গল্প : সুখ সংগ্রামী নারী : মুহাম্মদ বেলাল

0

লংকরণ: ফারিনা আহমেদ

আসমা এখনও ঘুমায়নি। রাত একটা বাজে। হঠাৎ মনে হলো ঘরের পিছনে কে যেন ঝপঝপ করে পানি ঢালছে। জাহানারার কণ্ঠ শুনে আসমা বুঝতে পারল আলী গোসল করছে। সন্ধ্যায় জাহানারা বলেছিল তার স্বামী নাকি কামালের ঘাটে গেছে। জাহাজ থেকে সিমেন্ট তুলতে। আসতে রাত হবে।    

আসমার মনে হলো রাতে আজ আর বোধহয় ঘুম আসবে না। আগামীকাল ভোরেই ‘সফর’ আসবে শহর থেকে। এখন পথে, গাড়িতে আছে। সে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিল সেই ছয় বছর আগের শরতের পূর্ণিমার রাতের কথা। সেই রাতেই আসমাকে সফরের সাথে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। পথে একটা বিড়াল দেখে আসমা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তার জ্ঞান না ফেরা অবধি সফর না কি বেশ উৎকণ্ঠায় ছিল। কিন্তু আসমা এখন সন্দিহান। তার এই স্বামী কী করে অন্য নারীর দিকে লোলুপদৃষ্টি দিল। অন্য নারীকে আবার বিয়ে করল। আসমা ভাবে সফরের কী তার ছেলে তানুর প্রতি এখন আর কোন মায়া নেই? তাহলে সে কেন আসছে এতদিন পর। নাকি শুধু ছেলেকে দেখার জন্যই শহর থেকে আসছে। এমন সব রহস্যে ঘেরা প্রশ্নের আড়ালে সময়টুকু গা-ঢাকা দিয়ে অনেক দূর গড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আযানের ধ্বনি আসমার কানে ভেসে এল। জোয়ারে খালে পানি আসায় সে খাল থেকেই অযু করে ফজরের নামাজটা আদায় করে নিল।

সফর এসে পৌঁছাল সকাল ৮টায়। রাস্তায় নাকি গাড়ি নষ্ট হয়েছিল, তাই একটু দেরি। তানুর আনন্দের সেকি কল্লোল!  বাবা তার কতদিন পরে এল। তার জন্য কতকিছু নিয়ে এসেছে। তাতেই সে মহাখুশি। এতদিনের না দেখার কষ্ট আনন্দের আবডালে ঢাকা পড়ে গেল। তার মনে কিঞ্চিৎ দাগের রেখাও যেন অবশিষ্ট নেই। অথচ বাবা না থাকায় এতদিন তার কত অভিমান!

সফর বাড়িতে এসেছে এক সপ্তাহ গেছে। এর মধ্যে আসমা তার সাথে সামান্য কটুবাক্যও ব্যয় করেনি। বরং গতর খাটিয়ে রোজগার করা টাকা দিয়ে স্বামীর জন্য প্রতিদিন-ই কিছু না কিছু ভাল খাবারের ব্যবস্থা করেছে। 

একদিন শুধু এটুকুই জানতে চেয়েছিল, ‘মাইয়াডা ক্যাডা তুমি আমারে কও?’

সফর হাসে আর বলে, ‘আসমা তুই আমারে অবিশ্বাস করস্ ক্যান? আমি আরেকটা বিয়া করিনাই। মানুষ তোর আর আমার মধ্যে দ্বন্দ্ব বাজাইতে চায়, তুই বুঝস না?’

‘তুমি বিয়া না করলে রমজান কাকা সেইদিন ঢাকা গিয়া তোমার লগে যে মাইয়াডারে দেখল হেইডা ক্যাডা? তুমি নাকি ঐ মাইয়ারে নিয়া রাজা মিয়ার বস্তিতে থাকো? মাইনষে কি মিছা কথা কয়?’

কিছুক্ষণ বাদে আসমা আবার বলে, ‘তুমি যদি আরেকটা বিয়া না-ই কর তাইলে এতদিন ক্যামনে কোন খোঁজ-খবর না নিয়া পারলা, পোলাডারে লইয়া একজন মাইয়া মানুষ হইয়া ক্যামনে থাকি, কি খাই খোঁজ নিছ একদিনও?’

সফর বলে, ‘এতদিন আমার একটা ঝামেলা আছিল। তাই খোঁজ নিতে পারি নাই।’

আসমা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল যেন। রেগেমেগে বলল, ‘তাতো জানিই। ঝামেলা তো একটাই। যার একটা বউ খাওয়ানোর মুরদ নাই, সে আবার নতুন একটা যোগাড় কইরা লইছে।’

সফর আর কিছুই বলতে পারেনা। সে ভাবে, সত্যিই পুরুষের কেন এত চাহিদা! যেখানে একজন মেয়ে মানুষের দায়িত্ব নিয়ে ঠিকমতো সেই দায়িত্ব পালনের কোন উপায় থাকেনা। অপারগতাই যেন সর্বব্যাপী। আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে সফর খেয়াল করল আসমা এখন আর যুক্তিসঙ্গত প্রলাপ বকছে না।

কিছুদিন থাকার পর সফর শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এতদিন থেকেও সে আসমাকে কোনো টাকা-পয়সা দেয়নি। শুধু যাওয়ার সময় ছেলে তানুর হাতে পাঁচশো টাকা গুঁজে দিয়েছে। এমন দায়িত্বহীনতার খবর শুনে আশেপাশের অনেকেই সফরের মতো পুরুষের প্রতি তুমুল ধিক্কার জানায়। কারও বুঝতে বাকি থাকেনা যে, সে আরেকটা বিয়ে করেছে। আসমার তাতে কোন মাথাব্যাথা নেই। সে এসবের তোয়াক্কা করেনা। শুধু স্বপ্ন দেখে ছেলেকে মানুষ করবে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত করবে। তার পর সে মরেও শান্তি পাবে।

সফর ঠিকমতোই পৌঁছেছে। এখন বেশ কিছুদিন যাবৎ নিয়মিত স্ত্রী-সন্তানের সাথে কথা বলে। প্রতি হাটবারে টাকা পাঠায়। আসমা প্রথমে টাকা নিতে নারাজ ছিল। কিন্তু আশপাশের মানুষের কথায় সে এটুকু উপলব্ধি করতে পারল যে, তার স্বামীর সবকিছুতে তারও অধিকার সমান। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে টাকা নিতে শুরু করল। মাস তিন-চার ভালোই টাকা দিল সফর। এরপর আবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আসমা তাতেও কিছুটা বিচলিত হয়না। সে মনে করে এটাই তার স্বামীর চিরাচরিত স্বভাব। বরং টাকা পাঠানোর দিনগুলোই যেন তার নিকট মনে হচ্ছে সফরের স্বভাব বিরুদ্ধ!

এক সকালে আসমা স্কুলের দিকে যাচ্ছিল তানুকে ভর্তি করানোর জন্য। রাস্তার পাশে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ অনাবশ্যক দৃষ্টি পড়ল রাস্তার ওপারে হাসানের দোকানে। আচমকা চোখ পড়ে হাসানের দিকে। হাসান সফরের চাচাতো ভাই। আসমাকে হাসান দোকানে আসতে বলল। তারপর তানুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে তানু বাপরে পাইয়া চাচারে ভুইলা গেলি?’

আসমা হঠাৎ তার চোখে প্রশ্নের রেখা টেনে হাসানের দিকে তাকায়। হাসান বলে উঠল, ‘কী ভাবি, এমনে তাকাইয়া আছো কেন?’

আসমা আরেকটু বিস্মিত হল। বলল, ‘তুমি কী কও এইসব। কীসের ওর বাপরে পাইয়া ভুইলা গেছে। আইজ দুই বছর যাবৎ তোমার ভাইয়ের কোন খোঁজ নাই, ফোন বন্ধ। আর তুমি আইছো ঠাট্টা মারতে?’

হাসানও রীতিমতো গোলকধাঁধায় আটকে গেল। বলল, ‘আরে ভাবি কী কও না কও! সফর ভাইরে দেখলাম কাইলকা মোটরসাইকেলে চইড়া এদিক থেকে বোয়ালপুরের দিকে যাইতে।’

আসমার বুঝতে বাকী থাকেনা। সে ভাবে যদি সত্যিই এসে থাকে তাহলে বোয়ালপুরেই এসেছে। সফরের দ্বিতীয় বউয়ের বাবার বাড়ি নাকি বোয়ালপুর। তবুও আসমার ইচ্ছে করছিল একবার বোয়ালপুর গিয়ে যাচাই করে।

আসমা সফরের দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনার শুরুতেই শুনেছে, যে মেয়েকে সফর বিয়ে করেছে সে ফকির বাড়ির হারু ফকিরের মেয়ে। নাম আরজু।

আসমা সকালে তার মা আর তানুকে নিয়ে বোয়ালপুর রওনা হয়। সেখানে গিয়ে বাজারের লোকজনকে আরজুদের বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে সবাই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘কোন আরজু, ঢ্যাং ঢ্যাং আরজু? হারু ফকিরের মাইয়া?’

একজন বলে উঠল, ‘ওহ! ওই মাইয়া তো মিয়া বাড়ির এক বিয়াতো পোলার লগে ভাইগা গিয়া সাঙ্গা বইছে।’

আরেকজন বলল, ‘কাইলতো ঢাকা থেইকা আইছে। তয় আফনেরা কেডা?’

আসমার মা বলে, ‘আমাগো বাড়ি বকুলপুর মেরধা (মৃধা) বাড়ি।’

আসমার মা পিছনে ফিরে দেখে আসমা ছোট্ট একটি মেয়ের সাহায্য নিয়ে সেই বাড়ির কাছে গিয়ে দাড়িয়ে আছে।  দুজন একসাথে বাড়িতে ঢুকে দেখে সফর বাড়ির উঠানে বসে কতক জোয়ান মর্দের সাথে গল্প করছিল। আসমাকে দেখেই সে ভড়কে যায়। ছেলেকে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে থেকে আসমার চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে থাকে। বাড়িতে এর মধ্যে হই-হই, রই-রই কাণ্ড ঘটে গেল আর আশপাশের  লোকজনের শোরগোল পড়ে গেল। মানুষের ভিড়ে সফর নিজেকে নিয়ে বড় এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হল। 

সে যাত্রা সফর নীরবে আসমার বকাঝকা শুনে গেল, কোন রাও করল না। কিন্তু নিজেকে পরিবর্তনের সদিচ্ছাটুকুও মনের করিডোরে ঠাঁই দিলনা। বিয়ে করলেই যে সব শেষ হয়না, বরং শুরু হয় তা সফর কখনও মনেও আনেনি। দুই বিবির প্রতি সমান দায়িত্ব, সমান দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তা কখনও তার বিশাল জ্ঞানের কলেবরে চরণটিও ফেলেনি। এবং সে এর শূন্যতাও অনুভব করেনি।

একদিন আসমা বাবার বাড়িতে বসেই শুনতে পায় সফর নাকি আরজুকে নিয়ে তার নিজ বাড়িতে থাকা শুরু করেছে। কখনও আসমার খবর তো নেয়ই না বরং এখন সন্তান তানুর খবরটিও নেয়না।

এতটুকু নিষ্পাপ শিশুটিও বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত। আসমা ছেলের মুখের পানে তাকিয়ে টপটপ করে কয়েকফোঁটা নোনা রহস্য ঝরায়। পরক্ষণেই আঁচলের কোণে মুছে নেয় সেই রহস্য। স্বচ্ছ রহস্যের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে রঙিন স্বপ্নে মোড়ানো সুখের ঝাণ্ডা। সে তাকিয়ে দেখে গোঁধুলির আবির মেখে সুখের ঝাণ্ডা সাঁইসাঁই করে উড়ছে। আর আসমার কানে কানে ফিসফিস করে বলছে,―আসমা, আমরা তোমার দুঃখের যবনিকা ছিঁড়ে নয়, আপোষেই তুলে দিব। তোমাকে আমরা ক্ষণস্থায়ী আনন্দ নয়, চিরস্থায়ী সুখের বন্দোবস্ত করে দিব।

আসমাও বুঝতে পারে। সে তার চোখের কোটরে সুখের সিংহাসনের নকশা করে। সে আনমনে ভাবতে থাকে,  দুঃখের কালিমামাখা জীর্ণ যবনিকার ফুরসত থেকে যদি কিছু আসে তবে সেটি আনন্দ। আনন্দে সুখ যদি থেকেও থাকে সেটি ক্ষণিকের। কিন্তু সুখের গায়ে আনন্দ, তৃপ্তি ও সময়ের ভর মাখামাখি।

আসমা তার মতো হাজারো স্বামী পরিত্যক্তা নারীর সংগ্রামী সুখের প্রতীক হতেও স্বপ্ন দেখে। নারী, নারী হয়েই বাঁচতে চায়। ফানুস যেমন নীলের গায়ে স্বাধীনভাবে ভেসে বেড়ায় আসমাও ঠিক তেমনি রংধনুর আবির মাখা ফানুস হতে চায়। নাটাইয়ে বাঁধা ঘুড়ির মতো কারও ইচ্ছের বাহুডোরে আটক হয়ে বাঁচতে সে আলবৎ নারাজ।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন