জর্জ বার্নার্ড শ’।। দি মিরাকিউলাস রিভেঞ্জ।। অনুবাদ: নাহিদুল ইসলাম

0

ছবি: সংগৃহীত।

লেখজক পরিচিতি: জর্জ বার্নার্ড শ মূলত সাহিত্য সমালোচনার মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা শুরু করলেও তার প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে নাটকে। শিক্ষা, বিয়ে, ধর্ম, সরকার, স্বাস্থ্যসেবা, শ্রেণীসুবিধা, রাজনীতি, কূটনীতি ইত্যাকার সামাজিক বিষয়বস্তু নিয়ে সরসতাপূর্ণ রচনাশৈলী তার রচনায় শ্রমজীবী মানুষের কন্ঠস্বরের পক্ষেই তার সুস্পষ্ট অবস্থাানকে প্রকাশ করে। জনসম্মুখে অদ্ভুত খামখেয়ালিপূর্ণ এবং বিদ্রোহমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্বের আড়ম্বরহীন প্রকাশ তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ১৯২৫ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এমনকি নোবেল প্রাপ্তির সংবাদে তিনি উদাসীন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। ১৮৫৬ সালে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে জর্জ বার্নার্ড শ’ এর জন্ম এবং ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ডের আয়ট এস্টি লরেন্সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

অনুবাদ:
৫ আগস্ট বিকেলে ডাবলিনে পৌঁছে আমি সেখানকার গীর্জার প্রধান যাজক আমার মামার বাসভবনে হাজির হলাম। আমার পরিবারের অধিকাংশের মতই তিনি ছিলেন বোধহীন একজন মানুষ এবং একারনেই ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রতি তিনি ছিলেন নিরুত্তাপ। একটা মলিন বাড়িতে থাকেন তিনি, যার সামনের জানালা দিয়ে গীর্জার একদিকের দীর্ঘ বারান্দার দৃশ্য এবং পেছন দিকে একটা দৈত্যাকার সরকারি বিদ্যালয় দেখা যায়। আমার মামা কোন লোকলস্কর পোষেন না। মানুষ ভাবে, দেবদূতেরাই তার দেখভাল করে। আমি যখন মামার দরজায় কড়া নাড়লাম, তার একমাত্র চাকর, একজন বৃদ্ধ মহিলা, দরজা খুলে দিল এবং জানাল, মামা গীর্জায় কাজ করছেন কিন্ত তার অনুপস্থিতিতে আমার জন্য রাতের খাবার তৈরির নির্দেশ দিয়ে গেছেন। একটা উট্কো নোনা মাছের গন্ধে আমি খাবারের নাম জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম। সে জানাল, একজন পবিত্র পাদ্রীর বাড়িতে শুক্রবারে যা কিছু রান্না করা অনুমিত, সেসবই করা হয়েছে। শুক্রবারেই এসব রান্নার বিশেষত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে সে জবাব দিল, শুক্রবারই হচ্ছে প্রথম দিন। আমি পবিত্র পাদ্রীকে একথা জানাতে বলে বেরিয়ে এলাম যে, আমি শুধু তার সাথে দেখা করার জন্যই এসেছিলাম। আমি স্যাকভ্যালি স্ট্রিটে আমার হোটেল এপার্টমেন্টে ফিরে রাতের খাবার শেষ করলাম।
খাবার শেষে আমি পুনরায় আমার চিরায়ত অনুসন্ধানে নামলাম। আমি জানিনা কেন এটা আমাকে আগাগোড়া একটা শেকলের মত চালিত করে। আমি ব্যর্থভাবে রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম। আমি নাট্যশালায় গেলাম, সঙ্গিতটি ছিল জঘন্য আর দৃশ্যগুলো দুর্বল। এই নাটকটি আমি একমাস আগেও লন্ডনে দেখেছিলাম, সেখানেও মূল ভূমিকায় একই সুন্দরী শিল্পী অভিনয় করেছিল। দুবছর পেরিয়ে গেছে, তাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, ভেবেছিলাম যে এ-ই হচ্ছে আমার সেই কাঙ্খিত রহস্য যাকে দীর্ঘ সময় ধরে আমি খুঁজেছি। কিন্ত সেটা মিথ্যা প্রমানিত হয়েছিল। আজকের রাতে আমি তার কথা শুনলাম, সেই একই অতিক্রান্ত আশা নিয়ে তাকে দেখলাম এবং পর্দা নেমে গেলে তার উচ্ছসিত প্রশংসাও করলাম। কিন্ত তবুও আমি একাকীই রয়ে গেলাম। এমনকি যখন আমি একটা রেস্তোরায় বসে স্যুপ খেলাম, হোটেলে ফিরে এলাম এবং পড়তে চেষ্টা করলাম, তখনও। ব্যর্থ হলাম। ঘুমানোর জন্য ফিরে আসা বাসিন্দাদের করিডোর ধরে হাটার শব্দ বই থেকে আমার মনযোগ সরিয়ে দিল। হঠাতই আমি অনুধাবন করলাম আমি আমার মামার চরিত্রকে কখনই বুঝে উঠতে পারিনি। বিরাট একপাল দীন আর অজ্ঞ আইরিশদের পিতা তিনি, কঠোরভাবে আত্মসংযমী এবং সাত্বিক ধরনের একজন মানুষ। তার কাছে প্রতিদিন আশাহত মানুষের দল স্বর্গলাভের আশায় সাহায্য প্রার্থনা করে। তার সুনাম রয়েছে কখনই কোন ক্লিষ্ট কৃষকের বিপদে পাশে থেকে উদ্ধার করতে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি বলে, এবং তার জানুসন্ধি পূজাবেদিতে পদাঙ্কের চাইতে পাপী আর হতভাগাদের অশ্রু ও আলিঙ্গনে বেশি জীর্ণ হয়ে পড়েছে; সে আমার সামান্য অপচয়ী ধাতটাকেই সহ্য করতে পারে না। এমনকি আমার সাথে বই, ফুল বা সঙ্গিত নিয়ে কথা বলার সময় পায় না। আমি কি ব্যাকুলভাবে এগুলো আশা করিনি? এখন আমার সহানুভূতি প্রয়োজন, আমি সেই সুবিবেচনা করেই এসেছি। আমি একজন সত্যনিষ্ঠ মানুষের সঙ্গ এবং তার সাথে আমার অশ্রু ভাগাভাগি করে নিতে চেয়েছিলাম।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। মধ্যরাত পেরিয়ে প্রায় একঘন্টা চলে গিয়েছে। করিডোরের শেষপ্রান্তে শুধুমাত্র এক ফিন্কি আলো ছাড়া সব বাতিই নেভানো ছিল। আমি কাঁধে একটা আচ্ছাদন ঝুলিয়ে নিলাম, একটা স্প্যানিশ হ্যাট্ নিলাম মাথায় এবং এপার্টমেন্ট ছেড়ে জনশূণ্য পথ ধরে অপসৃত আমার ছন্দবদ্ধ পায়ের আওয়াজ শুনতে শুনতে বেরিয়ে এলাম। প্রধান সিঁড়ির অবতরণস্থলে একটা অদ্ভুত দৃশ্য আমার গতিরোধ করল। একটা উন্মুক্ত দরজা দিয়ে আমি দেখলাম একটা সেলুনের জানালায় জ্বলজ্বল করছে চাঁদের আলো, সেখানে কিছুক্ষণ আগেই কোন বিনোদনের হল্লা হয়ে গিয়েছে। আমি আবারও ঘড়ির দিকে তাকালাম। সবে একটা বেজেছে তবে অতিথিরা চলে গিয়েছে। আমি ঘরটায় ঢুকলাম, আমার বুটজুতো মসৃণ পাটাতনে উচ্চস্বরে বেজে উঠল। একটা চেয়ারের ওপর শিশুদের জামাকাপড় আর একটা ভাঙা খেলনা। অনুষ্ঠানটি কোন বাচ্চার জন্মদিন উপলক্ষে ছিল। মেঝেতে নিজের ছদ্মবেশী ছায়া, ঘরের এলোমেলো সাজসজ্জা আর ঘরময় সাদা ভৌতিক আলো দেখে আমি একটু দাঁড়ালাম। ঘরের মাঝখানে একটা বিরাট পিয়ানো তখনও খোলা অবস্থাায় ছিল। সেটার সামনে বসতেই আমার আঙুল নেচে উঠল, এবং সেইসব অনুভূতি প্রকাশিত হয়ে গেল যা আমি একটা বিশাল বন্দনাসংগীতে অনুভব করেছিলাম, যেখানে একটা গভীর সম্মতির গুঞ্জন শীতল নিঃস্পন্দ ছায়াগুলোকে রোমাঞ্চিত করে তুলেছিল এবং চাঁদের প্রভায় মানুষকে নিয়ে গিয়েছিল দেবদূতদের কাছাকাছি। দ্রুতই সেখানে একটা আলোড়ন তৈরি হল। যেন পরমানন্দটি বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি জয়সূচক ভঙ্গিতে নিজ কন্ঠে গান করে চললাম। ফাঁকা সেলুনটা পুনরায় উতসবমুখর হয়ে উঠল, অর্কেস্ট্রা থেকে যেন বজ্রধ্বনি বেজে উঠল।
‘হ্যালো স্যার! আপনাকে বাঁধা দিতে হচ্ছে- আপনি কি মনে করেন যে এটা… এটা কি ধরনের শয়তানী?’
আমি ফিরে তাকালাম, নীরবতা নেমে এল। ছয়জন অর্ধবস্ত্র পরিহিত নোংরাচুলো মানুষ রাগন্বিতভাবে আমার সামনে দাঁড়াল। তাদের প্রত্যেকের হাতে মোমবাতি ছিল। একজন হাতে প্রহারদন্ডের মত করে একটা লম্বা জ্যাক ধরে রেখেছিল। প্রথম জনের কাছে ছিল একটা পিস্তল। আর দারোয়ানটা ভয়ে কাঁপতেও ভুলে গিয়েছিল।
‘স্যার,’ পিস্তলধারী রুক্ষভাবে বলল, ‘আমি কি জানতে পারি, আপনি কোন ধরনের পাগল যে এই সময়ে এধরনের অযৌক্তিক শব্দ করে মানুষের শান্তিভঙ্গ করছেন?’
‘অসম্ভব, আপনি এটাকে কিভাবে অপছন্দ করলেন?’ আমি ভদ্রভাবে উত্তর দিলাম।
‘অপছন্দ!’ সে ক্রোধান্বিত হয়ে বলল, ‘পুরো জঘন্য- আপনার কি মনে হচ্ছে আমরা এটা উপভোগ করছিলাম?’
‘সাবধান, সে একটা উন্মাদ।’ জ্যাকধারী লোকটা তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল।
আমি হাসতে শুরু করলাম। স্বভাবতই তারা আমাকে পাগল মনে করল। আমার স্বভাব এবং সঙ্গিতকলা সম্পর্কে সম্ভবত তাদের কোনই ধারণা ছিল না, যদিও তা হাস্যকর, তাই আমাকে পাগল ভাবা অস্বাভাবিক ছিল না। আমি উঠে দাঁড়ালাম। তারা একে অপরের কাছাকাছি ঘেষে গেল এবং দারোয়ানটা দৌড়ে পালাল।
‘ভদ্রমহোদয়গণ,’ আমি বললাম, ‘আমি আপনাদের জন্য দুঃখিত। আপনারা যদি ঘরে শুয়ে থেকে সঙ্গিতটি শুনতেন তাহলে আমরা সকলেই আরো ভাল এবং সুখী বোধ করতাম। কিন্ত আপনারা যা করেছেন তা আর ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। দয়া করে নৈশপ্রহরীকে জানাবেন, আমি আমার পাদ্রী মামা আদিউ’র সাথে দেখা করতে চলে গিয়েছি।’
নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথা বলার সুযোগ দিয়ে আমি তাদের অতিক্রম করে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমি মামাবাড়ির দরজায় ধাক্কা দিলাম। প্রথম ফ্লোরের একটা জানালা খোলা ছিল। সেখানে চাঁদের আলোকচ্ছটা একটা কালো টুপি পরিহিত ধূসর মস্তকের ওপর পতিত হল। পাথরফলকের নীচের অতল বিষাদময় ছায়ার সামনে নিতান্তই বিবর্ণ মনে হচ্ছিল তাকে।
‘কে আপনি?’
‘আমি জিনো লেগি।’
‘এত রাতে তুমি কি চাও এখানে?’
প্রশ্নটা আমাকে আহত করল। ‘প্রিয় মামা,’ আমি উচ্ছসিতভাবে বললাম, ‘আমি জানি আপনি এটা আশা করেননি। কিন্ত আপনার কথায় আমি নিজেকে অনভিপ্রেত ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। আমি অনুরোধ করছি, নিচে নামুন, আমাকে ভেতরে আসতে দিন।’
সে দৃঢ়ভাবে বলল, ‘তোমার হোটেলে ফিরে যাও, আমি সকালে তোমার সাথে দেখা করব। শুভরাত্রি।’ সে জানালাটা বন্ধ করে চলে গেল।
আমি উপলদ্ধি করলাম, যদি আমি এই অপ্রত্যাশিত প্রত্যাখ্যানকে মেনে নেই তাহলে সকালই হোক বা ভবিষ্যতে, প্রকৃতপক্ষে মামার প্রতি আমি কোনদিনই সদয় হতে পারব না। তাই যতক্ষণ না ভেতর থেকে দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল, আমি ডান হাত দিয়ে দরজায় অবিরত ধাক্কা দিয়ে গেলাম আর বাম হাত দিয়ে দরজাঘন্টি বাজিয়েই চললাম।
দরজার সামনে পাদ্রী মহাশয় যখন আমার মুখোমুখি হলেন, তার অভিব্যক্তি ছিল বিমর্ষতায় আচ্ছন্ন একটা কবরস্থাানের মত।
‘মামা!’ আমি তার হাত ধরে কেঁদে বললাম, ‘আমাকে তিরষ্কার করবেন না, হতভাগাদের জন্য আপনার দরজা কখনই বন্ধ থাকে না, আমি একজন হতভাগা। চলুন, আমরা সারারাত বসে কথা বলি।’
‘জিনো, তোমাকে আসতে দেয়ায় জন্য আমার বদান্যতাকে নয়, বরং আমার অবস্থাানকে তোমার ধন্যবাদ জানানো উচিত।’ সে বলল। ‘আমার প্রতিবেশীদের কথা ভেবেই আমি আমার পড়াশুনার সময়ে এই দরজায় তোমাকে আসতে দিলাম, নয়ত তোমার ওই গর্দভসুলভ খেলাটাই তোমাকে চালিয়ে যেতে হত। অনুগ্রহ করে চুপচাপ উপরে চলে এসো। আমার গৃহকর্মী একজন পরিশ্রমী মানুষ। সে অল্পকিছুক্ষণের জন্য ঘুমানোর সুযোগ পায়, সেটায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে।’
‘আপনি একজন মহৎ মনের মানুষ, মামা। আমি ইঁদুরের মত হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসব।’
‘এটাই আমার পড়ার ঘর।’ দ্বিতীয় ফ্লোরে দুর্বলভাবে সজ্জিত একটা গুহাবিশেষ ঘরে প্রবেশ করার সময় সে বলল। ‘তুমি যদি চাও তো আমি তোমার আরামের জন্য একচুমুক কিসমিসের পানীয় দিতে পারি। আমার বিশ্বাস, ডাক্তার তোমাকে উত্তেজক পানীয় স্পর্শ করতে নিষেধ করেছে।’ সে আশির্বাদসূচক ভঙ্গিতে আঙুল উত্তোলন করে বলল।
‘মাফ করবেন, শপথ করাটা আমার ভুল হয়েছিল। ডাক্তারের কথা আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছি। ডিনারের সময় আমি এক বোতল ওয়াইন সেঁটে দিয়েছি।’
‘সে কি! তোমার একা একা ভ্রমণ করাই উচিত নয়। তোমার মা আমাকে বলেছিল যে বুশি তোমার সাথে আসছে।’
‘ধুর! বুশি কোন অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ নয়। সে একটা কাপুরুষ। সে আমার সাথে আসতে রাজি হয়নি কারন আমি একটা পিস্তল কিনেছি।’
‘তার উচিত ছিল পিস্তলটা তোমার কাছ থেকে নিয়ে নিজের কাছে রাখা।’
‘কেন আপনি আমার সাথে একটা বাচ্চাসুলভ আচরণ করতে বদ্ধপরিকর, মামা? আমি নিশ্চিত বলতে পারি আপনাকে, আমি একজন সংবেদনশীল মানুষ। আমি একাই পৃথিবী ঘুরে দেখেছি, এবং আয়ারল্যান্ডে ঘুরতে আমার কোন শুষ্ক সেবকের প্রয়োজন নেই।’
‘এখানে থেকে কি কি করবে বলে স্থির করেছ তুমি?’
আমার কোন পরিকল্পনা ছিল না। জবাব দেয়ার বদলে আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে এপার্টমেন্টের চারদিকে চোখ ফেরালাম। মামার ডেস্কের ওপর একটা কুমারীমূর্তি রাখা ছিল, আমি সেটার মুখের দিকে তাকালাম। যেহেতু মামা নিজের কাজকে সবসময় চূড়ান্ত সন্তুষ্টি নিয়ে দেখতে অভ্যস্ত ছিল, আমি তার মুখে একটা চিরায়ত শান্তি দেখতে পেলাম। মনে হল, আমাদের ওপর স্বর্গ থেকে উজ্জ্বল গোলাপী মেঘদলের এক অসীম অন্তর্জাল নেমে এসে বাতাসকে ভাস্বর করে তুলল।
‘মামা,’ আমার সবচেয়ে মধুরতম অশ্রুতে ভেসে গিয়ে আমি বললাম, ‘আমার বিস্ময়ের সমাপ্তি ঘটেছে। আপনি সহায়তা করলে আমি চার্চে প্রবেশ করব। চলুন, আমরা একসাথে ফাউস্টের তৃতীয় অংশটা পড়ি, অবশেষে আমি এটা বুঝতে পেরেছি।’
‘চুপ করো, বাছা!’ বিপদ সংকেত দেয়ার মত হাত উঁচু করে বলল সে, ‘নিজেকে সংযত করো।’
‘আমার অশ্রু দেখে নিজেকে বিভ্রান্ত করবেন না। আমি শান্ত আছি, ঠিক আছি, দ্রুত আসুন, চলুন আমরা গ্যেতে পড়ি:’
যা কিছু অবর্ণনীয়
তা বর্ণিত হবে
শাশ্বত এই নারীগর্ভ
আমাদের স্বর্গে নিয়ে যাবে।

‘চোখ মুছে ফেলো, চুপ করো, এসো, এসো, আমার এখানে কোন লাইব্রেরী নেই।’
‘কিন্ত আমার কাছে আছে, আমার হোটেলের ব্যাগের মধ্যে,’ আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমি নিয়ে আসছি, পনেরো মিনিটেই ফিরে আসব।’
‘আমার বিশ্বাস, তোমার ওপর শয়তান ভর করেছে, এটা হতে পারেনা-’
আমি চিৎকার করে হেসে তাকে বাঁধা দিলাম, ‘পাদ্রী মশাই,’ সশব্দে বললাম, ‘আপনি অপবিত্র হয়ে গিয়েছেন। একজন অপবিত্র যাজকই সবসময় সেরা অনুসারী হতে পারে। চলুন আমরা কিছু ওয়াইন পান করি, এবং তারপর আমি একটা জার্মান সুরার গান গাইব।’
‘হায় ঈশ্বর! আমি তোমার কোন ক্ষতি করে থাকলে মাফ করো। কিন্ত আমার মনে হয় ঈশ্বর কোন পাপের প্রায়শ্চিত্তের ভার তোমার অসুখী মাথায় সঁপে দিয়েছে। তুমি কি আমার কথা একটু মনযোগ দিয়ে শুনবে? আমি কিছু বলতে চাই। অবশ্য সাড়ে পাঁচটায় জেগে ওঠার আগে আমাকে একটু ঘুমোতে হবে।’
‘সেটা তো আমার ঘুমোতে যাওয়ার সময়, যদি আদৌ আমি ঘুমাই, তাহলে। যাই হোক, আপনি বলুন। অমনযোগিতা নয় বরং অতি সংবেদনশীলতাই আমার দোষ।’
‘বেশ। তাহলে আমি চাই তুমি উইকলো’তে যাও। কারণ-’
আমি তাকে বললাম, ‘যে কারণেই হোক, এটাই যথেষ্ট যে আপনি চান।’ আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমার অবিলম্বে যাওয়া উচিত।’
‘জিনো, তুমি কি বসে আমার কথাটুকু শুনবে?’
আমি অনিচ্ছুকভাবে আমার চেয়ারে আবার বসলাম। ‘আপনার চোখে ব্যগ্রতা একটা অপরাধ দেখছি। এমনকি যখন তা আপনার সেবায় নিয়োজিত, তখনও। আমি কি বাতিটা নিভিয়ে দিতে পারি?’
‘কেন?’
‘আমার অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাবটাকে ফিরিয়ে আনতে, যাতে আমি অক্লান্ত ধৈর্য্য নিয়ে আপনার কথা শুনতে পারি।’
‘আমিই এটা বন্ধ করে দিচ্ছি, তাতে হবে?’
আমি তাকে ধন্যবাদ দিলাম এবং ছায়ায় বসে শোনার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিলাম। অনুভব করলাম, আমার চোখ চকচক করছে। নিজেকে এল্যান পো’র দাঁড়কাক মনে হল আমার।

‘তোমাকে উইকলোয় পাঠানোর কিছু কারণ আছে। প্রথমত, তোমার নিজের জন্যই। যদি তুমি শহরে থাকো অথবা অন্য যেকোন জায়গায় যেখানে কোনভাবে হুযুগে ভেসে যাওয়ার সুযোগ আছে তাহলে তুমি এক সপ্তাহের মধ্যে নিজেকে হাসপাতালে পাঠাবে। তোমাকে অবশ্যই পল্লীগ্রামে এমন কারো তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে যার ওপর আমি নির্ভর করতে পারি। এবং স্যার জন রিচার্ড যেভাবে আমাকে লিখেছেন, তোমাকে অবশ্যই তোমার বর্তমান রুগ্ন অবস্থার জন্য ক্ষতিকর সঙ্গিত, চিত্রকলা আর কাব্য থেকে দূরে থেকে এমন কিছু করতে হবে যা তোমাকে সকল কুকর্ম থেকে রক্ষা করবে। দ্বিতীয়ত, আমি তোমার মত একজন বিচক্ষণ মানুষের হাতে এমন একটা বিশ্বস্ত কাজের দায়িত্ব দিতে চাই যেটা না করলে চার্চের সুনামহানি হতে পারে। সংক্ষেপে আমি তোমাকে দিয়ে একটা অলৌকিক ব্যাপারের তদন্ত করাতে চাই।’ সে আমার দিকে মনযোগসহকারে তাকাল। আমি পাথরের মত বসে রইলাম।
সে বলল, ‘তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?’
‘এতটা আর কখনও বুঝিনি,’ আমি কর্কশ স্বরে বললাম। ‘আমাকে মাফ করুন, আমি আপনাকে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছি, বলতে থাকুন।’ নিজের কল্পনাশক্তির চালে নিজেই আমোদিত হয়ে বললাম।
‘আশা করি তুমি বুঝেছ। বেশ। উইকলো শহর থেকে চার মাইল দূরে একটা গ্রাম আছে, নাম চতুর্মাইল লেক। সেখানকার আবাসিক পাদ্রীর নাম ফাদার হিকি। এরও আগে নক্ এলাকার অলৌকিক ব্যাপারটার কথা কি তুমি শুনেছিলে?’
আমি চোখ পিটপিট করলাম।
‘নক্ এর ঘটনা সম্পর্কে তুমি কি মনে কর সেটা শুনিনি আমি, তুমি খোদ ঘটনাটা শুনেছ কি? তুমি শুনেছ তাহলে। তোমাকে নিশ্চয়ই এটা বলে দিতে হবে না যে, এমনকি একটা অলৌকিক ঘটনাও এদেশে চার্চের ভালোর চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে যতক্ষণ না যথাযথ প্রমাণস্বরূপ বিশ্বাসীদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে অবিশ্বাসী হিংসুক ও শক্তিমান শত্রুদের মুখ বন্ধ করে দেয়া যায়। তাই গত সপ্তাহে যখন আমি ওয়েডফোর্ড সংবাদপত্রে চতুর্মাইল লেকে সংঘটিত ঐশ্বরিক শক্তির ঘটনাটির একটা অদ্ভুত বর্ণনা দেখলাম, আমি এটা নিয়ে মনে মনে শংকিত হয়ে পড়লাম। আমি ফাদার হিকিকে চিঠি লিখে পত্রিকার বর্ণনাটির সত্যতা সম্পর্কে জানাতে বললাম এবং যদি তা সত্য না হয়, তাহলে প্রার্থনাপীঠ থেকে ঐ রিপোর্টারের প্রতি নিন্দা প্রস্তাব জানিয়ে ঐ পত্রিকায় একটা প্রতিবাদলিপি পাঠাতে বললাম। এই হচ্ছে তার জবাব।’ সে বলল। ‘এর প্রথমাংশ চার্চের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে, তা শুনিয়ে আমি তোমাকে বিব্রত করতে চাই না।’ সে বলে গেল।
‘এক মিনিট থামুন। এটা কি ফাদার হিকির নিজের হাতে লেখা? এটা কোন মানুষের হাতের লেখা মনে হচ্ছে না।’
‘তার ডান হাতের আঙুলে তীব্র বাতের ব্যাথা আছে। তার সাথে তার এক এতিম ভাতিজি থাকে, সে-ই শ্রুতিলেখক হিসেবে কাজ করে। যাই হোক-’
‘থামুন। তাঁর নাম কি?’
‘তাঁর নাম? কেট হিকি।’
‘বয়স কত তার?’
‘ধুর ছাই! সে একটা বাচ্চা মেয়ে। যদি সে তোমার মাথাব্যাথার কারণ হওয়ার মত যথেষ্ট বড় হত, আমি তোমাকে সেখানে পাঠাতাম না। তাঁর সম্পর্কে কি আর কোন প্রশ্ন আছে তোমার?’
‘একটাও না। আমি মেয়েটিকে একটা সরল সাদা অবগুন্ঠনে নিষ্পাপ ধর্মীয় আচার পালনরত অবস্থাায় কল্পনা করে নিয়েছি। তাঁর সম্পর্কে যথেষ্ট হয়েছে। ফাদার হিকি ভুতগুলো সম্পর্কে কি বলেছে?’
‘তারা ভুত নয়। সে যা বলেছে তা আমি তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি।’ সে গলা খাকরি দিল।
‘যাজকপল্লীতে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনা সম্বন্ধে আপনার অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে জানাচ্ছি যে, আমি এটার নিশ্চিত সত্যতা নিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারি। এবং সেটা এলাকার সকল ক্যাথলিক অধিবাসীদের কাছ থেকেই নয় শুধু, এমনকি গীর্জার মাহাত্ম্যকে অস্বীকারকারী বালটিংগ্লাসের সেইসব প্রটেসস্ট্যান্টদের(ভিন্ন চার্চের মতাদর্শের অনুসারী) কাছ থেকেও নিশ্চিত হয়ে, যারা বছরে ছয় সপ্তাহ এলাকার পাশেই বাস করে এবং তারাও কবরস্থানটার পূর্বের অবস্থাানের সাথে পরিচিত। সংবাদপত্রের ব্যাপারটা বরং অসম্পূর্ণ। সত্যটা হচ্ছে, প্রায় চার বছর আগে উলফটোন ফিৎ্জার্লড নামে এক ব্যক্তি এখানে যুদ্ধঘোড়া পালনকারী হিসেবে বাস করতে শুরু করে। তার পূর্বপুরুষ সম্পর্কে জানা যায়নি, তবে তার কোন পরিবার ছিল না। সে একাই থাকত এবং এলোমেলো জীবনযাপন করত। আর যখন সে পানপাত্র হাতে নিত, বস্তুত সবসময়ই নিত আরকি(!), তখন ঈশ্বর হোক বা মানুষ, কারো সম্পর্কেই সে শ্রদ্ধা পোষণ করত না। প্রকৃতপক্ষে কোন মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে খারাপ কথা বলা উচিত নয় কিন্ত যে কেউই বলবে, সে ছিল নোংরা, মদ্যপ এবং ধর্মহীন একটা বদমাশ। আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, আমার ভয় হয়, সে ছিল একটা নাস্তিক কারণ সে কখনই সার্বজনীন প্রার্থনাসভায় আসত না এবং প্রধান যাজককে নিয়ে সে এমন খারাপ ভাষায় কথা বলত যা এমনকি রাণীকে নিয়েও সে বলত না। আমার বলা উচিত সে ছিল একটা উগ্র বিদ্রোহী। সে দম্ভ করে বলত যে তার দাদা ’৯৮(১৭৯৮ সালের আয়ারল্যান্ডের বিদ্রোহ) সালের বিদ্রোহের পরে ছাড়া পেয়েছিল এবং তার বাবা ছাড়া পেয়েছিল স্মিথ ও’ব্রিয়েন(উইলিয়াম স্মিথ ও’ব্রিয়েন আইরিশ সংসদে ন্যাশনালিস্ট সদস্য ছিল। বিদ্রোহের কারণে তাঁকে নির্বাসনে দেয়া হয়েছিল) এর সাথে। সর্বশেষে সে নিজে ব্রিমস্টোন বিলি নামধারণ করেছিল এবং তার সকল পাপাচার নিয়ে গ্রামে বসবাস করছিল। আপনি জানেন যে আমাদের কবরস্থানটা লেকের উত্তর পাশে অবস্থিত এবং এটা চতুর্মাইল লেকের তপস্বী ভিক্ষু সিস্টার উরসুলাসহ অনেক পবিত্র মানুষের সমাধিক্ষেত্র হিসেবে সারাদেশেই পরিচিত। কোন প্রটেস্ট্যান্টকেই আজ পর্যন্ত এখানে সমাহিত না করার জন্য আইনগত কোন দাবি ওঠেনি, যদিও আমার জানামতে অন্তত দুজন আমার সময়েই মারা গিয়েছে। কিন্ত তিন সপ্তাহ আগে এই বদমাশ ফিৎজার্লড মদপান করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে মারা যায়। যখন তাকে এই গোরস্থানে সমাহিত করার কথা ওঠে তখন তার বিরূদ্ধে গ্রামে একটা হইচই পড়ে যায়। লাশটা যাতে চুরি না হয় এবং গোরস্থানমূখী আড়পথের ওপরেই যাতে কেউ তাকে কবর না দিয়ে ফেলে সেজন্য লাশটাকে নজরদারিতে রাখা হয়। আমার মানুষেরা খুবই অসন্তুষ্ট হয় যখন তারা জানতে পারে আমি লাশটা গোরস্থানে কবর দেয়া থামাতে কিছুই করতে পারিনি, বিশেষ করে ঐ সময়ে একটা উৎসবে যখন আমি এবিষয়ে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানাই। যাই হোক, আমি তাদের বাঁধা দিতে দেইনি এবং ১৪ জুলাই শেষ বিকেলে যথাযথ সময়ের বেশ পরেই সমাধিকার্যটা সম্পন্ন হয়। কোন ঝামেলা হয়নি। পরদিন সকালে দেখা গেল, গতদিনের তাজা কবরটি শুধুমাত্র লেকের উত্তর দিকে বহাল আছে, আর খোদ গোরস্থানটাই লেকের দক্ষিণ দিকে সরে গিয়েছে। এভাবেই এখন লেকের দুপাশেই গোরস্থাান রয়েছে। মৃত সন্তরা ঐ দুশ্চরিত্রের সাথে একই মাটিতে থাকতে চায়নি। আমি একজন খ্রীষ্টান পাদ্রী হিসেবে এটা সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত; এবং যদি এটা চার্চের বাইরের কাউকে সন্তুষ্ট করতে না পারে, আমি আবারও বলছি, তারা প্রত্যেকেই যেন মনে করে দেখে দুই মাস আগে কবরস্থাানটা কোথায় ছিল।’ আমি বিনীতভাবে পরামর্শ দেব, আপত্তিকারী ভদ্রলোকদের (প্রটেস্ট্যান্ট) সমন্বয়ে প্রস্তাবিত একটা কমিটির মাধ্যমে এই অলৌকিক ঘটনার সত্যতা নিয়ে একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হোক। আমার জনগণের একটি কথাও তারা উপাত্ত হিসেবে না নিতে পারে। যুদ্ধম্যাপেই দেখা যায় কবরস্থাানটা পূর্বে কোথায় ছিল, এবং যে কেউ নিজেই দেখতে পারে কবরস্থানটা এখন কোথায় আছে। মাননীয়, আপনাকে আমার বলে দিতে হবে না যে, এটা পবিত্র চার্চের সেইসব শত্রুদের জন্য বড় একটা জবাব হয়েছে যারা এর আগেও নক্ চ্যাপেলের চমৎকার সংবাদটা প্রকাশের পর সেটার ওপরেও একটা কলঙ্ক লেপন করতে চেয়েছিল। যদি তারা চতুর্মাইল লেকে আসে, পুনরায় পরীক্ষা করার দরকারই হবে না তাদের। তারা শুধু নিজেদের বিবেক যা বলবে সেটা বিশ্বাস করবে।
মাননীয়, এবিষয়ে আপনার পরামর্শের জন্য অপেক্ষা করব, ইতি, ইত্যাদি……’

‘তাহলে জিনো, ফাদার হিকি সম্পর্কে এখন তোমার কি মনে হয়?’
‘মামা, আমাকে প্রশ্ন করবেন না। এই ছাদের নিচে বসে আমি সবকিছুই বিশ্বাস করতে চাই। কিংবদন্তি সম্বন্ধে আমার আগ্রহ দারুণভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন রেভারেন্ড হিকি। চলুন, আমরা তার বর্ণনার কাব্যিকতার প্রশংসা করি। এবং উপেক্ষা করি একজন খ্রীস্টান পাদ্রীর শপথ করে মিথ্যা কথা বলা এবং একটা কবরস্থানের নদি পার হয়ে ওপারে গিয়ে মধ্যরাতে ফিরে আসতে ভুলে যাওয়ার সম্ভাব্যতার অসামঞ্জস্যতাকে।’
‘টম হিকি মিথ্যা বলছে না, মান্যবর, এ আমি তোমাকে শপথ করে বলতে পারি। তবে তার ভুল হতে পারে।’
‘এই ধরনের ভুল পাগলামির পর্যায়ে পড়ে। এটা ঠিক যে আমি নিজে হঠাৎ করে গভীর রাতে জেগে উঠে বুঝি যে আমার বিছানার অবস্থানটা উল্টে গেছে। কিন্ত চোখ খুললে সে বিভ্রম কেটে যায়। আমার ভয় হয়, মি. হিকি একজন পাগল। আপনার জন্য সেরা করনীয় হতে পারে এটা; চতুর্মাইল লেকে একজন যথার্থ সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন তদন্তকারী পাঠান, যে একজন তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষক। একজন স্বাস্থ্যাবান এবং কৌশলী মানুষ, যার অনুভব করার ক্ষমতা সম্পুর্ণভাবে ধর্মীয় কুসংস্কারমেঘমুক্ত। এক কথায়, আপনি আমাকে পাঠান। আমি কিছুদিনের মধ্যেই আপনাকে প্রকৃত ব্যাপারটার প্রতিবেদন পাঠাব। আর তারপর আপনি হিকি’কে তীর্থপীঠ থেকে পাগলা গারদে স্থানান্তর করার প্রস্তুতি নিতে পারবেন।’
‘হ্যা, আমি তোমাকে পাঠানোর কথাই চিন্তা করছিলাম। তুমি চমৎকারভাবে চোখা; এবং যদি একটা বিন্দুতে মনযোগ ধরে রাখতে পারো, তাহলে তুমি বিরাট একটা গোয়েন্দাকার্য সম্পন্ন করতে পারবে। কিন্ত এসব ক্ষেত্রে তোমার প্রধান যোগ্যতা হল তুমি এতটাই উন্মাদ যে, যেসব সংশয়ের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন সেসবের কিছুই উদ্রেক হবে না তোমার মধ্যে। তবে এই ব্যাপারটা চালও হতে পারে। যদি তাই হয়, আমি এটাই আশা করি এবং বিশ্বাসও করি যে, সেখানে হিকির কোন হাত নেই। তারপরেও সবরকম সতর্কতা নেয়া আমার দায়িত্বও বটে।’
‘মাননীয় পাদ্রী, আমি কি জিজ্ঞাসা করতে পারি আমাদের পরিবারের কারো মধ্যে কোন ধরনের পাগলামির ইতিহাস আছে কি না?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘তুমি আর আমার দাদী বাদে আর কারো মধ্যে নেই। আমার দাদী ছিলেন একজন পোলিশ। এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমার চেহারাও তার সাথে মিলে যায়। তুমি এই প্রশ্ন কেন করলে?’
‘কারণ প্রায়ই আমার মনে হয় আপনার মাথায় সামান্য সমস্যা আছে। আমার অকপটতাকে মাফ করবেন। কিন্ত একজন মানুষ, যিনি নিজের গোটা জীবনটাকে গীর্জার লালটুপির পেছনে উৎসর্গ করেছেন, যিনি মনে করেন তার চারপাশের সকলেই পাগল এবং একটা ভবঘুরে গোরস্থানের গালগপ্পকে ঐকান্তিক গুরুত্বের সাথে শোনেন এবং বিশ্বাস করেন, তিনি সুস্থ হতে পারেন না। বিশ্বাস করুন মামা, আপনার বিশ্রাম এবং হাওয়াবদল প্রয়োজন। আপনার পোলিশ দাদীর রক্ত আপনার ধমনীতে বয়ে যাচ্ছে।’
সে তীব্রভাবে উত্তর দিল, ‘আমি আশা করি চার্চের ব্যাপারস্যাপারে একজন অশ্লীলভাষীকে পাঠিয়ে আমি কোন পাপ করছি না। যাই হোক, আমাদের হাতে যতটুকু উপায় আছে ততটুকুই ব্যবহার করতে হবে। তুমি কি যেতে রাজি?’
‘গল্প করে আপনি ইতিমধ্যেই আমাকে দেরি করিয়ে দিয়েছেন। এসব আমি ওখানে গিয়েও শুনতে পারতাম। আমার এতক্ষণে সেখানে পৌছে যাওয়া উচিত ছিল।’
‘এত অধৈর্য হবার কিছু নেই, জিনো। তোমার থাকার ব্যবস্থা করতে বলতে হবে হিকিকে। আমাকে বলতে হবে তুমি সেখানে স্বাস্থ ভাল করতে যাচ্ছ। আদতেও তা-ই। এবং জিনো, তোমাকে স্বর্গের দোহাই, বিচক্ষণতার সাথে থেকো, বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মত চলাফেরা করো। হিকির সাথে ধর্মীয় বিষয়ে ঝগড়া করো না। আমার ভাগ্নে হয়ে আমার সম্মানহানি করো না।’
‘আমি একজন প্রদীপ্ত ক্যাথলিক হয়ে আপনার অনন্ত সুনাম গেয়ে যাব মামা।’
‘এমন যদি হতো! যদিও চার্চ তোমাকে মানিয়ে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। এখন তোমাকে বিদায় নিতে হবে। প্রায় তিনটে বেজে গেছে। আমাকে ঘুমোতে হবে। তুমি হোটেলে ফিরে যাওয়ার পথটা চিনতে পারবে তো?’
‘আমি এখান থেকে নড়তে চাই না, এই চেয়ারেই ঘুমাতে পারব। আপনি বিছানায় যান, আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।’
‘তুমি এই বাসা থেকে নিরাপদে চলে যাওয়ার আগে আমি কিছুতেই চোখ বন্ধ করব না। এসো, নিজেকে ওঠাও এবং শুভরাত্রি বলো।’

পাদ্রী মামার কাছে পাঠানো আমার প্রথম প্রতিবেদনটা ছিল এমন:
চতুর্মাইল লেক, উইকলো,
১০ আগস্ট

প্রিয় মামা,
অলৌকিক ব্যাপারটা নিখাদ সত্য। হিকি এবং গ্রামের মানুষ যাতে আমার ওপর নজরদারি না করে, সেরকম বিশ্বাসযোগ্যতা আমি যথাযথভাবেই অর্জন করে ফেলেছি। বুঝেছি একজন সন্দেহপ্রবণ আগুন্তকের সাথে তাদের কথা বলার পদ্ধতিকে। আমি যুদ্ধম্যাপগুলো পরীক্ষা করেছি এবং প্রতিবেশী প্রটেস্ট্যান্ট ভদ্রমহোদয়দের কথা পুণঃনীরিক্ষা করেছি। পুরো একটা দিন আমি লেকের উভয় পাশেই কাটিয়েছি এবং মধ্যরাতেও সেখানে থেকেছি। প্রাদেশিক কর্মচারীদের পরামর্শ অনুযায়ী আমি উৎক্ষেপণতত্ত্ব, প্রশমনতত্ত্ব, আগ্নেয়গিরিতত্ত্ব এবং জোয়ারভাটার তরঙ্গতত্ত্বকেও বিবেচনায় নিয়েছি। সবকিছুই অসমর্থনযোগ্য। এখানে মাত্র একজন কমলারঙা বিদ্রুপকারী আছে। সে কবরস্থানটা অপসরণের বিষয়ে কথা বলেছে, দাবি করেছে যে এটা খুঁড়ে ফেলা হয়েছিল এবং রাতে একদল মানুষ ফাদার হিকির নেতৃত্বে সেগুলো অপর পাশে স্থাপন করে দিয়েছিল। এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। ব্রিমস্টোন বিলি, যে কিনা চার বছর আগে এসেছিল এখানে, তার সমাধিটাই একমাত্র সমাধি যেটাতে সাম্প্রতিক খোঁড়াখুড়ির আলামত আছে। এটাই এখন উত্তর দিকের একমাত্র সমাধি, রাতে এলাকার বাসিন্দারা এদিকটা এড়িয়ে চলে। দিনের বেলা প্রত্যেক পথচারি এদিক দিয়ে যাওয়ার পথে একটা করে পাথর নিক্ষেপ করে যায় এখানে, এটা শীঘ্রই একটা বড় শীলাস্তুপে পরিণত হবে। সমাধিক্ষেত্রটার কেন্দ্রে যে একটা বিধ্বস্ত পাথরফলক ছিল, সেটাও এখন দক্ষিণ পাড়ে চলে এসেছে। আপনি চাইলে একটা কমিটি পাঠিয়ে যতদ্রুত সম্ভব তদন্ত করাতে পারেন। যেমনটি হিকি লিখেছিলেন, অলৌকিক ঘটনাটা যে সত্যিই ঘটেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আমার জন্য ব্যাপারটা এমন যে আমি এসবকিছুতে এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে খোদ উইকলো গ্রামটাই যদি নাচতে নাচতে আমার সাথে লন্ডনের মিডলসেক্সেও সরে যায়, তাহলে আমার বন্ধুদের কাছ থেকে সেটার বিস্ময়কর গল্প শুনেও আমার কোন ভাবান্তর হবে না।
উপরের কথাগুলো কাজের মত হয়েছে, তাই না মামা? তাহলে এখন এই মামুলি দৈব ব্যাপারটা বাদ দিন। আপনি যদি নিজের জন্য একটা অনন্ত অলৌকিকতা খুঁজে পেতে চান, আজীবনের জন্য যৌবন আর সুস্বাস্থ্যর পুষ্পমাল্যে সজ্জিত মুকুটের সুন্দরতম নিদর্শন প্রত্যক্ষ করতে চান, তাহলে এখানে চলে আসুন এবং মিস কেট হিকিকে দেখুন, একটা বাচ্চা মেয়ে বলেছিলেন যাকে আপনি। মতিভ্রম ছিল তা, মাননীয় যাজক, মতিভ্রম! তার বয়স সতেরো, একটা প্রস্ফুটিত কুঁড়ি সে, তার প্রাদেশিক বাচনভঙ্গি নিমিষেই আপনার সন্ন্যাসরোগ ছাই করে ফেলবে। তার কাছে আমি একটা বিস্ময়কর বস্তু যেন, যেন পাপের শহরে পালিত একজন আগুন্তক। খামারের জিনিসপত্রের মত ছয় ফুট লম্বা একজনের সাথে বিবাহের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সে। লোকটা যেন সর্বশক্তিমানের স্থুল মানবিকতার এক কর্তিত দৈর্ঘ্যাংশ বিশেষ। লাঙলচাষের জন্য উইকলোতে পড়ে আছে সে। নাম তার ফিল ল্যাংগন এবং আমাকে সে ঘৃণা করে। ফাদার টমকে সঙ্গ দেয়ার জন্য আমাকে ল্যাংগনের সাথে মিলেমিশে থাকতে হয়। আপনার কাছ থেকে সলমনোকোতে শোনা বন্য গালগল্পগুলো বলে আমি তাকে আমোদিত করি। প্রথমদিনেই আমি নিজের গল্প বলে শেষ করে ফেলেছি এবং এখন আলোচনার সময়ে আপনাকে অস্থির নৈতিকতার একজন যুবক হিসেবে গড়ে তুলে স্প্যানিশ সম্মানসূচক পলায়নপর প্রেমপূর্ণ গল্প খুঁজে নেই আমি। এতে ফাদার টম খুবই মজা পায়। আমি অনুভব করি আপনার প্রতি আমার এই সেবাটুকু কেটির কল্পনায় আপনার পূর্বের শান্ত যাজকীয় বিমূর্ত অবয়বকে এক আবেগী চিত্তাকর্ষক রূপ দান করে।
কি সুন্দর এই গ্রামটা! একটা পশ্চাতপদ বাগান; এত সুন্দর আকাশ এখানে! বিদায় মামা।
ইতি,
জিনো লেগি।

চতুর্মাইল লেকের প্রেমে পড়েছি আমি। আমি প্রায়ই প্রেমে পড়ি, কিন্ত বছরখানিকের মধ্যে আমার সাথে যত নারীর দেখা হয়েছে, কেট হিকির মত কেউই এতটা ঘায়েল করতে পারেনি আমাকে। সে খুবই বিচক্ষণ এবং হাসিখুশি। আমি যখন তার সাথে শিল্প নিয়ে কথা বলেছি, সে হাই তুলেছে। যখন আমি পৃথিবীর অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে দুঃখ করেছি, সে হেসেছে, এবং ‘বেচারা’ বলেছে আমাকে। আমি যখন তাকে বলেছি কি অপরূপ সৌন্দর্য আর স্নিগ্ধতায় ঐশ্বর্যবান সে, সে উপহাস করেছে আমাকে। যখন আমি তার নিষ্ঠুরতা নিয়ে অনুযোগ করেছি, সে রেগে গিয়েছে এবং আমার এরকম ভদ্রতার জন্য অবজ্ঞা করেছে আমাকে। এক রৌদ্রজ্জ্বল বিকেলে আমরা তার চাচার বাড়ির ফটকে দাঁড়িয়েছিলাম, সে ধুলিধূসর পথের দিকে তাকিয়ে ঐ জঘন্য ল্যাংগনের জন্য অপেক্ষা করছিল, আমি নভঃনীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, সে বলল, ‘আপনি লন্ডনে ফিরে যাবেন কবে?’
‘আমি লন্ডনে ফিরে যাচ্ছি না, মিস হিকি। চতুর্মাইল লেকের প্রতি এখনো ক্লান্তি আসেনি আমার।’
‘আমি নিশ্চিত আপনার এই সদয় বিবেচনায় চতুর্মাইল লেক খুব সম্মানিত হবে।’
‘আপনি তাহলে এই জায়গার প্রতি আমার ভাল লাগাকে অনুমোদন করেন না? যে সুখ আমি এখানে খুঁজে পেয়েছি তা কি আপনার গাত্রদাহ উদ্রেক করছে? আমার মনে হয় আইরিশ নারীরা পুরুষের এক মুহুর্তের সুখকেও সহ্য করতে পারেনা।’
‘আইরিশ নারীদের প্রতি আপনার এই লব্ধ ধারণা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। মনে হচ্ছে আপনার সামনে অনেক বেশি অযোগ্য তারা।’
‘আমি কি বলেছি তারা আমার যোগ্য নয়, মিস হিকি? আমার মনে হয়, আমার প্রতি আপনার একটা গভীর আকর্ষণ তৈরি হয়েছে।’
‘আসলেই! হ্যা, আপনি ঠিকই বলেছেন, মি. লেগি। আমি আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি আপনার কথা ভাবলে আমি ঘুমোতে পারি না। আপনি নিজেকে এত বিশাল ক্ষুদ্র ভাবেন যে তা দেখে একজন খ্রীষ্টান এর থেকে বেশি কিছু করতে পারে না।’
‘একসাথে তিনটা ভুল বললেন আপনি, মিস হিকি। প্রথমত আমাকে ব্যঙ্গ করে। দ্বিতীয়ত, আপনি কখনও কখনও আমার কথা ভাবেন এটা মনে করার কোনই কারণ নেই এমন একটা ভান করে এবং শেষমেষ যে অকপটতার সাথে আমি শপথ করে বলি যে আমি সবসময় নিজের কথা চিন্তা করি সেটাকে নিরুৎসাহিত করে।’
‘তাহলে আমার সাথে আপনার কথা বলা উচিত নয়, যেহেতু আমার কোন ভদ্রতা নেই।’
‘আবারও? আমি কি বলেছি আপনি অভদ্র? আমার মুখ থেকে উৎসারিত উষ্ণতম শব্দগুলোও আপনার কানে অপমানে রূপান্তরিত হয়ে বাজে। আমি যদি পবিত্র কুমারীর প্রার্থনাসঙ্গিতের পুনরাবৃত্তি করি, আপনি এমন ভাব করেন যেন আমি আপনার নিন্দা করছি। এসবের কারণ হল আপনি আমাকে ঘৃণা করেন। অথচ যাকে আপনি ভালবাসেন সেই ল্যাংগনকে তো কখনই ভুল বোঝেন না আপনি।’
‘মি. লেগি, ল্যাংগনের আচরণ নিয়ে আমি কিছু জানি না। কিন্ত আয়ারল্যান্ডে এটা আশা করা হয় যে ভদ্রলোকেরা নিজের চরকায় তেল দেবে। আমি ল্যাংগনকে ভালবাসি একথা বলার সাহস আপনার হল কি করে?’
‘তাহলে আপনি তাকে ভালবাসেন না?’
‘আমি তাকে ভালবাসি আর না বাসি তাতে আপনার কিছু হওয়ার কথা নয়।’
‘আপনি অন্য কাউকে ভালবাসেন আর আমাকে করেন ঘৃণা, এতে আমার কিছুই হওয়া উচিত নয়?’
‘আমি তো বলিনি আমি আপনাকে ঘৃণা করি। মানুষ যা বলে সেটা বোঝার ক্ষেত্রে আপনি খুব পটু নন, যদিও মানুষই আপনাকে বোঝে না এরকম একটা হইচই করেন আপনি।’ এই বলে সে নিচের রাস্তায় তাকাল এবং হঠাতই খুশি হয়ে উঠল।
‘আহা!’ আমি বললাম।
‘আহা, বলে আপনি কি বোঝালেন?’
‘কিছুই না। আমি এখন আপনাকে দেখাব একজন পুরুষের সহানুভূতি কি জিনিশ। মিস্টার ল্যাংগন আপনার সাথে দেখা করতে আসছেন। লোকটা তার বয়সের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা- যাই হোক। একজন হিংসুটে নারী হলে এসব ক্ষেত্রে যা করত, তার পরিবর্তে আপনার সাথে এখানে থাকার চাইতে বরং নিজেকে সরিয়ে নেব আমি।’
‘আমি নিশ্চিত, আপনি থাকুন অথবা চলে যান, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। মি. ল্যাংগনের মত ভাল মানুষকে আপনি যা বললেন তাতে আমি অবাক হলাম।’
‘আমি যা মনে করি সেটাই বলেছি। শপথ করে বলছি। কিন্ত তা একমাত্র এজন্য বলেছি যে, মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির চাইতে লম্বা মানুষে বেশি মুগ্ধ হন আপনি। মি. ল্যাংগনকে বড়জোড় প্রস্থহীন একটা দৈর্ঘ্য, অবস্থানহীন একটা উচ্চতা বলা যেতে পারে, বলা যেতে পারে একটা দৃশ্যের উপর একটা রেখা যার মধ্যে কোন বিন্দু নেই।’
‘আপনি কত চালাক!’
‘আপনিও আমাকে বোঝেন না দেখতে পাচ্ছি। আপনার প্রেমিক চলে এসেছে দেখুন, যেন একটা উট একটা দেয়াল পেরিয়ে আসছে। এবং আমি চলে যাচ্ছি, যেভাবে ফলক পেরিয়ে একজন খ্রীস্টান চলে যায়। শুভ বিকেল মি. ল্যাংগন, আমি চলে যাচ্ছি কারণ মিস হিকি আমার সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলতে চায় যেটা আমার উপস্থিতিতে বলা উচিত নয়। আপনি আমাকে চলে যেতে দিন।’
‘ওহ! অবশ্যই।’ বর্বরভাবে বলল সে। আমি হাসলাম এবং বেরিয়ে এলাম। যথেষ্ট দূরত্বে চলে আসার আগেই শুনলাম, মিস হিকি ফিসফিস করে তীব্রভাবে তাকে বলছে, ‘লোকটাকে আমি ঘৃণা করি।’
আমি আবারও হাসলাম। কিন্ত আমার উদ্দীপনা কেটে গেলে আমি কদাচিৎ এমন করি। একটা কর্কশ ভীতিসঞ্চারী শব্দ শনতে শুনতে আমি চলে এলাম, যেন একটা সানাইগীতির নিম্নমাত্রার আওয়াজ অরণ্যের লক্ষ্যভেদ করে ‘দার ফ্রেচুজ’ * (অপেরার বিখ্যাত সানাই আওয়াজ) নিরবিচ্ছিন্নভাবে বেজে চলছে।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে আমি নিজেকে কবরস্থানের মধ্যে আবিষ্কার করলাম। অন্তোষ্টিক্রিয়ার প্রবেশদ্বারসহ একটা কাদামাটির দেয়ালে পরিবেষ্টিত সমাধিক্ষেত্রটা নিস্ফলা হয়ে গিয়েছিল। চাষী সম্প্রদায় যখন তখন চতুর্মাইল লেক ও বাজার শহরে যাতায়াত করার জন্য এই পথটাকে একটা শর্টকাট হিসেবে ব্যবহার করত। কবরগুলোয় ঘাসের পাহাড় জমে গিয়েছিল। কোন পরিচারক ছিল না সেখানে; ছিল না কোন ফুল বা বেড়া অথবা চলিত রীতির এমন কিছুই যা একটা ইংলিশ কবরস্থানকে বিরক্তিকর করে তুলতে পারে। ‘পবিত্র ভগিনীদের সমাধি’ নামে পরিচিত কবরটার কাছে একটা বিশাল কাঁটার ঝোপ ছেঁড়া পশমী কাপড়ে আচ্ছাদিত হয়েছিল। একদিন যে কৃষিজীবী নারী এর সামনে এসে প্রার্থনা করত, সেও আজ এদের পাশেই ঘুমিয়ে আছে। আমি প্রবেশ করে দেখলাম সেখানে তিনজন হাটু গেড়ে বসে আছে, অলৌকিক ঘটনাটা ঘটার পরে এখানকার খ্যাতি পুনঃজীবন লাভ করেছে। এবং কাছেই একটা ফেরীঘাট চালু হয়েছে যাতে ওপার থেকে দর্শনার্থীরা কবরস্থানটা দেখতে আসতে পারে। আমি যেখানে দাড়িয়েছিলাম, সেখান থেকেই লেকের ওপারে ব্রিমস্টোন বিলির পরিত্যাক্ত সমাধির উপর পাথরের স্তুপ দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার গত দর্শনের পরে যে স্তুপের আকার দর্শনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি গভীর আন্তরিকতাহীন চোখে সেদিকে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থাকলাম এবং লেকের দিকে নেমে গিয়ে নৌকায় উঠলাম।
‘শুভ বিকেল স্যার।’ জলে ডুবে থাকা রশিটাকে টেনে টেনে নৌকাটিকে এগিয়ে নিয়ে আসতে আসতে বলল মাঝি।
‘শুভ বিকেল। তোমার ব্যবসায়ে কি মন্দা চলছে নাকি এখন?’
‘বিশ্বাস করুন, যত ভাল হতে পারত ততটা কখনই ছিল না স্যার। দক্ষিণ দিক থেকে যেসব মানুষ আসে তারা পানির ওপার থেকেই ব্রিমস্টোন বিলির সমাধি দেখতে পারে। ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুন। মানুষ এক পেনি খরচ করে তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করাকেও ভাল মনে করে না। ডাবলিনের দিক থেকেই যাহোক দুএকজন ভ্রমণ করতে আসে। দয়াময় আপনি আজকের এই শুভদিনে তৃতীয় ব্যক্তি যাকে আমি দক্ষিণ থেকে উত্তরে পার করে দিচ্ছি।’
‘বেশিরভাগ মানুষ কখন আসে? বিকেলে নিশ্চয়?’
‘সন্ধ্যার পর ছাড়া যেকোন সময়ই আসে, স্যার। সূর্য ডুবে গেলে গ্রামের একটা প্রাণীও ঐ কবরের সীমানায় আসে না।’
‘আর তুমি? তুমি কি সারারাত এখানেই থাকো?’
‘পবিত্র স্বর্গের নিষেধাজ্ঞা! আমি কিভাবে এখানে থাকব, স্যার? না। আমি সাতটার সময় নৌকাটাকে বেঁধে ওপার থেকে ব্রিমস্টোন বিলির ওপর সকাল পর্যন্ত নৌকাটার দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে চলে যাই! ইশ্বর আমাকে মাফ করুন।’
‘আমার আশঙ্কা হয় নৌকাটা কোন রাতে চুরি হয়ে যাবে।’
‘হুহ, কার সাহস আছে এটার কাছে আসার? চুরির কথা বাদই দিলাম, অন্ধকারে আমি এটার দিকে তাকানোর আগেও দুইবার ভাবব। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন, স্যার, আপনাকে দীর্ঘ জীবন দান করুন।’
ছয় পেনি দিলাম আমি তাকে। আমি পরিত্যক্ত কবরটার দিকে গেলাম, ওটার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে সূর্যের অবরোহী আলোয় ঝলমলে আকাশের দিকে তাকালাম। বিশাল বৃক্ষরাজি বিস্তৃত বনভূমি এবং জমকালো অট্টালিকায় অভ্যস্ত আমার ইংরেজ চোখদুটোর কাছে এই দৃশ্যপটকে বন্য এবং আথিতেয়তাশূন্য মনে হচ্ছিল। মাঝি ইতিমধ্যেই ঐ পারে ফিরে যাওয়ার জন্য গুটিয়ে নিচ্ছিল দঁড়ি, আমি তাকে বলেছিলাম আমার এপথে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আমি দেখলাম, দক্ষিণ পারের দিকে সে দ্রুতই বৈঠা চালিয়ে গেল, তারপর গায়ে কোট চাপিয়ে ক্লান্তভাবে বাড়ির পথে পা বাড়াল। আমি কবরের দিকে ফিরলাম। যারা মানুষের পিটুনির ভয়ে কোন এক অসময়ে তাড়াহুড়ো করে ব্রিমস্টোন বিলির কবরটা খুঁড়েছিল, তারা আসলে কবরটা ভালভাবে খননই করেনি। আদতে বিপত্তিটাকে লুকিয়ে ফেলতে যতটুকু মাটি না খুঁড়লেই নয়, কোনরকমভাবে ততটুকু মাটিই খুড়েছিল। অধিক কিছু নয়। হয়তো একটা পথভ্রষ্ট ছাগল লাথি মেরে ঢিবিটার এককোণ ধসিয়ে ফেলেছে, ভেতরের কফিনটা দেখা যাচ্ছে। ভগ্নাংশটা ঠিক করে দেয়ার জন্য শিলাস্তুপ থেকে কিছু পাথর নিয়ে সেখানে জড়ো করতে গিয়ে আমার মনে হল, যদি অলৌকিক ঘটনাটা কোন মানুষের দল ঘটিয়ে থাকে তাহলে তারা অনেকগুলো কবরের পরিবর্তে এই একটা কবর সরিয়ে ফেললেই পারত। এমনকি অতিপ্রাকৃত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও অদ্ভুত লাগে যে, পাপাচারীটাই পুণ্যাত্মাদেরকে নির্বাসিত করেছে, যেখানে তাদের সংখ্যাধিক্যের দ্বারা তারা অনেক বেশি সহজেই পাপীটাকে সরিয়ে দিতে পারত।
আমি যখন জায়গাটা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। আধমাইল হেঁটে একটা ব্রীজ দিয়ে নদীটা পুনরায় পেরিয়ে এসে আমার লজিঙের খামারবাড়িতে গেলাম। এখানে শুরুতে উঠেছিলাম আমি। শুধুমাত্র এক কাপ চা পান করলাম কারণ ইতিমধ্যেই আমার যথেষ্ট নিঃসঙ্গতা ভোগ করা হয়ে গিয়েছে। আমি ফাদার হিকির কটেজের দিকে রওনা হলাম।
আমি যখন পৌঁছলাম, কেট একা ছিল। আমি দরজা খোলার পরে দ্রুত এদিকে তাকাল এবং যখন আমাকে চিনতে পারল, অসন্তুষ্ট হল সে।
আমি বললাম, ‘অন্তত একবারের জন্য উদার হন আপনি। আমার উপস্থিতি দিয়ে আপনার সুন্দর বিকেলটাকে মাটি করে না দিতে আমি কয়েকঘন্টা উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়িয়েছি। যখন সূর্যের আলো ছিল, আমি নিজের ছায়া সরিয়ে নিয়েছি আপনার পথ থেকে। এখন অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। আমার ওপর একটু আলো ফেলুন। আমি কি আধঘন্টা থাকতে পারি?’
‘অবশ্যই, আপনি যতক্ষণ খুশি থাকতে পারেন। আমার চাচা শীঘ্রই চলে আসবে। আপনার সাথে কথা বলার মত যথেষ্ট চালাক সে।’
‘কি! আবারও বিদ্রূপ! মিস হিকি, একটা মনোরম সন্ধ্যা কাটাতে আমাকে সাহায্য করুন। এতে খুব বেশি হলে আপনার একটা হাসি খরচ হবে। আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। আদতে চতুর্মাইল লেক একটা স্বর্গ, কিন্ত আপনি ছাড়া এটা একটু নিঃসঙ্গ বটে।’
‘এই জায়গা আপনার জন্য নিঃসঙ্গই হবে। আমার অবাক লাগে কেন আপনি এসেছিলেন এখানে!’
‘কারণ আমি শুনেছিলাম এখানকার নারীরা সব ‘জারলিনা’ (বিশ্ববিখ্যাত ইতালীয় অপেরা ডন গিয়ভানি’র নারীচরিত্র), যেমন আপনি, আর পুরুষেরা ‘ম্যাসেটো(বিশ্ববিখ্যাত ইতালীয় অপেরা ডন গিয়ভানি’র পুরুষচরিত্র), যেমন মি. ফিল ল্যাংগন… আরে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আমাকে যেতে দিন মি. লেগি। আজ আপনি মি. ল্যাংগনের সামনে যেভাবে চলে গেলেন, এরপর আমি ভেবেছিলাম আর কখনই আপনার সাথে কথা বলব না। আমি বলতামও না, শুধুমাত্র চাচা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন আমি যেন আপনাকে ততটা গুরুত্ব না দেই কারণ তেমন কেউ নন আপনি। কিন্তু এবিষয়ে আমি আর আপনার কোন কথা শুনতে চাই না।’
‘যাবেন না প্লিজ। আমি শপথ করছি তার নাম মুখে আনব না আর। ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনি আর অনুযোগের কোন সুযোগই পাবেন না। ক্ষমা করবেন আমাকে?’
স্পষ্টতই আমার স্বীকারোক্তিতে যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বসে পড়ল সে। আমি একটা চেয়ার নিয়ে তার কাছে বসলাম। সে অধৈর্য হয়ে পা দিয়ে মেঝেতে চাপ দিল। আমি বুঝলাম, আমার প্রত্যেকটা নড়াচড়া, চাহনি বা আমার কন্ঠস্বরেও সে বিরক্ত হয়েছে।
আমি বললাম, ‘আপনি বলছিলেন যে আপনার চাচা আমাকে ততটা গুরুত্ব দিতে বারণ করেছে কারণ…’
সে তার মুখ বন্ধ করল, কোন জবাব দিল না।
‘আমার ভয় হচ্ছে আমি আবারও কৌতুহলবশত আপনার সাথে বিতর্ক করছি। কিন্ত সত্যিই তার বারণ করার কারণটা বলতেও নিষেধ করার কোন কারণ দেখছি না আমি।’
‘সে আমাকে নিষেধ করেনি। আচ্ছা, আপনি যখন সেটা জানার জন্য এতই বদ্ধপরিকর…’
‘না, মাফ করবেন। আমি জানতে চাই না। প্রশ্ন করার জন্য দুঃখিত।’
‘প্রকৃতই! আপনি দুঃখ পেলেও সম্ভবত আপনাকে বলা দরকার কারণটা। আমি শুধু আপনার কথা ভেবেই বলিনি তখন।’
‘তাহলে আপনার চাচা আমার অগোচরে আমার নিন্দা করেছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে আয়ারল্যান্ডে সত্যবাদী মানুষ বলে কিছু নেই। আপনি ছাড়া অন্য কোন জীবিত নারীর মুখে একথা শুনলে আমি বিশ্বাস করতাম না।’
‘আমি কিন্ত কখনই বলিনি যে আমার চাচা নিন্দুক। শুধুমাত্র আপনার সম্পর্কে সে কি মনে করে সেটা বোঝাতে আমার বলা দরকার, যদিও সেটা আপনি শুনতে চান বা না চান, সে আপনাকে গুরুত্ব দিতে বারণ করেছে কারণ আপনি একটা হতউন্মাদ প্রাণী, বিপদমুক্ত থাকতে যার পরিবার তাকে এখানে পাঠিয়েছে।’
‘ওহ, মিস হিকি!’
‘এখন তাহলে আমার কথাটা বুঝেছেন, আমার আগেই এসব আপনাকে বলে দেয়া উচিত ছিল। কখনও কখনও আমার মনে হয় আপনার ওপর কোন পাপাত্মার প্রভাব রয়েছে।’
‘আমি আপনার কথায় খুশি হয়েছি।’ ভদ্রভাবে বললাম আমি। ‘নিজেকে দোষ দিবেন না। আপনার চাচা আমার পরিবার সম্পর্কে ভুল শুনেছে। সে তো নিজেই কম বেশি একজন উন্মাদপ্রায় মানুষ। পাগল তো দূরের কথা, প্রকৃতপক্ষে লেগি নামের এই আমিই হচ্ছি ত্রিভুবনে একজন যৌক্তিক মানুষ। আমি এটা আপনাকে প্রমাণ করে দেব। এবং একইসাথে আপনার অবিবেচনাকে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েই এমন কিছু বলতে চাই যা আমার বলা উচিত নয়। সেটা হল আমি কোন বাতিল বা আকস্মিক পর্যটক হিসেবে এখানে আসিনি। আমি এখানে এসেছি অলৌকিক ঘটনাটার তদন্ত করতে। ওখানকার বিচক্ষণ পাদ্রী, যদিও সেও কিছুটা অস্থিরমতির একজন মানুষ, তার আয়ত্বের সবচেয়ে যোগ্যতর মানুষদের মধ্য থেকে আমাকে নির্বাচন করেছেন এখানে এসে ফাদার হিকির গল্পের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। একজন প্রধান যাজক কি এরকম একটা কাজের জন্য একজন উন্মাদকে বেছে নিতে পারে বলে মনে হয় আপনার?’
‘সত্যতা যাচাই মানে? কার সাহস আছে আমার চাচার কথায় সন্দেহ করে? আচ্ছা, আপনি তাহলে একজন গুপ্তচর, একটা নোংরা সংবাদদাতা!’
আমি চালু হয়ে গেলাম। যদিও এটা আয়ারল্যান্ডের সাধারন প্রকাশভঙ্গি হতে পারে, তবু যে বিশেষণটা কেটি ব্যবহার করল, তা একজন ইংরেজকে বিদ্রোহী করে তুলল।
‘আপনি যেটা বললেন, মিস হিকি, আমার মধ্যে একটা পাপাত্মা আছে। আমার পুণ্যাত্মাকে আঘাত করবেন না। সে একজন রুচিবান মানুষ। যদিও সে আমার হৃদয় থেকে বহুদুরে অবস্থাান করে পাছে ভয় পায় যাতে অন্যরা তার একচ্ছত্র সাম্রাজ্য থেকে ছিটকে না পড়ে। শুনুন! গির্জার ভক্তিগীতি বাজছে। পল্লীরাতের নিস্তদ্ধ অন্ধকারকে নির্মল করে তোলা এই সুরের বলয়ে আপনি কি পারেন একজন মানুষের প্রতি ঘৃণাবোধ করতে যে আপনাকে পছন্দ করে?’
হিস্টোরিয়াগ্রস্থভাবে সে বলল, ‘আপনি আমার প্রার্থনার মাঝেও হানা দেন।’ সে ফুঁপিয়ে উঠল। নিঃশব্দে কখনই সে এমন করেনি। তারপর ল্যাংগন আর পাদ্রী প্রবেশ করলেন।
‘ওহ, ফিল!’ সে কেঁদে উঠে ল্যাংগনের দিকে দৌড়ে গেল। ‘আমাকে এই লোকটার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাও। আমি সইতে পারছি না।’ আমি ল্যাংগনের দিকে ফিরলাম এবং একটা কপট হাসিতে দন্তবিকশিত করলাম। এক ঘুষিতে আমাকে ফেলে দিল সে, যেন সে ফেলে দিল একটা উঁচু গাছকে।
‘খুন! এ তুমি কি করছ ফিল!’ পাদ্রী চিৎকার করে বললেন।
কেটি ফুঁপিয়ে বলল, ‘সে একটা গুপ্তচর, সে আপনার উপর নজরদারি করতে এখানে এসেছে চাচা, এবং দেখানোর চেষ্টা করছে অলৌকিক ঘটনাটা একটা বানোয়াট। তার অপমানসূচক কর্মকান্ডে আগেই আমি বুঝেছিলাম। সে আমার সাথে প্রেম করতে চেয়েছিল।’
খুব কষ্ট করে আমি টেবিলের নীচ থেকে উঠে দাঁড়ালাম, কয়েক মুহুর্ত সেখানে অনড় হয়ে পড়ে ছিলাম আমি।
‘স্যার,’ আমি বললাম, ‘মি। ল্যাংগনের আক্রমণে আমি একরকম ঝলসে গেছি। তার কাছে আমার অনুরোধ, এরপরে তার সমপর্যায়ের শক্তিসম্পন্ন কারো সাথেও এমন করার আগে সে যেন নিজেকে একটা কারখানার চুল্লিতে রূপান্তরিত করে নেয়। আর আপনার ভাতিজি যা বলল তা আংশিক সত্য। আমি আসলেই প্রধান যাজকের মনোনীত মানুষ এবং অলৌকিক ঘটনাটা যে নির্ভেজাল সত্য তা জানিয়ে আমি ইতিমধ্যেই তাকে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। আমার পরামর্শ অনুযায়ী একটা দল কাল সেটা পুণঃনীরিক্ষা করতে আসবে। আমি ভেবেছিলাম তাদের কাছ থেকেই আমার কথা জানতে পারলে তা আরো বেশি পরিপূর্ণ হবে। মিস হিকি, যা কিছু আমাকে মুগ্ধ করে তার সবকিছুই আপনার আছে কিন্ত তাহলে এটাও বলতে হয়, আমারও সৌন্দর্যবোধ আছে। শুধুমাত্র আমি আপনার সাথে প্রেম করতে চেয়েছি বলাটা হবে অপবিত্রতা। মি. ল্যাংগন, আমার পকেটে লোডেড পিস্তল আছে একটা। এটা আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইংরেজ মানুষদের জন্য বহন করি। আমি যদি হালের মাথার মত লম্বা একটা হারকিউলিস হতাম আর আপনি আমার জায়গায় থাকতেন তাহলে এতক্ষণে মারা যেতাম আমি। রাঙা হয়ে উঠবেন না। আমি যতক্ষণ আছি, আপনি নিরাপদ।’
ফাদার হিকি বললেন, ‘চিরতরে আমার বাসা থেকে চলে যাওয়ার আগে শোনো, আমি যদি জানতাম তুমি একটা চর, তাহলে কখনই তুমি আমার ত্রিসীমানায় আসতে পারতে না, তা তোমার মামা যদি স্বয়ং পোপ হতেন, তাহলেও।’ তাকে অযথাই রাগন্বিত মনে হল।
আমার মধ্যে একটা ভীতিকর ব্যাপার ঘটল। আমার মাথা ঘুরে গেল, আমি মাথাটা চেপে ধরলাম। তিনফোটা উষ্ণ রক্ত ঝরে পড়ল। তাৎক্ষণিকভাবে মনে হল আমি মরে যাচ্ছি। মুখ দিয়ে রক্ত উঠে এল, চোখ ঝাপসা হয়ে গেল, আমি ডুবে যাচ্ছিলাম। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার হাতটা পিস্তলে চলে গেল। তাৎক্ষণিকভাবে আবেগের অনুবর্তী হওয়া আমার স্বভাব। সৌভাগ্যের ব্যাপার, হঠাৎ আমার মাথায় এল কি অবলীলায় আমি এই গর্দভগুলোর পাগলামির অসাড়তাকে সম্মান জানিয়েছি, আর খুন করার তাড়নাটা মাথা থেকে হারিয়ে গেল আমার। আমার কান থেকে রক্ত গড়িয়ে এল, আমি আবার ঝাপসা দেখলাম, শুনলাম।
ল্যাংগন বলল, ‘দেখো, যদি তুমি মনে করো হাতে লড়াইয়ের চেয়ে পিস্তলের ডুয়েলে তোমার সুবিধা হবে, তাহলে যখন বলবে তখনই আমি তোমার সাথে ডুয়েল লড়ব। নিজের সুনাম আমার কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ফাদার টমের সম্মানও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। এবং তার বিপক্ষে তুমি একটা কথাও বললে সেটা মিথ্যাই বলবে।’
‘তার সুনামের ভার আমার হাতে। আমি প্রধান যাজকের মনোনীত সাক্ষী, তুমি কি আমাকে অস্বীকার করো?’ আমি বললাম।
দরজাটা খুলে দিয়ে পাদ্রী বললেন, ‘দরজা এদিকে। যতক্ষণ না ঈশ্বরের হাতের কাজকে তুমি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারো, তোমার সাক্ষ্য আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’
আমি বললাম, ‘ফাদার হিকি, চতুর্মাইল লেকে পূণরায় সূর্য ওঠার আগেই আমি ইশ্বরের হাতের কাজটাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনব এবং তার ইঙ্গিতবাহী আঙুলটাকে বিদ্রুপভরে তোমার পাদপীঠের দিকে তুলে ধরব।’
আমি মাথা নীচু করে কেটিকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরে এতই অন্ধকার ছিল যে প্রথমে বাগানের সামনের ফলকটাই দেখতে পাইনি আমি। ওটা দেখার আগেই জানালা থেকে ফাদার হিকির গলা শুনলাম, ‘ ফিল, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না এসব ঘটে গেল। প্রধান যাজক আমাকে বলেছিলেন, সীমান্তের শশকের মত উন্মাদ একজন মানুষ সে।’
আমি লজিঙে ফিরে এলাম। গলা আর কাঁধের রক্ত পরিষ্কার করে একটা ঠান্ডা গোসল দিলাম। যে ঘুষিটা আমি হজম করেছি তা এত তীব্র যে গোসল আর হালকা খাবারের পরেও আমার মাথা ঘুরছিল, অসাড় লাগছিল। সেলফে পড়ে থাকা এলার্ম ঘড়িটায় আঘাত করলাম আমি, তারপর রাত সাড়ে বারোটার এলার্ম দিয়ে এমনভাবে চাপা দিয়ে রাখলাম যাতে এলার্মের শব্দ পাশের ঘরের কেউকে বিরক্ত করতে না পারে। এরপর ঘুমাতে গেলাম, সোয়া একঘন্টার একটা সুন্দর ঘুম দিলাম। অতঃপর এলার্ম বেজে উঠল। সম্পূর্ণ জেগে ওঠার আগেই আমি চমকে লাফিয়ে উঠলাম। যদি ইতস্তত করতাম, আবার গভীর ঘুমে ডুবে যেতাম আমি। যদিও আমার গলার পেশিগুলো ব্যাথায় শক্ত হয়ে গিয়েছিল আর প্রাথমিক তন্দ্রায় যে স্নায়বিক দূর্বলতা এসেছিল তাতে আমার হাতদুটো ঝিম ধরেছিল, আমি অটল হয়ে পোশাক পরে নিলাম। একচুমুক ঠান্ডা পানি পান করে আমি চুপচাপ বাইরে চলে এলাম। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গরুর খামারবাড়িটা খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছিল আমার, আমি একটা কোদাল এবং আলুর বস্তা টানার জন্য ব্যবহৃত একটা ছোট্ট ঠেলাগাড়ি নিয়ে নিলাম। বাড়ি থেকে শব্দ শোনা যাবে না এমন নিরাপদ দূরত্ব পর্যন্ত এগুলোকে তুলে নিয়েই চললাম আমি। তারপর গাড়ি ঠেলে কবরস্থানের দিকে রওনা দিলাম। আমি জানতাম কেউই এসময়ে এদিকে আসার সাহস করবে না, চাকার শব্দের তোয়াক্কা না করে আমি দ্রুত অগ্রসর হলাম। লেকের অপর প্রান্তে তাকিয়ে ব্রিমস্টোন বিলির নিঃসঙ্গ সমাধির অনুপ্রভ আভা দেখতে পেলাম আমি। এটা আমাকে খেয়াঘাট খুঁজে পেতে সহায়তা করল। সামান্য হোঁচট খেতে খেতে আমি নৌকার কাছে পৌঁছলাম এবং আমার জিনিসগুলো তুলে নিলাম। দড়িটার সাহায্যে কোন ঝামেলা ছাড়াই ওপারে পৌঁছলাম। নামলাম। দ্রুতই আমার গাড়িটাকে টেনে পাড়ে নামালাম, এবং একটু বিশ্রাম নিতে সমাধির শীলাস্তুপের ওপর বসে পড়লাম। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে আমি আকাশের অগ্নিনক্ষত্রের*(জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন, আয়ারল্যান্ডে প্রচলিত হ্যালোয়েনের সময় ব্যবহৃত একধরণের আলোবিশেষ) দিকে তাকিয়ে থাকলাম এবং পরবর্তী কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম। গীর্জার ঘড়িতে একটার ঘন্টা বেজে উঠল। আমি কোদাল দিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে সমাধিটা অনাবৃত করে কফিন বের করে ফেললাম। ভয়াবহ দুর্গন্ধ বের হল। বাতাসের দিক বুঝে দাঁড়িয়ে কফিনের নীচে কোদালটাকে লিভারের মত ব্যবহার করে কঠোর পরিশ্রমে আমি ওটা গাড়িতে তুলে নিলাম। কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই চাকা ঘুরিয়ে গাড়িটা নামিয়ে নিয়ে গেলাম। গাড়ির হাতলটা নৌকার পশ্চাতভাগে স্থাপন করে মূল ভার কাঁধে তুলে নিয়ে কাদা ঘামে নেয়ে কয়েকবারের ব্যর্থ চেষ্টায় নৌকাটাকে বিরক্ত করে প্রায় বিশ মিনিটের কঠোর প্রচেষ্টায় অবশেষে আমি ভারটাকে নৌকায় তুলে দিতে সক্ষম হলাম। লেক পার হয়ে দক্ষিণ পাড়ে পৌছে গাড়ি আর কফিন নামিয়ে কবরস্থানের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে আমাকে তেমন বেগ পেতে হয়নি।
মধ্যরাত পার হয়ে গিয়েছিল। ভোরের সূচনা হচ্ছিল, প্রয়োজনীয় আলো পেতে কোন সমস্যা হয়নি। বিকেলে পবিত্র ভগিনীদের কবরের পাশে দোআঁশ মাটি লক্ষ্য করেছিলাম, সেদিক দিয়ে নিয়ে গেলাম গাড়ি। কাজ আমাকে তাজা করে তুলেছিল, গলার ব্যাথাটাও কমে গিয়েছিল, আমি সবলে মাটি খনন শুরু করলাম। কফিন আর তার ওপর মাটি চাপার জন্য যথেষ্ট গভীর একটা পরিখা তৈরি হয়ে গেল দ্রুতই। মুক্তারঙা শীতল ভোর ততক্ষণে অন্ধকার মুছে দিচ্ছিল। চতুর্মাইল লেক পরিবেষ্টিত নিজেকে দেখে আমি সতর্ক হলাম এবং কাজ শেষ করার জন্য আকুল হয়ে উঠলাম। তবু কফিনটা গর্তে স্থাপনের আগে একমুহুর্তের জন্য বিশ্রাম নিতে বাধ্য হলাম। কপাল ও হাতের ঘাম মুছে নিয়ে চারিদিকে তাকালাম। চারটা বিরাট পাথরফলকের বলয়ে পবিত্র নারীদের ধূসর সমাধি শিশিরে ভিজে ছিল। তার পাশেই ছেঁড়া কাপড়ে আবৃত কাঁটার ঝোপে নতুন গাছগুলো পূর্বদিকে ছড়িয়ে জাঁকালোভাবে বেঁড়ে উঠেছিল। কাজ শেষ করার সময় আসন্ন। আমি গাড়িটাকে কবরের সামনে রেখে কোদাল দিয়ে ধীরে ধীরে চাঁড় দিলাম যতক্ষণ না একটা মাতাল ঘুম থেকে আপত্তি জানানোর মত একটা ফাঁপা আওয়াজ করে কফিনটা গড়িয়ে স্থাপিত হল গর্তের মধ্যে। যতদ্রুত সম্ভব গর্তের চারপাশের মাটি দিয়ে গর্তটা ঢেকে দিলাম। পৌনে একঘন্টার মধ্যে সমাধিকার্য সম্পন্ন হল। কাদার ঢিবিটায় ভারসাম্য আনতে আর কাজের আলামতগুলো মুছে ফেলতে আরও দশ মিনিট লেগে গেল। এরপর আমি কোদালটা ফেলে হাত ঝেড়ে নিলাম, মুক্তি ও বিজয়ের একটা অভিব্যক্তি এসে গেল আমার মধ্যে। যখন খেয়াল করলাম আমি একটা পরিত্যক্ত হলুদ ফুলগুল্মের মধ্যে দাঁড়িয়ে, আমি পিছিয়ে এলাম। মানুষের আর কোন কিছুরই চিহ্ন ছিল না আমার চোখে, আমার গাড়ি ও কোদাল এবং আগের মতই একাকী ব্রিমস্টোন বিলির সমাধি ছাড়া। আমি ফিরে এলাম। পেছনে পড়ে রইল কবরস্থান, পবিত্র নারীদের সমাধি, সকালের বাতাসে কাঁটার বনে কম্পমান ছেঁড়া কাপড় আর মাটির ভঙ্গুর দেয়াল। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভজনালয়ও রইল, তার ক্ষয়প্রাপ্ত দেয়ালের একটুকরো পাথর পর্যন্ত স্খলিত হল না, বোঝা গেল না, সে ও তার এক্তিয়ারের শেকড়গুলো চারপাশের চিরায়ত পাহাড়সমূহের চেয়ে অনেক কম গভীরে প্রোথিত।
হতভাগা ব্রিমস্টোন বিলির কবরের দিকে তীব্র সমবেদনা নিয়ে তাকালাম আমি, যার সাথে পুণ্যাত্মারা ঘুমোবে না! শেষ পর্যন্ত কাজটা আমি করে ফেললাম ভেবে আমি নিজেই অবাক হলাম। কিন্ত পাখিরা উড়ে গেল, মুরগীরা জেগে উঠে ডাকাডাকি শুরু করল। আমার বাড়িওয়ালা ভোরে ঘুম থেকে উঠত। কোদালটা গাড়িতে নিয়ে আমি দ্রুত খামারবাড়িতে গিয়ে তাদের যথাস্থানে রেখে দিলাম। তারপর আমি চুপিচুপি আমার ঘরে ফিরে পরিষ্কার জুতো, ওভারকোট আর সিল্ক হ্যাট পরে নিলাম। শণজাত এই কাপড়ের পরিবর্তন আমার উপস্থিতিকে সম্ভ্রান্ত করে তোলার জন্য যথেষ্ট। বাইরে গিয়ে আমি চতুর্মাইল লেকে নেমে পা ধুয়ে নিলাম, কবরস্থাানের দিকে তাকালাম শেষবারের মত, তারপর উইকলোতে ফিরে সেখান থেকে ডাবলিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া প্রথম টেনে চড়ে বসলাম।
কিছু মাস পরে কায়রোতে বসে আমি আইরিশ সংবাদপত্রগুলোর কপিসহ একটা প্রধান খবরের আর্টিকেল হাতে পেলাম। অলৌকিক ঘটনাটার বিষয়ে ‘দ্য টাইম’ এর খবরের কর্তিতাংশ ছিল সেটা। ফাদার হিকি তার আথিতেয়তাহীন কর্মের পারিতোষিক ভোগ করেছেন। আমি চলে আসার পরদিন যে কমিটি চতুর্মাইল লেকে গিয়েছিল, তারা কবরস্থাানটাকে পূর্ববত অবস্থাায় খুঁজে পেয়েছে। ফাদার হিকি একটা বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদনের মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল, আর তা কমিটিকে ঘোষণা করতে বাধ্য করেছিল যে, অলৌকিক ঘটনাটা ছিল পুরোপুরি একটা বানোয়াট। ‘দ্য টাইম’ কিছু উদাহরণের মাধ্যমে এই যাজকীয় শঠতার প্রমাণ উল্লেখপূর্বক মন্তব্য করেছে, ‘আমরা জেনে আনন্দিত মি. হিকিকে চতুর্মাইল লেকের পাদ্রীর দায়িত্ব থেকে পূর্ণ অব্যাহতি দিয়েছেন উর্ধতন যাজক কর্তৃপক্ষ। মি. হিকির ওপর অখন্ড বিশ্বাস প্রকাশ করে তার আত্মপক্ষ সমর্থনে দেয়া হাস্যকর রিপোর্টের স্বপক্ষে দুইশত মানুষের সাক্ষরসম্বলিত স্মারকপ্রস্তাব দেয়া হয়েছিল কমিটির কাছে, যা ছিল অত্যন্ত অসন্তোষজনক।’

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন