দ্রাবিড় সৈকত।। প্রবন্ধ।। শিল্প সাহিত্য ও বাঙালি মনস্তত্ত্বের জারণ-বিজারণ

0

আর্টওয়ার্ক: দিদারুল লিমন

বাংলাদেশে শিল্প-সাহিত্যিক-কবি-বুদ্ধিজীবী-দার্শনিকের শুনেছি কোনকালেই অভাব ছিলনা। এখনো নেই, ভবিষ্যতেও হয়তো অভাব হবে না। এদের রচনা-বুদ্ধি-পরামর্শ-শীৎকারে একটা জমজমাট পরিস্থিতি নগর-শহর-মফস্বল থেকে নদীনালা-খালবিল পেরিয়ে একেবারে অজপাড়াগাঁয়ের মেঠোপথ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎপাদনে বানের জলের মতো ভেসে যাচ্ছে আমাদের সৃজনশীলতার জগত। কিন্তু মানুষ দিনদিন অরুচিশীল উন্মাদে পরিণত হচ্ছে;  মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, বিকৃত, নৈরাজ্যবাদী আর কূপমণ্ডুকতায় ছেয়ে যাচ্ছে পারিপার্শ্বিক সবকিছু। দিনে দিনে পশ্চাদপদতার প্রচণ্ড প্রতিযোগীতায় রীতিমতো হতবাক হয়ে যাবার মতো অবস্থা, তাহলে এই বানের জলে কি কোন গরল আছে? মারাত্মক কোন রুচি সংহারি বিষাক্ত পদার্থ? এতো মানুষ শিল্প-সাহিত্য করছে, পড়ছে, ভোগ-উপভোগে একেবারে গড়াগড়ি খাচ্ছে তাহলে আমরা যাকে কালজয়ী বলে চিহ্নিত করতে পারি এমন কোন রচনার কেন সন্ধান পাচ্ছিনা? মানুষে মানুষে ভেদ-বিসম্বাদ-বিষোদগার বেড়েই চলেছে। আকাশকুসুম আত্মম্ভরিতা আর মূল্যায়িত হওয়ার রগরগে লালসা শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সাংঘাতিক প্রকট আকার ধারন করেছে। এই সুযোগে অনেকেই মূল্যায়নের দোকানও খুলে বসেছেন। বিভিন্ন পুরষ্কার, পদক, উত্তরীয়, সনদ প্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকেরও রমরমা অবস্থা। তো আসল বস্তু কোথায়, যার ওজনে এতো কিছু পাওয়া হয়ে যাচ্ছে? কেন আমাদের বিদগ্ধজন হিসেবে পরিচিতদের আচরণ এমন বিকৃত? এদের অপরিণামদর্শী, অপরিণত, বালখিল্য আচরণের কোন ইয়ত্তা নেই। চিন্তকদের ভাবনাবলয় কেন কুৎসিত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায় ঘুরপাক খাচ্ছে? সৃজনশীলতার মোড়কে কেন বাণিজ্যই প্রধান হয়ে উঠেছে? শিল্প-সাহিত্য যেন এখানে আত্মবিক্রয়ের বিজ্ঞাপনের বাইরে কিছুই নয়, বিজ্ঞাপনে কে কতোটা চমক দিতে পারেন তারই প্রতিযোগীতা চলছে। পৃথিবীব্যাপী ধনতান্ত্রিকতার প্রভাব, ভোগের জয়জয়কারের পরেও তাদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে মহৎ সৃষ্টির উদাহরণ। আর আমরা উচ্ছিষ্টের পেছনে এমন ছুটছি কেনো? কী হয়ে যাবে আমাদের? ভোগ-বাসনার কতটুকু এক জীবনে মানুষ পূরণ করতে পারে?

বাঙলায় কোন শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মি কি বাঙলাকে বুঝেছে? বোঝার অন্তত প্রয়াসটুকু কি কারো আছে? অথবা ইওরোপকেই কি বুঝেছে? কোনো বাঙালির পক্ষে কি চৌদ্দজনমে ইওরোপীয়ান হয়ে ওঠা সম্ভব? কিংবা ইওরোপ কি তাকে সেই স্থানটুকু ছেড়ে দেবে? পশ্চিমের অনুকরণে আমরা উত্তম প্রভূভক্ত কুকুরের বাইরে কিছুই হতে পারবো না, একথাটি বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। বাঙালির কেবলি বাঙালি হওয়া ছাড়া মুক্তি নেই; তবু এই সহজ সমীকরণ কে কোকে বোঝাবে? পূর্ব-পশ্চিম দুই দিকের ধারণা না থাকলে উত্তর-দক্ষিণ তো গোলাবেই। আমাদের সংস্কৃতির মৌলিক প্রবণতা কি? পৃথিবীর অপরাপর সংস্কৃতির সাথে আমাদের সংস্কৃতি-দর্শনের মৌলিক পার্থক্য কোথায়? জল-ভূগোলের নিয়তিকে মানুষ চাইলেই কি অস্বীকার করতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর মোটামুটি একটা জবাব যদি কারো কাছে না থাকে তার পক্ষে সংস্কৃতিকর্মি হিসেবে আমরা যেই খিচুরি আশা করতে পারি, তারা তো সেই নিকৃষ্ট মানের খিচুরিই পয়দা করবেন, করছেনও। বাঙলায় ততদিন পর্যন্ত কোন শিল্পী-কবি-দার্শনিক জন্ম নেবে না যতদিন না এইসব প্রশ্নের সমাধান হয়। এখন আমরা যাদের কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-দার্শনিক হিসেবে আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখি তারা মূলত কিছু মেকি পদার্থ, আক্ষরিক অর্থেই বস্তাপচা কিছু ছাইপাশ প্রসবকারী এবং কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবি-দার্শনিক-সমাজকর্মির মুখোশ পড়া প্রতারক। হ্যাঁ প্রতারক, একেবারে খাঁটি প্রতারক। প্রতারক শব্দটি অনেকের কাছেই আপত্তিকর মনে হতে পারে, আপত্তির জবাবে আমি শুধু বলতে চাই তর্ক নয়, আপনি নিজের মনের কাছে নিভৃতে প্রশ্ন করে দেখুন। আপনি কবি পরিচয়ে, সাহিত্যিক পরিচয়ে, শিল্পী পরিচয়ে, বুদ্ধিজীবি পরিচয়ে আসলে কি চাচ্ছেন? পরিচিতি, খ্যাতি, অর্থের বাইরে আপনার অন্য কোন চাওয়া আছে কি? সমাজের মানুষের কাছে আপনার যে চেহারা উপস্থাপিত আছে তার সাথে আপনার বাস্তবতার মিল আছে কি? যদি থেকে থাকে আপনাকে প্রণাম, কিন্তু আপনার রচনাও কি একই কথা বলার ধৃষ্টতা রাখে? বাঙালি সংস্কৃতির মাতম শুনেছি অনেক, কিন্তু সেই বস্তুটাকে হাতে নাতে পাওয়া হয়ে ওঠেনি এখনো। বাঙলাকে বুঝেছেন এমন লোক এই সময়ে একেবারেই দুর্লভ, কেননা বাঙলা বহু আগেই দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে গেছে, এখন যা পড়ে আছে তা তার পরিত্যাক্ত খোলস, খোলস আকড়ে ধরে অথবা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে যারা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী অভিধা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হয় তারা ভণ্ড অথবা বর্তমান যুগে প্রায় অচল প্রকৃতির নির্বোধ। পরিতাপের বিষয় হলো এই নির্বোধেরাই সমাজে আবার প্রতিপত্তি ও প্রভাববলয় বিস্তার করে এমন একটা ধোঁয়া তুলে রেখেছে যে বিষয়গুলো প্রকৃতপক্ষেই এমন, ফলত বিভ্রান্তিতে পরে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের ভাবুক-চিন্তকের যথাযথ বিকাশের সম্ভাবনা; নতুন প্রজন্ম তাই অনেক কিছু করে ফেলবে এমন লক্ষণও নেই বরং নতুন প্রজন্ম দাসত্বের রজ্জু পড়ার জন্য দ্বিগুন মরিয়া হয়ে ছুটছে পূর্বসুরি উন্মাদদের পেছনে। স্বাভাবিক, সুস্থ, মানবিক, প্রাকৃতিক কোন শিল্প-সাহিত্য-চিন্তা আমাদের সামনে দীর্ঘদিনই অনুপস্থিত। বাঙলা অঞ্চলে তিনটি সুবৃহৎ সাংস্কৃতিক গণহত্যা (হিন্দু-মুসলিম-খ্রীস্টানদের দ্বারা) সংগঠিত হয়েছে। এই সাংস্কৃতিক গণহত্যার পরে আমরা যারা এখনো সংস্কৃতি সংস্কৃতি বলে কিঞ্চিৎ দৌড়ঝাঁপ করছি, তারা কি নিজেদের বোঝার সামর্থ রাখি? আমরা কি জানি কি পড়তে হবে আর কি ধরতে হবে? আমরা কি জানি কোনটি অর্জন আর কোনটি বর্জন করতে হয়? অন্তত আমাদের আচরণে এমন কোন প্রমাণ নেই। আমরা কোথায় চলছি, কেন চলছি, কিভাবে চলছি এর একটি ঠিকুজি রচনা করলে প্রত্যেক সচেতন মানুষই ভিমড়ি খেতে পারেন। কিন্তু সেটিও কি আমরা রচনা করার সামর্থ রাখি? যদি পথ্যের সন্ধানই পাওয়া যেতো তাহলে আর রুগ্ন জীবন যাপনের প্রয়োজন তো থাকে না। তার মানে হলো আমরা আসলেই জানিনা রোগ, পথ্য, বৈদ্য, দাওয়াই কোনকিছুই; তাই আমাদের হাতি দেখা চলছে নিরন্তর। আমরা হাতির সংজ্ঞায়ন করি, হাতির জীবন বীমা করি, হাতির ভবিষ্যত রচনা করি, কিন্তু হাতির বর্ণনায় আমরা কেউ একমত নই। এভাবেই বাঙালি সংস্কৃতি, বাংলা কবিতা, বাঙালির দর্শন, বাংলার জীবন যৌবন উজাড় হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের  প্রত্যেকেই সেমিজ, ইনার, আন্ডারওয়ার, জুতা-জামা-কোর্তা, চুল-পশম-লোমের নীচে কমবেশি লুকিয়ে রেখেছি- থেলিসবার্গারহিপোক্রেটাসপ্লেটোঅগাস্টিনপাস্তাডারউইনফ্রয়েডফ্রাইবেলঅ্যাডামস্মিথদান্তোগ্রিলকান্টহেগেলদেকার্তেপিকাসোলিওতারসস্যুরচিকেনমার্ক্সগ্রামসিনিৎসেদেরিদাপিৎজালাকাফুকোচমস্কিপেপসিবদ্রিলাররোলাবার্থজিজেকিত্যাদি, বিশ্বখ্যাত সকল ব্র্যান্ড ব্যান্ড গায়ক নায়ক কবি শিল্পী দার্শনিক সব। কিন্তু আমরা কি আমাদের জানি? নিজেদের দিকে তাকানোর সময় কি আমাদের আছে? আপনি যতই উদারতার ভেক ধরে থাকেন না কেন, যতই ‘সকলি আমার’ বলে সুর ভাজেন না কেন, যতই বিশ্বায়নের বোকা বোকা ভোক্তা হন না কেন; বুদ্ধিমান বলে পরিচিত পশ্চিমা প্রাণীকুল নিজেরটা বুঝে নিয়ে আপনার পাতে ভাগ বসানোর তালেই এই গান গাইছে। এখানে আমাদের তোমাদের বলে একটি বিষয় আছে; এখন যাকে ‘আদার’ নামে সবাই বেশ চেনে। এই ‘অপর’ আনপড় কারা, কেন, কিভাবে বানায়, এর মেশিনারিজ, কলকব্জা কিভাবে কাজ করে তা কি জানি আমরা? অপর, কাপড়, ফাপড় বলেও কিছু ঘটনা আছে, তাকেও কি চেনার দরকার আছে? নাকি হা করে অন্যের দেয়া বুলি গিলে গুলে খাচ্ছি আর ভাবছি বেশতো উদর পূর্তি হচ্ছে। উদর পূর্তি হচ্ছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, পুষ্টি-পরিপাক কি হচ্ছে? বিশ্বায়নের মহৎ ভাবনায় বুঁদ হয়ে আমাদের বিশ্ব নাগরিক কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-দার্শনিকের সেকি আহ্লাদ! বিশ্ব নাগরিকগণ আপনারা জানেন কি বিশ্ব নাগরিকত্বের নামে আপনি মূলত পশ্চিমা বিশ্বের বিনা পারিশ্রমিকের একজন প্রচারকর্মি এবং সেবাদাস? গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ, হেজিমনি, প্যারাডাইম, ডিকন্সট্রাকশন, ডায়াসপোরা, সিমুলাক্রাঁ, প্লুরালিটি, রাইজোম, সাইবর্গ, আনকনসাশ,  ডিসকোর্সের ধোঁয়ায় আপনার নেশার পরিমাণ জানেন? আপনি এটা জানেন না, কেননা আপনাকে আধুনিকতার পরপরই উত্তরাধুনিকতার পিল খাওয়ানো হয়েছে, আপনার সাথে যৌনকর্মের আনন্দ লাভ করা যাবে কিন্তু বাচ্চা হওয়ার ঝুঁকি নেই এবং দায়দায়িত্ব নেবার প্রসঙ্গ আসে না। সুতরাং আপনি একেবারেই নিরাপদ আনন্দপিণ্ড। তাত্ত্বিকভাবে আপনাকে আনন্দাশ্রয়ীতার অসীম পূণ্যের সাগরে স্নান করার প্রলোভন দেখানো হয়েছে, আপনি ছুটছেন একেবারে দিগম্বর দশায়! নিজের ইজ্জত-আব্রুর দিকে নজর দেয়ায় আপনার সময় কই? চরম প্রতিযোগীতা, আর সময়ও বেশ দ্রুতগতির! আপনি ছুটতে থাকুন। আপনাকে থামাবার সাধ্য আমাদের নেই। আপনার মগজ যারা জলের দরে কিনে নিয়েছেন তাদের মনোবাঞ্জা পূরণ হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনি থামতে পারবেন না, মেশিন নির্মাতা আপনার সুইচটি তার পকেটে রেখে দিয়েছে। আপনি থামতে গেলে আতংকে কুকড়ে যাবেন, কেননা আপনার নীতিবোধ আপনাকে দংশন করবে, কার সাথে বেঈমানি করবেন? প্রভুর সাথে তো আর যাই হোক, বেঈমানি চলে না। বেঈমানি করা যায় বন্ধুর সাথে, প্রতিবেশির সাথে, ভাই-বোন-আত্মীয়-স্বজনের সাথে, মায়ের সাথে, বাবার সাথে; প্রভূর সাথে অবশ্যই নয়।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এখানে হবার বিষয় নয়। এটা অনুবাদ-বিসম্বাদের জায়গা। শিল্প-সাহিত্যের গভীরতার জন্য যে দার্শনিক ভিত্তিভূমি প্রস্তুত থাকা লাগে তা নিঃশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অনেক আগেই, এখন এই জল ভূগোলের যে কোন কিছুকে সন্দেহ করার এক দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত আপামর জনগোষ্ঠী। আপনি একমুখে এখানে কোনো ভাল কথা বলবেন, একশ ক্রুদ্ধ মুখ আপনাকে ছিড়ে খুড়ে খাবে, বিষোদগার করবে, মূর্খ আনপড় বলবে, অযথা আবেগী, যুক্তিহীন ইত্যাদি অসংখ্য অপবাদে আপনার জীবন জর্জরিত হয়ে যাবে, কেননা তাদের বিশ্বায়নজনিত রোগের প্রকোপে, হোয়াইট সুপ্রিমেসির লালা ঝড়ানো স্রোতের তীব্রতায় আপনাকে নিঃশ্চুপ, নিঃশ্চল হয়ে যেতে হবে। ভাষার রাজনীতি, ভাবের রাজনীতি, তাত্ত্বিকতার রাজনীতিতে আপনি যে নকল বাস্তবতায় দিন যাপন করছেন সেখানে আসলকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। ইতিহাসের একরৈখিক পাঠ আপনার মগজকে অবসন্ন করে রেখেছে, সাথে রয়েছে চকচকে জীবনের লোভনীয় অনেক সম্ভাবনার সূত্র, সূত্রধরদের জীবনের তরক্কি আপনার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। সেই পোড়া, পরিত্যাক্ত জীবনের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় আতঙ্কিত এবং অবজ্ঞা-অবহেলা-অপমানে নিঃস্বতার ভার বহন করে লেজ নাড়ানো শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-দার্শনিকের উচ্ছন্নে যাওয়া সমাজচিত্রই বাংলায় প্রতিফলিত হচ্ছে।

সমাজচিন্তকদের মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিলে সর্বত্র তার উৎকট ছাপ প্রকাশ হয়ে পড়ে। সমাজের যে অংশ সৃষ্টিশীল, যারা সমাজকে নানাভাবে প্রলুব্ধ, উদ্বুদ্ধ ও অগ্রগামীতা বা পশ্চাদপদতায় আগ্রহী করে তোলে তাদেরই প্রথম দায় নিতে হবে। যারা অগ্রগামী চিন্তক হিসেবে চিহ্নিত, তাদের আত্মবিনাশী প্ররোচনা সমাজের সার্বিক পেছনে পড়ে থাকারই দলিল। একজন সৃজনশীল মানুষ আজ যা চিন্তা করছে ভবিষ্যতের আপামর জনতা তাকে অনুসরণ করবে, এই বোধটুকু সংস্কৃতিকর্মিদের আছে কি? তারা কি জানেন শিল্পের ক্ষমতা সম্পর্কে? না কি অভ্যাস বশত যাচ্ছেতাই উৎপাদন করে যাচ্ছেন? নিজের চেহারা দেখার মতো দায়িত্বশীলতাটুকু ভুলে যাওয়া সময়ের বাংলাদেশে আমরা বসবাস করছি। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো দায়িত্ব বিষয়ে কথা বলতে গেলে আপনি একঘরে হয়ে যাবেন, আপনার অসংখ্য শত্রু চারপাশে ঘেউ ঘেউ করতে থাকবে। কেননা দায়িত্বের প্রসঙ্গ এলে তার ঠুনকো শিল্পী সত্তাই হুমকির মুখে পড়বে, তার জানা শোনার স্তর নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হবে, তার বোঝাপড়ার প্রেক্ষিত নিয়ে কথা উঠবে, তার রচনার ধরন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে, সুতরাং মেকি মালগুলো বাজারে টিকতে পারবেনা, আপনার শিকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হবে, আপনাকে বলা হবে আপনি কে এসব প্রশ্ন তোলার? আর যেহেতু তাদের সংখ্যা বেশি সুতরাং আপনাকেই গায়েব করে দেবার সম্ভাবনা বেশি। যদি আপনার খুটির জোড় থাকে, আপনাকে গায়েব করে দিতে না পারে, তাহলে আপনাকে অন্তত ব্যাকডেটেট প্রমাণ করে ছাড়বে, তাদের হাতে আছে পশ্চিমা জ্ঞানের অসংখ্য গলিগুপচির সন্ধান, যেখানে আপনাকে অতি সহজেই বিবিধ ভেলকির প্রবঞ্চনায় চেতনাহীন করে দেয়ার কৌশলও সহজলভ্য; গলা বাড়ানোর অভ্যেস যাদের সাম্প্রতিক অতীতে দেখেছি তাদের অনেকেই এখন জিন্দালাশ হয়ে ঘুরে বেড়ান। আমাদের সাংস্কৃতি জগত এখন পুরোটাই এমন অজ্ঞান পার্টির দখলে, আপনি হয় দলে যোগ দিয়ে বখরা নিবেন, অন্যথায় চোখেমুখে অসম্ভব জ্বালা-যন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালে কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুর প্রহর গুনবেন। কাজেই এখান শিল্প-সাহিত্য হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। যা আছে তা সেই চর্বিত চর্বন, কুমিরের ছানার মতো শেয়ালের পাঠশালায় একই চেহারার অগণিত বিদ্যার্থী।

বাঙলা ভাষায় যারা লিখেন, যারা বাঙলায় ভাবেন এবং বাঙলার অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত তাদের আরো একবার ভাবতে বসা উচিত, আপনি এসব জঞ্জাল আরো সৃষ্টি করবেন না জাতিকে একটু মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে দিবেন। যদি আপনার একান্তই বদভ্যাস হয়ে গিয়ে থাকে যে, কিছুতেই ছাড়তে পারবেন না। তাহলে অন্তত বাঙলার দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন, তবে ঔপনিবেশিক চশমা খুলে চোখে একটু জলের ঝাপটা দিয়ে বাঙলার দিকে তাকাতে ভুলবেন না মশাই।

লেখক: দ্রাবিড় সৈকত। শিক্ষক, কবি ও গবেষক।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন