প্রবন্ধ : বুলবুল; প্রকৃতি ও অতিপ্রকৃতির গল্প : ছালমা জান্নাত ঊর্মি

0

অলংকরণঃ ফারিনা আহমেদ

নারীকে যদি প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করা হয়, বোধহয় ভুল হবে না। প্রকৃতি যেমন প্রতিনিয়ত সৃষ্টিশীল- নতুন নতুন রূপে পৃথিবীকে সাজিয়ে-গুছিয়ে-বাঁচিয়ে রাখার উপাদান যুগিয়ে চলেছে, প্রাণসম্পদে পরিপূর্ণ জীবকুলের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রয়োজন পূরণ থেকে রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত এবং প্রয়োজনে সবকিছুর বিনাশেও অদ্বিতীয়, নারীও তেমনই। শুরু থেকে আজ অবধি নারীর ইতিহাস-গল্প-আলোচনা জড়িয়ে আছে সৃষ্টি-জন্ম-সংরক্ষণ ও ধ্বংসের সঙ্গে। প্রাণ-ধারণে যেমন নারীই এক ও অদ্বিতীয় অবলম্বন, তেমনি জীবনের বিকাশ থেকে বিপর্যয় পর্যন্ত প্রতিবার নারীকেই বিভিন্নরূপে অভিহিত ও অভিযুক্ত করা হয়েছে। স্রষ্টা-সৃষ্টি-বিনাশক যে রূপেই পরিচিত হোক, নারী ও তার ভূমিকা নিয়েই জীবন, ইতিহাস, সাহিত্য কিংবা বিনোদনক্ষেত্র আজ সমৃদ্ধ। আধিপত্যশীল পুরুষ-সমাজের শক্তি ও ক্ষমতার প্রদর্শন টিকিয়ে রাখার অন্যতম ক্রীড়াভূমিও তাই নারী। সহজ-সরল-স্বস্তিদায়ক-প্রাকৃতিক রূপ থেকে নারীর জটিল-কুটিল-অস্বস্তিদায়ক-অতিপ্রাকৃতিক রূপে পরির্বতন বা বিবর্তনে পুরুষের ভূমিকা বরাবরই অনস্বীকার্য। যদিও পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর সূক্ষ্ম পর্দার আড়ালে এই ভূমিকা ঢাকা পড়ে যায় প্রতিবার, বারবার।

আজ কথা বলবো সম্প্রতি ওয়েব প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র বুলবুল-এ নারীর প্রাকৃতিক জীবন থেকে অতিপ্রাকৃতিক জীবনের রূপান্তর প্রসঙ্গে। আনভিতা দত্তের পরিচালনা এবং আনুস্কা শর্মা ও কার্নেশ শর্মার প্রযোজনায় নির্মিত ৯৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রে আমরা দেখি শিশু বুলবুল থেকে পর্যায়ক্রমে একজন নারী ও পরবর্তীতে তার ডাইনি ও দেবী হয়ে ওঠার গল্প। বুলবুলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তৃপ্তি দিমরি। বড়ঠাকুর ইন্দ্রনীল ও মেজদেবর মহেন্দ্রের চরিত্রে দ্বৈত ভূমিকায় রাহুল বোস, বিনোদিনীর চরিত্রে পাওলি দাম, ছোট দেবর সত্যর চরিত্রে অবিনাশ তিওয়ারি এবং ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।

চলচ্চিত্রের গল্প ১৮৮১ সালের বাঙ্গালী জীবনধারার। আমের বাগানে, গাছের ডালে, নুপূর পরে ঘুরে-বেড়ানো পিসীমার কাছে বেড়ে ওঠা ছোট্ট বুলবুলের বিয়ে হয় জমিদার বাড়ির বড় ছেলে ইন্দ্রনীলের সঙ্গে। বয়সে অনেক বড় স্বামীর পাশাপাশি বুলবুলের জীবনে নতুন সম্পর্কের তালিকায় যুক্ত হয়, মানসিক ভারসাম্যহীন মেজ দেবর মহেন্দ্র, তার স্ত্রী বিনোদিনী ও ছোট দেবর সত্য। বিয়ে বাড়িতে সমবয়সী দেবর সত্যর অবাধ বিচরণ ও সরল বাক্যবিনিময়ে বুলবুল তাকেই নিজের হবু বর ভেবে নেয়। শ্বশুড়বাড়ির পথে যাত্রারত পালকিতে ঘুম ভেঙ্গে পিসীমা কোথায় প্রশ্ন করায়, সম্পর্কে ছোটো কিন্তু বয়সে বড় ভাবীর কাছে হাত-পাখার বাড়ি খেয়ে চুপ হয়ে যায় ভীত বুলবুল। গা-ছমছম রাতের আঁধারে পালকির জানালার পাশে বসে বুলবুলকে ডাইনির গল্প শোনায় সত্য। শ্বশুড়বাড়িতে বাসর-ঘরে ঘুম চোখে জেগে বসে থাকা বুলবুলের কাছে স্বামী ইন্দ্রনীল উপস্থিত হলে বুলবুল জানতে চায়, যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, যে তারই বয়সী সে কোথায়। জমিদার বাড়ির বড় ঠাকুর-ইন্দ্রনীল জানায় বড় হলে বুলবুল বুঝতে পারবে স্বামী ও দেবরের মধ্যে পার্থক্য ।

খেলতে খেলতে বড় হয়ে ওঠে বুলবুল ও সত্য দুজনই। খেলার সঙ্গী থেকে মনের সঙ্গী হয়ে ওঠে একে-অপরের। মেজ জা বিনোদিনী সত্যর বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে বড় ঠাকুরকে ইঙ্গিত দিতে চায় বুলবুল ও সত্যর সম্পর্কের। সন্দিগ্ধ  ইন্দ্রনীল সত্যকে ওকালতি পড়ার জন্য দ্রুত লন্ডন পাঠিয়ে দেয়। শোক-বিহ্বল বুলবুলের প্রতি স্বামী ইন্দ্রনীলের বিরূপ হতে থাকা মানসিকতার আগুনে আবারও ঘি ঢালে বিনোদিনী। নিয়ন্ত্রন হারায় ইন্দ্রনীল। অনেক আদর-যত্নে বড় করা বুলবুলের পায়ে শাস্তি হিসেবে নৃশংসভাবে বারবার আঘাত করে লোহার শিক দিয়ে। ডাক্তার আসে। আত্মদহনের যন্ত্রনা নিয়ে ভোরবেলা বাড়ি ছাড়ে ইন্দ্রনীল। বিনোদিনীকে আশ্বস্ত করে যায়- মাসিক খরচ আসতে থাকবে। 

ডাক্তারের চিকিৎসা চলতে থাকে। মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রনায় আচ্ছন্ন-অবচেতন বুলবলের অসহায়ত্ত্বের সুযোগ নেয় এবার মানসিক ভারসাম্যহীন মেজ দেবর মহেন্দ্র। ধর্ষণের সময় মারা যায় বুলবুল। আবারও রক্তাক্ত হয়ে ওঠে বুলবুলের শরীর-মন-আত্মা। কিন্তু একই পরিবারের তিনপুরুষ ছোট দেবর সত্য, স্বামী ইন্দ্রনীল ও মেজ দেবর মহেন্দ্রর দূর্বলতা, নির্মমতা ও নিপীড়নের মধ্যে দিয়েই শেষ হয় না বুলবুলের ভালোবাসার-শ্রদ্ধার-নির্ভরতার ইতিহাস। অসীম আর্তনাদের মধ্য দিয়ে জন্ম ঘটে নতুন বুলবুলের। এবার দেবী প্রবেশ করে বুলবুলের শরীরে। এই বুলবুল সাহসী, আত্ম-নির্ভর, শক্তিশালী এবং অপরাধীকে শাস্তি দিতে সক্ষম।

ডাক্তার সুদীপের চিকিৎসায় বুলবুল অবারও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করে। নিপীড়নের পর এবার চলচ্চিত্রের কাহিনী আবর্তিত হয় শাস্তির পরিক্রমায়। পূজার রাতে মারা যায় মেজ দেবর মহেন্দ্র। ঘাড়ে কামড়ে তাকে হত্যা করে সবার মুখে মুখে আলোচিত এক ডাইনি যাকে কেউ কখনো দেখেনি। যে উল্টো পায়ে হাঁটে। সে রক্তের জন্য পিপাসার্ত। হাঁটু ছাড়িয়ে গেছে যার এলোচুল- যেমনটা শ্বশুড়বাড়ির পথে বুলবুলকে শুনিয়েছিল সত্য। শাস্তি পায় মাস্টার দীনকার- যে তার স্ত্রীকে পিটিয়ে হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। গ্রামের ছোট একটি মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করার সময় খুন হয় এক ব্যক্তি । ছোট মেয়েটি জানায় কালী-মা ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে ঘাড়ে কামড়ে।

ইতিমধ্যে লন্ডন থেকে সত্য গ্রামে ফিরে এসেছে মেজ ভাই মহেন্দ্রের মৃত্যুবার্ষিকীর পূজার উদ্দেশ্যে। ভীরু-দূর্বল-অসহায় প্রেমিকা বুলবুলের পরিবর্তে সত্য দেখতে পায় সাহসী-শক্তিশালী-অত্মনির্ভর এক নারীকে। যাকে সত্য ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। বড়ভাই ইন্দ্রনীলের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর সমস্ত দায়িত্ব এখন বুলবুলের হাতে। ডাক্তার সুদীপের সঙ্গে বুলবুলের বন্ধুত্বপূর্ণ মেলামেশা সত্যকে সন্দেহপ্রবণ করে তোলে। মেজবউ বিধবা বিনোদিনীকে বাহিরবাড়ি থেকে জমিদার বাড়িতে ফিরিয়ে আনে সত্য মূলত বুলবুলের উপর নজরদারি ও ডাক্তার-বুলবুলের সম্পর্ককে বোঝার জন্য। এক রাতে ডাক্তারের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বুলবুলকে ধূমপান করতে দেখে সত্য। বুলবুলের প্রতি আরও বিতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে সে। বুলবুলকে তার বাবার বাসায় পাঠিয়ে দিতে চায়। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয় ডাক্তারকে বিচারের উদ্দেশ্যে শহরে নিয়ে যাওয়ার।

প্রায় প্রতিটি হত্যাকান্ডের কাছাকাছি ডাক্তারের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারায় সত্য তাকেই মৃত্যুগুলোর জন্য দায়ী মনে করে। ডাইনি বা অশরীরী কোনো শক্তিতে বিশ্বাস নেই তার। ডাক্তারকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বনের পথে শহরে রওনা হয় সত্য। জমিদার বাড়ির এই গাড়োয়ান দ্বিতীয় স্ত্রীর প্ররোচণায় প্রথম স্ত্রীকে ঘরছাড়া করেছিল। লজ্জায়-অপমানে-দুঃখে পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করে প্রথম স্ত্রী। এ অপরাধের শাস্তি দিতে জনমুখে প্রচলিত ডাইনি কিংবা ছোট মেয়েটিকে রক্ষাকারী দেবী উপস্থিত হয় সত্য ও সুদীপকে নিয়ে রওনা হওয়া গাড়ির গাড়োয়ানের সামনে। ঘাড়ে কামড়ে হত্যা করা হয় তাকেও। সত্য একঝলক ডাইনিকে দেখার সুযোগ পায়। নিশ্চিত হয়, সুদীপ নিরপরাধ। ডাইনিকে হত্যা করার জন্য সত্য পুরো বনে আগুন লাগিয়ে দেয়। সুদীপ এসময় বুলবুলকে দেখতে পায় হাঁটুঅবধি লম্বা চুল, মাথায় লাল টিপ, মুখে রক্ত নিয়ে উল্টো পায়ে গাছের ডাল দাঁড়িয়ে থাকতে। সুদীপের মনে পড়ে প্রচন্ড আঘাত পাওয়ার কারণে পা ঠিক হওয়ার পরও বুলবুলের পায়ের গোড়ালি প্রায়ই ঘুরে যায় এবং পা উল্টো দিকে রেখেও বুলবুল হাঁটতে পারে। সুদীপের কাছে বুলবুল হয়ে ওঠে এক দেবী যে অন্যায়ের বিপরীতে ন্যায়বিচার নিয়ে প্রতিবার উপস্থিত হয়। সত্যকে থামানোর চেষ্টা করে সুদীপ। ব্যর্থ হয়। কিন্তু সত্য একসময় উপলব্ধি করে তার ভালোবাসা বুলবুলই সকলের কাছে ডাইনি হিসেবে অভিহিত। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পুরো বন পুড়ে শেষ।

জমিদার বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়। বহুদিন পর ইন্দ্রনীল ফিরে আসে বাড়িতে। রাতে শোবার ঘরে শুয়ে সে শুনতে পায়, বুলবুলের পরিচিত কন্ঠের ডাক- ঠাকুরমশাই। ঘাড় ফিরিয়ে জমিদার বাড়ির বড়ঠাকুর দেখতে পায় অলৌকিক আলো থেকে বুলবুলের শরীর বের হয়ে আসছে। চলচ্চিত্র শেষ হয়, কিন্তু দর্শক বুঝে নেয় বুলবুল সে নারী হোক কিংবা ডাইনি কিংবা দেবী, তার শেষ প্রতিশোধ কিংবা তার সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের শাস্তি দিতে সে বারবার ফিরে আসবে। ফিরে আসে।

চলচ্চিত্রের কাহিনী শেষ হয়, তবুও থেকে যায় বুলবুলের আবহ। চলচ্চিত্রের প্রথমভাগ জুড়ে যে বুলবুলকে দর্শক দেখতে পায় শিশুসুলভ খেলায়, বাগানে সত্যর সঙ্গে চঞ্চল-আনন্দে, ধীরে ধীরে পরিণত বয়সের বুলবুল-সত্য একসঙ্গে উপন্যাস লেখে, পুকুরপাড়ে গল্প করে, যে বুলবুল সত্যকে ছেড়ে থাকার ভাবনাতেও ভীত হয়ে ওঠে যখন জানতে পারে সত্যকে লন্ডন পাঠানো হবে, সত্যর বিয়ের আলোচনায় ব্যথিত হয়। সেই একই বুলবুল হুট করে সত্যর লন্ডন চলে যাওয়ার আকস্মিকতায় প্রথমে বিহ্বল তারপর ব্যাথাতুর হওয়া থেকে শুরু করে স্বামীর কাছে নির্যাতিত, দেবরের কাছে ধর্ষিত ও মৃত্যুবরণ করার পর নতুনভাবে দেবীশক্তিতে প্রাণ পেয়ে, দেবরের স্ত্রীর কাছে মুখবন্ধ রাখার চাপ নিয়ে আবিষ্কার করে জীবনের এক নতুন শক্তিকে। চলচ্চিত্রের শুরুতে সরলতার আবরণে মোড়া যে স্বচ্ছ বুলবুলকে দর্শক দেখতে পায়, সেই বুলবল এক অসীম শক্তির প্রতিনিধি নারী হিসেবে চলচ্চিত্রের সমাপ্তি টানে। যে অসীম শক্তি কখনো ব্যাখ্যায় আসে না। সাধারণ বোধের বাহিরে যেয়ে নারীর এই শক্তিকে বিচার করতে হয়েছে কাহিনীর চরিত্রের পাশাপাশি দর্শকদেরও। কখনও ডাইনি, কখনও দেবী-নামের অতিপ্রাকৃতিক উপাধিতে অভিষিক্ত হয়েছে নারীর এই শক্তি। নারীর দূর্বল-সরল রূপ আমাদের বোধগম্য হয়, কিন্তু নারীর শক্তি আমাদের বোধে আসে না। তাই শক্তির সঙ্গে, ক্ষমতার সঙ্গে, শাস্তির সঙ্গে নারীকে যুক্ত করতে হলে তার প্রকৃত-স্বাভাবিক রূপ থেকে সরে যেয়ে, অতিপ্রাকৃতিক-অস্বাভাবিক রূপের আশ্রয়ে তাকে সাজাতে হয়েছে স্বয়ং চলচ্চিত্র পরিচালককেও। এই বাস্তবতার সৃষ্টি ও ব্যাখ্যা নিয়েই আজকের আলোচনা।

শিশু বুলবুল থেকে নারী, ডাইনি ও দেবী হয়ে ওঠার পরিক্রমায় চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে ইন্দ্রনীল, মহেন্দ্র, সত্য, সুদীপ ও বিনোদিনী। পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামো ও শক্তির প্রতিভূ হিসেবে উপস্থাপিত জমিদার বাড়ির তিন পুত্র। বয়সে ছোট-বড় কিংবা মানসিক সুস্থতা-অসুস্থতা তাদের ক্ষমতা ও শক্তির ব্যবহারকে কোনোভাবে প্রভাবিত করে না। বরং তারা পুরুষ, তারা জমিদার। সুতরাং তাদের ভাষায়, তাদের কাজে, তাদের আচরণে খুবই স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলে আধিপত্যশীল ক্ষমতার প্রকাশ। বিয়ের আগ-মুহুর্তে ছোট্ট বুলবুলকে যখন মুখে ময়লা, হাতে আম, খোপা খুলে বের হওয়া অগোছালো চুল ও শাড়ির আবরণে সত্য প্রথমবার আবিষ্কার করে, সেসময় সত্যর প্রথম কথা ছিলো- ‘থোরি ম্যায়লি হে, পার কাম চালা লেঙ্গে’। অর্থাৎ একটু ময়লা বা নোংরা হলেও শিশু জমিদার সত্য জানায় বুলবুলকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। বুলবুল প্রতিবাদ হিসেবে সত্যকে মৃদু ধাক্কা দিলে, পিসীমা সত্যকেই সমর্থন করে।

পালকি চড়ে শ্বশুড়বাড়ি যাওয়া থেকে শুরু করে পুরো শৈশব জুড়ে সত্যর বর্ণনায় ঘাড়ে কামড়ে রক্ত-চুষে খাওয়া ডাইনির গল্প শুনতে শুনতে বড় হয় বাড়ির বড়বউ বুলবুল। বুলবুলের কাছে যখন বিনোদিনী জানতে চায় সত্যর জন্য বউ নিয়ে আসবে কিনা, ইন্দ্রনীল বিরক্ত হয়। সত্যকে বিয়ের কথা বলে বুলবুল। সত্য হেসে উড়িয়ে দেয়। জানায় বিয়ে করবে না। বুলবুল আশ্বস্ত হয়। কিন্তু সত্যকে যখন লন্ডনে ওকালতি পড়তে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ইন্দ্রনীল, তখন সত্য খুশিমনেই সম্মত হয়। সত্যর কাছ থেকে দূরে থাকার যে ব্যাথা বুলবুলের চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে উপস্থিত হয়, সে ব্যাথা সত্যর আচরণে ধরা দেয় না। লন্ডন থেকে ফিরে এসে নতুন বুলবুলকে দেখে স্বস্তিবোধ করে না সত্য। বড় ও মেজঠাকুরের অবর্তমানে বুলবুলের দায়িত্ব, পর্দা, নিরাপত্তা, আচরণ ও কাজের সীমানির্ধারণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সত্য। এবং বুলবুলকে ভুল বুঝে চরিত্রহীন মনে করে, শাস্তি হিসেবে তাকে বাবার বাড়িতেও পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। যে বুলবুলকে রেখে লন্ডন যেতে কষ্ট হয়নি, সেই একই বুলবুলের মুখে ডাক্তার সুদীপের নাম বারবার শুনে সত্য কষ্টে কাতর হয়ে ওঠে। বুলবুলের কাছে সত্য জানতে চায়- যে অল্পবয়সী বড় বউকে রেখে সে লন্ডন গিয়েছিল, সে কোথায় হারিয়ে গেছে। বুলবুলকে আগের মতো সেই ভীতু-দূর্বল-অসহায় হিসেবেই খুঁজে পেতে চায় সে। জমিদার বাড়ির গাড়োয়ান দ্বিতীয় বিয়ে করায়, বুলবুল যখন দুইস্ত্রীসহ গাড়োয়ানের বক্তব্য শুনে বিচার করছিল, সেসময় সত্য উপস্থিত হয়ে বুলবুলকে বলে- ঠাকুর ঠাকুর খেলছো ভাবি। ডাক্তার সুদীপের সঙ্গে বুলবুলের বন্ধুত্বকে মেনে নিতে পারে না সত্য। মেনে নিতে পারে না বুলবুলের স্বাধীনচারী মনোভাব ও আচরণ। নজরদারীর জন্য তাই বিধবা বিনোদিনীকে জমিদার বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। ডাক্তার সুদীপকে শাস্তি দিতে তৎপর হয়ে ওঠে। মাস্টার দীনকারসহ অন্য হত্যাকান্ডের জন্য সুদীপকে দায়ী মনে করে। চলচ্চিত্রের শেষ হতে হতে বড়ভাইকে লেখা সত্যর চিঠিতে কয়েক মুহূর্তের জন্য বুলবুল নয়, বরং নিজের ভুল ও অন্যায়ের উপলব্ধিরত সত্যকে পাওয়া যায়। 

মানসিক ভারসাম্যহীন মেজঠাকুর মহেন্দ্র। বুলবুলকে বিয়ের দিন থেকেই হাতে ধরে থাকা কাপড়ের পুতুলের সঙ্গে তুলনা করে বলে গুড়িয়া- অর্থাৎ ছোট পুতুল। বোধবুদ্ধিতে দূর্বল মহেন্দ্র বিয়ের দিন থেকেই ছোট্ট গুড়িয়ার প্রতি আকৃষ্ট। হাতের পুতুলটির মতো বুলবুলের সঙ্গেও খেলতে চায় সে। বাসরঘরে ইন্দ্রনীলের আগেই মহেন্দ্র প্রবেশ করে এবং বুলবুলকে পুতুল হিসেবে সম্বোধন করার পর ধুতির ফিতা খুলতে উদ্যত হয়। ইন্দ্রনীলের ডাকে মহেন্দ্র থেমে যায়। বিনোদিনীকে ডেকে স্বামীর খেয়াল রাখার বিষয়ে সতর্ক করে ইন্দ্রনীল। বুলবুল বড় হওয়ার পরেও মহেন্দ্র খেলতে চায় তার সঙ্গে। এই খেলার সুযোগ মহেন্দ্র প্রথমবারের মতো পায় যখন স্বামীর প্রচন্ড আঘাতে প্রায় জ্ঞানহীন বুলবুল লাশের মতো বিছানায় পড়ে আছে। ব্যান্ডেজ জড়ানো দু-পা দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা। গভীর রাতে মহেন্দ্র হাতের পুতুল নিয়ে উপস্থিত হয় বুলবুলের বিছানার পাশে। ক্ষতবিক্ষত পা-দুটো ঝুলিয়ে রাখা দড়ি ধরে বারাবার বুলবুলকে খেলার জন্য আহ্বান জানায়। ব্যাথায় কাতর বুলবুলের পা-দুটো রক্তাক্ত হতে হতেই মহেন্দ্র প্রবেশ করতে চায় গুড়িয়ার শরীরে। মুখ চেপে ধরে ধর্ষণ করে বাড়ির বড়বউকে। ব্যাথা-যন্ত্রনায় মারা যায় বুলবুল। খেলা শেষ হলে মহেন্দ্র বারবার জেগে উঠতে বলে বুলবুলকে। মহেন্দ্র বুলবুলের ঘর ছেড়ে পালিয়ে নিজের ঘরে ফিরতে যায় দ্রুত। অদ্ভুত বিষয় মানসিক বোধ-বুদ্ধির দূর্বলতা সত্ত্বেও একজন পুরুষের যৌনকামনা দমিত হয় না। শিশু বুলবুল থেকে বড়বউ বুলবুলের সঙ্গে দীর্ঘ বিশ বছর সম্পর্কের সময়কালে এই একই খেলার আগ্রহ নিজের ভিতরে লালন করে চলেছে মহেন্দ্র। সুযোগের অভাবে যে খেলা কখনো খেলতে পারেনি সে। বুলবুলকে ঘিরে ইন্দ্রনীল-বিনোদিনীর নিরাপত্তা-বলয়ে দমিত থাকতে হয়েছে মহেন্দ্রকে। মানসিকবুদ্ধির ঘাটতি সত্ত্বেও যৌনবোধের ঘাটতি ঘটে না সমাজের কোনো মহেন্দ্রের। মহেন্দ্ররা যেকোনো সময় ও পরিস্থিতিতেই বুলবুলদের সঙ্গে খেলতে পছন্দ করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই খেলার না হয় বিচার, না হয় এ খেলা নিরুৎসাহিত। তাই সমাজের সকল নারীর বিশেষত দরিদ্র বা বয়স্ক বা শ্যামবর্ণের নারীর বিয়ের জন্য পাত্র না মিললেও, পাগল, বুদ্ধিহীন, পঙ্গু, বৃদ্ধ, বেকার পুরুষের কখনো পাত্রীর অভাব ঘটে না। 

বুলবুলের স্বামী ইন্দ্রনীল। চলচ্চিত্রের শুরু থেকেই বুলবুলকে আদরে-আগলে রাখতে দেখা যায় ইন্দ্রনীলকে। বাসরঘরে মহেন্দ্রর উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেও, বুলবুলের কাছে মহেন্দ্রকে শিশু হিসেবেই উল্লেখ করে ইন্দ্রনীল। আমবাগানে বসে বুলবুলকে সুগন্ধী আতর আর কাঁচা আম উপহার দেওয়ার কথা বলে। নিজের হাতে পান খাইয়ে দেয় স্ত্রীকে। বিনোদিনীর ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় ছোট ভাই সত্যর সঙ্গে স্ত্রীর পরিণত বয়সের বন্ধুত্ত্ব ও প্রেম সম্পর্কে সচেতন হয় ইন্দ্রনীল এবং কোনোটাই মেনে নিতে পারেনা। ভুলে যায় এই বন্ধুত্ত্ব ও প্রেম কোনোটাই হঠাৎ হয়নি। শৈশবের খেলার সঙ্গীর সঙ্গে মানসিক ঘনিষ্ঠতার পরিণত রূপে ক্ষুব্ধ ইন্দ্রনীল সত্যকে শুধু লন্ডনে পাঠিয়েই শান্ত হতে পারেনা। আঘাতে আঘাতে একরকম পঙ্গু করে দেয় স্ত্রীকে। কৌশলে সব কাজ সম্পন্ন করার ক্ষমতসম্পন্ন ইন্দ্রনীলকে আপাত-বুদ্ধিমান মনে হলেও বিনোদিনীর প্ররোচণায় ঠিকই প্রভাবিত দেখা যায় তাকে। বিনোদিনীর সঙ্গে দৈহিকসম্পর্কেও যুক্ত হয় ইন্দ্রনীল। যৌনতা, ক্ষমতা, শক্তি-সবকিছুর সমন্বয়ে ইন্দ্রনীল মূলধারার পুরুষতন্ত্রকে পরিবেশন করে অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে। যে প্রেমকে অপরাধ বিবেচনা করে বুলবুলকে শাস্তি দিয়েছে, সেই একই অপরাধে ছোট ভাই সত্যকে শাস্তি দিতে পারেনি ইন্দ্রনীল। দিতে চায়ওনি। বাড়ি ছেড়ে যাবার সময়ও ক্ষমতার প্রকাশ রেখে যায় তার শেষ কথায়। মাসের খরচ সময়মতো পেতে থাকবে বিনোদিনীরা। ডাক্তারকে ভালোমানের বকশিস দিয়ে বুলবুলের দূর্ঘটনা গোপনের ইঙ্গিতও পাওয়া যায় ইন্দ্রনীলের কন্ঠে।

ইন্দ্রনীল, মহেন্দ্র, সত্যর বাহিরে কিছুটা ভিন্নধারার উপস্থাপন নিয়ে হাজির হয় ডাক্তার সুদীপের চরিত্র। সুদীপ বুলবুলের চিকিৎসা করতে যেয়ে বুঝতে পারে সিঁড়ি থেকে পড়ে এমন আহত হয়নি বুলবুল। টের পেয়ে যায় বুলবুল ধর্ষিত হয়েছে। রোগী-ডাক্তারের সম্পর্কের আশ্বাস দিয়ে জানতে চায় কে বুলবুলকে আবারও আহত করেছে। বুলবুলের সঙ্গে বন্ধুত্ত্বের সম্পর্কে যুক্ত হলেও, বুলবুলের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তাকে বড়বউ বলেই সম্বোধন করেছে। হিংসার বশবর্তী হয়ে সত্য ঠাকুর তাকে বিনা অপরাধে বিচারের জন্য শহর নিয়ে যেতে চেয়েছে। সেখানেও প্রতিবাদ করেনি। তবে যে মুহুর্তে সুদীপ বুঝতে পারে হত্যাকান্ডগুলো বুলবুলের ঘটানো, বুলবুল তার কাছে এক দেবী হিসেবে আবির্ভূত হয়। বনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সময় সত্যকে ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে সুদীপ। সুদীপের বাধায় বিরক্ত সত্য জানতে চায় ডাইনির সঙ্গে সুদীপের কী সম্পর্ক। সুদীপ বলে, বন্ধুত্ত্বের সম্পর্ক। ডাইনি নয় তাকে দেবী বলে উল্লেখ করে সুদীপ। চলচ্চিত্রে একমাত্র পুরুষ হিসেবে সুদীপের কথা-আচরণ-ভাষায় বুলবুলের প্রতি, নারীর প্রতি সম্মানবোধের প্রকাশ ঘটে। নারীর সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রাগুলো মমত্ববোধের সঙ্গে উপস্থাপিত হয় সুদীপ চরিত্রে।

মহেন্দ্র ঠাকুরের স্ত্রী বিনোদিনী। সধবা বিনোদিনী ছোট্ট বুলবুলকে কখনও হাত-পাখার বাড়িতে শাসন, কখনও অবজ্ঞা করার চেষ্টা করেছে। বাবার বাড়ি থেকে আনা সীমিত গহনার খোঁচা দিয়ে বুলবুলকে অপমান করার চেষ্টা করেছে। বুলবুলের প্রতি ইন্দ্রনীলের ভালোবাসাকে সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। বিরক্ত হয়েছে। বিষাক্রান্ত হয়েছে। ইন্দ্রনীলকে বুলবুলের বিপরীতে ক্রোধান্বিত করার চেষ্টায় থেকেছে। বুলবুলের প্রতি নেমে আসা ইন্দ্রনীলের  চরম আঘাতের পেছনেও ইন্ধন জুগিয়েছে বিনোদিনী। ইন্দ্রনীল পর্ব শেষ হওয়ার পর মহেন্দ্রের অপকর্ম বুঝতে পেরে স্বামীকে বাঁচানোর জন্য বুলবুলকে বারবার চুপ থাকতে বলেছে। ধর্ষণের পর আহত বুলবুলকে পরিষ্কার করার সময় বিনোদিনীর বলা কথাগুলো নারীর প্রতি সমাজের এমনকি খোদ নারীর দৃষ্টিভঙ্গিকে অত্যন্ত অমানবিকভাবে প্রকাশ করে, যা মূলত সমাজের আধিপত্যশীল শ্রেণি দ্বারাই প্রোথিত- এক চরমবোধর জন্ম দেয়। বিনোদিনী বলে- ‘জমিদার বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, কীসের কান্নাকাটি, চুপ থেকো। কিছুটা পাগল কিন্তু, বিয়ের পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিছুটা পাগল, কিন্তু জমিদারও তো। চুপ থেকো। একটু পাগল, কিন্তু গহনা পাবে। একটু পাগল কিন্তু, রেশমের কাপড় পাবে। সম্মান পাবে। চুপ থেকো। একটু পাগল, কিন্তু ওর কাছ থেকে না হোক, ওর ভাইয়ের কাছ থেকে সব পাবে। চুপ থেকো। বড় প্রাসাদে বড় গোপন বিষয় থাকে। চুপ থেকো।’ বিনোদিনীর কথাগুলো শুধু বুলবুলকে চুপ রাখা বা সান্ত্বনার জন্য ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে এই প্রলোভনগুলোর ছলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র মহেন্দ্রদের জন্য কোনো না কোনো বিনোদিনীর জোগাড় করেই দেয়। বিনোদিনী নিজেও এই জমিদার-গহনা-রেশম-সম্মান এর মোহজালে জড়িত হয়ে জমিদার বাড়ির বউ হয়েছে কিংবা হতে বাধ্য হয়েছে। পুরুষ যেহেতু ক্ষমতাবান শ্রেণির প্রতিনিধি তাই শুধুমাত্র তার লৈঙ্গিক পরিচিতি পুরুষ হওয়াই যথেষ্ট। এর সঙ্গে যদি জমিদার রক্ত, সম্পদ যুক্ত হয় তাহলে রোগ বা প্রতিবন্ধ্যত্ত্ব কিংবা বিকলাঙ্গতাও কোনো সমস্যা নয়। নারী সবসময়ই পণ্য। যেকোনো মূল্যে তা কেনা যায়ই। মানসিক প্রতিবন্ধী মহেন্দ্রর স্ত্রী, সত্য ও বুলবুলের পরিচারিকা এবং ইন্দ্রনীলের রক্ষিতা হিসেবে বিনোদিনী নানামুখী চাপ, কৌশল ও কূটনীতির মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্ত্ব ও আধিপত্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে। বয়সে ছোট বুলবুলকে বড় বউ বলে সম্মান দিতে অস্বস্তি হলেও মেনে নিয়েছে। স্ত্রীর প্রতি ভাসুরের মন নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। স্বামীকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে হয়েছে। বিধবা হওয়ার পরও বুলবুলের ক্ষমতাবান অস্তিত্ত্বকে মেনে নিতে পারেনি। জমিদারের কাজ বড়বউকে মানায় না, এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা দিয়ে নিজের মানসিক তৃপ্তি খোঁজার চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি সুদীপ-বুলবুলকে ঘিরে সত্যর মনে জমা সংশয়ের ক্ষেত্রে উসকানি এবং বুলবুলকে সত্যর ষড়যন্ত্রী মনোভাবের আভাস দিয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করার চেষ্টা করেছে। ছলনা-লোভ-শঙ্কা-মিথ্যা-কৌশল-বহুমুখীতা-অসহায়ত্বের সমন্বয়ে বিনোদিনী চিত্রিত হয়েছে এই চলচ্চিত্রে।

বুলবুল- যাকে ঘিরে এতো কথা-আলোচনা-বিশ্লেষণ। দেবী শক্তি প্রবেশে প্রাণলাভের আগ পর্যন্ত বুলবুল বাঙ্গালী সমাজের আর দশজন নারীরূপের উপস্থাপন ব্যতীত আর কিছুই ছিলো না। কিন্তু দেবীর প্রবেশের পর বুলবুল হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। ধর্ষক মহেন্দ্র, স্ত্রীকে অত্যাচারকারী মাস্টার দীনকার, ছোট মেয়েকে ধর্ষণের জন্য প্রলুব্ধকারী গ্রামের ব্যক্তি, দ্বিতীয় স্ত্রীর প্ররোচণায় প্রথম স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া গাড়োয়ান- সব পুরুষকে শাস্তি দেয় বুলবুল। চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে স্বামী ইন্দ্রনীলকে শাস্তি দিতে উপস্থিত হয় বুলবুল। দেবীরূপী বুলবুল পুরুষের অন্যায়ের শাস্তি দিতে বারবার ফিরে এসছে কিন্তু পরিচিত হয়েছে ডাইনি নামে। বুলবুলের পরিবর্তিত রূপ অন্যায় বা অপরাধের নয়, বরং অপরাধীর বিনাশকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চলচ্চিত্রের দ্বিতীয়ভাগে। গাড়োয়ানের ইন্ধনদাতা দ্বিতীয় স্ত্রী, কিংবা বিনোদিনীকে শাস্তি দিতে দেবী উদ্যত হয় না। কিন্তু অন্যায়কারী প্রতিটি পুরুষকে শাস্তি দিতে সময় নেয়নি সে।

পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও শক্তির বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে দুটি মাত্রায়। আর এই মাত্রা দুটিকে উপস্থাপনের জন্য আদর্শ মানদন্ডের নির্ধারক নারীর রূপ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে তথাকথিত সৎ-দূর্বল চরিত্রের নারী। ভালো নারী, সৎ নারী মাত্রই অসহায়, দূর্বল, নিপীড়িত, বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না গোত্রভূক্ত। যারা নিজেদের জন্য ন্যায় অর্জনে অক্ষম। এই ভালো নারীরা অসহায়, যেমন মাস্টার দীনকারের স্ত্রী স্বামীর কাছে মার খেয়ে হাত ভেঙ্গে যাওয়ার পরও স্বামীর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে নারাজ। সিঁড়ি থেকে পড়ে যেয়ে হাত ভেঙ্গেছে বলে জানায় সে। অথচ সিঁড়ি আছে শুধু জমিদার বাড়িতে। গাড়োয়ানের প্রথম স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ায় সে আত্মহত্যা করে, কিন্তু বিচার চায় না। আদর্শধারার এই প্রত্যাশিত ও প্রতিষ্ঠিত নারীরূপের বাহিরে নারীর ক্ষমতায়ন বা ক্ষমতাবান নারীর রূপ উপস্থাপিত হয় কূটকৌশলী হিসেবে যার আদর্শ উদাহরণ বিনোদিনী, যাকে ছলচাতুরী, কৌশল করে নিজের অস্তিত্ব ও ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে হয়। অথবা অতিপ্রাকৃত, ব্যাখ্যাতীত ক্ষমতার অধিকারী নারী হিসেবে তুলে ধরতে হয় বুলবুল চরিত্রকে। নিজের এবং অন্যের সঙ্গে ঘটে চলা অন্যায়ের শাস্তি দিতে যাকে মৃত্যুর পর ফিরে আসতে হয়েছে দেবীরূপে। কিংবা দেবীও বোধহয় তাঁর সৃষ্টির সহনশীলতা ও অন্যায়ের চূড়ান্তরূপ দেখার পর সিদ্ধান্ত নেন ন্যায় ও শাস্তির মাত্রা নির্ধারণের। দূর্বল-কৌশলী-ক্ষমতাবান নারীরূপের এমন গতানুগতিক উপস্থাপন চলচ্চিত্র মাধ্যমে নতুন নয়। দূর্বলের বিপরীতে নারীর শক্তিশালী রূপের উপস্থান খুব কম ক্ষেত্রেই স্বাভাবিকভাবে চিত্রায়িত হয়। নারীকে হয় সমাজ-বিচ্যুত চরিত্রের অধিকারী হতে হয় অথবা অতিপ্রাকৃত শক্তির আশ্রয়ে ন্যায় বিচার খুঁজে নিতে হয়। একজন নারী স্বাভাবিকভাবে নিজের জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারেন, এমন কাহিনী একবিংশ শতাব্দীকালেও তাই বিরলই থেকে যায়।

যেকোনো বিষয় জনসম্মুখে উপস্থাপন ও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র, রাষ্ট্রযন্ত্রের সামাজিকীকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। কারণ শাসকশ্রেণি যে ধরনের সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তার নির্মাণে চলচ্চিত্রকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা সম্ভব। চলচ্চিত্রসহ সমস্ত গণমাধ্যমই কমবেশি ক্ষমতাবান শেণির মতাদর্শ ধারণ করে। আর একারণেই নারীর যেকোনো ইমেজ নির্মাণে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। লৈঙ্গিক রাজনীতি পুরুষ ও নারী দু-লিঙ্গেরই সম্মতি আদায় করে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। গণমাধ্যম তথা চলচ্চিত্র সমাজব্যবস্থার ক্ষমতা-সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যে কাজ করে। যার ফলে চলচ্চিত্রে সমাজের যে প্রাধান্যশীল মতাদর্শ উপস্থাপিত হয়, তা সমাজের সবার কথা বা সবার রূপ নাও হতে পারে। সেকারণে নারী ও পুরুষকে ঘিরে সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত ডিসকোর্স চলচ্চিত্রে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হলেও একই বিষয়কেন্দ্রিক বার্তা পুনরুৎপাদিত হতে থাকে। নারী-ক্ষমতায়নের আলোচনা কিংবা ডিসকোর্স নির্মাণে তাই যৌনতা, সহিংসতা, ধর্ষণ, ছলনা, অতিপ্রাকৃতিক শক্তির বৃত্তায়ন জরুরি হয়ে ওঠে, তা সে উপস্থাপনের নির্দেশনা একজন পুরুষ দিক কিংবা নারী।  

লেখক: শিক্ষক, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন