শেখ সুজন আলী।। গল্প।। সেই প্রতিশ্রুত গল্পটি

0

প্রচ্ছদ: রাশেদ সুখন।

‘শান্ত হউন, বসুন; প্লিজ, ধৈর্য ধরুন। নিশ্চয় শোনাব, সেই গল্পটি। হ্যাঁ হ্যাঁ ‘সেই প্রতিশ্রুত গল্পটি’ বলব, আজকেই, এক্ষুনি।…’

অডিটরিয়াম ভর্তি উৎসুক শ্রোতাদের দুহাত নেড়ে নেড়ে সিটে বসতে বললেন, সেই বিখ্যাত লোকটি, যার গল্প শুনে অভিভূত হতো শহরের মানুষগুলো।  

তিনি ফিরে এসেছেন― খবরটি কদিন আগেই চাউর হয়ে গিয়েছে শহরের অলিগলি। আবার গল্প বলবেন, অনেক বছর আগে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়া সেই গল্পবলা লোকটি। এবং বলবেন সেই গল্পটি যেটি তিনি শোনাতে চেয়েছিলেন নিরুদ্দেশ হওয়ার ছমাস আগে।  

গল্পপ্রিয় মানুষগুলো উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় আছেন, যেমনটা থাকতেন আগেও। কেউ তার সন্তানদের, কেউ তার স্ত্রীকে, কেউ তার স্বামীকে এবং কেউ সঙ্গে এনেছেন তার ভগিনীকে― লোকটির গল্প শোনানোর জন্যে। লোকটি মাথা নেড়ে, চোখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এমনভাবে কথা বলেন মন্ত্রমুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না এইসব গল্পপ্রিয় মানুষগুলোর।

লম্বাটে মুখ, বসা চোয়াল; শ্যাওড়া ঝোপের মতো মাথার চুল আর কাঁচাপাকা দাড়ি যেন কাশবন। অনেকের চোখে বিস্ময়! কে এই লোকটি? যারা লোকটির বেশভূষা দেখে ভ্রু কুচকালেন, সেই উচ্চারণ ‘শান্ত হউন, বসুন; প্লিজ, ধৈর্য ধরুন’, শুনে স্বাভাবিক মুখায়বয়ব নিয়ে স্থিত হলেন তারা। ‘একেবারে চেনাই যায় না, এই কবছরে লোকটির চেহারার বেশ পরিবর্তন হয়েছে’, অবশিষ্ট প্রবীণ শ্রোতারা নবীন শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে বললেন।   

কোন ঘোষণা ছাড়াই হাতঘড়ি, মুঠোফোন সুইচড অফ হয়ে গেল, আগের সেই অভ্যেস এখনও ভুলেনি তারা, বোঝা গেল। অডিটোরিয়াম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। দু মিনিটেই, দরজা-জানালার পর্দাগুলোও হয়ে গেল নির্বাক মূর্তি, মেঝের সাথে আটকে থাকা কাঠের চেয়ারগুলোর মতোই। লোকটি এবার শুরু করলেন।

‘শহরের ফুটপাতে, অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায় যুবকটি, তার ধুলোভরা লম্বা চুলগুলো উসখো-খুসকো আর দেবদাস মুখটি অন্ধকার জঙ্গল। হেঁটে বেড়ায় ইতস্তত― সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত-প্রভাত।’

‘তাহলে ঘুমায় কখন?’ আচমকা নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল, দ্বিতীয় সারিতে বসে থাকা তরুণীটি। 

প্রায় একই সাথে প্রথম সারি থেকে এক ষাটোর্ধ বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে পড়লেন, ‘যুবকের নামটা কী?’ অজান্তেই, মুখ থেকে বেরিয়ে গেল প্রশ্নটি।

‘শান্ত হউন, বসুন; প্লিজ, ধৈর্য ধরুন।’ লোকটি আরেকবার হাত নাড়লেন শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে।

অডিটোরিয়ামে এখন আবার সেই নীরবতা। শুরু করলেন তিনি। 

‘যুবকটি কখন, কোথায় ঘুমায় তা আমি জানি না, এমনকি তার নামটিও। শুধু জানি, তার চেহারার এমন দশা হয়েছে মাস ছয়েক হল। একদিন আমার কানে কানে বলল, ‘জানো, আমি একটা ঠিকঠাক জায়গা খুঁজছি। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। গাছে-গাছে কাকের ডাক; রাস্তায়-রাস্তায় নামিদামি টয়েটো, মার্সিডিজের শব্দ; দালানে-ফুটপাতে শেয়ালের হাঁক-ডাক― কোথায় পায় বলো তো?’ সেই জায়গাটি!      

‘কী বলে, পাগল নাকি!’ বিশ্বাস করুন, ভয় পেয়ে আমি ভেবেছিলাম, হনহন করে হেঁটে যেতে যেতে।  

ঘুরতে ঘুরতে যুবকটি একদিন খুঁজে পেল। না জায়গাটি নয়, সেখানে যাবার উপায়টি। আমি হাঁটতে হাঁটতে ফার্মগেইটের দিকে যাচ্ছিলাম। খামারবাড়ির মোড়ে আমার পথ আটকালো, দু হাত দু দিকে প্রসারিত করে। তার ধুলোমাখা গালে হাসির রেখাটি জীবন্ত হয়ে উঠল। বলল, ‘আমি পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি।’ যদিও তখন রাস্তায় অসংখ্য গাড়ি― ভু-ভা, প্যা-পুঁ শব্দ হচ্ছে; কড়ই গাছটির ডালে এক ঝাঁক কাক, ডাকছে কা কা কা। 

‘কী পেয়েছ?’ আমি জানতে চাইলাম। ‘উপায়, পথ― হি হি হি’, হাসতে হাসতে ফুটপাত ধরে দৌড়ে চলে গেল, গায়ে ময়লা শার্টটি হাওয়ায় উড়িয়ে।      

‘পাখি হত্যা করা নিষেধ। দণ্ডনীয় অপরাধ। পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপণ জারি করা হয়েছে।’ পথ চলতি দুই যুবতি বলতে বলতে বেরিয়ে গেল, যুবকটিকে পাশ কাটিয়ে। মাথায় উঁচু মেয়েটির উন্নত বুক আলতো করে ছুঁয়ে গেল তার পিঠের ব্যাগটিকে। কদিন থেকে ছাই রঙের ছেঁড়া ব্যাগটি পিঠে নিয়ে ঘুরছে যুবকটি। ব্যাগের মধ্যে কী আছে কেউ জানে না।

জাতীয় উদ্যানের পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে যুবকটির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, জারুল গাছের ডালে কী যেন একটা পাখি ভারি মিষ্টি সুরে শিস দিচ্ছে দেখে। হালকা নীল, ডানার কিনারটা; লেজের কাছে নীলটা বেশ গাঢ়, খয়েরি বুক-পেট আর ঠোঁটে লেগে আছে চেরি ফলের রং। এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখল― অদূরেই দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ, এদিকে মুখ করে। ‘ইউরেকা’, মনে মনে বলল। ঝটপট পিঠের ব্যাগটি ঘুরিয়ে সামনে আনল, চেইনটা খুলে বের করল একটা তিন কোনা পাথর, বেশ ভারী। ডান হাতে পাথর, লক্ষ্য ঠিক করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল, তার পর ছুঁড়ে মারল তাক করে। লাগবি তো লাগ একেবারে লক্ষ্যবস্তুর মাথায়। ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে। রক্ত গড়িয়ে ভিজতে লাগল ফুটপাত। পাখা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে নিস্তেজ হয়ে পড়ল, শিস দেওয়া পাখিটি।

পুলিশটি লাঠি হাতে ছুটে আসছে। যুবকটির চোখ চকচক করছে। লাঠি উঁচিয়ে দৌড়ে আসছে পুলিশ, দৌড়ে আসছে দ্রুত গতিতে আর যুবকটির চোখের উজ্জ্বলতা বাড়ছে গতির সমানুপাতিক হারে। দৌড়াতে দৌড়াতে এসে পুলিশটি তাকে পাশ কাটিয়ে, রক্ত মাখা পাখিটিকে পেরিয়ে চলে গেল আর একটু দূরে মোটর বাইকটির কাছে। পুলিশ ইউনিফর্মের বুক পকেটে বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা পঞ্চাশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিল, বাইকটির চালক। কেউ তাকে দেখেনি এমনি ভঙ্গি করে পুলিশটি চলে গেল আরও দূরে, আরও খানিকটা দূরে যেখান থেকে যুবকটিকে আর দেখার সুযোগ থাকল না। 

‘স্টুপিড, নচ্ছার’ বলে গালাগাল দিতে লাগল মেয়ে দুটোকে, ভুল তথ্য দেবার জন্য। হতাশ হল যুবকটি। ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়া রিক্সায় বসে আমি তার বিজিত, মলিন মুখটি দেখতে পেলাম। 

আমি একবার ঘুরতে গিয়েছিলাম, ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরে। বড় মনোহর শহর শ্রীনগর! খুব সুন্দর, পাহাড়ে ঘেরা, মাঝে বিস্তীর্ণ ডাল লেকে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে পিন্দিস পাখি; জলকেলি করছে স্বচ্ছ জলে। যাচ্ছিলাম লেকের পাড় দিয়ে প্রশস্ত রাস্তাটি ধরে, মাইক্রোবাসে করে। রাস্তার দু পাশে চিনার ট্রি সারি সারি করে লাগানো। রঙ্গিন পাতাগুলো চমৎকার দেখতে, গাছভর্তি পাতাগুলোই যেন রঙ-বেরঙের ফুল। ‘চিনার ট্রি কাশ্মীরের জাতীয় বৃক্ষ; এদেশের মানুষ এগাছটিকে খুব সম্মান দেয়; শাস্তিযোগ্য অপরাধ এই গাছ কাটা, ডালপালা কাটাও সমান অপরাধ।’ আমাকে শুনিয়ে যাচ্ছিলেন মাইক্রোবাসের সুদর্শন কাশ্মীরি ড্রাইভার, হিন্দিতে। যদি বলি আমি হিন্দি ভাষা পড়তে, লিখতে এবং বলতে পারি না, তখন আপনারা বলবেন, ‘তবে তুমি জানটা কী হে?’ আমি বলব, ‘আমি হিন্দি ভাষা বেশ ভালোই বুঝতে পারি’, শার্টের কলারটি নাড়াতে নাড়াতে। 

গাড়িটির শোঁ শোঁ শব্দ থেমে গেল চিনার বনের গেইটে, কাশ্মির ইউনিভার্সিটি এলাকায়। ড্রাইভার হিন্দিতে যা বললেন তার বাংলাটা এমন, ‘নামুন, ভেতরটা একটু ঘুরে আসুন।’    

উঁচু উঁচু অসংখ্য চিনার বৃক্ষের সারি, সামনে-পিছনে-ডানে-বামে, চোখে পড়ল। কেবল চোখে পড়ল না এ বনের শেষ প্রান্ত, টানা এক ঘন্টা হেঁটেও । হঠাৎ করেই আমি চমকে উঠলাম, সেই নির্জন বনে গাছ কাটার শব্দ শুনে। ভয়ে ভয়ে আমি শব্দটির কাছে গেলাম, একেবারে কাছে; দেখি গাছটির অর্ধেক কাটা শেষ, একটি কুড়াল দিয়ে একমনে কুপিয়ে যাচ্ছে। এবং কুড়ালটি সেই যুবকটির হাতে যে যুবক ঢাকার জাতীয় উদ্যানে খুন করেছিল একটি পাখি, যে পাখিটি মিষ্টি সুরে শিস দিচ্ছিল জারুলের ডালে আর যার ঠোঁট ছিল চেরি ফলের মতো লাল। শরীরটা শিউরে উঠল, ধাতস্থ হতে হতে ছুটে এল তিনজন ফরেষ্ট অফিসার। সঙ্গে সঙ্গে মরাৎ করে আরেকটি শব্দ হল যে শব্দটি মাটিতে ফেলে দিল বৃক্ষটিকে। অফিসারত্রয় যুবটিকে ধরে ফেলল, পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল― উসখো-খুসকো চুল আর দেবদাস মুখ, পিঠে ঝুলানো ছাই রঙের ছেঁড়া ব্যাগ। যুবকটির চোখে খুশির ঝিলিক, ডাল লেকে প্রতিফলিত সূর্যের সবটুকু আলো তার দু চোখের মণিতে। তার পর, যখন তিরস্কার করে অফিসারগুলো বললেন, ‘ভাগ যাও, পাগল’, তখন যুবকটি কেঁদে উঠল। বলল, ‘হল না, এবারও যাওয়া হল না।’ অফিসারগুলোকে, ‘অকর্মণ্য, দায়িত্বহীন’ বলতে বলতে চিনার বনে গাছগুলোর মধ্যে হারিয়ে গেল।   

জুন মাস। বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তাটি কিছুটা নির্জন, এই মুহূর্তে। বড় রাস্তার দুপাশে হলদে সড়ক বাতিগুলো জ্বলে উঠল, জানিয়ে দিল সন্ধ্যা নামছে। হলুদ আলো গায়ে জড়িয়ে এপাশ-ওপাশ করছে ব্যস্ত নগরের কেউ কেউ। সময়ের সাথে সাথে, হেঁটে যাওয়া হলুদ মানুষগুলো আরও একটু হলুদ হয়ে উঠল, হলুদ আলোতে। বড় বড় দালান, মানুষের গায়ের রং, পোশাক― সেই যুবকটি ফুটপাতে শুয়ে শুয়ে দেখছে; যেন শহরের পায়ের কাছে বসে দেখছে শহরের শরীর। গাছের ছায়ার অন্ধকার ঝোপ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ফুটপাতের ওপর।     

দূর থেকে একটি লোক হেঁটে আসছে, মাথা নিচু করে, সিগারেটের আগুন সামনে পিছনে দুলছে তার ডান হাতের সাথে সাথে। বাম হাতের তালুতে একটি বই পাঞ্জাবির পকেট ঘেঁষে ঘেঁষে এগুচ্ছে, লোকটির পাশ ধরে। একটু সামনে এলেই স্পষ্টত দেখা গেল, লোকটির ঝাঁকড়া চুলে লুকোচুরি খেলছে সড়ক বাতির হলদে আলো। রাস্তার আলো আর ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেটের আলো চোর-পুলিশ খেলছে, মুখের খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে। একই দিক থেকে একটা মোটর বাইক এল ধীরে ধীরে। আচমকা একটি ধারালো ছুরি বসিয়ে দিল লোকটির পিঠে, বাইক আরোহী, তার পর চলে গেল এবং মিশে গেল শত শত মোটর বাইকের সাথে। কক করে উঠল, হাতের বইটি আঁকড়ে ধরল প্রাণপণে কিন্তু নিজেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারল না, ঝাঁকড়া চুলের লোকটি। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকল ফুটপাতের ওপর, গাছের ছায়া-ঝোপের মধ্যে।   

যুবকটি ছুটে গেল লোকটির কাছে। মাথাটা হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল তার, কী করবে বুঝে এল না। ধারেকাছে কেউ নেই। চিৎকার করতেও ভুলে গেল। আহত লোকটির সাদা পাঞ্জাবি ভিজে রক্ত ঝরতে লাগল, রক্তধারা গড়িয়ে গেল ফুটপাত বেয়ে বেয়ে। ওই শূন্য মাথাতেও তার চোখে মুহূর্তের জন্যে ভেসে উঠল, ঢাকার জাতীয় উদ্যানে খুন করা পাখিটির চেহারা, যে পাখিটি মিষ্টি সুরে শিস দিচ্ছিল জারুলের ডালে আর যার ঠোঁট ছিল চেরি ফলের মতো লাল।      

লোকটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করল, ডান হাত দিয়ে হ্যাঁচকা টানে বের করে ফেলল পিঠে বিঁধে থাকা ছুরিটা। সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে পিকআপ ভর্তি পুলিশ এসে হাজির। প্রত্যক্ষ করল, খুনের ঘটনাটি। লাশটিকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা হল। আর থানায় নিয়ে গেল যুবকটিকে, যার উসখো-খুসকো চুল, দেবদাস মুখ আর পিঠে ঝুলানো ছাই রঙের ছেঁড়া ব্যাগ। তিন টুকরো তেকোনা পাথর, একটি কুড়াল আর একটি চকচকে ছুরি বের করল কর্তব্যরত পুলিশ, ব্যাগটি থেকে।

পর দিন, দেশের সকল জাতীয় দৈনিকে লাল অক্ষরে লিড নিউজ হল―বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি ‘সুপ্রীত শ্রাবণ’ খুন, অজ্ঞাত যুবকের হাতে।’

অডিটোরিয়াম ভর্তি শ্রোতাদের কেউ কেউ উৎসুক হয়ে বলে উঠলেন, ‘তার পর, তার পর!’              ’

‘বলব, বলব,’ গল্পবলা লোকটি আরেকবার বললেন, ‘শান্ত হউন, বসুন; প্লিজ, ধৈর্য ধরুন।’ তার পর তিনি বলতে লাগলেন।

‘যুবকটি চৌদ্দ সিকের মধ্যে শুয়ে আছে, মেঝেতে, ক্লান্ত হাতের তালু দুটোকে বালিশ বানিয়ে। দিন দুটো কি দুঃস্বপ্ন ছিল? নিজেকেই প্রশ্ন করল, তবে উত্তর শোনার মতো শরীরের জোর অবশিষ্ট ছিল না তার। অবসন্ন চোখ জোড়া আলস্যে ঘুরছিল―দেয়ালের কোনায় কোনায়, খসে পড়া পলেস্তরায়, সিকের ফাঁকে ফাঁকে। তড়াক করে উঠে বসল মেঝে থেকে। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শরীরটা ঝরঝরে হয়ে গেল, যেন হাত-পায়ে টানা দিয়ে বেঁধে রাখা চারটি শেকল চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে শুকনো ডালের মতো পড়ে গেল মেঝেতে। ‘আমি পেয়েছি, হা হা হা…, পেয়ে গেছি সেই জায়গাটি। এখানে শেয়ালের উঁকিঝুঁকি নেই, কাকের কা কা নেই। এইতো সেই জায়গাটি, জায়গাটি…।’ বলতে বলতে শরীরটা তার এলিয়ে পড়ল মেঝেতে।  

অনেকদিন পার হয়ে গেল। শহরের সবকিছুই স্বাভাবিক, যেমনটা হয়। কত লেখককেই তো মরতে হয়েছে, তাতে কী! খুনিকে হাতে-নাতে ধরতে পেরেছে, পুলিশের এ এক বিরাট সাফল্য। সাবাশ পুলিশ! তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল শহর সমুদ্রের চিংড়ি, পুটি। আর গোঁফ নাড়িয়ে হাসল রাঘব বোয়াল। আমিও একজন শহরের মানুষ, ভুলে গেলাম বেমালুম― কবি ‘সুপ্রীত শ্রাবণ’ হত্যার ঘটনাটি। 

তার পর একদিন পৌঢ়টির ছাড়া পাবার ঘোষণা হল। পৌঢ়টি? আপনাদের মনে এই প্রশ্নটি আসা স্বাভাবিক। হ্যাঁ, বত্রিশ বছরের যুবকটিকে এখন পৌঢ়টি বলা যৌক্তিক, কারণ চৌদ্দ সিকের মধ্যে সে যে একটি যুগ শুয়ে বসে থেকেছে। যাইহোক, রাত দশটার দিকে একজন কারা পুলিশ গেল পৌঢ়টির কাছে, ছাড়া পাবার খবরটি জানাতে। সে তখন গভীর ঘুমে; বুকের ওপর একটা ডায়ারি। পুলিশটি তাকে জাগালেন না, ডায়ারিটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টালেন এবং পড়তে লাগলেন মনে মনে: 

… …। বিকেলটা শেষ হয়নি, তখনও, লাল আলো লেপ্টে আছে আকাশ ছুঁতে চাওয়া দালানগুলোর বারান্দার গ্রিলে; কড়ই আর নারিকেল গাছগুলো যেন সিঁথিতে সিঁদুর পরে দাঁড়িয়ে আছে। কানে আসছে শোঁ শোঁ শব্দ, গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছে রাস্তার এদিক-ওদিক। ইলেকট্রিক তারে বসে একটা ফিঙে দেহের ভারসাম্য ঠিক করে নিচ্ছে। ঠিক এমনি এক বিকেলে তার সাথে আমার দেখা, আগারগাঁও এর একটি নার্সারিতে। নার্সারিটি রাস্তার ধারেই। গোলাপের একটি টব হাতে নিয়ে ঘুরছে, দেখছে আরও কিছু গাছ― ফুটপাত থেকে তাকিয়ে দেখলাম আমি। টবের গাছটিতে ফুটে আছে একটিমাত্র গোলাপ, রং গোলাপি। দুলছে মৃদু হাওয়ায়। সতেজ-স্নিগ্ধ-সুন্দর গোলাপ ফুলটি, মেয়েটির মুখটিও। লোভ সামলান অসম্ভব হয়ে গেল। এগিয়ে গেলাম সেই গোলাপ আর গোলাপি মুখটি দেখতে দেখতে। বেশ কাছ থেকে দেখলাম― এক বিরল তনুলতায় ফোটা স্নিগ্ধ পুষ্প, তার মুখটি। মেয়েটির মনোযোগী দৃষ্টি পড়ল আমার ওপর। আমি নির্বাকই রইলাম; আমার দৃষ্টি পথ ধরে মেয়েটি চলে গেল, তার পরও।     

দু দিন পর। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে যাব বলে দাঁড়িয়ে আছি, শ্যামলীতে, বাসের অপেক্ষায়। খলখল একটা হাসি কানে এল রাস্তার ওপার থেকে, তাকিয়ে দেখি নার্সারিতে পাওয়া সেই তনুলতাটি বাসে উঠছে, বান্ধবীদের সাথে হাসতে হাসতে। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হলাম, উঠে পড়লাম আমিও। দাঁড়ালাম, মেয়েটি যে সিটে বসল তার ঠিক এক সিট সামনে। তার চুলগুলো বাতাসে উড়ছে; ছড়িয়ে পড়ছে কপালে, কপোলে―দেখলাম। বুঝলাম, চকিতা হরিণীটির কিছু সচকিত দৃষ্টি পড়ল আমার ওপর, ছোট্ট যাত্রাপথটুকুতে।    

নামল ইডেন কলেজের কাছে। কাজেই, আমার না নামবার কোন কারণ রইল না। পিছু পিছু হেঁটে গেলাম গেইট অবধি। লাভ যেটা হল― গেইটে ঢুকতে ঢুকতে লক্ষ্যবস্তুটির একটা দীর্ঘ দৃষ্টির স্পর্শ পেল আমার আপাদমস্তক। ভার্সিটিতে আর যাওয়া হল না সেদিন। ঘুরলাম ঘন্টা তিনেক― শাহবাগ-টিএসসি-সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, তার দৃষ্টি-স্পর্শ-ধন্য আমার দেহটি নিয়ে। সেদিন মাস্টার্সের একটা মিডটার্ম পরীক্ষা নেবার কথা ছিল আমার। সত্যি বলতে কী, পরীক্ষাটা নিলাম না বলে শিক্ষার্থীরা কী ভাবল না-ভাবল তা নিয়ে একটুও খারাপ লাগল না।         

তারপর শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড আর ইডেন কলেজ গেইট করলাম প্রায় ছমাস এবং শাহবাগ-টিএসসি-সোহরাওয়ার্দি উদ্যান ঘুরলাম, একাএকা। একদিন পরিচয় হল। এবং উদ্যানে-উদ্যানে বেড়ালাম, পথে-পথে হাঁটলাম আরও ছমাস, তন্বী তনুলতাটিকে সঙ্গে নিয়ে। দুজনই দুজনের পরিবারে জানালাম। তারা অপেক্ষা করতে থাকল ‘ভূমি’র ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার।  

দিনটি ছিল শ্রাবণ মাসের উনিশ তারিখ। রাত ৯.৩০ টা। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল ঢাকা শহরে। আকাশমণি গাছগুলো নুইয়ে পড়ছিল বৃষ্টিভারে, আমি দেখছিলাম বারান্দায় বসে। মুঠোফোনের রিংটোন বেজে উঠল। রিসিভ করতেই, ‘বাবা, ভূমি কি তোমার সাথে আছে? এত রাত হয়ে গেল এখনো বাসায় এল না! ফোনেও পাচ্ছি না ও কে।’ উৎকণ্ঠা নিয়ে কথাগুলো বলল ভূমির বাবা। ‘না, আমার সাথে তো নেই…। বৃষ্টিতে আটকে আছে মনে হয়। তাছাড়া আজকে তো শেষ পরীক্ষা ছিল, হয়তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে কোথাও।’ সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।  

ভূমি’র মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম, অনেকবার। প্রতিবারই একই উত্তর, ‘দুঃখিত, এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবীকে ফোন করলাম। ‘পরীক্ষা শেষ করে তো ভূমি’র বাসায় যাওয়ার কথা’, সে জানাল। 

রাত ১২.৩০ টা, সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে এলাম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। নেই। তার বাবার সাথেও কথা হল, বাসায় ফেরেনি, জানাল। ভাবলাম, হয়তো অন্য কোন বান্ধবীর বাসায় গেছে কিংবা আছে কোথাও; সান্ত্বনা দিলাম নিজেকে।

ঘুম হল না সে রাতে। পর দিন সকাল ৮.০০ টায় ভূমি’র বাবার ফোন এল। আমি বেরিয়ে পড়লাম। ভূমির বাবা-মা কাঁদছে, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে উৎসুক জনতা, বুড়িগঙ্গার পাড়ে। মাঝখানে আমার ভূমি’র নিথর দেহ, বিবস্ত্র।

কারা পুলিশের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল। জলভরা চোখে তিনি দেখলেন ডায়েরীর শেষ পৃষ্ঠায় লেখা:

রাজনীতির স্বার্থ-থালায় ভূমিকে নৈবেদ্য সাজিয়ে সমর্পণ করা হয়েছিল ধানমন্ডির এক দেবতার পদমূলে। ভক্তটি আর কেউ নয়, তারই চাচাতো ভাই।

পুলিশটি কয়েদির আসল পরিচয় জেনে গেলেন। তার চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।’

সাতদিন পর ছাড়া পেলেন, বিনা অপরাধে শাস্তি পাওয়া পৌঢ়টি। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে নিয়ে গেল অডিটোরিয়ামে এবং তিনি এখন অডিটোরিয়াম ভর্তি উৎসুক শ্রোতাদের শোনাচ্ছেন তার সেই প্রতিশ্রুত গল্পটি। মাঝে মাঝে শ্রোতাদের দিকে হাত নেড়ে নেড়ে বলছেন, ‘শান্ত হউন, বসুন; প্লিজ, ধৈর্য ধরুন।’

লেখক: কবি ও গল্পকার। শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন