মেহেদী উল্লাহ।। প্রবন্ধ।। সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনে লৌকিক ঐতিহ্য : প্রেক্ষিত নিউ মিডিয়া

0

ছবি: ‘নিউ মিডিয়া ও ফোকলোর’ গ্রন্থপ্রচ্ছদ

‘আসলে আমরা নিজেদেরকে বিদগ্ধ নাগরিক প্রমাণ করার অতি উৎসাহে যা কিছুকে অমার্জিত ও গ্রাম্য বলে প্রকাশ্যে নাসিকা কুঞ্চন  করি, আমাদের সত্তার মূল কিন্তু তারই গভীরে প্রোথিত।’ (যতীন সরকার, ২০১৬ : ৬১) নাগরিক সমাজ লোকসংস্কৃতিকে অমার্জিত আর গ্রাম্য জ্ঞান করে বিপরীতে লোক-সংগীতকে পপ সংগীতে রূপান্তরিত করেছে। প্রাবন্ধিক এমন প্রবণতাকে বলছেন ‘ইতরায়ন’ বা ভালগারাইজেশন, যাতে পৈশাচিক উদ্দামতা থাকে। (যতীন, ৬১)। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে, পোশাক-আশাক ও আরাম আয়েশের আধুনিক উপকরণের বহিরঙ্গ দিয়ে আধুনিক ও নাগরিক হওয়ার যত প্রাণপণ চেষ্টা করি আমরা, ততই আমাদের ভিতরকার চিরায়ত গ্রামীণ সত্তাটি তার উৎসের কাছে ফিরতে চায়। প্রাবন্ধিক মনে করেন, লোকঐতিহ্যের কাছে ফেরার যে ক্ষুধা আমাদের রয়েছে, তা পরিতৃপ্তির জন্য কোনো সঠিক দর্শন ও সুষ্ঠু পথ আমাদের জানা নেই। ফলে কেউ কেউ ভ্রান্ত ও বিকৃত পথে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে প্রাবন্ধিক বাংলাদেশে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর ‘ইতিহাস কথা কও’ উপস্থাপনার উদাহরণ টেনেছেন। এই পরিবেশনা যাঁরাই দেখেছেন তাঁরাই অভিভূত হয়েছেন। উদীচীর উপস্থাপনা অনেক অমার্জিত ও নিতান্ত গ্রাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিদগ্ধ নাগরিক শ্রোতা ও দর্শকবৃন্দ তা দেখে অভিভূত হয়েছেন। অভিভূত হওয়ার কারণ, নাগরিকের অবচেতনে লোক ঐতিহ্যের প্রতি অপরিসীম টান রয়েছে, অনুভব রয়েছে। গ্রামীণ লোকসমাজের সঙ্গে শহরের মানুষের বিচ্ছেদ ঘটলেও, তাঁদের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সংস্কারগুলো ‘একেবারে দুর্মোচ্য রূপে লেপ্টে রয়েছে।’(যতীন,  ৬১) প্রাবন্ধিক আহ্বান জানিয়েছেন, উদীচীর মতো বিদগ্ধ সংস্কৃতিসেবী ও সহৃদয় সামাজিকবৃন্দ যেন শেকড়ের সংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বয় করে বা সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন করে সুস্থ সংস্কৃতিকে গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। উদীচী আবহমানকালের বাংলার লোকসংস্কৃতির উপাদানগুলোকে একত্র করে তারই আধারে বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসকে কথা-কওয়ানোর সুস্থ শৈল্পিক প্রয়াসকে সামনে নিয়ে এসেছিল। এমন প্রয়াসের মধ্য দিয়েই সংস্কৃতির পুনর্গঠন সম্ভব। অর্থাৎ, নাগরিক যেন লোকঐতিহ্যের সান্নিধ্যে যান, লোকসংস্কৃতির উপাদানগুলোকে নগরে নিয়ে আসেন, অথবা পুনর্গঠন করে লোকসমাজের ভাষায় পরিবেশন করেন, যা নাগরিকের চিত্তের গহীনে অমূল্য বিত্ত হিসেবেই রয়ে গেছে।

প্রাবন্ধিক তাঁর বন্ধু আলোকময় নাহার নেত্বত্বে ময়মনসিংহ শহর থেকে একটা গণসংগীতের ট্রুপ ভাটি এলাকার গ্রামাঞ্চলে অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে গিয়েছিলেন, সেই দৃষ্টান্ত প্রয়োগ করে জানান:

প্রচুর শ্রোতাসমাগম হয় অনুষ্ঠানে। গায়ক-গায়িকারা খুবই দরদ দিয়ে গণচেতনা-উদ্বোধক সঙ্গীত পরিবেশন করেন, গ্রামীণ শ্রোতারাও অখ- মনোযোগের সঙ্গে তা শ্রবণ করেন। অনুষ্ঠান শেষে পরিবেশকবৃন্দ যখন শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন, তখন তাঁরা সহজে মুখ খুলতে চান না। অবশেষে শ্রোতাদের মুখপাত্র রূপে দু’একজন জানালেন ‘গান খুবই ভালো হয়েছে। কিন্তু এসব তো ইংরেজি গান, আমরা মূর্খ মানুষ তা বুঝতে পারি না কি-না, তাই…। (যতীন সরকার, ২০১৬: ৬২)

বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় রচিত গণসংগীতও বাঙালি গণশ্রোতাদের ইংরেজি বলে মনে হয়েছে। এটি আসলে একপ্রকারের কমিউনিকেশন গ্যাপ। এর কারণ মানুষে মানুষে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে আদান-প্রদানের রুদ্ধতা। নগরের সঙ্গে গ্রামের বিচ্ছিন্নতা, সাংস্কৃতিক দূরত্ব। এছাড়া নাগরিক ব্যক্তি মানুষ ও গ্রামীণ ব্যক্তি মানুষের বিচ্ছিন্নতা তো রয়েছেই। এর জন্য প্রবলভাবে দায়ী শ্রেণি বিচ্ছিন্নতা, শ্রমও দায়ী। ‘আদিম সমাজের মানুষের নাচ, গান আর কবিতা তো শ্রমের সঙ্গে অনপনেয় সূত্রে গাঁথা আর সে শ্রমে অংশগ্রাহী সমাজের সবাই; শ্রমিক আর অ-শ্রমিকের বিভাজন সে-সমাজে অপরিজ্ঞাত এবং শ্রম আর শিল্প অবিচ্ছিন্ন বলেই সে সমাজে শিল্পী আর শিল্পভোক্তার বিচ্ছিন্নতাও অচিন্তনীয়। (যতীন, ৬৩) ফলে গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ নগরের অ-শ্রমজীবী শিল্প ধরতে সমর্থ হয় না। নাগরিক মানুষ পুঁজিবাদী বিধানের সঙ্গে যুক্ত। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়ে নাগরিককে গ্রামীণ মানুষ থেকে আরো দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে, সাংস্কৃতিক পার্থক্যটা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী। নাগরিক ভাষা পরিণত হয়েছে একান্ত ব্যক্তির ভাষায়, তার চিন্তার ভাষা সামাজিক বোধ্যতার পর্যায়ে নেই। এমন অবস্থায় প্রয়োজন, নাগরিক মধ্যবিত্তের বৃত্ত ভেঙে মেহনতি লোকসমাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার তাগিদ অনুভব করা। গ্রামের ভাবাদর্শের সঙ্গে একীভূত হওয়া প্রয়োজন। তাদের সংস্কৃতিতে লোকভাষায় লোক চৈতন্যের প্রকাশ ঘটাতে সমর্থ হতে হবে। কেবল মধ্যবিত্তসুলভ ভাবাবেগের মধ্যে কিছু লোকঐতিহ্য চাপিয়ে দিয়ে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ গড়ে তোলা অসম্ভব। যদি তা না হয় সাংস্কৃতিক দূরত্ব বাড়বে এবং মধ্যবিত্তের সংস্কৃতিকে গ্রামের মানুষের কাছে বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বলে মনে হবে।

এ-কালীন নাগরিক সমাজের বাইরে যে বৃহত্তর লোক-সমাজের অবস্থান তারা কিন্তু অনেক ঝড়ঝাপ্টার মধ্যেও সংস্কৃতির অকৃত্রিমতাকে এখন পর্যন্ত অনেকখানি বাঁচিয়ে রেখেছে। এর মূলে ক্রিয়াশীল প্রাধানত দুটো শক্তি। এক. সংহত সমাজ-মানুষের উৎপাদন-সংশ্লিষ্ট শ্রম; দুই. ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জীবন-দর্শন। (যতীন, ২০১৬: ৬৫)

যদিও একথা সত্য, লোকয়ত জীবন-দর্শনের মধ্যে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সংস্কৃতির প্রবহমানতার দরুন গ্রামের সংস্কৃতিকে ভুল বোঝা হচ্ছে। নগরের মানুষের চোখে গ্রাম হয়ে উঠেছে ধর্মান্ধ-সংস্কৃতির আধার। এর সঙ্গে লোকঐতিহ্যের সম্পর্ক নেই, বরং লোকঐতিহ্যের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রতিহতকরণই দায়ী, আর সেটি গ্রামের একশ্রেণির ধর্মান্ধ মানুষের দ্বারাই ঘটে চলেছে। লোকসমাজের চেতনা ধর্মবেদ্বেষী নয়, বরং ধর্মের নামে যে অধর্ম প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে।

প্রাবন্ধিক প্রস্তাব করেছেন, কবিগান, যাত্রা, গম্ভীরা বা কথকতাই শুধু নয়, আধুনিকতার মাত্রা যোগ করে নতুন গণচেতনার বাহন হিসেবে গণসংস্কৃতির পুনর্গঠনে কাজে লাগানো যায় এমন বহু লোককৃতি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো প্রচলিত আছে। যেমন-জারি গান, জাগগান, ধুয়াগান, পটুয়া সংগীত, গাইনের গীত ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব প্রকরণের অনেকগুলোই একান্ত আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, বিশেষ বিশেষ সীমার বাইরে প্রচলন নেই। এসব বিভিন্ন প্রকরণেরও শৈল্পিক মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন নতুন প্রকারণও তৈরি করা যায়। সেসব প্রকরণকে নাগরিক বিদগ্ধ সমাজেরই শিল্প-আঙ্গিকের সঙ্গেও অনেক পরিমাণে যুক্ত করে দেয়া যায়। এভাবেই নাগরিক মধ্যবিত্তের নিরক্ত সংস্কৃতির দেহে তাজা রক্তের সঞ্চার ঘটানো যায়, নগর ও গ্রামের সংস্কৃতি বিচ্ছিন্নতাও দূর করে একটা অখণ্ড গণসংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়, আর এতে তথাকথিত কমিউনিকেশন গ্যাপেরও অবসান ঘটে।

প্রাবন্ধিকের এই প্রস্তাব সমর্থনযোগ্য ও যুক্তিসম্মত। বর্তমানে নিউ মিডিয়ায় নাগরিক মধ্যবিত্তের সংস্কৃতির কাছাকাছি অবস্থান করছে উল্লিখিত লোককৃতিগুলো। কবিগান, যাত্রা, গম্ভীরা, জারি গান, জাগগান, ধুয়াগান, পটুয়া সংগীত, গাইনের গীত ইত্যাদি লোক-আঙ্গিকগুলোর দেখা মিলছে নিউ মিডিয়ায়। এসবের দর্শকও কম নয়। আর দর্শকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হচ্ছেন নাগরিক বিদগ্ধ সমাজ। প্রতিটি কন্টেন্ট-এর মন্তব্যের ঘরে নাগরিকের উপস্থিতি প্রবল মাত্রায়। তাঁদের মন্তব্যগুলো দেখলেই চেনা যায়। আমরা ইতোপূর্বে মন্তব্যে প্রশংসাসূচক যেসব শব্দ উদ্ধৃতি করে দেখিয়েছি তার বেশিরভাগই নাগরিক বিদগ্ধ সমাজের অংশ। ইংরেজি শব্দের মাধ্যমে ও মধ্যবিত্তের ভাষিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে তাঁরা লোক-ঐতিহ্যের প্রশংসা করছে। এতে তাদের রুচির সঙ্গে লোকসংস্কৃতির সংযোগ ঘটছে। আলাদা করে হয়তো লোক-ঐতিহ্যের প্রকরণের সঙ্গে নাগরিক বিদগ্ধ সমাজের শিল্প-আঙ্গিকের যুক্ততা কম হচ্ছে, কিন্তু নাগরিক বিদগ্ধজনের সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলছে লোকসংস্কৃতি। এতে করে একটা বোঝাপড়া হচ্ছেই। নাগরিক মানুষ লোকসমাজকে উপলব্ধি করতে পারছে, তারই চোখের কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা উপকরণের সাহায্যে। আগে যেখানে তাকে এসব দেখতে গ্রামে যেতে হতো, যা ছিল নাগরিক বৃত্ত ভেঙ্গে বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব, আলাদা উপলক্ষ ও হাতে সময় নিয়ে গ্রামে যাওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়, আর সংস্কৃতিসেবী ও সংস্কৃতিগ্রাহী হিসেবে তো আরো নয়। আর নগরসংস্কৃতির অংশ ব্যক্তি মানুষের প্রতি গ্রামীণ মানুষের একপ্রকারের অবিশ্বাস রয়েছেই, এটা এতকালের সাংস্কৃতিক দূরত্বেরই অবিশ্বাস। হুট করে ঘুচিয়ে যাবার নয়। ফলে লোকঐতিহ্য সংগ্রহ করে শিল্পআঙ্গিকের সঙ্গে যে সংমিশ্রণ সেটাতে কৃত্রিমতাও চলে আসতে পারে। কিন্তু একই মাধ্যমে দুই ধরনের সংস্কৃতি বিরাজ করায় খুব সূক্ষ্মভাবে একটা রূপান্তর ঘটে চলেছে। যা অবশ্যই ইতিবাচক প্রাকৃতিক উপায়ে গড়ে ওঠা সংস্কৃতির পুনর্গঠনের জন্য। নগর সংস্কৃতির সঙ্গে গ্রামীণ সংস্কৃতির মিশ্রণের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তের রুচিতে পরোক্ষে একটা প্রভাব নিশ্চয়ই তৈরি হচ্ছে। লোকসংস্কৃতির যে অবচেতন সত্তা বিদগ্ধ নাগরিকের রয়েছে সেই টানেই সে এই সংস্কৃতির কাছে আসে, আর চোখের কাছে পেলে তো কথাই নেই। এতকাল স্থানিক কারণেই সংস্কৃতি পরস্পর দূরে সরে ছিল। বর্তমানে নিউ মিডিয়ার বাস্তবতায় সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগ ঘটছে। কোথাও কোথাও নাগরিক সমাজে সংস্কৃতির মিশ্র উপস্থাপনাও চোখে পড়ে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিয়ের অনুষ্ঠান, সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা উৎসবে দুই সংস্কৃতির যৌথতায় তৈরি মিশ্রিত সাংস্কৃতিক উপকরণও নিউ মিডিয়ায় উপস্থাপিত হচ্ছে। এতে গ্রামের দর্শক যেমন সেটি উপভোগ করে নগর সংস্কৃতিকে বুঝতে পারছে, আবার নগরের মানুষও লোকঐতিহ্যকে বুঝতে সক্ষম হচ্ছে। এখন দায়িত্বটা সবার। লোক ঐতিহ্যের ধারক সমাজকেও এ ধরনের আয়োজনকে স্বাগত জানাতে হবে, অন্যদিকে নগরের মানুষ নিজেই লোকঐতিহ্যের উপকরণটি তৈরি করেছে বলে সে নিজেই এই প্রক্রিয়ায় অবস্থান করছে। নগরের মধ্যবিত্ত এগিয়ে এসেছে সাংস্কৃতিক দূরত্ব ঘোচাতে, এখন গ্রামের মানুষটিকে এগিয়ে আসতে হবে। দুই সংস্কৃতির যে পুনর্গঠিত রূপ এসবের বেশি বেশি ধারণ  ও ছড়িয়ে দিতে হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এসব বিভিন্ন প্রকরণেরও শৈল্পিক মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন নতুন প্রকারণও তৈরি করা সম্ভব এই মাধ্যমে। সেসব প্রকরণকে নাগরিক বিদগ্ধ সমাজেরই শিল্প-আঙ্গিকের সঙ্গেও অনেক পরিমাণে যুক্ত করা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ফলে নাগরিক মধ্যবিত্তের নিরক্ত সংস্কৃতির দেহে তাজা রক্তের সঞ্চার পরোক্ষভাবে ঘটাচ্ছে নিউ মিডিয়া। নগর ও গ্রামের সংস্কৃতি বিচ্ছিন্নতাও দূর করে একটা অখণ্ড গণসংস্কৃতি গড়ে তোলার বড় সুযোগ দিয়ে রেখেছে এই মাধ্যম। কমিউনিকেশন গ্যাপেরও অবসান ঘটতে পারে, অন্তত রুচি ও বোধের পর্যায়ে দুই পক্ষের তরফ থেকে। 

বাংলা লোকসংস্কৃতি গানের মধ্যে দিয়ে মালদাবাসীকে আগমনির শুভেচ্ছা জানলো শহরের কিছু উঠতি যুবক পঞ্চমীর সন্ধ্যায়। শহরের মালদার উঠানপ্রাঙ্গণে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। (https://www.youtube.com/watch?v=6qweG4xJFo0) ব্যান্ডের নাম ফড়িং, এটি লোকসংগীতের ব্যান্ড। শহরে লোকগানের উপস্থাপন করা হয়েছে নতুন আঙ্গিকে, নতুন প্রকরণে। এরমধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক যৌথতা তৈরি হয়েছে নিশ্চিতভাবেই। বাস্তবেই ঘটে যাওয়া সেই অনুষ্ঠানের সংবাদ ইউটিউবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গ্রাম ও শহরের মানুষকে জানানোর ফলে তাদের মধ্যেও একটা সংযোগ ঘটেছে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের এমন সংবাদ বাংলাদেশে যারা এধরনের ব্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত তাদের জন্যেও একটা নির্দেশনা তুলে ধরেছে। যদিও লোকসংগীতের ব্যান্ডদলের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম নয়।     

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা পরিবেশিত হয় জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস-২০১৯ উপলক্ষে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক  অনুষ্ঠানে। নওগাঁ জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির আয়োজেন ২৮ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখে নওগাঁ জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণ, নওগাঁয় পরিবেশিত হয়েছিল এই লোক-ঐতিহ্য। গম্ভীরার মধ্য দিয়ে নানা-নাতি চরিত্র আইন সহায়তা নিয়ে পরিবেশনাটি করেন (https://www.youtube.com/watch?v=auAwU_8056Y)। সব শ্রেণির মানুষের কাছে আইনি সেবা পৌঁছাতে নির্মিত হয়েছে এই লোকসংস্কৃতির প্রকরণ, নতুন একটি আঙ্গিক। যেটির আঙ্গিক লোকসমাজে এমন ছিল না। কিন্তু শহরে এনে বিদগ্ধ নাগরিক সমাজের সামনে এটির প্রদর্শন হয়েছে বলে বদলে ফেলা হয়েছে প্রকরণ। এর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক সংযোগ তৈরি হয়েছে। সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনে অংশ নিয়েছে লোক-ঐতিহ্য। আজকাল উন্নয়ন ভাবনায় গম্ভীরাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। নাগরিক রুচিতে লোক-আঙ্গিকের এমন পুনর্গঠন অবশ্যই সাংস্কৃতিক সেতু নির্মাণে সাহায্য করছে। 

নিউ মিডিয়ায় সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখছে যাত্রাপালা। তেমনই একটি যাত্রাপালা ‘নছিমন’। স্টুডিওতে ধারণ করে সব শ্রেণির দর্শকের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। (https://www.youtube.com/watch?v=Kb-338xAz0M) অভিনয়ে আনোয়ার হোসেন, টি টি বাহার, আতোর আলি, দলু আরও অনেকে। সংলাপ রচনা করেছেন সৈয়দ আব্দুস সামাদ। পরিচালনা ও প্রয়োজনায় সৈয়দ আব্দুস সামাদ। ইউটিউবে পরিবেশন করেছে বন্ধু প্রোডাক্টস। এই যাত্রার দর্শক অধিকাংশই নাগরিক বিদগ্ধ সমাজ। মন্তব্যগুলো দেখলেই তা সহজে বোঝা যায় যায়, যদিও শ্রেণি বোঝার জন্য ভাষাই একমাত্র নয় । তবে নির্ভুল বানান, বাক্য ও শব্দ প্রয়োগ দেখলে বোঝা যায় শ্রেণিটি শিক্ষিত শ্রেণি। ২ ঘণ্টা ২৮ মিনিটের যাত্রাটি দেখার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ গড়ে উঠছে। কুয়েত প্রবাসী বিল্লাল মিয়া মন্তব্য করেছেন, ‘সব যাত্রার সেরা নসিমন সুন্দরী, আমার যখন মন খারাপ হয়, তখনই আমি নসিমন সুন্দরী যাত্রাটা দেখি। এই কুয়েত প্রবাসী দেশ ছেড়ে দূরে থাকলেও তার মধ্যে যে লোকঐতিহ্যের প্রতি টান রয়েছে তা প্রকাশ পেয়েছে। তেমনই আরেকজন প্রবাসী  সেলিম হোসেন ইরান থেকে দেখে মন্তব্য করেছেন। শুভকামনা জানিয়েছেন। মিঠু ইসলাম বলেছেন,‘আমাদের গ্রামের বাসায় এখনো হয়, খুব মজার।’ এর অর্থ হচ্ছে, তিনি বর্তমানে শহরে থাকেন। হায়দার খান মন্তব্য করেছেন, ‘এই সব যাত্রা পালা দেখলে অতীতের স্মৃতি খুব মনে পড়ে। এখন কোথায় হারিয়ে গেলো এইসব সব যাত্রাপালা। খুব খুব সুন্দর।’ মো. আমির হোসেন রয়েল মন্তব্য করেছেন, ‘১৯ বছর পর দেখলাম, খুব ভালো লাগল।’ মো. আকাশ মন্তব্য করেছেন, ‘আমি কাতার থেকে বলছি। আমার বাড়ি টাঙ্গাইল। অনেক ভালো লাগলো পালাটা।’ মো. সোহেল মন্তব্য করেছেন, ‘ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমিও অভিনয় করতাম। গুনাই বিবি, কমলার বনবাস, সাগর বাদশা, মানিক মালা।’ এসব মন্তব্য প্রমাণ করে লোকসমাজের মানুষও এই মাধ্যমে উপস্থিত। নাগরিক মানুষও উপস্থিত। তাদের যোগাযোগের ফলে সাংস্কৃতিক দূরত্ব অবশ্যই কমছে।

দশ মিনিটের একটি পালাগান প্রকাশ করেছে অ্যারাউন্ড চ্যানেল, গ্রামীণ প্রতিবেশ থেকে পরিবেশনাটি ধারণ করা। (https://www.youtube.com/watch?v=sUCZjeJH2i8) পালাকার বাউল সেলিম। ক্যামেরা ও ভিডিও সম্পাদন করেছে অ্যারাউন্ড টিভি টিম। পরিচালনা করেছেন মো. আরিফুল ইসলাম রানা। পালাটি ১২ লক্ষের বেশি মানুষ দেখেছেন গত এক বছরে (৪ অক্টোবর, ২০১৯ প্রকাশিত) পালাটিতে যাঁরা মন্তব্য করেছেন তা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় নাগরিক মানুষও এটির দর্শক। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই কন্টেন্ট প্রকাশ করা হলেও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ তৈরিতে ভূমিকা রাখছে পালাটি। পালাটি ধর্মীয় বিষয়কে আশ্রয় করে রচিত। এতে পালাকারের ধর্মবোধ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারছে বিদগ্ধ নাগরিক। এই পালাকার মূলত লোকসমাজের প্রতিনিধি। ফলে লোকসমাজের ধর্মীয় ভাবনা সম্পর্কে, লোকায়ত পরিবেশে ধর্ম কতটা উদার, অন্তত লোক-আঙ্গিকে সেসবের স্বরূপই প্রকাশ পেয়েছে পালাটিতে।

নিউ মিডিয়ার লোক ঐতিহ্যের একটি কমেন্টেও লোকঐতিহ্যকে অমার্জিত ও গ্রাম্য বলে কাউকে নাসিকা কুঞ্চন করতে দেখা যায় নি, এই পরিবর্তন অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করার মতো। অধিকাংশই মন্তব্য করেন প্রশংসা করে এবং ইতিবাচক শত শত মন্তব্য থাকে অধিকাংশ কন্টেন্ট-এর মন্তব্যে। শহরের মঞ্চে লোক-ঐতিহ্য বিশেষ করে গম্ভীরা পরিবেশনার সময় সামনের সারিতে বসা নাগরিক মানুষ মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করছে অনুষ্ঠান, কেউ কেউ মুগ্ধ দৃষ্টিতে গম্ভীরার সঙ্গে সংযোগ ঘটাচ্ছে। আবার দুই রুচিবোধ ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণে তৈরি পুনর্গঠিত সংস্কৃতি নিউ মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে লোকসমাজের কারো কারো মন্তব্য চোখে পড়ে। তাদের মন্তব্যও ইতিবাচক এবং তারা বুঝতে পারছে পরিবেশনা, এমন মন্তব্য আমরা দেখেছি। কেউ কেউ অতীতে লোকঐতিহ্যের পরিবেশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেই অনুভূতিও প্রকাশ করেছেন।  এ-কালীন নাগরিক সমাজের বাইরে যে বৃহত্তর লোক-সমাজের অবস্থান, সংস্কৃতির অকৃত্রিমতা, ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জীবন-দর্শন-এসব লোককৃতির সবই বিপুল উদ্দীপনায় আজ নিউ মিডিয়ার অংশ। নিউ মিডিয়া যেন দায়িত্ব নিয়েছে সংস্কৃতি পুনর্গঠনের, যা বিগত কালের জন্য অকল্পনীয় ছিল। ফলে যতীন সরকার তাঁর প্রবন্ধে (সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনে লোকঐতিহ্য, প্রথম প্রকাশ ২০০৭) নিউ মিডিয়া নিয়ে কোনো আলোচনার সুযোগ করে উঠতে পারেন নি। তবে ভার্চুয়ালি সৃষ্ট এই সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন বাস্তব সমাজে কোনো বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায় কিনা তা অনুধাবন করতে আরো সময় প্রয়োজন। এখন পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলমান। পরোক্ষভাবে দর্শক ও দর্শক সাংস্কৃতিক যোগযোগ ঘটে চলছে। মাধ্যমে হিসেবে কাজ করছে নিউ মিডিয়া। কিন্তু বাস্তবে সমাজে একই মাধ্যমের ভূমিকায় অবর্তীর্ণ এক আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, রাজনীতি, ক্ষমতা কাঠামো ইত্যাদি। তাই নিউ মিডিয়ার হাত ধরে নগর ও গ্রামের মানুষের সাংস্কৃতিক দূরত্ব কতটা ঘুচেছে এবং তা বৈপ্লবিক কিনা সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে যেটা দেখতে পারছি, নিউ মিডিয়ার হাত ধরে ধর্মীয় সংস্কৃতির একটা সাম্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে গ্রাম ও শহরের মানুষের কাছে। গ্রাম ও শহর ক্রমেই ধর্মীয় অনুভূতিশীল হয়ে উঠছে সমানভাবে। ধর্মীয় সংস্কৃতির বিকাশের নমুনা এবং গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কৃতির যোগাযোগে দূরত্ব এখন অতি অল্প। এর ফলে ধর্মকে ব্যবহার করা সহজ হচ্ছে কারো কারো দ্বারা, সহজেই এবং মুহূর্তেই ধর্মীয় প্রপাগ্যাণ্ডা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম ও শহরে। এই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে নিঃসন্দেহে নিউ মিডিয়া। অন্যদিকে নিউমিডিয়ায় লোকসংস্কৃতি ও নগর সংস্কৃতির যোগাযোগ কতটা ঘটেছে, দূরত্ব কতটা কমেছে সেটা বোঝা সম্ভব হবে নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে প্রতিবাদী লোকচেতনার সঞ্চার ঘটলে। লোকসংস্কৃতি নগরসংস্কৃতির মধ্যে কতটা রক্ত প্রবাহিত করতে পারবে তার জন্য নাগরিক মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার ও গণচেতনার সত্তায় উপনীত হওয়ার অপেক্ষায় থাকলাম আমরা।     

তথ্যসূত্র:

যতীন সকার (২০১৬), বাংলার লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ, চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা। 
নিউ মিডিয়া 
<https://www.youtube.com/watch?v=6qweG4xJFo0> 
<https://www.youtube.com/watch?v=auAwU_8056Y> 
<https://www.youtube.com/watch?v=Kb-338xAz0M > 
<https://www.youtube.com/watch?v=sUCZjeJH2i8>

পুনশ্চ : প্রবন্ধটি লেখকের ‘নিউ মিডিয়া ও ফোকলোর’ (২০২১) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক ও গবেষক।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন