মুম রহমান।। প্রবন্ধ।। আবুল হাসান ফিরে আসে

0

ছবি: অন্তর্জাল

আজ থেকে ৩০ বছর আগের একটি কবিতার বই হাতে তুলে নিই। বইটির নাম ‘রাজা যায়, রাজা আসে’। কথা সত্য বটে, রাজারা আসে আর যায়, কিন্তু কবি, তেমন কবি অমন চক্রাকারে আসে যায় না। একটু তেতো মনে হলেও বলা যায়, আমাদের বাংলাভাষাতেও অনেক কবি আসে আর যায়। কিন্তু এই আসা-যাওয়ার পথের ধারে রয়ে যায় ক’জন!

আপনি আমি কেউ না, সে বিচার করবে সময়। আমাদের কবি ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার কবিতাখানি…’ – এর সহজতর ব্যাখায় বলতে পারি, অতোবড় যে ঋষি কবি তিনিও প্রত্যাশা রেখেছিলেন, শতবর্ষ পরেও তাঁর কবিতা মনোযোগে পড়া হবে। তাঁর কবিতা যে মুহূমুর্হূ পড়া হয়, আওড়ানো হয় এই উদ্ধৃতিও তার একটি ক্ষুদ্র নিদর্শন। এই উদ্ধৃতিটির আরেকটি দিক আছে বলে মনে করি – ঐ যে লিখলাম সময়ের কথা, সময় প্রমাণ করে কবির টিকে থাকা, মনে হয়, শতবর্ষ সেই সময়ের একটা বড় রকমের মাপকাঠি হতে পারে। শতবর্ষ পরেও যে কবির কবিতা পাঠক কৌতূহল ভরে পড়ে সেই কবিকে কিংবা তাঁর কবিতাকে আমরা কাব্যাসরের একটি মুকুট অন্তত দিতে পারি। শতবর্ষ নয়, ত্রিশবর্ষ পরে আবুল হাসানের রাজা যায়, রাজা আসে পড়তে গিয়ে মনে হয়, আবুল হাসানের মতো কবি যায়ও না, আসেও না; সে রয়ে যায়।

মানুষের হৃদয়ের কাছে খুব গভীর কষ্টের মতোই আবুল হাসান রয়ে যায় নিজস্ব দাপটে। নিজস্ব জন্ম-মৃত্যু এবং জীবনযাপনের চেয়েও বড় হয়ে সে রয়ে যায় মানুষের খুব কাছে। কেননা, সে কেবল আপন সুখ-দুঃখের কোঠরে ঘুরপাক খেয়ে টাল হয়নি কখনো। সে বরং মানুষের হাত ধরে, পাশাপাশি হাঁটতে চেয়েছে আর ভেবেছে পৃথিবীতে হানাহানি বন্ধ হয়ে যাক। তার সোজা-সরল উচ্চারণ –

মানুষ চাঁদে গেল, 
আমি ভালোবাসা পেলুম  
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলো না!  
(জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন) 

মানুষের চাঁদে পৌঁছে যাওয়া যেমন সভ্যতা ও নন্দনের জরুরি মাইলফলক, তেমনি ভালবাসা পাওয়াও আবুল হাসানের ব্যক্তিগত সাফল্য। পেয়ে যাওয়া অনিবার্য ভালবাসা এবং ভালবাসা দিয়েই সে হয়তো সব যুদ্ধ থামাতে চেয়েছিলেন। ধারালো ব্লেডের কাছেও তাই ভালবাসা নিয়ে গাল পেতে দিয়েছিলো আবুল হাসান। আমাদের কাব্য মানচিত্রে এমন ভালবাসা কাঙাল কবি আমরা কমই দেখি। পাঠক, একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন কাব্য জগতের এই রাজা কী অবলীলায় ব্লেডের তীক্ষতায় চুম্বনের ছবি এঁকেছিলো! উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারছি না ! –

 
 বলি তাই এসেছি তোমার কাছে ইস্পাতিনী
 শুশ্রুষায় সবুজ চুম্বনে আজ দগ্ধ কোরে দাও তুমি এ হেন মলিন মুখ,
 সামাজিক ওষ্ঠ আর অন্তরাল -
 সেবিকা, সেবিকা! 
 (ব্লেড) 

দাঁড়ি কাটার ব্লেড শুধু জীবন্তই হয়ে ওঠে না সেবিকা হয়েও ওঠে তার কাছে। এমন বিস্ময়কর চিত্রকল্প শুধু বাংলা কবিতাতেই নয়, বিশ্ব কাব্য মানচিত্রেও দুর্লভ। ব্লেডের তীক্ষ্ম ধার আমাদের মননে সমীহ জাগায়, কখনো সাবধানী হতে বলে। কিন্তু কখনো দাঁড়ি কাটতে গিয়ে মনে হয়নি তো ব্লেডের সবুজ চুম্বন আমাদের গালে মসৃণতার জন্ম দেয়! আবুল হাসানের কবিতা পড়ার পরই আমরা ধারালো ব্লেডের দিকে দরদ ভরে তাকাই।

বড় কবি তো এমনি করেই আমাদের তাকানোর চোখ খুলে দেয়। নিজের দেখার ভিন্নতর জগতটি আমাদের সামনেও তুলে দেয় মহৎ কবি। যেমন, যুগে যুগে কালে কালে মেঘ নিয়ে কতো কবিতাই না লেখা হয়েছে; সেই কালিদাস থেকে জয়দেব বসু তক বহু কবিই মেঘের অর্চনা করেছেন। অথচ কবিতার বহু চর্চিত মেঘকেও আবুল হাসান দেখেন ভিন্ন চোখে –

 প্রকৃতির সব চেয়ে নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারী
           ঐ মেঘ,
 ওরও তো রয়েছে বহু শিল্পকর্ম,
           এবং বাসনা!
 (মেঘেরও রয়েছে কাজ) 

কী বিস্ময়কর তার দেখার চোখ, মেঘ যেন আমাদেরই সহকর্মী কোন নিম্নতম বেতনভুক্ত কর্মচারী! প্রকৃতিকে এতো জীবন্ত করে আমরা তার কবিতাতেই পাই। মেঘের মতো গাছকে জীবন্ত করে রেখেছে আবুল হাসানের কবিতা। গাছের পানে তার মতো করে বাংলা কবিতার প্রান্তরে আর কে তাকিয়েছেন! শহীদ কাদরীকে উৎসর্গ করা ‘গাছগুলো’ কবিতায় তাঁর উচ্চারণ বড়ই স্বকীয় এবং সহজাত –

 
 সজীব গাউন পরা অই গাছগুলো কী রগড় করে যে
           হাওয়ার সাথে প্রতিদিন!
 সবুজ পাতার মুদ্রা তুলে তুলে নাচে, বক্ষোবাস খুলে খুলে নাচে
           নিপুণ নটীর সহোদরা! 

তার মায়াবী দৃষ্টিতে এই গাছেরাই যখন যিশুখ্রীস্ট হয়ে ওঠেন তখন আমাদের কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতায় নতুন পালক সংযোজিত হয়।

 
 বড় মায়া হয় যখোন ওদের দেখি
 কুঠারের ক্রুশে বিদ্ধ মেরীর সন্তান! 

বিংশ শতাব্দীর কাব্য জগতে নৈরাশ্য আর শূণ্যতার প্রবল প্রতাপ লক্ষ্য করে থাকবেন পাঠক। বাংলা কবিতার মানচিত্রে নৈরাশ্য, ব্যর্থতা, বেদনা কখনো কখনো ফ্যাশানের মতোই হুজুগেও হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু আবুল হাসান যে কোন হুজুগের বাইরে। তাই তার কবিতায় প্রচলিত নৈরাজ্য বিস্তার করে না। গাছের জন্য, মেঘের জন্য, ব্লেডের জন্য… সব কিছুর জন্যই তার মমতা ও ভালবাসা অপার। কেবল শূন্যতার জঠরে থেকেও তিনি আশার আলো দেখেন। প্রবল স্বপ্নবাজ আবুল হাসান স্বাধীনতা যুদ্ধের দাবানলে দাঁড়িয়ে ভাই-বোন সবাইকে হারিয়েও নিঃস্ব হয়ে উঠেন না। কেউ না থাকলেও তার চোখে স্বাধীনতা আর পতাকা ভেসে উঠে –

 ছোটো ভাইটিকে আমি কোথাও দেখিনা,
 নরোম নোলক পরা বোনটিকে আজ আর কোথাও দেখিনা!
  
 কেবল পতাকা দেখি, 
 কেবল উৎসব দেখি,
 স্বাধীনতা দেখি। 
 (উচ্চারণগুলি শোকের)

ভালবাসা, স্বাধীনতা, উৎসব, পতাকা নিয়ে আবুল হাসান আমাদের দিকে ক্রমাগত এগুতে থাকে, প্রতিদিন ঘনিষ্টতর হয়। তার বই হাতে নিয়েই মনে পড়ে, হঠাৎ একদিন আমাদেরও বয়স হয়ে গিয়েছিলো, একদিন, আমরাও সংকুচিত হয়ে গিয়েছিলাম নিজেদের কণ্ঠস্বর, আর চোয়ালের গড়ন বদলে যাওয়ায়। তখন কারো কাছে কিছু সুধাতে পারিনি, তখন পাইনি কোন সহমর্মী। মনেপড়ে তখনই হাতে এসেছিলো আবুল হাসান আর আমরা বয়সন্ধির কিশোরেরা নিরাময়ের মতো সঙ্গি হিসাবে এক কিশোরীকে পেয়ে যাই তার কবিতায়।

 
 আমার শরীরে এই অসহবিসহ আলো, বিচ্ছুরণ তেলেসমাতির খেল
 আমার শরীরে এই সোনালী ত্বকের ছটা বুক জোড়া উঁচু শিহরণ!
  
 কোথায় লুকাবো মা? ভয় লাগে, আমার ভীষণ ভয় লাগে!’
 (বয়ঃসন্ধি) 

দ্বিধাহত বয়ঃসন্ধির কিশোর আমি তখন কিশোরীর ভীতিতে হাত বুলিয়েছি, এই অভিজ্ঞতা আমার নিজের। কিশোর হৃদয়ের সমব্যথি হয়ে আবুল হাসানও যেন চির কিশোর হয়ে থাকেন –

 
 কোথায় ঘোরো সারাদুপুর; ক্লান্ত কিশোর কোথায় ঘোরো?
 বুকের মধ্যে কিসের একটা কঠিন দুঃখ রুক্ষ দুপুর শাসন করে,
 কিশোর তুমি তার ভিতরে বসেই থাকো বাড়ী ফেরোনা... বাড়ী ফেরোনা!
 (ক্লান্ত কিশোর তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়) 

আজ গর্বের সঙ্গেই বলতে পারি, আমাদের কৈশোরে আবুল হাসানে মতো বড় বন্ধু আর কেউ ছিলেন না। মেঘ কিংবা গাছের মতো আমাদের দিকেও তার চোখ পড়েছিলো।

শুধু তাকানোর ভিন্ন চোখ আর ভাবনার ভিন্নতা দিয়ে কবিতা হয় না। কবিতার শরীর নির্মাণে শব্দের কারুকাজ ভিত্তি হিসেবেই কাজ করে। সেই বহুখ্যাত উক্তি ‘শুদ্ধতম শব্দই কবিতা’ আর তার আদর্শ উদাহরণও তো পথে-ঘাটে পাওয়া যায় না। আবুল হাসান, এক্ষেত্রেও দুর্লভ কবি, কেননা, শব্দ বিচারে মারাত্মক কুশলী কারিগর তিনি। শব্দকে নিয়ে যখন যেভাবে খুশি ‘জাগলিং’ করেন তিনি সুচারু দক্ষতায়।

 আমার দিকে তাকিয়ে আমি আমাকে শুধালেম
  
 এখন তুমি কোথায় যাবে?
 কোন্ আঘাটায় জল ঘোলাবে?
 কোন্ আগুনের স্পর্শ নেবে
 রক্তে কি প্রব্লেম?
 (একলা বাতাস) 

শব্দ ব্যবহারে আবুল হাসান যেন স্বৈরাচারী রাজা। শব্দের তথাকথিক প্রাচীনতা তিনি মানেন না বলেই, অনায়াসে ‘শুধালাম’ বলতে পারেন, আবার একই কবিতার মধ্যে দুম করে ‘প্রব্লেম’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করেন।

উচ্চারণগুলি শোকের কবিতায় নরম না লিখে তিনি লেখেন ‘নরোম’। নরমকে আরো ‘নরোম’ করে বলা আমরা আবুল হাসানের কাছ থেকেই শিখেছি। শব্দ ব্যবহারের ভিন্নতার মতো বানানের ক্ষেত্রেও তিনি ভীষণ স্বকীয়। এই স্বকীয়তা স্রেফ স্বকীয়তা’র তাগিদে নয়, বরং কবিতার প্রয়োজনেই। তার কবিতা পড়েই আমরা বুঝতে পারি নির্ধারিত কোন বানান রীতিতে কবির চাহিদা পূরণ হয় না। কবিকে তার কবিতার প্রয়োজনেই নতুন বানানের ভিত গড়তে হয়।

এই পর্যন্ত এসে স্বীকার করে নেয়াই ভালো যে, একে একে আবুল হাসানের সবগুলো কবিতা নিয়ে আলোচনার লোভ জাগছে। কিন্তু লেখার সীমিত পরিধির কারণেই সাধ ও সাধ্যের দূরত্ব রয়েই যায়। অতএব, বাধ্য হয়েই চূড়ান্ত মন্তব্যে চলে যাওয়া যাক। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, আবুল হাসান আমাদের ছেড়ে যান না কখনো। ঘরের মানুষের মতোই এদিক ওদিক ঘুরেফিরেই তিনি বারবার ফিরে আসেন। আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই –

 আমি আবার ফিরে এলাম, আমাকে নাও
 ভাঁড়ার ঘরের নুন মরিচ আর মশলাপাতা গেরুয়া ছাই
 আমায় তুমি গ্রহণ করো। 
  
 আমি আবার ফিরে এলাম,
 স্নিগ্ধ কাক, আলাপচারী তালচড়াই
 আমাকে আজ গ্রহণ করো। 
 (প্রত্যাবর্তনের সময়) 

এবং আমি অপেক্ষা করি, সবসময়ই, যে কোন সময়ই তাকে গ্রহণ করার জন্য। ‘রাজা যায় রাজা আসে’ পড়তে বসে অন্যসকল পাঠকের সঙ্গে এই কথাটাই বলতে চাই আমি যে, আবুল হাসান গেলেও, বারবার ফিরে আসে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন