গল্প : পলকা : আসিফ ইকবাল আরিফ

0

অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

শ্রাবণ দিনের ঘন বরষার মেঘ থমথমে অন্ধকারসম সময়ে যখন দিব্যি দুপুর হওয়া স্বত্বেও সন্ধ্যে মনে হচ্ছিল, ঠিক এমন সময় স্নান কার্য সেরে জানালার আধফাটা পর্দাটা সরিয়ে চুল শুকানোর চেষ্টা করছে চ্যামেলী। লম্বা আর ঘন কালো কেশ এমনভাবে বিছিয়েছে যে শ্রাবণ দিনের স্বয়ং কালো মেঘও লজ্জা পাবে। আর চাকচিক্যময় মুখখানা যখন সে এদিক-ওদিক করছে, তখন মনে হচ্ছে কদম ডালের সবুজ পাতার আড়াল থেকে কদম ফুলের সাদা তুলতুলে আবরণটি খসে-খসে পড়ছে। নিতান্তই পূণ্যের কপাল না হলে কী আর বকুলের কপালে এমন বৌ জোটে? দীর্ঘক্ষণ চুল শুকানোর বাহানায় জানালার ওপাশে চেয়ে মন ভালো করার পায়তারা করছে সে। চোখের চাহনির উজ্জ্বল থকথকে ভাব কিছুটা নয়, বড্ড বেশিই মলিন হয়েছে। হঠাৎ নাড়া খাওয়া  লজ্জাবতী পাতা যেমন স্বাচ্ছন্দের পাতা ফোলানো অবস্থার দম্ভ রেখে মুহূর্তেই কুচকে যায় তেমনি চ্যামেলীর ভ্রুযুগলও কুঁচকে গেছে।  প্রেমের আলোকরশ্মি ছড়ানো মুখের হাসিও স্ফীত হয়ে গেছে কয়েকদিন আগে ফুঁটে ঝরে পড়া গোলাপ ফুলের মতো। মুখাবয়ব এতটাই ভার করে বসে আছে যে চঞ্চুর কালো তিলকখানি আর গ্রীবা তলদেশের আঁচিলটিও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। নদীর তলদেশ গভীরের মৃত্তিকা প্লেটে যেমন উপর দেশের জলতরঙ্গ ভেঙে পড়ে জলরাশির গতিপথ বদলে দেয় তেমনিভাবে চ্যামেলীর মনকে বিরহ-ব্যাথা আর অভিমানের ঢেউ ঠুকরে ঠুকরে ভেঙে দিচ্ছে। ঠিক এমন সময় বৃষ্টিজলে ভিজতে ভিজতে মোটর বাইক হাঁকিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল বকুল। বকুল একটি সরকারি স্কুলে বাংলা পড়ায়।        

বকুলের চাকরির বয়স আর চ্যামেলীর সাথে তার বিয়ের বয়স প্রায় সমান― মাত্র দুই মাসের আগ-পাছ। মোদ্দাকথা হচ্ছে  বকুল চাকরি পাবার দুই মাস পরে চ্যামেলীকে বিয়ে করে। বিয়ের আগে তারা পাকা তিনবছর প্রেম করেছে। বকুল যে স্কুলে শিক্ষকতা করে ঠিক সেই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী চ্যামেলী। আর পাশাপাশি গ্রামের হওয়াতে দু জনের মধ্যে চেনা পরিচয় কমবেশি আগে থেকেই ছিল। যাইহোক, চ্যামেলী যখন শহরের কলেজে ডিগ্রি ভর্তি হবার জন্য আসে, ঠিক তখন থেকে শুরু হয় তাদের প্রেমের সম্পর্ক। উনুন থেকে সদ্য নামান ভাজা মাছের টুকরোটি যেমন কোনো আত্মা গরম গরম খেয়ে পরিতৃপ্তি পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে, তেমনিভাবে সদ্য চাকরি পাওয়া বকুল চ্যামেলীকে বিয়ে করে যৌবন বাগানের কর্ষণ প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য ছটফট করতে থাকে। এই ছটফটানি যে চ্যামেলীর মনেও ছিল! যে প্রেমিকের সাথে এই শহরতলীতে ঘুরে ঘুরে প্রেম করে বেড়িয়েছে তার সাথে সংসার হওয়া এমনিতেই সুখের কপাল। আর তার উপর যদি প্রেমিকের একটা সরকারি চাকরি থাকে তাহলে তো কোন কথা থাকেনা। বিয়ের পরে শহরতলীতে একটি আধপাকা বাড়িতে ভাড়া থাকে তারা। যাইহোক, করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকলেও আজ বকুল স্কুলের অফিসে গিয়েছিল দরকারি কিছু কাজ করতে।  

বৃষ্টিতে ভেজা টি-শার্ট আর কালো জিন্সের প্যান্ট ছাড়িয়ে লুঙ্গি পরে ঘরে ঢোকে সে। আর চ্যামেলী যে ফিরে এসেছে তা বারান্দায় চ্যামেলীর কাপড় নাড়া দেখেই সে বুঝতে পেরেছে। একটি পাতলা সাদা রঙের লুঙ্গি পরে ঘরের অন্য এক জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মাথার চুল মুছতে থাকে বকুল। চ্যামেলী যে ঘরে আছে তা বকুল দেখেছে কিন্তু কোনো কথা না বলেই নিজের আপন মনে ভেজা চুল মুছতে থাকল। চ্যামেলীর কর্ণকুহরেও বকুলের ঘরে প্রবেশের শব্দ এসেছিল কিন্তু তার সম্যক জ্ঞানের সাক্ষী কান, চোখ আর মগজ কোনটিই বকুলের দিকে ফিরে তাকানোর ঈশারা দেয়নি বরং উল্টো চোখ ফিরিয়ে থাকার উস্কানি যুগিয়েছে।  

জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতেই চ্যামেলীর চোখ পড়ল কিছু কচু গাছের উপর। এইতো মাত্র দুইমাস আগে যেগুলো শুষ্ক আর মৃতপ্রায় ছিল, বৃষ্টির জল পেয়ে সেগুলো সবুজে থকথক করছে। কচুর পাতার রঙ এতোটাই গাঢ় সবুজ হয়েছে যে মনে হয় মাটির সবটুকু নির্যাস চুষে খেয়ে নিয়েছে। বিনা পরিচর্চায় শুধু বৃষ্টি জলে দুমড়ান আর লাল হয়ে যাওয়া পাতাগুলোকে সবুজ হতে দেখে অন্যরকম অনুভূতি আসে চ্যামেলীর মন কুঠিরে।

অন্যদিকে একই ঘরের বিপরীত জানালায় দাঁড়িয়ে ছিল বকুল। দুই বছর আগে মালিকের হাতে লাগানো ট্যাংটেঙে প্রায় মরে যাওয়া জলপাই গাছও বৃষ্টির জল পেয়ে তরতাজা পাতা ছেড়ে ফুল ধরিয়েছে। ফোঁটা ফোঁটা স্বচ্ছ বৃষ্টির জল ফুলের উপর পড়ছে আর ফুলের উপরে আটকে থাকা মাকড়সার জাল খুলে খুলে পড়ছে। ফুল স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছতর আর তরতাজা দেখাচ্ছে। চ্যামেলী কোনো কিছু দেখার আগেই বকুল চ্যামেলীকে এক পলক দেখে আবার জলপাই ফুলের দিকে তাকায়। এই মুহূর্তে বকুলের মনের মধ্যে যা ঘটছে তা কেবল তার মন আর তার মনের সৃজনকর্তা ছাড়া আর কেউ জানে না। দীর্ঘ সময়ের সুপ্ত বায়ুকণা যেমন অতল সমুদ্রে জমে প্রবল বেগে জলকণা ভেঙ্গে জল আঁছড়ে আঁছড়ে বের হয় তেমনি গত দুই মাসে চ্যামেলীর প্রতি জমে থাকা বকুলের মন বেসাতির আদর আর আবেশের পর্দা বড্ড কামাতুর হয়ে চ্যামেলীর অর্ধ্ব আবৃত যৌবন সাগরে দমকা হাওয়া হয়ে পড়তে চাচ্ছে। এই জলপাই গাছের ফুল তার মনের জ্বালা দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। এই জ্বালা এখন যদি সে নেভাতে চায় তাহলে নিশ্চয় চ্যামেলীর হাত ধরে তাকে সম্মতি আদায় করতে হবে। আর কপাল খারাপ হলে হয়তো পা-ও ধরা লাগতে পারে। আর মনে যদি পশুবৃত্তি থাকে তাহলে অন্যকথা। এই বন্দি ঘরে চ্যামেলীর উপর সে জোর জবরদস্তিও করতে পারে। যাইহোক, কিঞ্চিৎ পরিমাণ দেরি না করেই বকুল উদোম শরীরে বাড়ির উঠোনে নেমে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। বাসা এখন পুরো ফাঁকা। অন্য যে ভাড়াটিয়া পাশের রুমগুলো নিয়ে থাকত, তারা এই ‘লকডাউন’ কালে বাসা ছেড়ে চলে গেছে।  

বকুল বৃষ্টিতে ভিজতে যাওয়ার পরে চ্যামেলী সেই জানালাতে এল। চ্যামেলী চোখ ঘুরাতেই দেখল বকুল বৃষ্টিতে ভিজছে। বকুলকে একটু দূরের ঘরের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকতে দেখে চ্যামেলীও উঠোনে নেমে আসে। 

বকুলের পেছনে দাঁড়াতেই চ্যামেলীর চোখে পড়ে ঘরের চালার উপর দুটি পায়রার আদর মাখামাখির দৃশ্য। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের আদরে হয়তো মুরগী, কবুতর ডিম দেবে না। তাই বলে কী তারা একে অপরকে আদর করা থেকে বিরত থাকে? থাকেনা। আদর আর আবেশের মায়া মাখা খেলা দমে থাকেনা, দমিয়ে রাখা যায়না।  

এই কবুতর পাখির প্রেমের দৃশ্য বকুলও দেখেছে। বকুলের মনের মধ্যে ঝড় উঠে যাচ্ছে। জলপাই ফুলের ডগায় বৃষ্টির জল, কবুতরের প্রেম আর চ্যামেলীর ঘরে ফিরে আসা সবকিছু মন কুঠিরে ঝড় তুলে দিচ্ছে। মন ঘরের ধৈর্য্যকে মনে হয়না বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখবে তারা দু জনে।    

বকুল মনে মনে চ্যামেলীকে পাশে পাওয়ার বাঞ্ছা প্রকাশ করে এই ভেবে যে চ্যামেলী যেন তার পাশে এসে দাঁড়ায়। আর বকুলের মনের মতো হয়ে শুধুই দাঁড়িয়ে থাকে। মনে কল্পনার আবেশে কত ভাবনা সাজাতে থাকে সে। চোখ সম্মুখে জলজ্যান্ত মানুষকে দাঁড় করিয়ে তাকে মনের মতো করে সাজানো যায়না। নানা বাধা বিপত্তি থাকে। আর যেটা বেশি হয় সেটা হচ্ছে ‘ইন্টারাপশন’। বকুল এমনক্ষণে তার মনের কল্পনায় চ্যামেলীকে পুতুলের মতো করে সাজাতে চায় কেননা বাস্তবের  চ্যামেলী অনেক সুন্দর হলেও সেইদিন মুখের উপর যেসব কথা বলে বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিল, সেই চ্যামেলীকে আর বাস্তবে চোখের সামনে আনতে মন চাচ্ছেনা বকুলের।  বকুল তার কল্পনায় চ্যামেলীকে এমন পুতুল বানিয়ে অনুভব করতে চায়, যে চ্যামেলীর কোনো ভাষা নেই, নড়াচড়া নেই, মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই আর ঝগড়া করার মন মানসিকতাও নেই।  

বকুল তার চোখের সম্মুখের জলজ্যান্ত চ্যামেলীকে স্পর্শ করবে নাকি তার কল্পনায় সাজানো চ্যামিলীকে অনুভব করবে―এই নিয়ে দ্বিতল অনুভূতির ধাক্কা খেতে খেতেই গত দুইমাসের ঘটে যাওয়া ঘটনার ছবি এক এক করে তার মনে আসতে শুরু করল।  

দুজন যখন একে অপরের প্রতি কথার ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে তখন শুধু নিজের উপর আসা আঘাতটাকেই দেখেছে। বকুলের কথায় চ্যামেলীর অন্তর্ঘাত বকুল দেখেনি আর চ্যামেলীর কথায় বকুলের অন্তর্ঘাত চ্যামেলী দেখেনি। একের আঘাত অপরের থেকে বেশি ভেবে দুজন দুজনকে ছেড়ে দিন পার করেছে।  

চ্যামেলী মান ভাঙানোর খেলায় একটু বেশিই এগিয়ে ছিল কেননা বাবার বাড়ি থেকে সে নিজের ইচ্ছাতেই বকুলের কাছে এসেছে। আবার উঠোনে বৃষ্টিতে ভিজতেও সে বকুলের প্রস্তাবের অপেক্ষা করেনি।     

তবে কচু পাতা আর জলপাই ফুলে বৃষ্টির ফোঁটা, সাথে সাথে আবার উঠোনের পাশে চালের উপর কবুতরের আদর মাখামাখির খেলা তাদেরকে অভিমান ভুলে কামচাঞ্চল্যে ফিরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে। দুজনেই একে অপরের বক্ষে মিশে যেতে চাচ্ছে। এই মুহূর্তে তাদের মন আর শরীরের যে আকুতি তা হয়তো বাইরে থেকে অনুভব করা যায়। তবে এই ছাই চেপে থাকা আদরমাখা সম্ভোগের খেলার যাতনা দমিয়ে রাখার যে জ্বালা তা কেবল ভুক্তভোগিরাই ভালো জানে।    

আজ কী তাহলে তাদের দীর্ঘ দুইমাসের রাগ আর অভিমানের পালা শেষ হবে? বিনিদ্র রজনীতে পানিতে ভেজা বীজের মতো কী আজ আবার তাদের আদর লেপনের গান অঙ্কুরিত হবে? যেহেতু তারা প্রকৃতির ইঙ্গিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে, তাহলে হয়তোবা দুজনের মধ্যে মিলন উৎসব হলেও হতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে অভিমানে জমাট বাঁধা আবরণ কে আগে সরাবে? বাড়ি ফিরে এসে আর উঠোনে বৃষ্টিতে ভিজতে এসে চ্যামেলী কিন্তু দুই পা বাড়িয়ে দিয়েছে। বকুলের এগিয়ে না আসার কারণ হয়তো বকুল ভালো বলতে পারবে। তবে অভিমান ভাঙ্গানোর খেলায় কেউ বেশি এগিয়ে এলে অন্যজন পিছিয়ে যায়। আর যে বেশি এগিয়ে যায় তার জয়ের পাল্লা কিছুটা হলেও কলুষিত করার চেষ্টায় আর একজন পিছিয়ে থাকার অভিনয় করে। জয় মাল্য যখন অন্যজনের পায়ের কাছে পড়ে তখন সেইজন রতিতে আসতে রাজি হয়। এইখানে চ্যামেলী বেশি এগিয়ে এসেছে বলে লজ্জ্বার ভারে বকুল হয়তো পিছিয়ে থাকার অভিনয় করছে।   

দুজনে কী দুজনের মতো বৃষ্টি স্নানে মাতবে নাকি দুজন একসাথে উপভোগ করবে? এমন দ্বৈতদোলা হয়তো দুজনের মনেই চলছে। প্রকৃতি কী এমন কোনো হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তাদের মন থেকে অভিমানের আবৃত মেঘ সরিয়ে দেবে? ঠিক এমন সময়ে আকাশ থেকে বিকট শব্দের এক বজ্রপাত এল। বজ্রপাত বেশ দূরে পড়েছে কিন্তু শব্দটা বেশ বিকট ছিল। তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি বরং বজ্রপাতের বিকট শব্দে তারা দুইজন দুইজনাকে জড়িয়ে ধরল। বকুল এবং চ্যামেলী দুজনেই বজ্রপাতকে জমের মতো ভয় পায়।  

সারা দুপুর বৃষ্টিতে ভিজে ভেজা কাপড় ছেড়ে আদরের আবেশে ভিজতে দুজনে ঘরে ঢোকে। প্রেম-ফাল্গুনী নৃত্যে তারা মাতলামি করে মায়ার চাদরের তলে। অবশেষে তাদের মান ভাঙ্গার গান শেষ হয়।   

অনেক দিনের জমে থাকা আদর আর আবেশের পর্ব শেষ করে ঘরের বারান্দায় সিগারেট টানে বকুল। উদাস মনে ধোঁয়ার কুণ্ডলি ছেড়ে সে ভাবে এই সংসার বড্ড পলকা’র মতো। সংসারের সব মান-অভিমান, ভালোবাসা আর বিদ্বেষ সব পলকা বা ভঙ্গুরের ন্যায়। মনে যেমন রাগ, অভিমান আর বিদ্বেষকে কংক্রিটের মতো দানাবেঁধে রাখা যায়না, ঠিক তেমনি এই সংসারের আদর, ভালোবাসা আর প্রেম শক্তভাবে দানা বেঁধে থাকেনা। এই প্রেম সংসার বড্ড পলকার মতো। এখানে কোনকিছুই শক্ত থাকেনা, বড্ড টলে যায় আর দুলে দুলে চলতে থাকে।

লেখক: শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন