গল্প: কালো মেঘের আকাশে: তন্ময় নাহা

2

অলংকরণ: নাহিদুল ইসলাম

হাতের  খবরের কাগজটি চার ভাঁজ করে টেবিলের উপর রাখলাম। না, ঠিক রাখলাম না, ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আমি টেবিলের কাছে চেয়ারে বসার জন্য পায়ের উপর থেকে ভর সরিয়ে নিলাম। কিন্তু চেয়ারে বসতে পারলাম না। ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেলাম। যেরকম শব্দ হয়েছে তাতে আমার ‘আ্যাঁ’ জাতীয় চিতকারে বাড়ির মানুষ জড়ো করা উচিত ছিল কিন্তু করলাম না। অনেক সময় মানসিক অস্থিরতা শারীরিক ব্যাথাকেও বুড়ো আঙ্গুল দেখায়। আমার ক্ষেত্রেও হয়তো সেটাই হয়েছে। আজ আমি মানসিকভাবে অস্থির কারণ আমার অহংকার চূর্ণ হয়েছে। আমার ধারনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমার ধারনা ছিল আমার দ্বারা কখনো কারো ক্ষতি হতে পারে না। কিন্তু হয়েছে। শুধু ক্ষতি না একজন মানুষ আমার জন্য মারা গেছে ভেবেই শরীর রিনরিন করে উঠছে। এক অদ্ভুত অপরাধবোধ আমাকে তিলে তিলে গ্রাস করে নিচ্ছে। আমি কি খুনি? ‘না আমি খুনি নই, আমার উদ্দেশ্য কাউকে মারার জন্য ছিল না’ এই কথাটি চিতকার করে সবাইকে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। আশ্চর্য, মানসিক অস্থিরতার এত শক্তি কীভাবে হলো, যেন আমার থেকে শেষ বিন্দু শক্তিটিও নিংড়ে নিল। আমার চিতকার করার ক্ষমতা নেই, নেই উঠে দাঁড়ানোর শক্তি। আমার চোখে এখন শূন্য দৃষ্টি। আমি তাকিয়ে আছি জানালার শিকের ভিতর দিয়ে বাইরের কালো আকাশে। চোখে এক এক করে বিস্মৃত সব স্মৃতি ভেসে চলেছে নিজের মতো করে। আমার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই তা নিয়ন্ত্রণ করার। আমি যেন এক সস্তা খেলার পুতুল।

সপ্তাহখানেক আগের কথা। সেদিনও আকাশে মেঘ জমে ছিল। আকাশ কালো হয়ে আসছিল ক্রমেই । সেই ছুটির দিনের সকালে আমরা পুরো পরিবার একসাথে নাস্তা করছি। বাবা ব্যাংকে চাকরি করার কারনেই ছুটির দিনটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই একটা মাত্র দিনই বাবা আমাদের সাথে থাকেন।  

ছোট সুখী আদর্শ পরিবার যাকে বলে তার উপযুক্ত উদাহরণ আমাদের পরিবার। আমি দশম শ্রেণির ছাত্র, স্থানীয় এক স্বনামধন্য স্কুলে পড়ি আর আমার ছোট বোনও এইবছর থেকে সেই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী হয়েছে। আমার মা একজন আদর্শ‌ গৃহিণী। টিভি নাটকে যে সকল মহিলা নীরবে সবকিছু সয়ে পরিবার ধর্ম পালন করে ঠিক সেইরকম আমার মা। মাকে এককথায় ভদ্র মহিলাদেরও ভদ্র মহিলা বলা যায়। আর আমার বাবা আমার দেখা দুনিয়ার একমাত্র পুরুষ যিনি উদাসী ভাব নিয়েও কোন স্বনামধন্য কবি না হয়ে ব্যাংকের ম্যানেজারের মতো যথেষ্ট গাম্ভীর্যপূর্ণ কাজ করছেন। তার অফিসের কাজকর্মেও কোন উদাসী ভাব আছে কি-না আমাদের জানা নেই , তবে এই বিষয়ে কোন অভিযোগ এখন পর্যন্ত আমাদের কানে আসেনি । ছোট পরিবারের ছোট ব্যাখা ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। আমাদের পরিবার সুখী পরিবারও বটে।  

বিষয়টি একটু অন্যরকম রকম শোনায় তাই না? বেশিরভাগ সত্যিকারের সুখী মানুষই ব্যাখা করতে পারবে না তারা কেন সুখী। রাশিয়ান লেখক লিও টলস্টয় বলছেন ‘প্রতিটি সুখী পরিবারই একরকম আর প্রতিটি দুঃখী পরিবার তাদের নিজেদের কারণেই দুঃখী’। তাই আমরা সুখী কারণ অন্য সুখী পরিবারের সাথে আমাদের মিল রয়েছে । কী মিল জানা নেই। সবচেয়ে বড় কথা আমরা সুখী।

তাড়াহুড়ো করে নাস্তা পর্ব শেষ করে বাবা উঠে চলে গেলেন। এখন টেবিলে মা, আমি আর টুসনি (আমার ছোট বোন)। মা টুসনিকে খাইয়ে দিচ্ছেন।

বাবা বেশ আয়োজন করে ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছেন দেখে মা খানিকটা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘এই দিনে তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

বাবা নিজের হাতের বাজারের ব্যাগটা উঁচিয়ে ধরে বললেন ‘বাজারে যাচ্ছি। এখন বৃষ্টি পড়ছে না, তাড়াতাড়ি বাজার করে আসি।’

‘পড়ছে না, পড়বে। দেখছো না আকাশের অবস্থা?’

‘যত গর্জে তত বর্ষে না । তাছাড়াও এই সপ্তাহে দম ফেলারও সময় পাবো না, বাজার করা তো দূরের কথা।’

মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ততক্ষণে বাবা বেরিয়ে পড়েছেন। তিনি একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার টুসনিকে খাওয়াতে শুরু করলেন।   

মার দীর্ঘশ্বাস ফেলার কারণ তিনি বাবার বাজারে যাওয়ার পিছনের কারণ ধরে ফেলেছেন। বাবার মধ্যে এখনো খুব অল্প করে হলেও সুক্ষ্ম একটা ছেলেমানুষি ভাব রয়ে গেছে। সমগ্র কবিসমাজের কবিদের মতো আমার বাবাও বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসেন। কিন্তু অল্প কয়েকদিন আগে বৃষ্টিতে ভিজে বাবা এক হুলুস্থুল রকমের জ্বর বাধিয়ে ফেলেছিলেন। তার যে বয়স হচ্ছে তা তিনি কেন যে মানতে চান না সেটা বোধহয় একটু ভাববার বিষয়। আজও নিশ্চয়ই জ্বর হবে সেক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি রকমের কিছু হবে কি-না সেটাই একমাত্র চিন্তার কারণ।

খাওয়া শেষ করে বারান্দায় এসে দুই হাতলযুক্ত চেয়ারে বসলাম। আকাশ এখনও থম ধরে আছে। সকাল এগারোটার কিছু কমবেশি হবে হয়তো কিন্তু আকাশের অবস্থা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। মনে হচ্ছে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।

দূরের বিদ্যুৎ লাইনের উপর কিছু কাক বসে কা কা করে ডাকছে। কাকের গলা যত কর্কশ হোক না‌ কেন এই থম ধরা আকাশের সাথে খুব মানিয়েছে। শুনতে এতটা খারাপ লাগছে না।

শুধু শুধু বসে থাকার কোন মানেই হয় না, কিছু চিন্তা করা যাক। যেমন বাবার বিষয়ে, তিনি বাজারে যাওয়ার সময় যে প্রবাদটি বলে গেলেন ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ এইক্ষেত্রে আকাশে গর্জানোর কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না বলেই বোধহয় আজকের বৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হবে। আবার পিঁপড়া নাকি ভূমিকম্পের আভাস মানুষের আগে পায়, তবে কী কাকেরাও ঝড়বৃষ্টির আভাস মানুষের আগে পায়? সেজন্যই কী এরা কা কা করে ডাকছে? আমাদের সতর্ক করছে?

আমার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটলো। বুড়ু দা, বুড়ু দা বলে টুসনি আমাকে খুঁজছে। আমি টুসনির উদ্দেশ্যে গলা উঁচিয়ে বললাম ‘আমি বারান্দায়। বারান্দায় আয়।’

আমার ভালো নাম বরুন সাহা। তবে মা আমাকে ‘বুড়া’ বলে ডাকেন। কখন থেকে ডাকেন জানা নেই। বুঝবান হওয়ার পর থেকেই মার কাছে আমি ‘বুড়া’ ডাক শুনে আসছিলাম। বুড়ো আঙ্গুল যেমন জন্ম থেকেই বুড়ো আমিও জন্ম থেকেই বুড়া। টুসনিও মাকে অনুকরণ করে আমাকে ‘বুড়া’ বলে ডাকতো। তবে কিছুদিন পরেই আমার প্রমোশন হয়, সে আমাকে তখন ‘বুড়া দা’ বলে ডাকতে শুরু করছে। আমি এই বিষয়ে মার কাছে একাধিক বার অভিযোগ করার পরেও ফলাফল শূন্য দেখে অভিযোগ করা ছেড়ে দিয়েছি। টুসনির নতুন স্কুলের নতুন এক বান্ধবী নাকি খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে। তাই সেও সুন্দর করে কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে সারাক্ষণ। তাঁর সুন্দর করে কথা বলার বলি স্বরুপ এই ‘বুড়ু দা’। তার ধারনা বুড়ার চলিত রূপ বুড়ু।

টুসনি বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। তার হাতে ‘জাপানের রুপকথা’ নামের একটি বই। বইয়ের মলাটটি হলুদ রংয়ের। তাতে বিভিন্ন ধরনের সবুজ লতাপাতা আর অদ্ভুত সব গাছের ছবি আঁকা। গাছগুলো অদ্ভুত কারণ আমার ধারনা পৃথিবীতে এমন গাছ নেই। আমি বুঝতে পারলাম আমাকে গল্প পড়ে শোনাতে হবে।

টুসনি আমার দিকে তাকিয়ে বললো ‘আজ গল্প পড়ে শোনাতেই হবে।’

আমি কিছুক্ষণ টুসনির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। গোলাপি গোল গলার গেঞ্জি আর কালো থ্রী কোয়াটার প্যান্টে তাকে চমৎকার মানিয়েছে। এত সুন্দরী ছটফটে একটা বাচ্চা মেয়ে অথচ গলার স্বরে কত দৃঢ়তা।

গত তিন দিন যাবৎ তাকে গল্প শোনানোর আশ্বাস দেওয়া হয়েছে কিন্তু শোনানো হয়নি বলেই কী গলার স্বর এত দৃঢ়? আমি বুঝতে পারলাম আর আশ্বাসে কাজ হবে না। এবার তাকে গল্প শোনাতেই হবে। তবুও একটা শেষ চেষ্টা করলাম। কথা ঘুরিয়ে দেবার জন্য টুসনিকে কাক এর দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইঙ্গিত করে দেখতে বললাম। এখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ভাব ভালো নয়। মনে হচ্ছে সারাদিন এইরকম ভাবে পড়তেই থাকবে।

কাকগুলো এখনও কা কা করেই চলেছে। টুসনি সেদিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। তার মুখের ভাবান্তর নেই।

আমি রহস্য করে বললাম ‘কাকের ডাকের সাথে নাকি মানুষের মৃত্যুর একটা সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের দিদিমা যেদিন মারা যান সেদিনও তিনি নাকি খুব কাকের ডাক শুনেছিলেন। আজকেও কাক ডাকছে। আমার খুব ভয় করছে।’

টুসনি এইবার চোখেমুখে হাসি ফুটিয়ে বললো ‘আজ তোমাকে গল্প বলতেই হবে। আর কোন কথা শুনবো না।’

এইটুকু টুসনির বুদ্ধিতে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মুখের হা গোল আলুর মতো হয়ে আসলো মনে হয় । একটু নিষ্প্রভ হয়ে মৃদু স্বরে বললাম ‘কিন্তু আমার যে ভয় করছে।’

টুসনি চোখমুখ এইবার শক্ত করে ঝাঁজালো গলায় বললো ‘ওহ্ দাদা তুমি এত বোকা ! একটা কাক মারা গেছে তাই অন্য কাকেরা কান্না করছে। মানুষ যেমন ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে।  কাকেরা ও তেমনি কা কা করে কাঁদে ‌‌।’

এই মুহূর্তে আমার অন্য সকল মানুষের মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমি আমার ছোট বোনের কাছে হার শিকার করে নিয়ে বললাম ‘আচ্ছা, বইটা দেখিতো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনবি?’

‘পা সোজা করে বসো। কোলে বসবো’

আমি পা সোজা করে টুসনিকে কোলে বসালাম। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বইয়ের পৃষ্ঠা খুলে পড়তে শুরু করলাম। টুসনি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প শুনছে। মাথা দোলানার কারনে তার লম্বা লম্বা চুলগুলো আমার চোখে মুখে এসে লাগছে। পড়তে সমস্যা হচ্ছে কিন্তু রাগ হচ্ছে না বরং ভালোই লাগছে। একেকবার টুসনি মুখ পিছনে ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ‘দাদা রুপকথা কী সত্যিই আছে?’

‘হ্যাঁ আছে। আমাদের জীবনও কিছুটা রুপকথার মতোই।’

খুব জোরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। কাক গুলো এখনও কান্না করছে কিংবা আন্দোলন। যদি আন্দোলন হিসেবে ধরে নিই তবে কাকেদের কাছ থেকে মানুষের শেখার অনেক কিছুই আছে।

গল্পের মাঝ পথে আছি যেখানে রুপকথার রাজ্যের রাজকন্যা হারিয়ে যায়। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে আমার আর টুসনির শরীরে। বই ও কিছুটা ভিজে গেছে। এইসময়ে দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। বোধহয় অনেকক্ষণ ধরেই হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ উপেক্ষা করে ঠক ঠক শব্দ হয়তো শোনা যায়নি।

টুসনি আমার কোল থেকে নেমে পড়লো ছলাৎ করে। সাধারণ ঝরনা জলের ক্ষেত্রে আমরা ছলাৎ উপমা ব্যবহার করে থাকি। পাহাড় গা ঘেঁষে ঝরনার জল যেমন শূন্য থেকে ঝাঁপিয়ে নিচে পড়তে থাকে, কিছুটা ওইরকম ভাবেই টুসনি আমার কোল থেকে নিচে নেমে পড়লো।

টুসনি আনন্দে চোখ বন্ধ করে লাফিয়ে লাফিয়ে বলতে লাগলো ‘বাবা এসে পড়েছে…..বাবা এসে পড়েছে …..আমার জন্য ম্যাংগো বার এনেছে।’

আমি বললাম ‘বাবা না , হিবু এসেছে। যা দরজা খুলে ওকে বারান্দায় নিয়ে আয়। আর এই বইটাও নিয়ে যা। আবার আগামীকাল পড়ে শোনাব বাকিটুকু। এখন তো আমার আর তোর দুজনেরই গরমের ছুটি।’

‘তুমি কীভাবে বুঝলে যে হিবু দা এসেছে? বাবাও তো হতে পারে বা ওই কাক গুলোও তো দরজায় ঠোকর দিতে পারে।’

‘এমনিই বুঝলাম। দরজাটা খুলে দিয়ে আয়, অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে আছে বেচারা।’

‘না, কীভাবে বুঝলে আগে বলতে হবে ।’ টুসনির গলার স্বর এইবারও দৃঢ়।

আমি খানিকটা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বললাম ‘তুই না….. এতো গোঁয়ার হয়ে যাচ্ছিস কেন দিনকে দিন? শোন প্রত্যকটি মানুষের যাওয়ার সময় দরজা লাগানোর শব্দ একরকম। কিন্তু আসার সময় দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ প্রত্যক মানুষের হয় আলাদা। আর হিবু এইভাবেই দরজায় টোকা দেয়। বুঝেছিস ? এখন দরজা খুলে দিয়ে আয়, বইটাও নিয়ে যা।’

টুসনি বই নিয়ে চলে গেল। আমি তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। গর্জনহীন বৃষ্টি। নতুন একটা প্রবাদ বলা যায় না ‘যতই না গর্জে ততই বর্ষে’।  অর্থ্যাৎ গর্জনহীন বর্ষার স্থায়িত্ব হবে অনেক।

আমার দৃষ্টি বাইরের বাঁধনহারা বর্ষনের দিকে। এদিকে চুপিচুপি হিবু এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়। আমি খেয়াল করিনি। সে বললো ‘আরে বুড়ু দা যে! কী খবর আপনার? আজ একটু উদাসী উদাসী ভাব মনে হচ্ছে।’

আমি ভেতরে ভেতরে একটু চমকে উঠে তাকালাম হিবুর দিকে। সে আমার খুব সামনে চলে এসেছে অথচ টের পাইনি। আমি হিবুর দিকে তাকিয়ে আছি।

নাদুসনুদুস চেহারার হিবুর চুল এখন একেবারেই অগোছালো। টপটপ করে জল ঝরছে। তার পরনের খয়েরি রংয়ের শার্ট পুরোপুরি ভিজে গেছে। পায়ের কালো প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত ভাঁজ করে উঠানো। গোড়ালির কাছে অল্প অল্প কাদামাটি লেগে আছে। সে দারুণ তৈরি হয়েই বারান্দায় এসেছে। একহাতে ছোট টুল আরেকহাতে টাওয়েল দিয়ে নিজের চুলের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। দুষ্টু হাসি।

আমিও হেসেই জবাব দিলাম ‘হ্যাঁ হুবু দা, একটু উদাসী হয়েই পড়লাম। ভাবছি কবিতা লিখবো। কবিতার নাম হবে ‘মেঘমেদুর বর্ষা’। কেমন হয়?’

সে আমার প্রশ্ন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে খানিকটা মেকি আতঙ্কিত স্বরে বললো ‘সেকি, আমার নামও ‘হুবু’ হতে চলেছে নাকি?’

‘আমি যদি বুড়া থেকে বুড়ু হয়ে যাই তবে তোর ক্ষেত্রে হিবু থেকে হুবু হয়ে যাওয়া কী খুব অসম্ভব কিছু?’

হিবুর ভালো নাম হিমেল বষাক। তবে আমার মা ওঁর সেই বড় নামকে এক অভিনব কায়দায় ছোট করে ‘হিবু’ বানিয়েছে। তিনি হিমেল থেকে হি নিয়ে এবং বষাক থেকে ব নিয়ে প্রথমে তার নামকরণ করে ‘হিব’। তারপর আস্তে আস্তে সেই হিব আমাদের কাছে আজকের হিবু। কালে কালে ভাষার শব্দ সম্ভার কীভাবে পরিবর্তন হয় তা হিব থেকে হিবু হয়ে যাওয়াতে কিছুটা দৃশ্যমান। এখন তার এই ডাকনামটি তার পরিবার স্বীকৃত। তবে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি এই ব্যাপারে যে ডাকনাম দেওয়ার এই অভিনব প্রক্রিয়া আমার সময় আবিস্কার হয়নি। হলে হয়তো আমার নাম বরুন থেকে ব এবং সাহা থেকে সা নিয়ে ডাকনাম হয়ে যেত ‘বসা’। টুসনি হয়তো আমাকে ‘বুসু’ দা ডাকতো। হিবু হয়তো এখন এসে রসিকতা করে বলতো ‘বসা দা, বসবো?’

হিবু আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো ‘কী এতো ভাবছিস?  অমন করে হাসছিস কেন? তোর ভাবসাব তো ভালো ঠেকছে নারে বুড়া।’

আমি বললাম ‘কিছু না‌।‌‌’

কালো মেঘের আকাশে দুপুরের আলোও যেন ম্লান হয়ে আছে। সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নময় লাগছে দেখতে। আমি হিবুর দিকে তাকিয়ে বললাম ‘আমি ভেবেছিলাম তুই আজ আসবি না। এত বৃষ্টি!’

‘আসবো না ভেবেছিলাম। তারপর ভাবলাম শুধু শুধু আম কাঁঠালের ছুটিটা ঘরে কাটানোর মানে হয় না। আমি যখন ঘর থেকে বের হয়েছি তখন বৃষ্টি ছিল না।’

‘আম কাঁঠাল তো…….’ আমার কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে হিবু প্রায় বিশ্বকাপ জেতার উল্লাস নিয়ে বললো ‘পেরেছি, রহস্য উদঘাটন করে ফেলেছি।’

‘কীসের রহস্য? কীসের উদঘাটন?’

‘মনে নেই তোর, মনে নেই? ওই যে চিঠিটা, তিন্নি যেটা তোকে দিয়েছিল। তুই যে কিছু না বুঝে ফেলে দিতে চেয়েছিলি। পরে আমি কুড়িয়ে নিয়ে অনেক গবেষণা করে রহস্য উদঘাটন করেছি।’

‘ভাল করেছিস।’

হিবু আহত গলায় জিজ্ঞেস করলো ‘তুই শুনতে চাস না বুড়া?’

‘না। কারণ ওই চিঠির কথা আমি ভুলে গেছি।’

‘আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি।

 চিঠিতে লেখা ছিল :

                     nurabuoyevoli

                                    From Tinni  

এখন এই চিঠিটা যদি আয়নার সামনে রাখা হয় তাহলে দেখবি….’ এই বলে হিবু সীমাহীন উৎসাহ নিয়ে চিঠিটা নিজের কোমরের কাছে প্যান্টের গুপ্ত পকেট থেকে বের করল। হিবু চারদিক তাকিয়ে আয়নার খোঁজ করলো কিন্তু পেল না। তাতে তার উৎসাহ দমে গেল না। সে বলল ‘আরো একটি উপায় আছে । চিঠিতে যা লেখা তা পিছন থেকে লিখলেই ক্যাল্লা ফতে।’ এইবলে সে কাগজ কলম আনতে ঘরে যেতে টুল থেকে উঠে দাঁড়াল।

আমি একহাত উঁচিয়ে সবকিছু উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম ‘বাদ দে তো। আমার জানার ইচ্ছে নেই। রহস্যকে সবসময় রহস্যময় করে রাখতে হয় । তাতেই না আসল মজা।’

তিন্নি আমাদের সাথেই একই স্কুলে পড়ে। বেশ সুন্দরী মেয়ে এবং ভালো ছাত্রী। অহংকার করার সবগুলো গুণ তার মধ্যে যেহেতু আছে সেহেতু সে অহংকারী। আমার ধারনা সে আমাকে পূর্ব জন্ম এবং আগামী কয়েক জন্মের ভবিষ্যত শত্রু মনে করে বলেই আমাকে দেখে দাঁত কিড়মিড় করে তাকায়। একদিন সে জ্বলন্ত চোখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে তার এক মধ্যস্থতাকারী বান্ধবীর মাধ্যমে আমাকে শুনিয়ে বলে ‘নে ওকে এই চিঠিটা দিয়ে দে।’  

সেদিন আমি চিঠিটা নিয়েছিলাম কিন্তু সেটির অর্থ উদঘাটন করতে পারিনি। এদিকে তিন্নির কাছে গিয়ে চিঠির অর্থ সম্পর্কে জানতে চাওয়া আমার সাহসে কুলাবে না ভেবে চিঠিটা গুটিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু কোন সাংকেতিক ভাষায় কথা লেখা আছে ভেবে এই চিঠির রহস্য উদঘাটন করতে হিবু সেই চিঠি কুড়িয়ে নেয়। আজ সেই চিঠির আসল কথা আমার জানতে একটুও ইচ্ছে নেই। কিছুটা ভয়ও করছে অবশ্য। কারণ আমার ধারনা কোন অভিনব উপায়ে তিন্নি আমাকে গালাগালি করেছে সেই চিঠিতে। আর হিবু সেই গালাগালের রহস্য উদঘাটন করেছে। সে যেরকম মেয়ে, বাবারে বাবা! তাকে দেখলেই আমার শরীরের রক্ত তরল জলে পরিণত হয়ে যায়।

হিবুর মুখ কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছে। তবে তাতে আমার কোন দুশ্চিন্তা নেই। তার মতো ছেলেরা কোন বিষয়ে দ্রুত অভিভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমি কী বলবো তাকে ভেবে পাচ্ছি না। এমন সময় দিনের ম্লান আলো হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেল। খুব অল্প সময়ের জন্য আকাশে ঝকমকিয়ে উঠল। হিবুর মুখের কৃষ্ণ বর্ণ কিছু সময়ের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল। খুব অল্প সময়ের জন্য বোধহয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য আকাশের বুক চিরে বজ্রপাতের আলোক ঝলকানি খেলে গেল। আশ্চর্য, কোন শব্দ হলো না। তার প্রায় বেশ কিছু সেকেন্ড পর গুড়ুম গুড়ুম শব্দ শোনা গেল। আমি বেশ অবাক হলাম। এই আলোক ঝলকানির সাথে নিতান্ত এত ভদ্র সভ্য টাইপের আওয়াজ মেনে নিতে পারলাম না।

প্রতি সেকেন্ডে নাকি পৃথিবীতে দুইশত বার বজ্রপাত হয়। সেক্ষেত্রে এই সেকেণ্ডে এই বজ্রপাতও দুইশত বার এর একটি। তবে একটা জিনিস খুব আশ্চর্যের , সিনেমাতে যতবারই বজ্রপাত হয় ততবারই বজ্রপাতের বিকট আওয়াজ আর আলোক ঝলকানি একসাথেই হয়। কিন্তু বাস্তবে আলোক ঝলকানি আগে হয় তারপরে হয় শব্দ‌। আলোর গতি যে শব্দের গতির তুলনায় বেশি তার সবথেকে ভালো হাতেনাতে প্রমাণ বোধহয় এটিই।

আমি আকাশের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রায় বিড়বিড় করে বললাম ‘রয় সুলিভান…!’

কিন্তু এই বিড়বিড় শব্দও হিবু ঠিক শুনে ফেলল। সে অতি উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘কী বললি? রয় সুলিয়ান?’

আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম ‘রয় সুলিয়ান নয়, রয় ক্লিভিলেন্ড সুলিভান (Roy Cleveland Sullivan)। যিনি সাতবার বজ্রপাতের শিকার হন আর প্রত্যকবারই বেঁচে যান। যার নাম গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বুকে লেখা আছে। সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের শিকার হওয়ার পরও জীবিত থাকতে পারা মানুষ হিসেবে।

‘তুই জানিস কীভাবে? তাকে দেখেছিস টিভিতে?’

‘না দেখেনি, তবে পড়েছি। আর দেখার সুযোগ ও নেই তিনি মারা গেছেন।’

হিবুর মুখ থেকে হতাশার ছাপ দূর হয়েছে। তার মুখ এখন আগের মতো উজ্জ্বল। সত্যিই সে দ্রুত অভিভূত হয়। মাত্র কিছুক্ষণ আগেও সে চিঠির বিষয়ে কথা বলছিল আর এখন জনাব সুলিভান এই বিষয়ে জানতে চাইছে। আর আমিও তার উৎসাহের আগুনে ঘি ঢালার চেষ্টা করছি।

‘বজ্রপাতের কবলে পড়েও মানুষ জীবিত থাকে!’

‘একবার তো নয়, সাত সাতবার জীবিত ছিলেন। এইজন্য তাকে ডাকা হতো ‘Human lighting conductor’ এবং ‘Human lighting rod’ নামে। তবে এই মানুষটির জীবনের শেষ দিনগুলো খুব দুর্বিষহ গেছে। তাকে মানুষজন এড়িয়ে চলতো, তাদের ধারনা সুভিলান সাহেবের সংস্পর্শে থাকলে তাঁরা ও বজ্রপাতের শিকার হতে পারে। এইসব দুঃখ সহ্য করতে না পেরেই হয়তো ১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যার পথ বেছে নেন নিজের মাথায় গুলি করে। তখন তার বয়স ছিল ৭১ বছর।’

আমি শেষটায় ইচ্ছে করেই সুলিভান সাহেবের জীবনের করুণ পরিণতি উল্লেখ করলাম যাতে হিবু এই বিষয়ে অন্তত অভিভূত না হয়। একবার সে মাকড়সা ধরে নিজের হাতের উপর রেখেছিল কামড়ানোর জন্য। তার ধারনা মাকড়সার কামড়ে তার মধ্যে অতি শক্তিশালী এক সুপার হিরো জন্ম নিবে। কিন্তু তার ভাগ্য ভালো সেই মাকড়সা সম্ভবত নিরামিষ ভোজী ছিল। তাই তাকে কামড় দেয়নি।

হিবু একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ধারনা সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেও আকাশ দেখতে পাচ্ছে না। তার চোখ এখন শুধু রয় ক্লিভিলেন্ট সুলিভান সাহেবের কাল্পনিক রুপ দেখাচ্ছে। আর সে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে আছে।

যমে মানুষে টানাটানি বলে একটা কথা আছে। গল্প উপন্যাসে যমে মানুষের টানাটানির অনেক হৃদয়স্পর্শী ঘটনার সম্পর্কে আমাদের বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজ প্রায় সকলেই জানে । কোন প্রেমের উপন্যাসে হয়তো নায়ককে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি বেঁধে গেল, তখন দেখা গেল নায়িকা এসে কান্না জুড়ে দিয়ে বলবে ‘না তুমি একা যেত পারো না, বাঁচলে আমরা একসাথে বাঁচবো মরলেও একসাথে মরবো’। অনেক সময় তীব্র বেদনা থেকে নায়করাও এসব কথা বলে থাকেন তবে সেক্ষেত্রে নায়িকাকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি হয়। তাছাড়াও আরও অন্য চরিত্র তো আছেই যাদের নিয়ে যমে মানুষের টানাটানির কাছে মানুষ হার মানে এবং এক হৃদয়বিদারক কাহিনীর সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো মানুষেরা ‘আসবার কালেও আইলাম একা যাইবার কালেও যাইবো একা’ হয়ে পৃথিবীতে আসে এবং বিদায় হয় না?

যমে মানুষের টানাটানি কথাটি নিয়ে আমার নিজের একটি ব্যাখা আছে। বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞেরা এই ব্যাখা কীভাবে নিবেন জানা নেই তবুও বলতে তো বাধা নেই। যমরাজ যিনি মৃত্যুর দেবতা তাঁর সাথে মুমূর্ষু বা মরনাপন্ন রোগীর নিকট মানুষের একটা অদৃশ্য যুদ্ধ হয়। যমরাজ চান মরনাপন্ন রোগীকে মৃত্যুপুরীতে নিয়ে যেতে আর মরনাপন্ন রোগীর নিকট মানুষেরা চান সেই মরনাপন্ন রোগীকে তাদের কাছে রেখে দিতে । এই অদৃশ্য যমে মানুষের যুদ্ধ ততদিন চলে যতদিন না রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন কিংবা সুস্থতার দিকে এগোতে থাকেন।

আমার বাবাও ঘরে এসে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন । তাকে নিয়েও প্রায় এক সপ্তাহ আমাদের সাথে যমরাজের যুদ্ধ চলল । অবশেষে যম রাজ হার মানলেন। এখন বাবার শরীরের অবস্থা সুস্থতার দিকে। একসপ্তাহ কেটে গেছে। সেদিন হিবু চলে যাওয়ার পর আর এইদিকে আসেনি। এটা একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা টানা এক সপ্তাহ তার সাথে যোগাযোগ হয়নি এমনটি আগে কখনো হয়েছে কিনা মনে করতে পারলাম না। চলে যাওয়ার সময় তার চোখেমুখে একটা ঘোর লাগা ভাব ছিল। সে জনাব রয় ক্লিভিলেন্ট সুলিভান এর কথা শোনার পর থেকেই কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। সে যাওয়ার সময় পর্যন্ত কোন কথা বলেনি। চুপচাপ উঠে চলে গিয়েছিল।

তার কিছুক্ষণ পরেই বাবা আসে। চোখ লাল, মাথা দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে, ভেজা শার্ট এর সবগুলো বোতাম লাগানো, প্যান্টও ভিজে পায়ের সাথে সেঁটে আছে। আশ্চর্য, জুতা নেই, খালি কাঁদা মাখা পা। শরীরের চামড়াও অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে কুঁচকে গেছে। তবে তার মুখের ভাবে একটা তৃপ্তির রেখে ভেসে আছে। তার মুখে হাসি। আমাকে বাজারের ব্যাগ দিয়ে বললেন গরম জল বাথরুমে দিয়ে আসতে। আমি তাই করলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে । ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ প্রবাদটির  সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। মেঘের গর্জন শুরু তো বর্ষন শেষ। সেইদিন বিকাল থেকেই বাবার আকাশ পাতাল জ্বর।  আজ এক সপ্তাহ পর ছুটির দিনে বাবার অবস্থা‌ আগের থেকে ভালোর দিকে।

এই কয়দিন হিবুর খবর নেওয়া হয়নি। তবুও কেন জানি মনে হচ্ছে আজ হিবুর সাথে দেখা হবে কিংবা তার খবর জানতে পারবো‌ । আমার বাবা অসুস্থ জানলে ও নিশ্চয়ই দেখা করতে আসতো।

আমাদের বাসায় সকালের প্রথম খবরের কাগজ আমি পড়ি। বাবা পড়েন রাতের বেলা। তিনি বাসি খবর পছন্দ করেন। তার কথা মতে দুটো জিনিস তরতাজা থেকে বাসিই বেশি ভালো, এক পোলাও আর দুই খবরাখবর।

আমি খবরের কাগজ হাতে নিলাম। ইদানিং ধর্ষণ খুব বেড়ে গেছে।  আমি খুব সতর্কতার সাথে এইসব খবর এড়িয়ে চলি। আজকেও তাই করলাম। আমার প্রধান আকর্ষণ সম্পাদকীয় পাতা। মোটামুটি আমার কিছু প্রিয় লেখকের লেখা হলে পড়ি নয়তো খেলাধুলার পাতায় চলে যাই। আজ জাফর ইকবাল স্যারের ‘সুরঙ্গ শেষের আলো’ শিরোনামে একটি লেখা বের হয়েছে । খুব তৃপ্তি সহকারে পড়া শেষ করলাম। পাতা উল্টিয়ে দেখতে পেলাম খুব ছোট করে এক জায়গায় লেখা ‘বজ্রপাতের শিকার স্কুল ছাত্র’। আমার মনে একটা নাম না জানা ভয় খেলে গেল। হাত অসাড় হয়ে এল। পায়ের উপর থেকে দ্রুত শক্তি অনত্র চলে যেতে লাগল। হঠাৎ করেই নিজেকে অনেক দূর্বল অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। তবুও খুব কৌতুহল নিয়ে লেখা পড়া শুরু করলাম কিন্তু শেষ করতে পারলাম না। একজায়গায় গিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে বজ্রপাতের শিকার আমাদের হিবু। আমার পা থেকে যেন সমস্ত শক্তি নিংড়ে বের হয়ে গেল। চোখ দিয়ে জল ঝরছে অঝোরে। আর পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম। আজও আকাশ কালো করে দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছে। চেয়ার ধরে ওঠার বৃথা চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ। হঠাৎ দমকা বাতাসে টেবিলের উপর থেকে খবরের কাগজ মাটিতে পড়ে গেল। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সেদিকে। মনে হতে লাগলো হিবুর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। শারীরিকভাবে একজন মানুষ আরেকজনকে মারলে সেটা অপরাধ‌ বলে গন্য হয় । কিন্তু আমি যে হিবুকে মানসিকভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি তা কী অপরাধ নয়? বাংলাদেশের সংবিধান মতে আমার কী শাস্তি হবে না? সবচেয়ে বড় কথা আমি কী অপরাধী?

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

2 মন্তব্যগুলো

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন