর এল না। আনার জেলে জলে ফেলা খ্যাপলা জাল টেনে তুলতে থাকল ধীরে ধীরে, আলগা হয়ে যাওয়া লুঙ্গির গিট কোমরে গুঁজতে গুঁজতে।  

সেদিন, ‘আব্বা, অংকের মাস্টার কছে ভাল করা পড়ালেকা করে হামাক বড় আপিছার হওয়া লাগবি।’ বৈঠা চালাতে চালাতে বাবাকে শুনিয়েছিল শরিফ। ঠিক তখনই একটি গাঙচিল তাদের মাথায় উপর দিয়ে করতোয়ার পশ্চিম দিকে জলের মাঝ বরাবর উড়ে যেতে যেতে ছোট হতে হতে মিশে গেল, হেলে পড়া সূর্যালোকের প্রতিফলনে চিকচিক করতে থাকা জলের কায়ায়।   

গাঁয়ের বটতলায় বসে আছে আনার জেলে, মাথায় লাল রঙের গামছা পেঁচিয়ে; খলুই এর মধ্যে চ্যালা, চিংড়ি আর বেলে মাছ নিয়ে, বেচতে। শনিবার, বটতলায় হাট বসেছে। এ এলাকায় সপ্তাহে দু দিন হাট বসে, শনি আর বুধবার। আজ অনেক মাছ পেয়েছে সে, কেজি পাঁচেক তো হবেই সব মিলিয়ে। গত দু দিন ধরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে, থেমে থেমে। রোদের দিনে মাছ ধরা পড়ে কম। উজান পাড়ার মানুষ অনুমান করতে পারে, আনার জেলের খলুই-এ মাছের ওজন, তার পান চিবানো, পানের পিক ফেলার ধরন দেখে।      

ছেলে শরিফকে খুঁজেছিল বাড়িতে, আশেপাশে, হাটে আসার সময়। পায়নি। ওপাড়ার ছেলেদের সাথে মার্বেল খেলতে গেছে হয়তো। আজ মাছ বেচে ওর জন্যে একটা হাফ প্যান্ট কিনবে সে। আব্বা প্যান্ট কিনে দাও, প্যান্ট কিনে দাও এই ঘ্যানঘ্যানানি আজ বন্ধ হবে। একটা মাত্রই প্যান্ট শরিফের। সেটার-ও পিছনের দিকে দুটো ছিদ্র হয়ে গেছে প্রায় একমাস হলো। শরিফের চার চোখ, শরিফের চার চোখ— বলে ক্ষ্যাপায় পাড়ার ছেলেরা, এ অভিযোগ শুনতে আর ভালো লাগছে না তার। খচখচ করে উঠেছিল, আনার জেলের বুকের ভেতরটা, ছেলেকে গামছা দিয়ে পিছনের দিকটা ঢেকে স্কুলে যেতে দেখে। ঠোঁট দুটো ফাঁক করে, পিক জড়ানো লাল দাঁত দিয়ে পানের বোটা থেকে চুন কামড়ে নেবার সময় একটু অন্যমনস্ক দেখাল তাকে। খলুই এর ওজনের অনুমান ভুল হয়ে যেত, উজান পাড়ার যে কারোর-ই, আনার জেলের এই মুহূর্তের মুখটা খেয়াল করলে।  

হাটে লোক সমাগম বাড়তে শুরু করেছে, যদিও ফিসফিস করে বৃষ্টি পড়ছে। ‘বেটার মাতার বেরেন খুব ভাল। ইস্কুলোত আসাডা বন্ধ করে দিবিন না’ চিংড়ি মাছ ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে আনার জেলেকে বললেন, মোজাম্মেল হক, ‘হামার বিশ্বাস উই একদিন মেলা বড় হবি।’

আমি কী পারব পড়াতে, পড়াশোনায় তো অনেক খরচ― মাথা নাড়লেন, মৃদু হাসলেন, মনে মনে বলতে বলতে। ‘দেকি’, শব্দটাই কেবল উচ্চারিত হল; অনুচ্চারিত ভাবনাটা মিশে থাকল মাথা নাড়ানিতে, শুকনো হাসিতে।

দুই  

সড়কটির দুপাশে বাতিগুলো জ্বলল, মাত্রই। নীড়ে ফেরা পাখিগুলো কিচকিচ করছে, শিরীষের ডালে ডালে। একটু ক্লান্ত দেখাল ওদের, হেঁটে হেঁটে এসে যখন প্যারিস রোডে পৌঁছুল। ‘চল, একটু বসি’, শান বাঁধানো আম গাছটির নিচে বসল ওরা, পিয়াস’র অনুরোধে। হাঁটতে হাঁটতে তারা যে আলাপের ভিতর ছিল তাতে পিয়াস’র পক্ষে একথা বলা অপ্রাসঙ্গিক নয়, ‘জানিস, অতীত মানুষকে খুব দুঃখ দেয়। এই ধর শ্রেয়া’র কথা…’

‘আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি’, পিয়াসকে থামিয়ে দিয়ে বলল শরিফ, ‘শ্রেয়া’র সাথে তোর ব্রেক আপ হয়েছে সেকথা অনেক শুনেছি। ওসব আর মনে করিসনা। এমএসসি টা শেষ কর। ভালো একটা চাকরি কর। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তাছাড়া দুঃখ হলো একটা ধাতব মুদ্রার মতো যার একপিঠে দুঃখ অন্যপিঠে সুখ। মুদ্রাটির দুঃখ পিঠের আয়তন যতই বাড়ুক না কেন, শুধু একটু উল্টিয়ে নিলেই হয়।’             

ঠিক তখনই, শরিফের মনের মধ্যে উল্টিয়ে রাখা মুদ্রাটি উল্টে গেল, কথা শেষ না হতেই। এপিঠের দুঃখগুলো তির তির করে বয়ে যেতে লাগল শিরা উপশিরা হয়ে তার হৃৎপিণ্ড-মোহনায়। উজান পাড়ার সেই ছোট্ট শরিফ আজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। খেয়ে না-খেয়ে, পরে না-পরে তাকে স্কুল-কলেজ পাস করতে হয়েছে। করতোয়ার জল কমে যাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে কমে গিয়েছিল বাবা’র উপার্জন। কতদিন যে না খেয়ে কলেজে যেতে হয়েছে! বন্ধুদের গায়ের ভালো শার্ট, পায়ের দামি কেডস, স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। অধিকাংশ দিন-ই ভাতের সাথে থাকত শাক পাতার তরকারি। বাবা’র খ্যাপলা জালে ধরা পড়া রুই, গজাল মাছটির দিকে তাকিয়ে থেকেছে, মাকে কিছু বলতে পারেনি; ওটা বিক্রি করেই যে চাল-ডালের ব্যবস্থা হবে। পাশের বাড়ি থেকে ভাত চেয়ে এনে মরিচ গুড়ো মাখিয়ে খাইয়েছে মা আয়েশা খাতুন, তার স্পষ্ট মনে পড়ল। মা আমি বন্ধুর বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি, মা’র শুকনো মুখের দিকে না তাকিয়ে বলতে হয়েছে। তার খুব মনে পড়ল, পোষা মুরগীর ডিম বিক্রি করে লেখার খাতা কিনে দিয়ে বলেছিল মা, যখন বড় অফিসার হবি তখন এই মায়ের কথা মনে রাখিস। বাবার কথা মনে করতে যেয়ে চোখ ছলছল করে উঠল। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হবার ঠিক পরদিন সন্ধ্যায়, ছুটে যেতে হয়েছিল করতোয়ার জলের কিনারে যখন ঝিরঝির বৃষ্টি মাথায় গাঁয়ের মানুষ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল, আনার জেলের মাথায় বাজ পড়েছে গো, বাজ পড়েছে। জলের ধারে পড়ে থাকা বাবার সেই পুড়ে যাওয়া কয়লা-খণ্ডের মতো দেহটা পরিস্কার দেখতে পেল শরিফ।    

‘এই কী ভাবছিস?’ শরিফের কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল পিয়াস। গোপনে চোখ মুছে নিয়ে বলল, ‘কিছু না, চল উঠি।’  

সড়কে জ্বলতে থাকা বাতিগুলোর আলোর উজ্জ্বলতা বেড়েছে ততক্ষণে। পাখিগুলোর ডাক আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এখন। দুই বন্ধু হাঁটতে থাকল, বিনোদপুরের দিকে, মেসে যেতে হবে তাদের। তিন মাস পর তাদের এমএসসি ফাইনাল পরীক্ষা। বিএসসি তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে শরিফ। এমএসসিতেও এই রেজাল্ট ধরে রাখতে হবে তাকে। গাঁয়ের মোজাম্মেল হক স্যারের কথা মনে পড়ল তার, হেঁটে যেতে যেতে।   

‘দোস্ত, মাধুরী’র কী খবর রে?’ প্রশ্নের উত্তরে, ‘আরে বাদ দে ওসব, তোর মাথায় খালি এসব ঘোরে না!’ বলল শরীফ।    

মাধুরী পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফোর্থ ইয়ারে। ঢাকাতে একটি প্রজেক্ট ফেয়ারে দেখা হয়েছিল তাদের, এবং পরিচয়। ফোনে কথা হয়, ফেইসবুকে, ম্যাসেঞ্জারেও। মাধুরী দেখতে সুন্দর। ভালো লেগেছিল শরীফের, প্রথম দেখাতেই, মাধবীলতার মতো তন্বী মাধুরীকে। মাধুরী’র গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে, থাকে ঢাকার আজিমপুরে, বাবা-মা’র সাথে। বাবা মন্ত্রণালয়ের সচিব, অবস্থা বেশ ভালো, সরকারি চাকুরে মা। শরিফ সেরকম কিছু ভাবার সাহস পায়নি। তবে মাধুরী এবং শরিফের কথোপকথনের মধ্যে যে আন্তরিকতা খেলা করে তাতে পিয়াসের ‘দোস্ত, মাধুরী’র কী খবর রে?’ প্রশ্নটি করা অস্বাভাবিক নয়। শরিফের মনের মধ্যে মাধুরীর জন্য একটা স্নিগ্ধ জায়গা আছে পিয়াস তা জানে। পিয়াস শরিফের ক্লাস মেইট এবং রুম মেইট। শরিফের চোখ-মুখের ভাষা বুঝতে তার অসুবিধা হয়না। এদিকে শরিফের বিষয়ে মাধুরীর সবচেয়ে কাছের বন্ধুটির কাছে যদি জানতে চান, তবে সে দৃঢ়ভাবে মৃদু হেসে বলবে, মাধুরীর ভাবনায় অন্য কিছু নেই, শরিফ ছাড়া।   

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, গ্রীস্মকালীন ছুটি, দেড় মাসের জন্য। মেসের সবাই বাড়ি চলে গেছে, শরিফ ছাড়া। তার টিউশনি আছে, তাছাড়া ছুটির পরেই এমএসসি ফাইনাল পরীক্ষা। টিউশনির টাকায় পড়ালেখার খরচ চালিয়ে আসছে, মাকেও পাঠাতে হয়। ছুটিতে অন্যরা গেলেও তার যাওয়া হয়নি, হয়না। একএকা গা ছমছম করে, রাতে, নির্জন মেসে। মেসের আশপাশের এলাকাটা ভালো না, যাবার সময় পিয়াস মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘সাবধানে থাকিস দোস্ত।’  

সকাল ৯ টা। কী যেন ভাবছে মাধুরী, শাওয়ার নিতে নিতে। বিদায় দিয়েই গোসলে ঢুকেছে সে, বাবা-মাকে। অফিসে গেল তারা। ক্লাস টেস্ট আছে আজ, গোসল শেষে সে-ও বের হবে।       

হঠাৎ চমকে উঠল, ‘কে?’ ভয় মেশানো কণ্ঠে বের হলো শব্দটা। ভেজা চুল মোছা বন্ধ করে একটু এগিয়ে গেল ড্রয়িং রুমের দিকে। কে যেন বসে আছে সোফায়! ‘কে বসে ওখানে?’ বলতেই ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাল শরিফ। ‘তুমি!’ ভয় এবং ভাললাগা মিশে গেল ধমনীতে। মুঠোফোন বেজে উঠল, ঠিক তখন-ই, তার রিডিং রুমে। হাতে ভেজা তোয়ালেটা নজরে পড়ল। ‘একটু বসো, ফোনটা রিসিভ করে আসছি’, বলে ভয়-ভাললাগা অনুভূতি নিয়ে রিডিং রুমে গেল মাধুরী।  

‘শরিফ আমাদের বাসায়! কিন্তু বাসায় ঢুকল কী করে? বাবা-মা বের হবার পর কি দরজাটা খোলাই রেখেছিলাম?’ ভাবতে ভাবতে মুঠোফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখল। পিয়াস, শরিফের বন্ধু! আরেকবার চমকে উঠে রিসিভ করল ফোন। পিয়াস জানাল, ‘মাধুরী সর্বনাশ হয়ে গেছে! ব্যাপারটা সকাল ৮টায় জানতে পেরেছে পুলিশ, গতরাতে মেসে খুন করা হয়েছে শরিফ কে!’  

মাধুরী সেকেন্ডের মধ্যে ড্রয়িং রুমে এল। কেউ নেই, কোথাও। বাসার মধ্যে চিৎকারের শব্দ হলো। তার পর আরেকটা শব্দে কেঁপে উঠল মেঝে। মেঝেতে পড়ে থাকা হাতের মুঠোয় মুঠোফোনে শব্দ হতে থাকল, ‘হ্যালো মাধুরী, মাধুরী…’  

শেষ বিকেলে যখন এ্যাম্বুলেন্সটির সাইরেন বেজে উঠল উজান পাড়ায়, তখন: অপেক্ষমাণ মানুষগুলো ‘আহা আতের খাবারডাও খাইতে দেয়নি গো, ভাতের থালডা টেবিলতই পড়া আচে। সারা ঘরত অক্ত জুমা আচে দলা দলা হইয়া।’ বলাবলি থামিয়ে ছোটাছুটি শুরু করল; বলতে লাগল, ‘উই আচ্চে, উই আচ্চে…।’  

উঠান বেয়ে একটি জলের ধারা মিশে যেতে থাকল করতোয়ার জলে, প্রতিবেশীরা শঙ্কা-ব্যস্ত হয়ে জল ঢালছে বেহুঁশ বৃদ্ধা আয়েশা খাতুনের মাথায়।       

লেখক: শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

3 মন্তব্যগুলো

  1. চমৎকার গল্প। ভাষিকচিত্রে গল্পকারের নিজস্বতা আশান্বিত করে। অবিনন্দন কথাশিল্পীকে।

  2. পড়ছিলাম- আর সেই সাথে ভাবছিলাম কিছুদিন পূর্বে ময়মনসিংহ শহরে মেসে থাকা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রটির নৃশংস খুন হয়ে যাওয়া ঘটনা। ত্রিশালের অন্য আরেকটি ছাত্রের খুন হওয়ার ঘটনা। বাবা মায়ের অহায় কান্না। স্বপ্নের অপমৃত্যু।
    গল্পটি চেতিন পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দেবে। ভাবনায় থাকবে অনেকদিন।
    ভালো লাগলো। শুভকামনা সবসময়।

  3. গল্পের অনুভূতিতে কখনো আমাকে, কখনো আমার বন্ধুকে আবার কখনো আমার ছাত্রকে পাই। আর কোথাও কোথাও যেন না বলে যাওয়া আসা করে আমার কাছের মানুষ জন। চেনা জানা কিছু অনুভব। ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন