গল্প : চাঁদ : সানজিদা আক্তার

1

অলংকরণ: নাহিদুল ইসলাম

‘চাঁদ’, ওর নাম। আকাশের মতো বিশাল মন ওর বুকে। মায়ের ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে ও। বয়স আট কী নয়, কম-ও হতে পারে, কে রাখে কার খোঁজ! ভালোবাসে গাইতে। গান সে জানে না। শুধু গুনগুন করে। এই গুনগুন-ই তার খেলার সাথী। আর তো সাথী নেই! বন্যার পানিতে ভেসে গেছে সব। যারা বেঁচে আছে তারাও মনে হয় বাঁচবে না। না-খেয়েই কঙ্কাল হয়ে পড়ে থাকবে।             

আটাশির সেই বন্যার কথা বলছি, যে বন্যায় বাংলাদেশের ষাট ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা সেই বন্যায় চাঁদের বাবা আর বড় বোনটা হারিয়ে গিয়েছিল। টানা ৯ দিন বৃষ্টির পর, বাবা কোথা থেকে জানি এক পুটলি চাল নিয়ে এল। দুপুরে বেশ খাওয়া দাওয়া হলো। ভাত আর কলমি শাক সেদ্ধ। রাতে পঁচা পান্তা আর লবণ দিয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সবাই। এতদিনে সিদ্ধ শাকপাতা খেয়ে থাকা মানুষগুলো বেশ আরামসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মা। চাঁদ’র-ও ঘুম ভেঙে গেছে। সে দেখল, প্রায় পুরো ঘরটা ভেসে গেছে তাদের। কিন্তু, বাবা কোথায়? আর বোন? চাঁদ তখনো মায়ের কোলে, ঘরের যেখানে উঁচু মাচা সেখানে। বাবা আর বোন কী তাহলে ঘুমের মধ্যে ভেসে গেল? দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এল তার। কান্না করতে গিয়ে পারল না। এই বন্যার পানির কাছে তার কয়েকফোঁটা অশ্রু কিছুই নয়। এভাবে পরদিন বিকেল পর্যন্ত কাটল। তখন পর্যন্ত সে ভাবছিল হুট করে বাবা আসবে একটা ভেলা নিয়ে। এসে বলবে, ‘আরে পাগলি ভয় পেয়েছিস? তোদের জন্যে ভেলা বানাতে গেছিলাম।’ বাবা আসেনি, এসেছে একদল শহুরে নৌকাওয়ালা মানুষ। তাদের সাথে মা আর চাঁদ চলে গেল পুনর্বাসন কেন্দ্রে। একটা স্কুল, এত এত মানুষ গাদাগাদি করে আছে। স্কুলটা দেখে মায়া হলো চাঁদ’র। বাবা কতদিন বলেছে তাকে স্কুলে পড়াবে! এই বুঝি সেই স্কুল। আচ্ছা এখানে কী বাবাকে পাওয়া যায়? মা তখন একটু ঘুমিয়েছে। চাঁদ সরে পড়ল আস্তে করে। পুরো স্কুল ঘুরল। নাহ, বাবা নেই কোথাও। মায়ের কাছে চলে এল। কী সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে মা! তার চোখে ঘুম নেই। বোনের সাথে বাবার সাথে কাটানো দিনগুলো মনে পড়ছে খুব। তারা কী তাহলে সত্যিই ভেসে গেল? হু হু করে উঠল বুকটা। পূনর্বাসন কেন্দ্রে বেশ সমস্যা। বিশেষ করে খাবারের। চাঁদ’র পেট ভরে কলাপাতায় বিলি করে দেয়া ওইটুকু খিচুড়িতে। মায়ের থেকেও খানিকটা খায়। আর বসে বসে বন্যার ধ্বংসলীলা দেখে। এক সপ্তাহ এই লীলা দেখেই কাটল। তারপর পানি কমতে শুরু করল। আর যা কমলো তা হলো খাবার বিতরণ। আগে লাইন ধরে থাকতে পারলে তিনবেলাই খিচুড়ি পাওয়া যেত। এখন একবেলাই পাওয়া মুশকিল। দুপুরের খাবার পেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। হোক, তাতে কী! খাবার তো আসে! এই ঢের। আর তিনদিন পর পুনর্বাসন বন্ধ করে দেয়া হলো। পানি কমেছে। এবার নিজেদের আশ্রয় খোঁজার পালা। একটা গাছের নিচে ছাউনি হল তাদের। মা যে কী! কী করে জানি জাদুর মতো সব বের করে নিয়ে আসে। ছাউনি দেখে বেশ আনন্দ হলো চাঁদ’র। এবার আরামসে ঘুমোন যাবে। কিন্তু পেটে যে ক্ষুধা! সন্ধ্যা নেমেছে। জোনাকি জ্বলছে ছাউনির ভেতরে। আর পেটের ভেতর জ্বলছে ক্ষুধার আগুন। মা নেই। মসজিদে শিন্নী আনতে গেছে। এই মসজিদ না থাকলে হয়তো তাদের মতো অনেকেই না-খেয়ে থাকত। অনেক্ষণ পর মা এল। চাঁদ, ডাক দিতেই লাফ দিয়ে উঠল সে। মায়ের হাতে ক’টা কচু। চাঁদ বলল, ‘মা শিন্নী হয়নি?’ মা ছেড়া আঁচলে মুখ চেপে বলল, ‘না রে, আজ কচু সেদ্ধ করেই খাব চল।’ সেদ্ধ কচুপাতা। মুখে ঝাঁঝ লাগে, উপায় নেই তো। পেটের ঝাঁঝ তার চেয়ে কঠিন!

পরদিন, মা আবার বেরিয়ে গেছে। চাঁদ-ও বেরিয়ে পড়ে, একটা গান ধরে। হাঁটতে থাকে উদ্দেশ্যহীন। পথে যেন কীসের ওপর পা পরে। আঁতকে ওঠে সে। নরখুলি! অন্য সময় হলে ভয় পেত। কিন্তু এখন পায় না। একদিনে এত ভেসে আসা লাশ দেখেছে যে মৃত্যু এখন বেশ সহজ। অনেকটা বড় হয়ে গেছে সে। দিন পেরিয়েছে, মা তখনো আসে নি। চাঁদ’র হাতে ক’টা ধুতুরা ফুল। আজ এ দিয়েই সে সারাজীবনের ক্ষুধা মেটাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী,  জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন