প্রবন্ধ: উত্তর আধুনিকযুগে প্রিয়জন বা বন্ধু নির্বাচন: মো: রিয়াজুল ইসলাম

0

অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

সমাজতাত্ত্বিক জে বাওমান তাঁর রাইজ অব নেটওয়ার্ক সোসাইটিগ্রন্থে বলেছেন উত্তর আধুনিক যুগে আমরা প্রত্যেকেই তাৎক্ষণিক প্রাপ্তিতে বিশ্বাসী বাওমানের এই উক্তিটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বর্তমানে সবাই দ্রুত সফলতা, দ্রুত অর্থ-বিত্তের মালিক এমনকি দ্রুত নিজের চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত। বর্তমান সময়ে সবার মাঝে কেমন যেনো সবকিছুতে অস্থিরতা বিরাজ করছে- এই যে অস্থিরতা, এই যে অধিক পাওয়ার আগ্রহ, এটা একদিনে বা একবছরে সৃষ্টি হয়নি! নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বৈধ বা অবৈধ অধিক আগ্রহ এবং নিজেকে সবার থেকে স্বতন্ত্র করার ব্যক্তি মানসিকতা থেকেই এই অস্থিরতার উৎপত্তি। এখন পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা যেকোন কর্মক্ষেত্রে মানুষ প্রথমে নিজের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে তারপর অপরের কথা। এই জন্যই সমাজতাত্ত্বিক গিনেড্স বলেছেন, ‘এই সমাজ এমন সমাজ যেখানে অনেক সুযোগ সুবিধা যেমন আছে তেমন আছে বিশাল বিশাল ঝুকিঁ!অর্থাৎ উত্তর আধুনিক সমাজে হাত বাড়ালেই এবং অর্থ খরচ করলেই মানুষ যা কিছু প্রয়োজন তাই হাতের নাগালে পাচ্ছে আবার একই সাথে যেকোন সময় বিপদের সম্মুখীন হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। যেমন: মোবাইল ফোন বা ফেসবুকের মাধ্যমে অজানা অচেনা নারী-পুরুষ একজন আরেক জনের প্রেমে পড়ছে, নতুন সম্পর্ক তৈরী করছে এমন কী বিয়ে করে সংসার করছে তবে এমন অনেক উদাহরণও রয়েছে যে, ফেসবুকের মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরী করে সর্বস্ব হারাচ্ছে, অর্থাৎ বর্তমান সমাজে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও রয়েছে। সুযোগ-সুবিধার এই আধুনিক সমাজে মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার কারনে এবং নিজের স্বার্থ সিদ্ধির প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে প্রিয় মানুষ, প্রিয় বন্ধু বা প্রিয়জন নির্বাচনের ক্ষেত্রে তৈরী করছে এক বিশাল সামাজিক সংকট। একটি ছেলে কিংবা একটি মেয়ে বন্ধু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে পতিত হচ্ছে নানাবিধ বিড়ম্বনায়। এই বিড়ম্বনা সবচেয়ে বেশি সৃষ্টি করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। গত কয়েক মাস পূর্বে একটি গবেষণা চালিয়ে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা কোন একক সর্ম্পক বা বন্ধু নির্বাচনে স্থির নেই! একই জন একই সাথে একাধিক বা তারও বেশি প্রিয়জন নির্বাচন করে রেখেছে এবং প্রতিজনের সাথেই সময় অতিবাহিত করছে! উত্তর আধুনিক যুগে এই প্রবণতা প্রকট ছিলো পশ্চিমা দেশগুলোতে কিন্তু অতি সম্প্রতি এই প্রবণতা আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শুধু নয় আমার মনে হয় কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেও অনুপ্রবেশ করেছে। বন্ধু নির্বাচনের এই পদ্ধতি শুধু সামাজিক অস্থিরতাই সৃষ্টি করছেনা, এটা ভবিষতে সামাজিক অবক্ষয়েরও কারণ হতে পারে। মূলত: পারিবারিক ভাঙ্গন, ব্যক্তিগত চাহিদা বৃদ্ধি, ব্যয় বেড়ে যাওয়া, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারনে মানুষের মধ্যে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, এই ধারণার ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ভালো এবং মন্দের পার্থক্য নিরুপণ করতে যে সময় প্রয়োজন সেই সময় কেউ ক্ষেপণ করছেনা, যেকারনে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই শ্রেণীকক্ষের বন্ধু নির্বাচন এবং ফেসবুকের বন্ধু নির্বাচন উভয় ক্ষেত্রেই ভণিতার আশ্রয় নিচ্ছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে চাকুরীজীবীদের বড় একটি অংশ প্রিয়জন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক মানদন্ডের তোয়াক্কা করছেনাযেকারণে বিবাহ বিচ্ছেদ, বহুবিবাহ, পরকীয়ার মতো সামাজিক সমস্যা দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে। মানুষ পোশাক পরিচ্ছেদে বেশ পরিপাটি হলেও দিনশেষে প্রায় অধিকাংশই বিষবৃক্ষ বুকে নিয়ে ঘরে ফিরছে। নিকট অতীতে মানুষ নিজের পরিবার, ভাই-বোন, আত্বীয়-স্বজনদের সাথে বেশ আড্ডা দিতো, অবসর সময় অতিবাহিত করতো, এখন পশ্চিমা বিশ্বের মতো সবাই ব্যক্তি প্রয়োজনে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যেটুকু অবসর সময় পাচ্ছে সেটুকু সময় কেড়ে নিচ্ছে পুজিঁবাদী প্রতিষ্ঠান ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইউটিউব! সামাজিক মেলবন্ধন কিংবা বন্ধুত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই সামাজিক মাধ্যমের যেমন অসামান্য অবদান রয়েছে ঠিক তেমনি পরিবার ভাঙ্গন, হৃদয়হরণ, বিষবৃক্ষরোপন, বিবাহ বিচ্ছেদ, সুন্দর সর্ম্পকের অবনতির ক্ষেত্রে এর ভূমিকা তুলনাহীন। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও মানুষ পারিবারিক প্রেক্ষাপট, সততা, চরিত্র এবং মেধার মূল্যায়ন করতো এখন বন্ধুত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব হারিয়েছে, এসেছে সীমাহীন পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে লাভবান হয়েছে পুজিঁবাদী প্রতিষ্ঠান ক্ষতি হয়েছে আবহমান বাংলাদেশের ঐতিহ্যের। তাই আমাদের উচিৎ প্রিয়জন কিংবা বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক পদক্ষেপ নেয়া, কেননা একজন বন্ধুই আমাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।

লেখক: শিক্ষক, জাককানইবি।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন