গল্প : মাধবীলতার সুবাস : চৌধুরী নিশাত আনজুম

0

ছবি : শেখ সুজন আলী


দুশ্চিন্তা গ্রাস করে নিয়েছে সবকিছু। কী হচ্ছে, কী হবে এসব ভেবে কোন কূল কিনারা মিলছে না। মাথায় চপচপে তেল দিয়ে চিটচিটে চুলে ছাদে গিয়ে বসল একটা কোনায়। মাথাটাও ধরেছে আজ। আকাশটা খুব ঘোলাটে। মনে হচ্ছে যে কোন সময় আকাশটা কেঁদে উঠবে প্রচণ্ডডভাবে, কেঁদে মনের সব দুঃখ প্রকাশ করেই ছাড়বে। এমন সময় এক কাপ চা খুব প্রয়োজন। এত মাথা ব্যাথার মাঝেও রবীঠাকুরের সেই গানটা বারবার মনে পড়ছে, ‘যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙল ঝড়ে, জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে…’।

এমনই এক মেঘলা দিনে নীলাভের সাথে পরিচয় হয়েছিল সুরঞ্জনার। সময় পেরিয়ে বহুকাল কেটে গেল কিন্তু আজকের এই সময়টা মনে হচ্ছে আবার অতীতের সেই সময়টাকে আগমন জানাচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই মাধবীলতার তীব্র আদুরে ঘ্রাণে এক নিমেষেই মনে হলো মাথা ব্যাথাটা ঠিক হয়ে গেছে। দু বছর হলো মা গাছটা লাগিয়েছে। এরই মধ্যে তরতর করে বেড়ে উঠে ছাদে গিয়ে ঠেকেছে গাছটা। বর্ষার ছোঁয়া পেয়ে সবুজ গাছটা একধরনের গোলাপি আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। দেখলেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। যেন একটা পাহাড়ি কন্যা, যাকে ছুঁয়ে দিলেই লজ্জায় আরো রঙিন হয়ে যাবে। সুরঞ্জনার রুমের দেয়াল বেয়েই উঠে গেছে গাছটা। প্রতিরাতে সুরঞ্জনার হৃদয়টা মাধবীলতার তীব্র ঘ্রাণে উদ্বেল হয়ে ভাসতে থাকে।  মনে হয় কোন ঈশ্বরীয় অস্তিত্বের গন্ধে সবকিছু যেন নেচে নেচে অবনত নিবেদনে মগ্ন হয়ে গিয়েছে।  আজও মনে পড়ে কিছু বছর আগেও এমন বর্ষাদিনে মুঠোফোনে মেসেজের ক্রমশ আহ্বানে এক মূহূর্তের জন্যও নীল ওকে একা থাকতে দিত না। কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব স্বপ্নময় দিনগুলো? কীভাবে মনের মানুষ বাস্তবে দানব হয়ে যেতে পারে তার কথা ভাবতে ভাবতেই ঝড়টা শুরু হয়ে গিয়েছে।


দৌড়ে রুমে এসে পড়ল সুরঞ্জনা। মাধবীলতার গন্ধ তীব্র পাওয়া যাচ্ছে। ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর। নীলাভের বাসা ছেড়ে সে এসেছে দুমাস হলো, এরমধ্যে একবারের জন্যও যাওয়া হয়নি। ঝড় দেখে বারবার মনে পড়ছে কীভাবে আগে ঝড়ে সবাই মিলে একসাথে পাল্লা দিয়ে আম কুড়াত।  এক রাতে সুরঞ্জনা একাই গিয়েছিল আম কুড়াতে। সেইবার খুব ঝড়ে কারও বের হবার জো ছিল না। এই সুযোগে সব আম হাতাবার লোভে মাকে না বলে একাই চলে গিয়েছিল সুরঞ্জনা। জায়গাটা ছিল বাড়ি থেকে একটু দূরে শীববাড়ি। পুরোন জমিদার বাড়ি। বিশাল বিশাল আম গাছের বাগান। এখন এ বাড়িতে কেউ থাকে না। মায়ের কড়া মানা সেখানে যাওয়াই যাবে না। রাতে মা ঘুমায় আর মানুষও কম থাকে সেই ভেবে একাই ঢুকে পড়েছিল দেয়ালের ভাঙ্গা জায়গাটা গলে। ঝড়ের বেগে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিল না ভালোভাবে,  তবু আম বাগানে ঢুকেছিল সে। এ বাড়িতে দিনের বেলাতেও মানুষের আনাগোনা কম, আর দেশ বিভাগের পর শীববাড়ির মানুষ পশ্চিম বাংলায় পাড়ি দিয়েছিল। একবার পাটের মিলের লোকেরা এখানে পাটের কারখানা করতে চেয়েও কী যেন ঝামেলা হয়েছিল, পরে আর তারা আসে নি। এসব ভেবে ভেবে ছোট সুরঞ্জনা পৌঁছে গেল আমবাগানে। খুব আম ধরেছিল সেইবার গাছে। আম কুড়াতে কুড়াতে কখন যে পৌঁছে গিয়েছিল শীববাড়ির ভাঙা মন্দীরের কাছে বুঝতেই পারে নি। হুট করে যখন খেয়াল হলো দেখল একটা লালশাড়ি পরা বৌ সুরঞ্জনাকে ডাকছে। সে ভয় পেয়ে গেল, ভাবল এবার হয়তো আম চুরির অপরাধে মায়ের কাছে মার খেতেই হবে৷ বুকে সাহস নিয়ে কাছে যেতেই আর খুঁজেই পেল না বৌটিকে। যাই হোক, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাহস নিয়ে আবার আম কুড়াবে এমন সময় কিছু একটার আঘাতে মাথাটা প্রচন্ডভাবে ঝিম ধরে গেল, তার পর কী হলো আর মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর যতটুকু মনে পড়ে খোকা আর নয়ন ওকে সকালে খুঁজে শীববাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছিল, সেবার যে কী বকুনি আর মার-ই না খেয়েছিল মায়ের হাতে! এসব ভেবে ভেবে হুট করে মনে হলো ঝড় থেমে গিয়েছে। কিন্তু সেই তীব্র মাধবীলতার গন্ধটা আর নেই। নীল খুব ভালোবাসত ও-কে। একটা মুসলিম মেয়ের হিন্দু ছেলের সাথে বিয়েটা সমাজে এখনো মেনে নেয়া হয় না। সাম্প্রদায়িকতা আর সংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে বের হয়ে কিছু করলে তাকে বাঁকা চোখেই দেখা হয়। অনেক ঝামেলা পেরিয়েই এক হয়েছিল ওরা। ভালোবাসা ছিল কিন্তু হয়তো সম্মানের অভাবটাই সম্পর্কটা শেষ করে দেয়। একটা সময় ভালোবাসাটাও চলে যায়। শুধু থেকে যায় কিছু মেনে নেয়া শারীরিক মানসিক কষ্ট। এইসব ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে বিগত দিনগুলোর ছবিগুলো যেন স্লাইড শো’র টানা প্রদর্শনীর মতো একে একে হানা দিতে লাগল ওর মনে।

সুরঞ্জনা ভাবেই নি নীল কখনও ওকে মারতে পারে। আপন মানুষের কাছ থেকে পাওয়া কিছু কষ্ট ভুলে গেলেও তার দাগ কখনই মুছে ফেলা যায় না। সেই রাতে যখন মাতাল হয়ে সুরঞ্জনাকে মেরে যাচ্ছিল নীলাভ তখন কী যেন একটা শক্তি ওর মধ্যে ভর করেছিল, অসীম একটা শক্তি আর মনোবল, যা কখনই ছিল না সুরঞ্জনার, তা যেন সয়ংক্রিয়ভাবে সঞ্চয় হয়ে গিয়েছিল। টেবিলের উপর রাখা কেচিটা দিয়ে অনবরত আঘাত করে করে নীলাভের মুখটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল সে। কিন্তু এ ব্যপারে কখনই সুরঞ্জনার কষ্ট হয় না, অপরাধবোধ পীড়ন করে না তাকে। তার শুধু মনে পড়ে তাদের ভালোবাসাময় সেইসব দিনগুলোর কথা। লুকিয়ে লুকিয়ে শক্ত করে হাতটা ধরার কথা। নীলাভের কাঁধে মাথা রেখে সব সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবার কথা। ওর সেই গন্ধটার কথা। সেই গন্ধটা এখনও সারাগায়ে মাখতে ইচ্ছা করে সুরঞ্জনার। যেই রাতে নীলাভের মৃত্যু হয় তার পর এক সপ্তাহ সুরঞ্জনা অজ্ঞান ছিল। এরপর কিছুই ভালোভাবে মনে করতে পারত না ও। সে রাতেও কিন্তু আজকের মতো একটা জিনিস একইরকম ছিল। তা হলো এই গন্ধটা। মাধবীলতার গন্ধ। কী যেন একটা মাতাল করা গন্ধ। দেবীর আবির্ভাবের আভাস।


মা ডাকছে। কাল কোর্টে যেতে হবে। শেষ শুনানির দিন। এসব নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই সুরঞ্জনার। মনে হয় যেন একটু আগেও নীলাভ তার পাশেই ছিল। ওর কাঁধে মাথা রেখে শক্ত করে হাতটা ধরে ট্রেনের কোন কামরায় বসে থাকতে ইচ্ছা করছে।  ভাবছে কিছুদিন পর এই সমস্যা সমাধান হলেই ও আর নীলাভ ট্রেনে করে সীতাকুণ্ড যাবে। ওর পাহাড় দেখার খুব শখ, সুরঞ্জনা আবার সমুদ্র ভালোবাসে…

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ ।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন