জাফর জয়নাল।। গল্প।। একজন অশোক

0

আর্টওয়ার্ক: দিদারুল লিমন।

নিধীরগঞ্জে এখন শীতকাল। গাছের পাতা ঝরে পড়ছে, কোথাও কোথাও নতুন নতুন পাতা গজাচ্ছে। এখানে বসবাস করেন এক কবি। তার নাম অশোক দাশ গুপ্ত। তাকে নিয়েই এই ‘একজন অশোক’ গল্পের যাত্রা শুরু। কবি চিঠি লিখছে তার এক কাছে বড় দাদার কাছে।

শ্রীচরণ কমলেষু,

আশা করি কুশলেই রয়েছেন। আমার এখানে রাত বাড়লে শীতও বাড়ে। অনেক দিন যাবৎ আপনার কোনো পত্র নাই! আমার অবসর কাটছে না। আজ ক’দিন ধরে শরীর ভালো যাচ্ছে না। শহরের দিকে গিয়ে ঘুরে আসা যায় কিন্তু দিনের বেলা একদম সময় পাই না। বিকেলে নরেন আসে, কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিয়ে যায়। সকালে আসতে পারে না। এখানে কাজের লোকের দারুণ অভাব। স্থানীয় লোকজনের ভাষা একদমই বুঝতে পারি না। যদিও তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে। পান এদের প্রিয় খাদ্য বলে মনে হয়, অনিমেষ দা। কাল তোমার দেওয়া নীল রঙের সোয়েটারটা পড়ে বাইরে বের হয়েছিলাম। বেশ ওম আছে তাতে। সময় করে চিঠি দিও।

তোমার আদরের

অশোক দাশ গুপ্ত

৩৬ লেন বাবু বাজার, নিধীরগঞ্জ

চিঠি পোস্ট করতে যেতে হবে শহরে, নিধীরগঞ্জ পোস্ট অফিস বাজারের পাশে, সেখানে সপ্তাহে দুই দিন হাট বসে, বৃহস্পতি এবং শনিবার। আজ বৃহস্পতিবার, হাটে লোকের ভীড় যথেষ্ট। রিক্সা, ভ্যান, প্রচুর মানুষের ঠেলা-ঠেলিতেও দিব্যি সব কিছু চলছে, কেউ কেউ পাকা কলার দর দাম করছে, সেই সঙ্গে বাতাসা-ঝুড়ির মিষ্টি ব্যাচা-বিক্রি ভালোই চলছে। কবি অশোক পাঁচ হালি কলা কিনলো, বাজারে রোজ রোজ আসার সুযোগ নেই, তাই যতটা পারে বাজার সারলো।

চিঠি পোস্ট করা হলো, সঙ্গে কয়েকটা এনভেলাপ, ডাকটিকিট কেনার পর। ভ্যানে চেপে বসলেন। ভ্যানে চলাচল বেশ অনিরাপদ তবু এই অঞ্চলের মানুষজন কেমন করে যেন মানিয়েছে এর সঙ্গে। ভাঙা রাস্তা, ভ্যানে চেপে বসার পর, বাবা লোকনাথের নাম নিতে নিতে চলতে হয়। নিধীরগঞ্জের পাশেই যে গ্রাম তার নাম কাশিগঞ্জ। সেই গ্রাম থেকেই আসে কত লোক! এই রাস্তা দিয়েই। সেখানে ভালো বেগুন হয় বলে শোনা যায়, তাই বিক্রি করতে আসে বৃহস্পতি আর শনিবার। নরেনের বাড়ি কাশিগঞ্জ। নরেনের মুখেই এসব শোনা কথা। কতটা সত্য কিংবা মিথ্যা যাচাই করে দেখা হয়নি। এত কম সময়ে এতকিছু আসলে জানাও যায় না। মানুষ আর মানুষের আচার ব্যবহার বাইরে থেকে দেখে অনুমান করলে বেশিরভাগ সময়ই ভুল হয়। তারপরও আমরা অনুমানের ভিতর দিয়েই চলি, কারণ দুজন মানুষের ভিতর যে বিষয়টি খুব সহজে ঘটে যাওয়া সহজ তা হলো, ভুল বোঝা। এসব ভুলের ভিতর দিয়েই আমাদের মানব সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো অশোকের। নরেন রান্না চাপিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অশোককে দেখেই হাসি মুখে এলো। বলল- দাদাবাবু সন্ধ্যায় কীর্তন হবে, দূর্গামন্দিরে যাবেন?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হতে হলো, ‘যাবো, আমাকে নিয়ে যেও। হেডমাস্টার মশাইও অবশ্য যেতে বলেছিলেন।’

তখন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক চারিদিক মুখরিত করে দিয়েছে। বাতাস কেমন যেন বিষন্ন হয়ে আছে, উৎকর্ণ হয়ে থাকলে কিছুটা বোঝা যায়। অশোকের পাশে পাশে হাঁটছে নরেন। কিছুক্ষণ পর পর নীরবতা ভেঙে দিয়ে নরেন কথা বলে উঠছে। তাতে বোঝা যায় তারা দুটি মানুষ পথ চলছে, সামনে তেমন কেউ নেই। নরেনের স্বাস্থ্য ভালো, গোলগাল মুখের গড়ন, অনেকটা- গণেশ ঠাকুরের মত। সে হাঁটছে কচ্ছপের গতিতে। মনে হচ্ছে যেন, এ হাঁটা শেষ হবে না, অন্ততকাল ধরে।

নিধীরগঞ্জ আদর্শ বিদ্যাকুঞ্জের পাশেই খগেন কুমারের বাড়ি। তিনিই এই স্কুলের প্রধান পণ্ডিত, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। নিজেই চাষবাস করে, নিজের জমিতে, কামলা জুটিয়ে আনে দু’গ্রাম ঘুরে। তার বাড়িতেই দূর্গামন্দির। অশোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে গ্রামের অল্প কিছু মানুষের আগমন ঘটেছে মন্দিরে, ফাঁকা জায়গায় সামিয়ানা টানানো হয়েছে। মহিলা পুরুষ নিবিড় শেষে বসেছে তাতে; কেউ কেউ চাদর মুড়িয়ে শীত কমানোর চেষ্টা করছে।

এক কীর্তনীয়া গান ধরেছে-

আমার শ্যাম যদি হইতো মাথার কেশ...
হাতে দর্পণ ধরি, রূপ নিহারি পুরাইতাম মনের খায়েশ…

খগেন মাস্টার বেরিয়ে এলেন আঙিনায়, পরনে সাদা রঙের ধুতি এবং সাদা পাঞ্জাবির ওপরে সোনালি রঙের কটি, তার ওপর ঘিয়া রঙের চাদর, পায়ে উলের মৌজার সঙ্গে চকলেট রঙের জুতা। চুল সিঁথি করেছেন পেছনের দিকে, কপাল প্রশস্ত হতে হতে পৌঁছে গেছে মাথার অর্ধেক পর্যন্ত, বাকি চুলগুলো হয়ে উঠেছে সোনালি পাটের আঁশের মত, ছোট করে কাটা কাঁচা-পাকা গোঁফ; বোঝা যায় বয়স হয়েছে, কিন্তু মনের বয়স এখন বাড়েনি। অতি সজ্জন এই লোককে বোঝা যায় না বাইরে থেকে, কারণ বাইরে তিনি গম্ভীর প্রকৃতির। কোন এক মাঝ সকালে তিনি অশোকের সঙ্গে স্কুলের মাঠে শীতের পাতা শুকানো রোদে আলাপ করছিলেন নিজের অতীত আর বর্তমান নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে তার তেমন কোন ভাবনা নেই জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তখন সাংবাদিকতা করি, সঙ্গে রাজনীতি করে বেড়াই, তখনকার ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, বিয়ে করবো, বউ খুঁজে পাওয়া গেলো। বিয়েতে বউও পেলাম, সঙ্গে পেলাম তখনকার দিনে অতি মূল্যবান একখানা ক্যামেরা। বিয়ের কিছু দিন পর এলো মুক্তিযুদ্ধ।’ মুক্তিযুদ্ধের কথা আসতেই অশোক নড়ে-চড়ে বসলো, জানতে চাইলো, খগেন মাস্টারের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। কেমন ছিলো তাঁর নিজের মুক্তিযুদ্ধ?

‘আমি তখন সাংবাদিকতা করি আর রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ওষুধ বিতরণের কাজ করে বেড়াই। ছবি তুলি মুক্তিযোদ্ধাদের, যাকে বলে সম্মুখ সমর তেমনটা আমার হয়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি, তখনকার সোনাদিয়ার ডিসি’র সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে আলাপের নানান ঘটনা আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে, বলতে পারো।’ মুখে পান নিতে নিতে বলেছিলেন, খগেন মাস্টার।

এমন অনেক কথা বলে তার সঙ্গে, যেন অতি আপনজন। অশোকের সঙ্গে দেখা হলেই বলে, ফিরোজ বসো। অশোক বিব্রত হয়, এভাবে যে, এই ফিরোজটা আবার কে! পরে একদিন নরেনের কাছে জেনে নেয়া যাবে, এই ভেবে সে বিষয়ে ইস্তফা দেয়।

আঙিনায় পাতানো তিনখানা চেয়ার, একটায় বসলো খগেন মাস্টার অন্যটায় অশোক, অশোকের পাশে জায়গা হলো, গণিতের শিক্ষক তাইজুল হোসেনের। তাইজুল হোসেন গণিতের শিক্ষক হলেও অতি সরেস মানুষ। গানের আসর শুরু হলো। একের পর এক গান চললো। সবই ভক্তিমূলক গান, তাতে হালকা প্রেমের ছোঁয়াও আছে বটে। গানের সময় হেড মাস্টার মাঝে মাঝে মাথা দুলিয়ে, হাত তালি দিয়ে আসর জমাচ্ছেন, অশোকের বড় ভালো লাগলো। এমন হেড মাস্টার যে নিধীরগঞ্জে এসে পাওয়া যাবে তা সে ভাবেনি। ভক্তি গানের বাইরে গাওয়া হলো একটি অন্যরকম সহজ গান। যা অশোকের মনে গেঁথে গেলো। এক-এক দিন এমন হয়। সারাদিন ধরে একটি গানের সুর এবং কথা মনের ভিতর ভোমরের মত ঘুরতে থাকে। গোসলখানার জলের শব্দের ভিতর, ক্লাস নেওয়ার সময় একের পর এক কথা বলার পরও সেই সুর অনুরণন তুলতেই থাকে। গভীর ভাবে সেই ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। বোঝানোর ভাষা নেই সেই অনুভূতির কথা। সে গানের কথা এবং সুর অন্য গানের কথাকে আর তার কাছে আসতে দেয় না। এভাবে কয়েকদিন যায়, সেই গান পুরনো হয়ে আসে এক সময়, তখন নতুন কোনো বিষয় এবং ঘটনা অথবা শারীরিক কোন যাতনা সেই স্থান অধিকার করে নেয়। সারাক্ষণ কানে বাজে-

... দিন হতে দিন আসে যে কঠিন 
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম…

একসময় গান শেষ হয়ে এলো, আসর ভেঙে গেলো। তখন ফেরার পালা, নরেন আর অশোক হাঁটতে শুরু করেছে আবার, ঘন কুয়াশার ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসছে দুই জন মানুষ।

আলো আর আঁধারের আলাদা অস্তিত্ব আছে বলেই হয়ত, দিন এবং রাতের ভিতর এত বৈচিত্র্য দেখা যায়। জানুযারি মাসের রাতে নিধীরগঞ্জের মানুষগুলো ঘুমিয়ে পড়ে অতি তাড়াতাড়ি। রাস্তার পাশে জমসেদ চাচার একটা চায়ের দোকান আছে, তিনি সচারচর অনেক সন্ধ্যার পর পরই দোকান বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন। তার বাড়ি-ঘর নাই। বাড়ি আর ঘর বলতে তার এই অতি সামান্য চায়ের দোকান। দোকানের পাশেই ছোট একটা ছাপড়াঘর। দিনে এখানেই দু-একজন মুসলিম আসে নামাজের জন্য। রাতে তিনি এই ছাপড়াতেই থাকেন। ছাপড়ার পাশে গতকাল একটি অশ্বথ গাছের চারা মাটিতে পুঁতে দিয়েছেন। একদিন এই গাছকে ঘিরেই হয়ত এখানে গড়ে উঠবে নতুন নতুন দোকানপাট। কাশিগঞ্জের মুরব্বিদের কাছে এমন কত গল্পই না, জমসেদ চাচা ছোট বেলায় শুনে আসছেন, তার কতকটা তার মনের ভিতর আশা জাগিয়েছে, এই নিধীরগঞ্জও একদিন তাকে না চিনুক তার অশ্বথ গাছকে ঠিকই চিনে নেবে। এমনই তো হয়ে আসছে চিরকাল। মানুষ যায় মানুষ আসে কিন্তু তাদের নেক কাজ থেকে যায়। গোজনিখোলার হাটে সেবার জিলাপি বিক্রি করতে গিয়ে হুজুরের ওয়াজ শুনেছিল, নবীজি বলেছেন,‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষরোপণ করে আর ফলদার হওয়া নাগাদ তার দেখাশোনা করে, তার প্রতিটি ফলের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে সদকার সওয়াব দেবেন।’ জমশেদ আলীর মৃত্যু ভীতি একসময় প্রবল ছিল, এখন একা থাকতে থাকতে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চা খেতে কেউ এলে বলেন, বড়ই নিষ্ঠুর এই দুনিয়া ভাইসাব। চক্ষু বুজিলেই দুনিয়া অন্ধকার।’

অশোক এবং নরেন কিছুদূর পথ হেঁটে দেখতে পেল জমশেদের দোকানে টিমটিম করে হারিকেনের আলো জ্বলছে। তাতে বোঝা যায় জমশেদ চাচা মিঞার দোকান এ মাঝ রাত অবধি খোলাই আছে। তাহলে এক কাপ চা অন্তত রাতে পেটে চালান করা প্রয়োজন রয়েছে। দোকানের এক পা ভাঙা বেঞ্চে গিয়ে বসলো নরেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে কবি অশোক, তার মনে হলো, পৃথিবী বড়ই সুন্দর রাতের বেলায়, কিন্তু আমরা তো দিনের সৌন্দর্য উপভোগ করেই শেষ করতে পারিনি। 

আজকের সকালটা অন্যদিনের সকালের মত না, রোদ করেছে বেশ, কাক ডেকেই যাচ্ছে। কা-কা,কা-কা,কা-কা…, নরেন বিরক্তিভরে বলে যাচ্ছে, ওরে ব্যাটা সারাদিন শুধু কা-কা করলে চলবে! একবার অত্যন্ত ভাতিজা তো ক’। অশোকের মাত্রই ঘুম ভেঙেছে, গতকাল রাতে বিলম্বে ঘুম হয়েছে। আজ যেহেতু স্কুল নেই, ছুটির দিন। তাই এই বেলা করে জেগে ওঠার প্রয়াস। তাছাড়া শীতের দীর্ঘ রাতে বহুবার তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম নাকি মৃত্যুর আর এক রূপ, চিরকালীন ঘুম একবারে মৃত্যু। মৃত্যুর পরে জীবন কেমন, কীভাবে তার শুরু এবং শেষ, তা নিয়ে অশোকের ভাবনার অন্ত নাই। নরেন এসে ঘরের দরজার কাছে দাঁড়ালো, দাদাবাবু, মালঞ্চ এসেছে। মালঞ্চ এই পাড়ার ঘোষ বাড়ির মেয়ে, সে জানতে এসেছে- ‘আপনি আজ তাদের বাড়িতে নেমন্তন্নে যাবেন কি না।’ গায়ে চাদর জড়াতে জড়াতে বাইরে এসে দেখলো, মালঞ্চ নামের যে মেয়েটির কথা, এতক্ষণ নরেন বলছিল সে দাঁড়িয়ে আছে কাঁঠালতলার নিচে, বয়স হবে হয়তো সাত থেকে আট বছর। অশোক বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে বললো, ‘আচ্ছা, দুপুরে তোমাদের বাড়িতে খেয়ে নেবো, তোমার বাবাকে জানিয়ে দিও।’

‘আচ্ছা, আসবেন কিন্তু। বাবা মশায় আসতে বলেছেন।’ চিৎকারে বলে গেলো মেয়েটা। বোঝার উপায় নেই এই অঞ্চলের মানুষদের। না, যেতে চাইলে হয়তো, টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার পাঠিয়ে দেবে, এমন বিচিত্র ঘটনা, এখানে আসার বহু আগে থেকেই তার প্রত্যক্ষ করার অভ্যেস আছে। কোন কোন অভিভাবক আছে, কথাই বলতে চায়না, কাউকে আবার আটকে রাখা যায় না, কথা তিনি বিরামহীন ভাবে বলেই যাবে, তখন নীরব হয়ে শোনা ছাড়া উপায় থাকে না।

মানুষ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজেকে কিন্তু সেই নিজের সঙ্গেই তার দেখা হয় খুব কম সময়। সারাদিন সে কত মানুষই না দেখে, কত শহর, ইমারত, গাড়ি কিংবা বৃক্ষ। সব কিছুর পরিবর্তন ঘটছে, তার কিছুটা হলেও সে বুঝতে পারে অথবা বুঝতে চেষ্টা করে, শুধু নিজের বিষয়ে নিজেকে তার একধরনের অজানায় থেকে যেতে হয়। শীত চলে গিয়ে যে বসন্ত আসবে, তারপর আবার সেই তাপদাহ ফিরবে তা সে বুঝতে পারে বাকি শুধু থাকে নিজেকে বোঝা।

দর্পণে অশোক নিজেকে দেখছে, ছোট করে কাটা চুল, উচু নাসিকা, বাদামি রঙের চক্ষু, যেন দিগন্ত বিস্তারী তার ভাষা। বয়সের ভার মুখের ওপর এসে পড়েছে, খানিকটা গম্ভীর সে মুখ, কর্ণের পাশে হালকা একটা কালো বিন্দুসম তিল। মা বলতেন, কখনো হারিয়ে গেলে, আমার অশোককে আমি এই তিল দেখেই চিনে ফেলবো। সে মায়ের সঙ্গে অশোকের দেখা হয় না, চার মাস হয়ে এলো। চিঠিপত্রেই হয় যোগাযোগ। দুইদিন পর পর অশোক মায়ের কাছে চিঠি লেখে। সে চিঠিতে স্মৃতিচারণই বেশি থাকে, মা জানায় ভাইদের কথা, বোনদের কথা। তারা কেমন আছে, ভালো আছে কিংবা মন্দ আছে তার বিশদ বিবরণ। মায়ের মন বলে তো কথা!

অশোককে বসতে দেওয়া হয়েছে, চৌকির ওপর, পাশে বসেছেন এই বাড়ির কর্তা অমল ঘোষ। অমল ঘোষ পেশায় মাস্টারি করেন, সে সুবাদে অশোকের সঙ্গে তার খাতির। অশোকের সঙ্গে পরিচয় কয়েকদিনের, তাতেই বেশ ভাব হয়েছে। অমল ঘোষ বিরামপুর হাই স্কুলের হেড মাস্টার। কিন্তু থাকে নিধীরগঞ্জে। চার মাইল সাইকেল চালিয়ে গিয়ে স্কুল করে আসে।

চৌকিতে খাবার পাতা হয়েছে, ম্যাওয়া পিঠা, দুধ চিতোই, ক্ষির। খাবার দিয়ে গেছে, অমল ঘোষের বড় কন্যা, মোহনা। মোহনা দেখতে- দুধে আলতা গায়ের রঙ, দীঘল কালো চুল, ঠিক যেন দেবী দূর্গা মর্তে নেমে এসেছে। লোকমুখে শোনা যায় অমল ঘোষের এই কন্যার বয়স নাকি কুড়ি ছুঁই ছুঁই করছে, তাতে কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার তেমন কোনো চিন্তার চিহ্ন দেখা যায় না। কন্যা কলেজ যায়-আসে, তাতে এই অজপাড়া গাঁয়ের কারো তেমন কোনো বিকার হওয়ার কথা না, কিন্তু তাতে তো চলে না, কারো না কারো সমস্যা হওয়া উচিত, সেই সূত্রেই গাঁয়ের মোড়লদের মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। যাক সে সব কথা। খেতে খেতে অশোক কিছুটা আলাপ করল, সেসব কথা সাংসারিক কথা নয়। সেসব কথা বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার নিয়ে, শোনা যাচ্ছে, কোয়ান্টাম ফিজিক্সে সময়ের ধারণা নাকি বদলে দিচ্ছে। সময়ের ধারণা আবার কিভাবে বদলে যায়! সেই নিয়ে আলাপ হচ্ছে, এসব বিষয়ে অমল ঘোষ তার মেয়ে মোহনার কাছেও কিছুটা শুনেছে, আজ শুনলো অশোকের কাছে। বিজ্ঞান মানুষের জীবনকে সুন্দর করেছে, কিন্তু বিজ্ঞানের বিষয়ে জানা শোনার মত সুযোগ তো নিধীরগঞ্জে নেই। আর তাছাড়া ছেলেমেয়েরা দিন দিন বিজ্ঞান পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, ভালো শিক্ষকের কিছু অভাবও আছে বটে। কিন্তু পাঠ্য বই দিয়ে তো আর বিজ্ঞান মনস্ক সমাজ গড়া যায় না। চাই প্রতিদিনকার চর্চা, জীবন চর্চায় সঙ্গে মিশে যাবে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো। কই তেমন তো দেখা যাচ্ছে না, আজকাল। মনে মনে ভাবে অমল ঘোষ, তাহলে এই ছেলেটা কিছুটা হলেও আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছে! তার বেশ ভালো লাগলো।

একটু পর চা আসলো, আঙিনায় দুটো চেয়ার পাতা, কথা বলছে অশোক। বেশ আগ্রহ নিয়ে সেসব শুনছে, অমল ঘোষ। মাঝে মাঝে নিজেও দু-চার বিষয় নিয়ে কথা বলছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মালঞ্চ আর তার দিদি মোহনা কি নিয়ে যেন নিজেরা কথা বলছে, স্পষ্ট শোনা যায় না। কিছুক্ষণ পর তাদের মা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। হাতে কাঁসার পানের বাটা, ওপরে সাজানো কয়েক খিলি পান।

অনেক আলাপ হয়ে হলো আজ, অশোক বললো, আজ আসি। তাতে সকলেই বেঁকে বসলেন, রাতের খাবারটা অত্যন্ত খেয়ে যেতে হবে। ইলিশ মাছ রান্না করা হচ্ছে, ইলিশ মাছের সঙ্গে পুঁইশাকের পাতলা করে ঝোল। বেশ স্বাদের হয়, কতদিন যে এই খাবারের স্বাদ জিভে লেগে আছে, বলে বোঝাতে পারবে না সে। এই ইলিশের অমৃত স্বাদ নেওয়ার জন্য রাতের খাবার খেয়ে তবেই ফিরলো অশোক। আসার পথে নানা চিন্তা অশোকের মাথায় আসে, অনেকগুলি চিঠি জমা হয়েছে, কোনো জবাব দেওয়া হচ্ছে না। তেমন কোনো কাজ নেই, তারপরও জবাব দিচ্ছি, দেবো করে অনেক দিন চলে যাচ্ছে। চিঠিতে খবর পাওয়া যায় কে মারা গেলো, কার বাচ্চার জন্ম হলো। ছোটবেলায় অশোককে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে যে পিসি, সেই পিসি এই শীতেই মারা গিয়েছে। দারিদ্র এই পিসি’র বিয়ে হয়নি, দেখতে তেমন উজ্জ্বল ছিলেন না বলেই শুধু তার বিয়ে হয়নি এমন না। পিসি’র বাবা মারা যাওয়ার পর দাদারা কেউই তার বিয়ের ব্যবস্থা করেনি, যে যার মত নিজেকে নিয়ে স্বার্থপরের মত আলাদা হয়ে গেছে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে তার জীবন চলত, পূজা-পার্বণে দেখা হলে পিসি’র হাতে কিছু টাকা দেয়া ছিল মা’র নির্দেশ, দেশে থাকতে অশোক তা করে গেছে। দূরসম্পর্কের এই পিসি’র কথা ভাবলেই অশোকের চোখ জলে ভরে ওঠে। মা এই পিসিকে বছর বছর পূজায় নতুন কাপড় কিনে দিতেন, আর বলতেন, অশোক বড় চাকরি পেলে তোর জন্য নিশ্চয় সে টাকা পাঠাবে, তখন তোর অভাব কমে যাবে রে, তুই কতই না কোলে পিঠে করে আমার অশোককে মানুষ করেছিস। এক সময় সবকিছু নীরব হয়ে আসবে, এটাই নিয়তি। পিসিও নীবর হয়ে গেলো অশোকের জীবন থেকে।

নীরবতার যে একটা আলাদা অর্থ আছে, তা বেশি ভাগ মানুষই বুঝতে পারে না। বিশাল সাগরের বুকে যে নাবিক থাকে সে যেভাবে নীবরতা কে উপলব্ধি করে, নির্জন পথে একাকী যে পথিক তার যে নীরবতার অর্থ তা নিশ্চয় এক হবে না, কিন্তু এমন নির্জনতা ক’জনই বা পায়?

কারো কাছে থেকেও দূরে থাকে মানুষ। জাগতিক সব রহস্য মানুষ বুঝে গেলে জীবন আর জীবন থাকে না। ঘরে ফিরতে রাত ১০টা বেজে গেলো। শীতের রাত দীর্ঘ হয়, বারবার ঘুম ভাঙে।

হঠাৎ ঘুম ভাঙলো অশোকের, তখন রাত ৩ টার কাছাকাছি। নিষ্প্রভ একটা রাত, খেয়ালী বাতাস বইছে, বারান্দায়। মানুষের নানামুখী চাহিদার জন্য, মানুষ তার স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ হারিয়ে ফেলে, মানুষ নিজেও জানে না, আসলে তার এই জীবনের আসল উদ্দেশ্য কী। কোন সে এক মহাশূন্যতা তাকে নিয়ে খেলায় মেতে রয়েছে। বিশ্ব চরাচরে এই যে মানুষের জীবন আর মৃত্যুর খেলা- সে প্রত্যহ খেয়াল করে, তারই বা কী উত্তর হতে পারে! লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এই যে মানুষের আসা-যাওয়া, তারই বা রহস্যটা কী? কে তার স্রষ্টা, তিনিই বা কেমন। এমন প্রশ্ন অশোকের মনে এই মাঝ রাতের আকাশের দিকে চেয়ে মনে হলো। আকাশ ভরা জোছনা-তারা, আলো ছড়াচ্ছে। কেমন যেন আকীর্ণ এখানকার জীবন, কেমন যেন ম্রিয়মাণ। এখান থেকে বদলি নেওয়াটা জরুরি, এখানে তার আর মোটেই ভালো লাগছে না। কিন্তু এখানে তো অত্যন্ত একটি বছর থাকতেই হবে। চাকরির নিয়ম। নাকি চাকরি ছেড়ে দেবে সে? এখানে যে মানুষ ও প্রকৃতি তাতো তাকে আর টানে না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে তার। তবে সে যাবে কোথায়! কলকাতায়? সেও কী সম্ভব! সেখানে তার কেউ নেই, সেখান মানুষজনই বা কেমন। তার চেয়ে তার জন্য সহজ হবে, ঢাকায় চলে যাওয়া কিন্তু সেখানে গিয়ে সে কী করবে। সে পারে বলতে একটি মাত্র কাজ, মাস্টারি করা আর লেখালেখি। মাস্টারি করা বিষয়ে তার হৃদয় বহু আগেই বিষিয়ে গিয়েছে, এখন বরং, তার জন্য ঢাকায় কোন একটা পত্রিকায় চাকরি জুটিয়ে নেওয়াই ভালো হবে। অনিমেষ দাদা কে কাল একটা চিঠি লিখে জানানো প্রয়োজন …

চিঠি লেখার এক সপ্তাহ পর।

ক্রমেই সকাল হয়ে এলো, সূর্য-উদয়ের ভিতর দিয়ে রঙিন হলো আকাশ। সকালের আলোয় অশোক বেরিয়ে পড়েছে। গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে সে যাত্রা, নিতান্ত যাত্রা নয়! সে যাত্রা জীবনের প্রয়োজনে। জীবনে এভাবে কত নগর, কত শহরই না মানুষকে বদলাতে হয়, এই ছোট্ট জীবনে, অথচ জীবন কত ছোট!

লেখক: গল্পকার, অনুবাদক ও শিক্ষার্থী। জাককানইবি।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন