গল্প : পাতাদের গল্প : আরাফাত শাহীন

0

অলংকরণ: সানজিদা আক্তার

‘তাহলে এই কী আমাদের নিয়তি, কিছুদিন গাছের কোনো এক শাখায় ঝুলে থেকে, হঠাৎ একদিন কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই টুপ করে ঝরে পড়লাম মাটিতে! এমন জীবনই কি চেয়েছিল আমাদের আদি পিতা-মাতা!’

‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, বড়ই আতৃপ্ত তোমার আত্মা। এই যে এতদিন ঝুলে রয়েছ গাছের একেবারে মগডালে; তুমি রয়েছ সবার ওপরে এবং আশেপাশের পরিবেশ দেখতে পাচ্ছ সবার চেয়ে বেশি। এটা কী তোমার জন্য আশীর্বাদ নয়?’

‘আমি আসলে তোমার কথা অস্বীকার করছি না। তবে আমাদের জীবন তো খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী নয়। দ্যাখো, মানুষ কতদিন ধরে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থেকে রীতিমতো দাপিয়ে বেড়ায়।’

বড় পাতাটি ছোটো পাতার মনের আক্ষেপটা বুঝতে পারে। এক সময় সে যখন অমন তরুণ ছিল, এরকম চিন্তাভাবনা তার মাথাতেও আসত। একদিন সে তার পাশের সবচেয়ে বয়স্ক পাতাটিকে জিগ্যেস করেছিল, ‘আচ্ছা, গাছের ডালের সঙ্গে ঝুলে থাকাই আমাদের নিয়তি হলো কেন? আমরা কী মানুষের মতো হেঁটে বেড়াতে পারতাম না? কিংবা নিদেনপক্ষে পাখিদের মতো আকাশে উড়ে বেড়ানোর সুযোগ পাওয়ার হকদার কী আমরা ছিলাম না!’

বয়স্ক পাতাটি প্রশ্ন শুনে না পেরেছিল হাসতে, না পেরেছিল মন খারাপ করতে। বরং তার মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। বয়স্ক পাতাটি বলেছিল, ‘শোনো বাছা, তোমার বয়স কম বলেই হয়ত এমন প্রশ্ন মাথার ভেতরে এসে জট পাকিয়ে তোমায় বিভ্রান্ত করছে। তুমি নিজের মর্যাদাকে খাটো করে দেখছ কেন? একটা মানুষ কিংবা একটা পাখির চেয়ে পৃথিবীতে তোমার অবদান একটুও কম নয়। তুমি মানুষকে বসবাসের জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছ। আবার পাখিরাও তোমার বুকে এসে আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে। এটা কী তোমার জন্য একেবারে কম কিছু?’
ছোট পাতাটি সেদিন নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য লজ্জিত হয়েছিল। আর আজ সে নিজেও বৃদ্ধ বয়সে এসে এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। 

বড় পাতাটিকে অন্যমনস্ক দেখে অধৈর্য হয়ে পড়ে ছোট পাতা। তার মনে হয় বড় পাতা হয়ত তার কথা ভুলেই গেছে!
‘ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’ ছোট পাতা তাড়া দিয়ে বলে।

‘না, ঘুমোইনি। এখন আর আগের মতো ঘুম আসে না। একটু অতীতে ফিরে গিয়েছিলাম। অতীত আমাকে স্মৃতিকাতর করে ফেলে।’

‘এবার তাহলে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।’

‘তুমি কি নিজেকে যথেষ্ট ধৈর্যশীল বলে মনে কর?’ বড় পাতা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ছোট পাতার দিকে। ছোট পাতা বিরক্ত হয়। তবু আচরণে সে তা প্রকাশ করে না। বড় পাতা তবুও ধরে ফেলে সব। কারণ, তার অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে এসব।

‘তোমার মন খারাপের কারণ আমি বুঝি। তবে সাধারণত অযৌক্তিক কারণেই আমাদের মন সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়…’
‘তুমি কি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ কিংবা আমার প্রশ্নটিকে উপহাস হিসেবে দেখছ?’ ছোট পাতাটির ধৈর্য অনেক কম। সে তা বারবার প্রকাশ করে ফেলছে।

‘তোমার ধারণা মোটেও ঠিক নয়। আমি তোমাকে বুঝে ওঠার চেষ্টা করছি। তাতে তোমার প্রশ্নের জবাব দেওয়া সহজ হবে।’

ছোট পাতাটি চুপ করে থাকে। সে বুঝতে পারে, হয়ত নতুন কিছু শিখতে যাচ্ছে। এখন তাকে চুপচাপ ধৈর্য্য ধরে বড় পাতাটির কথা শুনে যেতে হবে।

দুই

‘তোমার যখন জন্ম হয় তখন আমার বয়স ছিল ঠিক তোমার মতো। নানান উদ্ভট প্রশ্ন আমার মাথাতেও এসে জট পাকিয়ে থাকত। আমি আমার আশেপাশের বয়স্ক পাতাদের প্রশ্ন করে বিরক্ত করে ফেলতাম। সেসব বয়স্ক পাতা কবেই তো ঝরে গেছে…’

‘তোমার কী মনে হয় না এতদিন তোমার ঝরে যাওয়া উচিত ছিল?’ প্রশ্ন করার পর ছোট পাতা লজ্জিত হয়। তার এমন প্রশ্ন করা মোটেও উচিত হয়নি। কারও অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা পাতাদের রীতি নয়। বড় পাতা তবুও মন খারাপ করে না একটুও।

‘একটা বিষয় তোমার খুব ভালোমতো বুঝে রাখা দরকার। প্রতিটি জীবনের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। কেউ যেমন তার সেই সীমাকে অতিক্রম করতে পারে না, আবার সেই সীমার আগেও কারও জীবন বিলীন হয়ে যেতে পারে না। এটা হলো সৃষ্টির সুন্দর একটা নিয়ম। এতে ভারসাম্য রক্ষিত হয় মহাবিশ্বের। অবশ্য এসব কথা তোমার মাথাতে কতটুকু ঢুকবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান।’

ছোট পাতার কিছুটা রাগ হয়। বড় পাতা হয়ত নিজেকে একটু বেশি জ্ঞানী মনে করা শুরু করেছে। সে ছোট হলেও এসব কথা না বোঝার মতো শিশু সে নয়।

আকাশ এখন অনেক বেশি পরিষ্কার। কয়েকদিন ধরে মেঘ ভেসে বেড়ালেও সেটা পুরোপুরি কেটে গেছে। সুন্দর একটা দিন। এমন দিনে ছোট পাতাটির ইচ্ছে অনুযায়ী পাখির মতো আকাশে ভেসে বেড়াতে পারলে মন্দ হয় না। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। বাতাসে ধীরে ধীরে দোল খাচ্ছে গাছের সমস্ত পাতা। বড় পাতা এবং ছোট পাতাও পরম সুখে দোল খাচ্ছে। এই দুলুনিতে তাদের দু-জনার ঘুম চলে আসছে। বারবার টলে পড়ছে বড় পাতাটি। হয়ত কথা বলতে বলতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

একটা ঘুঘু পাখি এসে বসে গাছের ডালে। ওদের কাছ থেকে খুব একটা দূরে নয়। ঘুঘুর ডানা ঝাপটাবার শব্দে ঘুমের রেশ পুরোপুরি কেটে যায় পাতাদের চোখ থেকে। ওরা জেগে দেখে অসম্ভব সুন্দর ঘুঘু পাখিটা ডালের ওপর ডেকে ডেকে নেচে বেড়াচ্ছে। এখন ওদের প্রজনন মৌসুম। কাছেপিঠে ওর সঙ্গীও থাকতে পারে। সে হয়তো তাকে উদ্দেশ্য করেই নিজের শিল্পশৈলী প্রদর্শন করে চলেছে। পাখিদের মধ্যে যেসব পাখি গাছের ডালে এসে বসে, ঘুঘু পাখিটাকে সবচেয়ে ভালো লাগে ওদের। এই পাখিটা প্রায়ই এখানে আসে। কাছেই বাসা হয়তো ওর।
ছোট পাতাটি আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। ও গাছের সবচেয়ে উঁচুতে। তাই সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পায়। বড় পাতাটি চেয়ে দেখে, নিচে একজন লোক বন্দুক কাঁধে ঘুঘু পাখির দিকে নল তাক করে রয়েছে। ওদের বুকের পানি শুকিয়ে আসে। বড় পাতাটি ঘুঘুকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে ওঠে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। বন্দুক থেকে গুলি বের হয়ে গেছে। ঘুঘু পাখিটা ধপাস করে গাছ থেকে মাটিতে পড়ে যায়। উল্লাসে লাফিয়ে ওঠে বন্দুক কাঁধে করা লোকটি। সে তার কাজে সফলতা অর্জন করেছে।


বড় পাতাটি দুঃখি গলায় ছোট পাতার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এমন জীবন পেলেই কী তুমি বেশি সুখি হতে!’
ছোট পাতাটি কোনো জবাব দেয় না। মন খারাপ করে চুপ হয়ে থাকে।

তিন

‘নিচে কীসের শোরগোল শোনা যায়? তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছো?’ ছোট পাতাটি গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে। মানুষের শোরগোল সে নিজেও শুনতে পেয়েছে। ‘পাশের বাড়িটা থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। অনেক লোকজন সেখানে জড়ো হয়েছে। তুমি কী অনুমান করতে পারো সেখানে কী হয়েছে?’ বড় পাতাটির প্রশ্ন শুনে ছোট পাতাটি হতাশ হয়। কারণ, সে কিছুই অনুমান করতে পারছে না। খুব আস্তে আস্তে সে বলে, ‘আমি এ সম্পর্কে কিছুই বলতে পারছি না।’

বড় পাতাটি তেমন কিছু মনে করে না। কারণ, এই সম্পর্কে ছোট পাতার কাছ থেকে সে তেমন কিছু আশা করেনি।
‘আমি জানি সেখানে ঠিক কী হয়েছে।’ বড় পাতাটি বলে।

‘কী জানো তুমি? আমায় বলবে?’ ছোট পাতার কণ্ঠে সুস্পষ্ট উত্তেজনা।

‘গত রাতে তুমি কোনো কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছো?’ বড় পাতার প্রশ্ন শুনে ছোট পাতা হতাশভাবে মাথা নাড়ে। সে কিছুই শুনতে পায়নি।

‘আমি আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’

‘এটা মোটেও দোষের কিছু নয়। আমি অবশ্য জেগেই ছিলাম। রাতে আমার তেমন ঘুম হয় না।’ ছোট পাতাটি আসল ঘটনা শোনার অপেক্ষায় ধৈর্য্য ধরে বসে থাকে।

‘গত রাতে আমি সদ্য জন্ম নেওয়া একটা মানবশিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। জন্ম নিয়েই সে তার আগমনী বার্তা জানান দিতে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল।’

‘তার পর কী হলো? বাড়ির বাকি লোকজন বুঝি অনেক খুশি হয়েছিল?’

‘হ্যাঁ, তা হয়েছিল বটে। দীর্ঘদিন পর তাদের বাড়ি আলো করে একটা মানবশিশু এসেছে। তাই পরিবারে খুশির একটা ঢেউ আছড়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। আমি এখান থেকেই তাদের খুশির রেশ অনুভব করেছি।’

‘কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে আজকের শোরগোলের কী সম্পর্ক?’

বড় পাতাটি প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসে। তারপর জবাব দেয়, ‘সম্পর্ক তো অবশ্যই একটা আছে। তা না হলে আমি তোমাকে কেন ব্যাখ্যা করে শোনাব?’

‘তাহলে বিষয়টা আমাকে বুঝিয়ে বলো। কিছুই আমার বোধগম্য হচ্ছে না।’

ছোট পাতার অধৈর্য অবস্থা দেখে বড় পাতাটি গম্ভীর হয়ে ওঠে। তারপর বলে, ‘কিছুক্ষণ আগে রাতে জন্ম নেওয়া সেই শিশুটি মারা গেছে। বাড়ির খুশির রেশটা অল্প সময়ের মধ্যেই বিষাদে পরিণত হয়েছে।’

মৃত্যুর কথা শুনে ছোট পাতাটির মন বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। যে কোনো মৃত্যুই পাতাদের হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলে যায়।

‘তুমি বলেছিলে পাতার পরিবর্তে মানবশিশু হয়ে জন্ম নিলেই বেশি সুখি হতে; দীর্ঘ জীবন পেতে পারতে। কিন্তু তুমি কীভাবে তোমার নিয়তিকে এড়িয়ে যেতে পারবে!’ বড় পাতাটির কথা ছোট পাতাটি নীরবে শুনে চলে। তার হৃদয়েও কি গোপন অশ্রুপাত শুরু হয়ে গেছে!

চার

হঠাৎ করে পাতাদের মাঝে একটা সংবাদ রটে যায়। মানুষের মাঝে আজকাল যেমন দ্রুতগতিতে গুজব রটছে ঠিক তেমনভাবে। তবে এই সংবাদটাকে গুজব হিসেবে উড়িয়ে দিতে পারেনি কোনো পাতাই।

‘খবর শুনেছ কিছু, কী এক আজব রোগ নাকি ছড়িয়ে পড়েছে সারা দুনিয়ায়?’ নিচের দিকের একটা পাতা ওপরের দিকে মুখ করে চেঁচিয়ে বলে।

‘রোগ বলছ কেন- আমি তো শুনলাম সেটা একটা কঠিন ভাইরাস।’ অপর একটি পাতা বলে ওঠে।

ভাইরাসের কথা শুনে নড়েচড়ে বসে সমস্ত পাতা। কারণ, গাছ এবং তার পাতার জন্য এটা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
‘এটা কী মানুষের নাকি গাছেদের আক্রমণ করছে?’ ওপর থেকে বড় পাতাটি প্রশ্ন করে। ছোট পাতা অবাক হয়ে সবার কথা শুনে যায়। কারণ, এসব বিষয় সম্পর্কে সে কিছুই জানে না।

‘আমি ঠিক বলতে পারব না। নিচ দিয়ে একটা মানুষ দৌড়ে যাচ্ছিল। সে-ই চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করছিল।’ রোগের কথা প্রথম যে পাতাটি বলেছিল সে বলে।

বড় পাতাটি বুঝে উঠতে পারে না, ঠিক কী ঘটতে চলেছে।

পরদিন আসল ঘটনা জানতে পারা যায়। গাছের সকল পাতা অবাক হয়ে খেয়াল করে, রাস্তায় কেমন যেন একটা শোরগোল পড়ে গেছে। দূরের কোথা থেকে- হয়ত শহরই হবে, মানুষ দলে দলে ফিরে আসছে এদিকে। সবার মুখেই কাপড় জড়ানো; গরুকে গাছ খাওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য যেভাবে মুখ ঢেকে দেওয়া হয়। সবার চোখেমুখে কেমন যেন আতঙ্ক দেখা যায়। গাছের পাতারাও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। তবে কি শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ানক সেই ভাইরাস?

ছোট পাতাটি আতঙ্কভরা চোখ নিয়ে প্রশ্ন করে, ‘কী হয়েছে আমাকে বলতে পার?’

‘আপাতত আমাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। মানুষের মাঝেই হয়ত সেটা এসেছে। তাদের আতঙ্কিত মুখগুলো দেখে আমি বড় কৌতুক অনুভব করছি।’

ছোট পাতাটি বড় পাতার এই কথা শুনে ভারি অবাক হয়ে যায়। সে বড় পাতাকে যথেষ্ট সংবেদনশীল বলেই জানে। সকলের দুঃখে সে দুঃখ অনুভব করে। তার হৃদয়টা বড় কোমল। কিন্তু ছোট পাতা কিছুতেই ভেবে পায় না মানুষের কষ্টের মাঝে সে কীভাবে কৌতুক খুঁজে পেতে পারে!

‘তুমি তো এর আগে কখনও এমন কথা বলোনি! মানুষের দুঃখে তোমার কৌতুক অনুভব করার কারণটা কী?’

‘আজকাল মানুষ আমাদের দুশমন হয়ে উঠেছে। আমরা তাদের বেঁচে থাকার জন্য সমস্ত উপকরণ সরবরাহ করি। ঝড়ঝাপটাসহ যে কোনো বিপদ সবার আগে আমাদের ওপর দিয়েই যায়। মানুষ আমাদের কারণেই নিরাপদে বসবাস করতে পারে। অথচ তারা করছে কী? গাছপালা কেটে একেবারে বিনাশ করে ফেলছে। তুমি কি জানো, তারা আমাদেরও মেরে ফেলার চক্রান্ত করছে? কদিন পরেই এই গাছটা কেটে ফেলা হবে।’

ছোট পাতার মনটা সহসা দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মানুষ সত্যি সত্যি বড় খারাপ হয়ে উঠছে।
বড় পাতাটির গলা ধরে আসে। সে বলতে থাকে, ‘এই যে ভাইরাস এসেছে দেশে দেশে এটাও মানুষের নিজহাতে উপার্জন করা। মানুষ এখন তার ভেতরকার মানবীয় গুণাবলি জলাঞ্জলি দিয়ে চলেছে। তাদের ওপর এমন আযাব না এলেই বরং আমি অবাক হতাম। তবে আমাকে একটা বিষয় আরও গভীরভাবে ভাবাচ্ছে।’

‘কী সেটা?’ ছোট পাতা প্রশ্ন না-করে পারে না।

‘মানুষের ছোটাছুটির সময় আমি একবার পঙ্গপাল সম্পর্কে শুনেছি। জানি না তারা এখন কোথায় আছে। তবে পঙ্গপাল যদি সত্যি সত্যি এদিকে এসে পড়ে তাহলে আমাদের প্রজাতির বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’
পঙ্গপাল সম্পর্কে ছোট পাতাটি আগেও শুনেছে। সে ভয়ানকভাবে শিউরে ওঠে। মনে মনে প্রার্থনা করে, হারামির দল যেন এদিকে কিছুতেই আসতে না পারে।

পাঁচ

ধীরে ধীরে সময় বয়ে চলে। পাতাদের জীবনে তেমন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আর ঘটে না। প্রতিদিন শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটে আসছে মানুষ। এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা। মানুষের বাচ্চারা অবশ্য মুখ ভার করে রয়েছে। শহর ছেড়ে আসতে হয়তো তাদের মোটেও ভালো লাগছে না। বাবা-মা তাদের বোঝাতে গিয়ে রীতিমতো হয়রান হয়ে পড়ছে। যে মানুষেরা মনে করে, শহরই হলো একমাত্র তাদের বসবাস করার মতো উপযুক্ত জায়গা; দলে দলে তাদের শহর ছেড়ে চলে আসা অবাক করার মতোই ঘটনা। একদিন গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়া মানব সন্তানটিও ভুলে যেতে বসেছিল তার মাটিকে। সামান্য একটা ভাইরাস তাদের আবার টেনে মাটিতে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। এসব ভাবলে বড় পাতাটির বড্ড হাসি পায়। তার মুখে হাসির রেখা দেখে ছোট পাতাটি জিজ্ঞেস করে, ‘হাসছ কেন? তোমার মাথায় নতুন কোনো বিষয় প্রবেশ করেছে নাকি?’

বড় পাতা তাকিয়ে দেখে ছোট পাতাটি তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে। সে বলে, ‘হাসছি মানুষের কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে।’

‘মানুষ আবার কী করল?’

‘তারা-ই তো সবকিছু করে। তারা সভ্যতা ভাঙ্গে আবার গড়ে। এই যে দ্যাখো, একদিন তারা গাট্টি-বোচকা নিয়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে শহরকে তারা আপন করে নিল। শুধু তাই নয়, গাছপালা কেটে সাফ করে তারা নতুন নতুন শহর গড়ে তুলল। এখন তারাই দ্যাখো কেমন করে গ্রামে ছুটে আসছে।’

‘প্রকৃতি ধ্বংস করে এখন তারাই আবার প্রকৃতি গড়ে তোলার কথা বলছে।’ ছোট পাতার কথা শুনে বড় পাতাটি চমৎকৃত হয়। এই কদিনে সে বেশ শিক্ষা নেওয়া শুরু করেছে।

আকাশের এক কোনায় মেঘ জমে উঠতে শুরু করেছে। পাতারা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মেঘকে। এখান থেকেই তো ঝড় হয়। আর সেটা হলে ঝড়ের দাপটে গাছের পাতারা ছিটকে পড়তে থাকে মাটিতে। মানুষের মতো তারা অবশ্য মাটিতে পড়লে ব্যথা পায় না। কারণ, ততক্ষণে তাদের কারও শরীরে জীবনের অস্তিত্ব থাকে না।
ধীরে ধীরে মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য ঝলমল করে ওঠে। পাতারা ভারি খুশি হয়। এবার তাহলে নিস্তার পাওয়া গেল।
ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। এমন বাতাসে পাতাদের বড্ড ঘুম পায়। বড় পাতাটির চোখও ঘুমে বুঁজে আসছে। ছোটটি তো ঘুমিয়ে একেবারে কাঁদা হয়ে পড়ে রয়েছে। জগত সংসারের চিন্তা তো আর তাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি!
হঠাৎ আকাশের পটভূমিতে একটা বাজপাখিকে ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। ঘুমে ঢুলুঢুলু বড় পাতাটির বুঁজে যাওয়া চোখ খুলে যায় সহসা। পাখিদের ভেতর সে এই বাজপাখিকে একেবারে সহ্য করতে পারে না। কত পাতার জীবন যে সে নাশ করে নিজের প্রয়োজনে! বহুক্ষণ ধরে আকাশে ভেসে বেড়ানো বাজপাখিকে এদিকে উড়ে আসতে দেখা যায়। সে কি এই গাছটাতেই এসে বসবে! বড় পাতাটি একবার ভেবে দ্যাখে ছোটো পাতাকে জাগাবে কি-না। পরে সে চিন্তা বাতিল করে। ছোটো পাতাটি ভয় পেতে পারে। বাজপাখি সোজা উড়ে আসে গাছের দিকে। এসে ঝপাৎ করে পড়ে ডালের ওপর। চোখ বুঁজে সে ধাক্কা সামাল দেয় ওরা। পাতাদের বাহু বড্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। ওরা আর কতক্ষণ ডালের সঙ্গে ঝুলে থাকতে পারবে বলা মুশকিল।

বাজপাখির দৃষ্টি বহু দূরে। সে হয়তো তার খাবারের সন্ধান পেয়েছে। ওড়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় সে। বড় পাতাটিও নিজের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। ছোট পাতাটি অবশ্য তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারেনি এখনও। গাছের ডালে সর্বশক্তিতে ঝাঁকি দিয়ে উড়াল দেয় বাজপাখি। তাতেই পাতাদের যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে যায়। বহুদিন ধরে গাছের যে জায়গাটিতে তাদের আশ্রয় সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা; ভাসতে থাকে নিচের দিকে। মাটিতে পড়ার পথেই মুখোমুখি হয় দুটি পাতা। বড় পাতাটি খেয়াল করে দেখে, ছোট পাতাটির মুখে কোনো ক্লেশ নেই। বরং তার মুখ থেকে আশ্চর্য একটা জ্যোতি ঠিকরে বেরুচ্ছে। খুশি হয় বড় পাতা। তার দেওয়া শিক্ষা আশ্চর্যরকম কাজে এসেছে। মাটিতে পতনের আগে একে অপরের দিকে চেয়ে একবার হেসে নেয় পাতা দুটি। তারপর চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ে মাটির বুকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন