গল্প: লালপদ্মের খোঁজে, লালপদ্মের ভাঁজে: আসিফ ইকবাল আরিফ

0

অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

আমি আর পারছিলাম না। আমার সবকিছু ছেঁড়ে-ছুঁড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছিলো। দিন যতো পার হচ্ছিলো, আমি ততোই হাঁপিয়ে উঠছিলাম। আমি আমার জীবনের আর কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, আর কোনো মানে খুঁজতেও চাচ্ছিলাম না। এই পৃথিবীর ফুল, পাখি, প্র্রজাপতি, বৃক্ষ, লতাপাতা আর তৃণের সবুজ আমাকে আর টানছিলো না। সমুদ্রের গভীরতা আমার আর ভালো লাগছিলো না। আমার ভালো লাগছিলো না প্রবল ঢেউয়ে সমুদ্রের তল থেকে ভেসে আসা শামুকের রঙ-বাহারী খোলাগুলো। দুর্বাক এক ঘূর্ণিপাকে আমার মন মরে যাচ্ছিলো। আমি ক্লান্ত হয়ে উঠছিলাম দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, সকাল, দুপুর, বিকাল, গোধূলি আর সন্ধ্যেতে, রাতের গভীরে, সব সময়। মাহিনের যন্ত্রণায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো সাগরে গিয়ে ডুবে মরতে, পদ্মা আর মেঘনার মিলনস্থলে গিয়ে হাত পা চিৎপটাং করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে। আমি না মরলে মনে হয় মাহিনের মনে কোনো শান্তি মিটতো না তখন। মাহিন ছিলো আমার প্রেমিকা। আমার মনের সবটুকু দিয়েই ওকে ভালোবেসেছিলাম। মাহিনের সাথে আমার পরিচয় অনেকদিন আগের। তা প্রায় বছর সাতেক হবে মনে হয়। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসলাম, তখন আমার বাবা মাহিনের বাবার ঠিকানাটা দিয়েছিলো। আমি তখন থেকেই মাহিনকে পড়াতাম। মাহিন তখন নবম শ্রেণিতে পড়তো। আমি ছিলাম ওর প্রাইভেট টিউটর। এখন মাহিনের বয়স বাইশ বছর। সে এখন অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। মাহিনদের গ্রামের বাড়ি আর আমাদের গ্রাম একই জায়গায়। আমি যখন অনার্স চতুর্থ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিলাম, তখন মাহিনের বাবা মারা গেলেন। আংকেল মরে যাওয়ার পরে মাহিনদের পরিবারের সাথে আমার যোগাযোগ আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়। ছেলে সন্তানহীন রজি আন্টির কাছে আমি তার নিজ সন্তানের মতো হয়ে উঠলাম।

তখন রজি আন্টির বাসাতে মিহির আপা, সে আর মাহিনই থাকতো। কাজের মেয়ে দেলোয়ারা আর বাসার কেয়ারটেকার মোক্তার ভাই নিয়মিতই তাদের দেখাশুনা করতো। মিহিরদের একসময় খানদানি ছিলো আমাদের গ্রামে। এখনো কিছু কিছু আছে। সেখান থেকে বছরে বেশ বড় অংকের টাকা আসে। আর ঢাকাতে রেজুয়ান আংকেলের একটা দশতলা বিল্ডিং আছে যা থেকে প্রচুর টাকা ভাড়া হিসেবে পায় মাহিনরা। আমি কখনো হলে থাকতাম। আবার কখনো মাহিনদের বাসাতে থাকতাম। এইভাবেই আমার পড়াশুনা প্রায়ই শেষ হয়ে গেলো। মাহিনও বড় হয়ে গেলো। তবে আমি যখন মাস্টার্স পরীক্ষায় পাশ করে রজি আন্টিকে মিষ্টি খাওয়াতে গেলাম, তখন তিনি মরণের টান পাড়ছিলেন। আমরা তাকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম। চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই তিনি মারা গেলেন।

রজি আন্টি মরে যাওয়ার পরে মিহির আপা একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন, মাহিন ভেঙে পড়েছিলো, আমিও ভেঙে পড়েছিলাম। তবে আমার ভেঙে পড়া হয়তো ওদের মতো শক্ত ছিলো না। আমি শুধু কৃতজ্ঞতার খাতিরে ভেঙে পড়ছিলাম। হ্যাঁ, এটা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই যে এই পরিবার আমাকে ঢাকা শহরে টিকে থাকার বড় একটা জায়গা দিয়েছে। আমি দিনের পর দিন এখানে এসেছি, থেকেছি। রজি আন্টি আর রেজুয়ান আংকেল তাদের জীবদ্দশায় আমাকে কখনোই বুঝতে দেন নি যে আমি বাবা-মা আর পরিবার পরিজন ছেঁড়ে ছিলাম। তাই রজি আন্টির মৃত্যুর পরে আমি আমার কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে ভেঙে পড়ছিলাম। মিহির আপা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তার বয়স পঁয়ত্রিশের মতো হবে আর কি। দুয়েক বছর কমবেশি হতে পারে। বিয়ে তার একবার হয়েছিলো। তবে সংসার টিকেনি তিনবছরের বেশি। এখন সে নিজেই নিজের অভিভাবক আর সাথে, মাহিনেরও। আমি যেদিন প্রথম তাদের বাসায় গিয়েছিলাম, সব জায়গাতে রজি আন্টি আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলো শুধু মিহির আপার রুমটি ছাড়া। ‘ঐ ঘরে যাওয়া যাবে না। ঐখানে গেলে তোমার মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। ঠিক যেমনটি মাথা নষ্ট হয়েছে মিহিরের, সেই দিন আন্টির বলা এই কথা আমাকে মিহির আপার রুমে যাওয়ার ইচ্ছে আমার ভেতরে খুব জাগিয়ে তুলেছিলো। আমি প্রায় বছরখানেক পরে কোনো একদিন মিহির আপার রুমে গিয়েছিলাম। মিহির আপার রুমে গিয়ে আমার ভেতরে এক ধরনের আবশে তৈরি হয়েছিলো তার উপর। পৃথিবীর সব বিখ্যাত বিখ্যাত বামপন্থী লেখকদের বইপত্রে ভরা ছিলো মিহির আপার বুক-শেলফ। কাল মার্কস, লেলিন, মাওসেতুং, চে সবার বই ছিলো। আর নারীবাদের যতো ধরনের বই ছিলো, ফাস্ট ওয়েভ, সেকেন্ড ওয়েভ, থার্ড ওয়েভ, ফোর্থ ওয়েভ সব তার কাছে ছিলো। আর মিহির আপার ঘরের চার দেয়ালে খুব সুন্দর করে লেখা ছিলো‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও লড়াই কর, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই, সাম্রাজ্যবাদের কালো থাবা, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও, এইসব শ্লোগানগুলো তার শোবার ঘরে ছিলো। শুধু তাই নয়, সিমন দ্য বুভোর ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, সমাজ তাকে নারী বানিয়ে ফেলে; এটাও তার পড়ার টেবিলে ছিলো। আমি তখন সবে অনার্স প্রথমবর্ষে পড়ছিলাম, তাই এই শ্লোগান আর মিহির আপার রুমে থাকা বইগুলো আমাকে অন্যরকমভাবে জ্বালিয়ে তুলছিলো। আর  আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দেওয়ালে দেওয়ালে তো এইগুলো লেখায় থাকতো সেসময়, এখনো লেখা থাকে। আমি যেহেতু সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম, তাই আমার শিক্ষাজীবনের নানান সময়ে এই বইগুলো পড়ার সুযোগ হয়েছিলো। আমি মিহির আপার কাছ থেকে বই নিয়ে নিয়ে আসতাম, আর পড়ে পড়ে ফেরত দিতাম। বিশেষ করে কার্ল মার্কস নিয়ে যখন কোনো এসাইনমেন্ট বা মিডটার্ম পরীক্ষা থাকতো, তখন আমি হল থেকে সোজা মিহির আপার কাছে গিয়ে ধর্ণা ধরতাম। মিহির আপার এক ঘণ্টা লেকচার শুনেই আমি পরিক্ষার জন্য যথেষ্ট, এমন তথ্য দিয়ে লিখে চলে আসতে পারতাম। মিহির আপাকে প্রথমে আমার নাম বলতেই সে আমাকে খুব পছন্দ করেছিলো। আমার নাম ছিলো বিপ্লব। আর এই নামের কারণেই মিহির আপা তার কাছে থাকা সব বইয়ের মধ্যে থেকে আমাকে বই দিতেন হয়তো। মিহির আপার সাথে শামীম ভাইয়ের সংসার কেন হয় নি সেটা আমি জানি না। আর কোনোদিন জানতেও যায় নি। মাহিনকে আমি ভালোবাসতাম, আর সেই কারণেই আমি তাদের বাসার উপরের তলাতে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতাম। মিহির আপা আর মাহিন একই পিতা-মাতার ঔরসজাত হলেও দুইজন ছিলো দুই কিছিমের। মাহিন আপা সিগারেট টানতো ধুমছে। আর মাঝে মাঝে দুয়েকটা লম্বা চুলওয়ালা পুরুষ নিয়ে রাত কাটাতো, হুইস্কি আর রেড লেভেল তার কাছে ছিলো সাদা পানির মতো। অন্যদিকে মাহিন পুরোপুরি পড়ে থাকতো ধর্মকর্মের বইগুলো নিয়ে। ভক্তিমূলক গান শুনে দিন আর রাতের অনেক সময় পার হতো তার। অলৌকিক প্রেম ভাবনায় ডুবে থাকতো তার মন। আংকেল-আন্টির মৃত্যুর পরে আমি ঘনিষ্ঠভাবে আটকে যায় মিহির আপাদের সাথে। মিহির আপা-ই প্রথমে আমাকে সিগারেট হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার প্রথম প্রথম লজ্জা লাগছিলো। পরে একটান দুইটান দিতে দিতে আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে রাত একটা নেই দুইটা নেই, মিহির আপা আমাকে তার রুমে ডাকতো। মাহিন তখন তার রুমে থাকতো। মনে হয় বেশিরভাগ সময় সে ঘুমিয়েই থাকতো। গভীর রাতে সুনীলের কবিতার বই আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতো পাঠ করতে। আমি কবিতা পড়তাম আর মিহির আপার মাতলামি দেখতাম। দেখতাম সে ঢলে ঢলে পড়ে যেতো। অশ্রাব্য গালিতে ভাসিয়ে দিতো তার অন্তরের যতো সব আক্ষেপ। এইভাবে বেশ কয়েক রাত আমি আর মিহির আপা এক সাথে ড্রিংকস করতাম।

মাহিনের সাথে যে আমার প্রেম চলছিলো এটা মিহির আপা জানতো না। সেটা জানার সময় তার ছিলো না। সকালবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে ক্লাস নিতে যেতো, বাসায় ফিরলে পড়তে বসতো, খাতা মূল্যায়ন করতো। তবে মিহির আপা মাঝে মাঝেই বাসার বাইরে রাত কাটাতো। কোথায় যেতো, তা আমরা জানতাম না। আর এটা আমাদের জানার কথাও ছিলো না। মিহির আপা রাতে না ফিরলে মাহিন আমাকে উপর থেকে নামিয়ে এনে তাদের অতিথি কক্ষে বসিয়ে রাখতো। বিভিন্ন পুরাণের বইপত্র আমাকে পড়তে বলতো। আমি পড়তাম আবার মাঝে মাঝে বিরক্তও হতাম। আমার এইসব একেবারেই ভালো লাগতো না। মাহিন আমাকে এমন এমন উপন্যাস পড়তে দিতো যা পড়ে আমার বিরক্ত লাগতো। একরাতে সে আমাকে একটা প্রেমের উপন্যাস দিয়েছিলো। আমি আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম। সেটা পড়ে আমার মেজাজ রীতিমত বিগড়িয়ে গিয়েছিলো লেখকের উপর। আমার মেজাজ বিগড়িয়ে

গিয়েছিলো লেখকের চেপে যাওয়া বাসনা দেখে। এটা লেখকগণ করতেই পারেন, সমাজ বা বৃহৎ রাজনীতির চাপ তাদের উপর থাকে, ধর্মীয় চাপ থাকে, এটা থাকতেই পারে। তাই বলে সারারাত একটা প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে আর মেয়ে এক সাথে থাকবে অথচ তাদের মধ্যে শরীর ছোঁয়াছুঁয়ি হবে না বা তারা শুধু কল্পনায় থেকে রাত অতিবাহিত করবে এটা অসম্ভব রকমের ভণ্ডামি। তাই আমি মাহিনকে সেই বই পড়ার পরে অনেক রাগ দেখিয়েছিলাম। এরপর মাহিন বলেছিলো, ‘এই জায়গাতেই তোমার আর আমার পার্থক্য। তুমি শুদ্ধতাতে বিশ্বাস করতে চাও না। সবকিছুতে এতো যৌনতা চাও কেন? যৌনতার বর্ণনা তোমার খুব ভালো লাগে সেটা আমি বুঝি। আর নগ্ন যৌনতাতে তোমার মন আরও মাতে সেটাও আমি বেশ জানি।’ মাহিনের কথাতে আমি আরও রেগে গেলাম। ‘কেন যৌনতা নিয়ে লেখকেরা লিখবেন না? সেটা কি বাস্তবতার বাইরে? আর সব লেখকেরাই কি যৌনতাকে তথাকথিত নগ্নভাবে উপস্থাপন করে? করে না। মানিকের লেখা পড়ো। দেখো সেখানে কতো নান্দনিক শিল্পের আশ্রয়ে যৌনতার বাস্তবিক চিত্র সে ফুটিয়ে তুলেছে।’ আমার এইসব কথাতে মাহিনের কিছু আসে যায় না। ও ওর মতো ভাবে, আমি ভাবি আমার মতো। ওর চুলে হাত দিতে গেলে বলে বিয়ের পরে, ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলে বলে বিয়ের পরে, হাত ধরতে গেলে বলে, বিয়ের পরে। ‘বিয়ের আগে এই সব করলে নাকি পাপ হয়’ বলে আমাকে সরিয়ে দেয়। আমার মেজাজ বিগড়াতে থাকে। শুনতাম মানুষের নাকি প্রেম থাকতে অনেক কিছু হয়। আমার আর মাহিনের মধ্যে এমন কিছুই হতো না। ওর কাছে প্রেম মানে অন্যরকম। আমি ওটা বুঝতে পারতাম না। একদিন আমি একটা চাকরির ভাইভা দিয়ে এসে মটকায় আগুন ধরিয়ে ছিলাম। বাড়ি থেকে বাবা বলেছিলো ‘একটা চাকরি বাকরি ধরেক। আর কতো!’  আমি একের পর এক সিগারেট টানছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম ‘আজ যদি মাহিন আবার রাতে ডাকে, আমি যাবো না।’রাত বারোটা পার হলো এই সব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে। মিহির আপার ফোন এলো। আমাকে তার রুমে ডাকলো। আমি নিচেই নেমে গেলাম। মিহির আপা দরজা খুলে দিয়েছিলো। মাহিন ঘুমিয়ে পড়েছিলো। আমি তার রুমের ভেতরে গিয়ে দেখলাম তার বুকের উপর সেই প্রেমের উপন্যাসখানা। মেজাজ আরেকবার গরম হলো প্রাণহীন এমন উপন্যাস মাহিনের বুকের উপর দেখে। আমি মাহিনের রুম ত্যাগ করে মিহির আপার বেডে চলে গেলাম।

মিহির: কি কমরেড মুড অফ নাকি?

আমি: হুম। খুব।

মিহির: কেনো? শাশ্বত প্রেমে জ্বলে মরো নাকি!

আমি: না। ঐসব না। চাকরির ভাইভা ছিলো আজ।

আমি যে ব্যাংকের চাকরিতে ভাইভা দিতে গিয়েছিলাম, এটা শুনেই মিহির আপা খিলখিলিয়ে হাসছিলো। ‘কমরেড। শেষ পর্যন্ত পুঁজিপতিদের কাছে ধরা দিতে গেলে?’ মিহির আপার এমন কথাশুনে আমি বললাম, পুঁজিপতিদের হাতে ধরা নেই কোন শালা? সবাই ধরা। মিহির আপা খালি হেসেই চলছিলো। আমি তার হাসির মধ্যে অন্যরকম শোভা দেখতে পাচ্ছিলাম যা মাহিনের হাসিতে ছিলো না, জানালার কাচের বৃষ্টিফোঁটাতে ছিলো না, মাঠের সবুজ ঘাসের ডগাতে ছিলো না, বর্ষার কদমফুলে ছিলো না, ভোরের সূর্যে ছিলো না। আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিলো, পুড়ে যাচ্ছিলো। আমি যতো পুড়ে যাচ্ছিলাম, মিহির আপা ততোই হেসে চলছিলো।

আমি সিগারেট ধরালাম, মিহির আপা হুইস্কি ঢাললো। মিহির আমার চোখের দিকে তাকাতেই আমার চোখে আগুনের ফুলকি দেখলো। ‘কমরেড রিভ্যুলিউশন হবে নাকি?’ আমি রাজি হয়ে গেলাম। তার সাথে সে রাতে আমার অন্যরকম সম্পর্ক হলো। পরের দিন সকালে আমার ঘুম ভাঙলে আমি খালি অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। আমার মনে হচ্ছিলো আমি মনে হয় পাপ করেছিলাম সেসময়। আমি মিহির আপার বাসায় আবার গেলাম। তার ভেতরে কোনো অনুশোচনা বা পাপের ছায়া দেখলাম না। সে খুব স্বাভাবিক ছিলো। এতোটাই স্বাভাবিক যা আমি অবাক হয়ে গেলাম। ‘মাংসের গন্ধে যে বাঘ আজ খাঁচায় এসে হাজির।’মিহির আপার এই কথার মানে না বুঝার চেষ্টা করেই তার মুখের দিকে তাকালাম আমি। ঐ সময় আমার মনে হচ্ছিলো যে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্য মিহির আপার কপাল জুড়ে রয়েছে। মিহিরের মুখখানি আমার কাছে এতোই সুন্দর লাগছিলো যে, যা নাগকেশর, অলকানন্দা, মধুমঞ্জুরী, ভাঁটফুল, সজিনা ফুল, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস এমনকি পথের ধারের ডোবাতে টগা উঁচু করে থাকা কলমি লতাতে ছিলো না। মিহির আমার থুতনিতে টিপ্পনি দিতেই বুঝতে পারলাম যে ‘শুধু বাঘ মাংসের গন্ধে খাঁচায় আসে না, বাঘিনীরও মাংসের গন্ধে মাতাল হয়।’আমার আর মিহিরের মধ্যে আবার শারীরিক সম্পর্ক হলো।

আমরা দুজনে বসে ছিলাম। ‘আমি আজ রাতে এখানে ঘুমাবো’, এটা বলতেই মিহির হাসি দিলো। আমি সেই হাসির মানে বুঝলাম না। আমার চায়ের নেশা পেলো। আমি চা পানের আবদার করলাম। মিহির আবার হাসি দিলো। ও হয়তো জানতো যে ওর প্রত্যেকটা হাসিই আমার বুকের বামপাশের সূচের মতো বিঁধছিলো। এরপর শুরু হলো তার আর আমার কথার ঝড়।

আমি : আমাকে মনে রাখবে সারাজীবন?

মিহির : মনে রাখার কি আছে? এমন ঘটনা তো সবার জীবনেই ঘটে। সবাই কি মনে রাখে?

আমি : আমাকে মনে রাখবে?

মিহির : না। না। না।

আমি রেগে গেলাম। মিহির আমাকে চলে যেতে বললো। আমি চলে গেলাম। আমি আমার রুমে এসে মিহিরকে নষ্ট মেয়ে বলে গালি দিতে লাগলাম। পৃথিবীর সব ভাষার শব্দ থেকে শব্দ নিয়ে মিহিরকে গালি দিতে মন চাচ্ছিলো আমার। এরপর আমি মাহিনের কথা ভেবে ঘুমোতে গেলাম।

এরপর বেশ দশ পনেরো দিন আমি নিচের ফ্ল্যাটে গেলাম না। একদিন মাহিন আসলো। আমি মাহিনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মাহিনকে আমার লালপদ্মের মতো মনে হলো। মনে হচ্ছিলো ওর গ্রীবা চিবুক থুতনি আর আশি হাজার ভাঁজের ঠোঁট দুটো পানির উপর ভেসে ছিলো। মাহিন চলে গেলো কিছু না বলেই।

মিহির আমাকে ডাকছিলো না বেশ কিছুদিন ধরে। একদিন আমি নিজেই গেলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিলো মাহিনের সাথে সময় কাটানোর। মাহিন আমার কাছে ছিলো ভোর সকালে ফোটা লালপদ্মের মতো। ওর প্রতি আমার মনের টান ছিলো যে টানটা মিহিরের প্রতি আমার একেবারেই ছিলো না। সে রাতে আমি মাহিনকেই খুঁজতে গিয়েছিলাম তার ঘরে। তবে মিহির এসে হাত ধরে তার রুমে নিয়ে গেলো। ‘বাঘিনীর মনে হয় মাংসের নেশা জেগেছে’ একথা মনে মনে ভাবতেই মিহির আমাকে বললো, ‘তোমার জীবনের চলার পথে অনেক ঘটনা ঘটবে। সব ঘটনা তোমার মনে থাকবে না, থাকে না। তোমার সাথে আমার যে রাতগুলো কেটেছে, এগুলো খুব স্বাভাবিক। তুমি না হয়ে অন্যকোনো পুরুষ থাকলেও এই ঘটনা ঘটতো। কতো মানুষই তো এইগুলো করে। এই শহরের চার দেয়ালের মাঝে অনেক কিছুই ঘটে। এইসব নিয়ে কারোর মাথাব্যথা থাকে না। সবাই সবার মতো সবাই চলে। ‘মিহিরের কথাতে আমি নতুন কি শিখলাম সেই দিন। নিজের প্রতি অনেক ঘৃণা লাগতে শুরু করলো। মিহিরের প্রতি ঘৃণা লাগছিলো আরও বেশি। তারপর আচমকা আমার ছোটমামার একটা ঘটনা মনে আসতেই আমার ঘৃণাবোধ কমতে শুরু করলো। আমার ছোটমামা বিবাহিত ছিলো। বিয়ের পরেও সে একটা সম্পর্ক চালিয়ে যেতো। একদিন তাদেরকে আমি হাতেনাতে ধরেছিলাম। আমার হাতে ধরা খাওয়ার পরে মামার মুখটা ছিলো পৃথিবীর সব থেকে বড় অপরাধীর মুখের মতো। শুধু আমার ছোটমামা নয়, তখন আমাদের গ্রামের অনেকের নামেই এই ধরণের অভিযোগের কথা শোনা যেতো। বিবাহ নামক কাঠামোতে থেকে অনেকেই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বজায় রেখে চলতো। হয়তো এখনো অনেকে চলে। সময় এবং পরিবেশ পরিস্থিতি কখন কিভাবে যে মানুষকে তাড়িত করে তা কেবল এর ভুক্তভূগীরাই ভালো করে বলতে পারে। এইসব প্রণয়ের ব্যাপারগুলো মনে হয় এইরকমই হয়। মিহিরের রুমে আমি কোনোদিনও কোনো পূর্বপরিকল্পনা নিয়ে আসি নি। মিহিরের মধ্যে এমন ছিলো কি না আমার জানা ছিলো না। মিহিরের শরীরে বিশেষ ধরণের গুণ ছিলো যা আমাকে জাগিয়ে তুলেছিলো। দুজন দুজনের সম্মতিতেই আমাদের শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিলো। সেখানে কেউ কারোর প্রতি জোর আরোপ করি নি। ‘আমি অন্তত একজন রেপিস্ট ছিলাম না’ এই ভাবনা ভেবে এখনো নিজেকে সান্ত্বনা দিই।

মিহির আঁচ করতে পেরেছিলো যে আমার আর মাহিনের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক চলছিলো। আমি তাকে মাঝে মাঝেই খুব সংকোচবোধে ভুগতে দেখতাম। কেন যে তার মুখের ভাঁজে এমন সংকোচবোধ কাজ করতো তা আমি বুঝতে পারতাম, তবে তা কোনোদিন বলতে যাই নি আমি। এরপর থেকে আমি মিহিরের সাথে আর কোনো শারীরিক সম্পর্কে যায় নি। শুনেছি লম্বা চুলের কেউ একজন নাকি এখন তার রুমে আসতো। আমি ঐসবের খবর খুব বেশি একটা আর নিতাম না। আমার ভাবনায় তখন একটা চাকরি খোঁজা আর মাহিন ছাড়া কিছুই ছিলো না।

একদিন বিকাল চারটার সময় আমার মোবাইল ফোনে একটা কল আসে। মিহিরের কল। সে কানাডা চলে যেতে চাচ্ছিলো। ঐ লোকটার সাথে গিয়ে ওখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার কথা ছিলো। লোকটা মিহিরের জন্যে কানাডাতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি চাকরিরও ব্যবস্থা করেছিলো। মিহির ওখানে চলে গেলো। আমি হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচলাম।

আমি এখন একটি ব্যাংকে চাকরি করি। ছুটিছাঁটা বা আরামের দিন বলতে শুধু শুক্রবার আর শনিবারেই পাই। মাহিনের পড়াশুনা এখনো শেষ হয় নি। তাই ওকে বিয়ে করে সংসারের চাপ ওকে দিতে চাই না। মাহিনের প্রতি আমার মনের আর শরীরের, দুটোর টানই অন্যরকম যা আমি অন্যকারোর মধ্যে পাই নে। দীর্ঘদিন পরে আজ মাহিন আমার সাথে রাত কাটাতে রাজি হয়েছে। তবে কোনো শর্ত ছাড়া যে মাহিন আমার সাথে শুতে যাবে তা কিন্তু নয়। সাত সাতটি লালপদ্ম তুলে নিয়ে আসতে হবে দূর লোকালয়ের কাদাজল পেরিয়ে দিয়ে। আমি কোনো সংকোচ করি নি। মাহিনের সাথে রাত কাটানোর জন্যে এটা আমার কাছে খুব বেশি কিছু না। শুনেছি গোপালগঞ্জের কোনো এক বিলে নাকি লালপদ্ম পাওয়া যায়। আমি একটি ভাড়া করা প্রাইভেটকার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি লালপদ্মের খোঁজে। সারাদিন ঘুরে মাহিনের কথা মতো সাতটি লালপদ্ম নিয়ে বাসার দিকে চলতে থাকলাম। আমি লালপদ্মগুলো আমার চোখের খুব কাছে নিয়ে মাহিনকে সাজাতে লাগলাম। মাহিনের চুলের খোঁপাতে, কাঁকাঁলের বিছাতে, বুকের উপর, মুখের উপর সব জায়গাতে লালপদ্ম দেখতে থাকলাম। আমি চোখ বন্ধ করে শুধু এটা দেখছিলাম যে আমি শুধু লালপদ্মের ভাঁজে আটকে যাচ্ছিলাম। সবচেয়ে বেশি যেখানে আটকে যাচ্ছিলাম, সেটা হলো মাহিন নামক লালপদ্মে। লক্ষ কোটি চুলের ভাঁজে, ঠোঁটের ভাঁজে, চিবুকের চওড়াতে, ওর পদ্মবিলের ছাঁচে। আমি আর দেরি সহ্য করতে পারছিলাম না। ঢাকা শহরের বুকের সব যানজট সরিয়ে যখন রাত দশটায় যখন বাসায় ফিরলাম, তখন দেখি সব শেষ হয়ে গিয়েছে। মাহিনের বুকের উপর চড়ে আছে কেয়ারটেকার মোক্তার। মোক্তারকে বুকের উপর নিয়ে মাহিন তাকে চুমো খাচ্ছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে। ট্যাটনা মোক্তার মাহিনের পদ্মবিলের ছাঁচ ভেঙে ভেঙে গাঙ বানিয়ে দিচ্ছে। এইসব দেখে আমি আমার হাতের লালপদ্মগুলো ছুঁড়ে ফেলে সেই যে মাহিনদের বাসা ছাড়লাম, আর কোনোদিন যাওয়া হয় নি মাহিনের সামনে। এখন আমার জীবনের নিয়মে জীবন চলে। ঐসব নিয়ে এতোটা আর ভাবি না। আমি মাহিনের জন্যে লালপদ্মের খোঁজ পেয়েছিলাম, তবে সেই লালপদ্মের ভাঁজে আমি বন্দী হতে পারি নি। মোক্তার বন্দী হয়েছিলো কোনো লালপদ্ম ছাড়াই।

লেখক: শিক্ষক, জাককানইবি।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন