গল্প : একলা বিভ্রমে : মেহেদী উল্লাহ

2

অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

কোনো এক এইচএসসি পরীক্ষার আগের কথা। এক যে ছিল গণিত স্যার। স্যারের কথা কী আর বলব! আরে ভাইরে ভাই! কলেজের সময়টুকু বাদ দিলে খালি প্রাইভেট আর প্রাইভেট! লাইনে লাইনে ছাত্র-ছাত্রী বাড়ি এসে পড়ে যায়। কেউ ম্যাথে এপ্লাস পেলেও স্যারের সুনাম, না পেলেও স্যারের নাম টানে লোকে। স্যারের কাছে পড়ছ না! পাবাই তো। স্যারের কাছে পড় নাই, আগেই বলছিলাম! স্যারের কাছে না পড়েও কেউ এপ্লাস পেলে তাকে কে কি বলে জানা যায় না। হয়তো বলে, স্যারের ক্লাস মনযোগ দিয়ে করেছে, প্রাইভেট দরকার হয় নাই। তো ঘটনা তা না, ঘটনা হইছে দুই ফ্রেন্ড রিয়া আর জুন; স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ত তারা। অনেকেই তো স্যারের কাছে পড়ে। তাদের কথা কেন আলাদা করে বললাম? এমনি এমনি কী বলছি! কারণ আছে। এইখান থেকেই ঘটনার শুরু। সামনে পরীক্ষা! একদিন স্যারের কাছে ম্যাথ করছিল তারা। মাঝে জুন, ডানপাশে স্যার আর বামপাশে রিয়া। তো, জুন একটা সূত্র ভুলে গেছে। তার হাতে ছিল একটা স্কেল। সে ম্যাথ করতে করতে বারবার স্কেল দিয়ে রিয়াকে খোঁচাচ্ছিল। অনেকক্ষণ পর দেখল স্যার তার দিকে চোর ধরার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। সে স্যারকে খোঁচাচ্ছিল! স্যার কী খেপে গেছিলেন? ধমক দিছিলেন? সেদিকে আর যাবই না। ঘটনা ভিন্ন জায়গায়। অংকের খেলা ভঙ্গ হল!

ঘটনা হইতেছে, গল্পের এইটুকুর প্রতিবাদ চোখে পড়ল। কে প্রতিবাদ করল? হয়তো যাকে নিয়ে গল্পটা সেই প্রতিবাদ করল! গল্পের লেখককে ম্যাসেঞ্জারে লিখে পাঠাল। রিয়াকে নিয়ে নাকি গল্প তাই সেই প্রতিবাদ করল। রিয়া কী করে? রিয়া লেখালেখি করে। কী নিয়ে লেখালেখি করে? গল্প লেখালেখি করে। কী রকম গল্প লেখে? গল্প লেখে বলেই তো বলছি গল্প লেখে। না লেখলে কেন বলব! আচ্ছা, সে বিষয়ে পরে বলব। আগে গল্পটার শুরু নিয়েই রিয়ার আপত্তির কথা বলি। রিয়া লেখককে লিখে পাঠিয়েছে: ‘আপনি তো ভুল বলছেন। ম্যাথ ভুলে আমি গিয়েছিলাম, জুন না! আমার নাম রিয়া, শুধু এইটুকু ঠিক লিখেছেন।’

আবার গল্পে চলে যাই। প্রতিবাদ প্রয়োজন হলে আবার যথাস্থানে তুলে ধরব। তো ঘটনা হইছে, যে রিয়া সূত্র ভুলে গেলে ম্যাথের জন্য ছিল এমন মরিয়া, তার আর মূল এক্সামেই বসা হল না। কী বলব রিয়ার কপালের কথা! আহারে! মেয়েটা! কত শখ ছিল ম্যাথসহ সব বিষয়ে এপ্লাস পাবে। কিন্তু ওর পরিবারে ছিল শুধু মা। বাবা না থাকলে যা হয়! মেয়েটারও তাই হইছে। হুট করে একটা ভালো সম্বন্ধ এলে মা আর না করতে পারেনি। একই এলাকার ছেলে। কথা শুনে তো মনে হইছিল ছেলেটা খুব ভালো। ছেলে কথা দিয়েছিল বিয়ের পর পড়াবে। কথা রিয়ার মাকে দিয়েছিল। রিয়াকে না। রিয়ার সাথে বিয়ে বা পড়াশোনা বিষয়ে কোনো কথাই হয় নাই ছেলের। আহারে মানুষের কপাল! চাইলেও কথা রাখা যায় না। কীভাবে রাখবে? বিয়ের পর শাশুড়ি ভীষণ অসুস্থ। হাইপ্রেশার, ডায়াবেটিস, কিডনিতে সমস্যা হই গেল তার। তাকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে, শহরে। রিয়ার না গেলে চলে না? সামনে তার পরীক্ষা! না, সেখানে রিয়াকেও সাথে থাকতে হবে। এট্টুর জন্য এক্সামই আর দেওয়া হল না রিয়ার। এভাবেই সংসারে মন দিল। ম্যাথ, ম্যাথের টিচার, মা, জুন এসরের জায়গায় নতুন নতুন নাম যুক্ত হল। তেল, নুন, সাবান, শ্যাম্পু।

ঘটনা হইতেছে, গল্পের এই অংশটুকুরও প্রতিবাদ চোখে পড়ল। কে প্রতিবাদ করল? হয়তো যাকে নিয়ে গল্পটা সেই প্রতিবাদ করল! গল্পের লেখককে ম্যাসেঞ্জারে লিখে পাঠাল। রিয়াকে নিয়ে নাকি গল্প তাই সেই প্রতিবাদ করল। লিখে পাঠাল : ‘না, এরকম হয়নি। বরং বছর দেড়েক  পর জুন বিয়ে করে নিল আর তা কোন পারিবারিক সমস্যার জন্য না। ওর প্রেমিককে। ওরা এখন একসঙ্গে পড়াশুনা করে। আমার পরিবারে এমন কিছু ঘটে নি। মা, বাবা দুজনেই সুস্থ। এইচএসসি এর পর আমি মেডিকেল প্রিপারেশন নিলাম, চান্স হল না! ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। আমার পেরেন্টস এখনো সুস্থ এবং আমার পড়াশুনা ভালোই চলছে।’

যাই হোক আবার গল্পে চলে যাই। প্রতিবাদ প্রয়োজন হলে আবার যথাস্থানে তুলে ধরব। তো ঘটনা হইছে, রিয়ার শাশুড়িকে আর বাঁচানো যায় নি পরে। সে বছরের এক্সামের পর যেদিন রেজাল্ট দিল সেদিনই তিনি মারা গেলেন। ফলে দুই কারণে রিয়ার মন খারাপ। আজ সেও এপ্লাস পেতে পারত। অন্যটা, শাশুড়ির মৃত্যু। ও, রিয়ার হাজব্যান্ড বিষয়ে বলা দরকার। তার নাম তাবিউর, পুরা নাম তাবিউর রহমান। সে ডিগ্রি পাশ করে সেসময় একটা ক্রোকারিজ কম্পানির সেলস ম্যান হিসেবে চাকরি নিয়েছিল। পরে সুবিধা করতে না পেরে মালয়েশিয়ায় চলে গেল শ্রম পেশায়। রিয়ার শ্বশুর ছিলেন না। মূলত ছেলে বিদেশ যাবে এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তাই মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল বাইরে যাওয়ার আগে ছেলের বউয়ের মুখ দেখবে। সম্ভব হলে নাতি-নাতনিরও। মায়ের আশা অর্ধেক পূরণ হইছিল। রিয়া এখন মায়ের কাছেই থাকে বেশির ভাগ। শ্বশুরবাড়ি তালা দেওয়া থাকে। হাজব্যান্ড ফোন দিলে বলে, একা ভয় লাগে। রিয়া কি ভীতু। আহ, না! এই ভয় আসলে সে ভয় নয়! মায়ের সাথে থাকার জন্য নিজে নিজে পাওয়া ভয়। এমন ভয় থাকলে সেটা কি দূর হয় কোন দিন?  হাজব্যান্ড বলে, ‘মাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে রাখ।’ সে উত্তর দেয়, ‘একই ত কথা। মা আর আমি, যেখানেই থাকি!’

ঘটনা হইতেছে, গল্পের এই অংশটুকুরও প্রতিবাদ চোখে পড়ল। কে প্রতিবাদ করল? হয়তো যাকে নিয়ে গল্পটা সেই প্রতিবাদ করল! গল্পের লেখককে ম্যাসেঞ্জারে লিখে পাঠাল। রিয়াকে নিয়ে নাকি গল্প তাই সেই প্রতিবাদ করল। লিখে পাঠাল : ‘আপনি কোন রিয়ার কথা বলছেন! যার কথা বলছেন সে আমি নই। তাবিউর রহমান নামটাই আজকে প্রথম দেখলাম! আগেই বললাম, আমি এখনো স্টুডেন্ট এবং অবিবাহিত। আমাদের বাড়ির কাছে এরকম একটা ফ্যামিলির কথা বাবার মুখে শুনেছিলাম। মা অসুস্থ, ছেলের ক্রোকারিজের দোকান। সেই ছেলের আদৌ বিয়ে হয়েছিল কিনা তা আমি জানিনা। তার মা মারা যাওয়ার পর তাকে আর আমরা খুব একটা দেখিনি। কিন্তু তার নাম তাবিউর না এবং তার সঙ্গে আমার কোন ধরনের সম্পর্ক নেই। চিনিও না ভালোভাবে। আপনার ভুল হয়েছে!’

যাই হোক আবার গল্পে চলে যাই। প্রতিবাদ প্রয়োজন হলে আবার যথাস্থানে তুলে ধরব। তো ঘটনা হইছে, রিয়ার হাজব্যান্ড মাসে মাসে টাকা পাঠায়। কিন্তু এত অল্প ইচ্ছাতে কি নতুন জামাইয়ের মন ভরে? না ভরে না। জামাইয়ের ইচ্ছা যখনি টাকা লাগবে রিয়া জানাবে। সুন্দর করে বলবে,‘অ্যাই, টাকা পাঠাবা কিচু? নতুন মডেলের একটা হেয়ার কাট আসছে! পার্লারে যাব।’ হেয়ার কাট কি নতুন মডেলের না স্টাইলের? একটা হলেই হয়। কথা হইতেছে, সে দ্রুত টাকা পাঠাবে। কিন্তু আয়হায়! রিয়া ফেসবুক জগতে নাই। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। রিয়ার মায়ের ফোন আছে। রিয়ার হাজব্যান্ড ওই ফোনে ফোন দিলে মাঝেমধ্যে কথা বলে। অধিকাংশ সময়ই বলে না। রিয়ার হাজব্যান্ড-এর ধারণা, বউ তার ওপর রাগ। নতুন বউ ছেড়ে বিদেশে পড়ে আছে জন্য এই রাগ তার শরীরে এমন অসুখের বাসা বানাইছে। আসলেই কি রিয়া রাগ? তার রাগ করার কথা না। আশ্চর্য! রাগ করবে কেন? রাগ নাহ! কিন্তু রিয়ার যুক্তি একটা আছে। তার চিঠি লিখতে ভালো লাগে। প্রতি মাসে দুইটা চিঠি পোস্ট করে হাজব্যান্ডকে। বেশি দরকার হলেও ফোন দেয় না। তাহলে কী করে? তার বরাত দিয়ে মা-ই কথা বলে। যখন তার মাকে ফোন দেয় তখন মা খুব করে সাধে এই বলে, ‘জামাই একটু কথা বলবে বলছে, দিব?’ তখন শুরুতেই রিয়া তাবিউরকে বলে,‘যা বলার চিঠিতে ত বলিই। তুমিও জানাও চিঠিতে।’ এনিয়ে কয়েক মিনিট তর্ক হয়। তাবিউর বলে, ‘এই যুগে কেউ চিঠি লেখে, কও ত।’ উত্তরে সে বলে, ‘আমি লিখব। আমার অনেক সময়। আর চিঠিতে বলতেই ভালো লাগে। ফোনে না।’ তাবিউরের কথা কী ঠিক না বেঠিক? এই যুগে কেউ চিঠি লেখে? এটা আসলে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। যার ইচ্ছা করে সেই হয়তো লেখে!

ঘটনা হইতেছে, গল্পের এই অংশটুকুরও প্রতিবাদ চোখে পড়ল। কে প্রতিবাদ করল? হয়তো যাকে নিয়ে গল্পটা সেই প্রতিবাদ করল! গল্পের লেখককে ম্যাসেঞ্জারে লিখে পাঠাল। রিয়াকে নিয়ে নাকি গল্প তাই সেই প্রতিবাদ করল। লিখে পাঠাল : ‘হোয়াট! বাই দ্যা ওয়ে, আপনি কী? এসব আষাঢ়ে গল্প লিখে আমাকে ইরিটেট করলেন কেন? বারবার বলছি আমি তাবিউর অর সামথিং নামে  কাউকে চিনি না! আর আমি ফেসবুকে থাকি না? কই পান এসব কথা! নিজের ফেসবুক, ইন্সট্রা কিছু থাকলে রিয়া তাবাসসুম নামে সার্চ দেন! দিনে কয়টা পোস্ট হয় জানেন! আর দিনে কয় মিনিট সবুজ বাতি অফ থাকে তা দেখেন! যাই হোক, আমি যে ছেলের কথা শুনেছিলাম সে সিঙ্গাপুরে থাকে। তার বউ আছে কিনা, নাম রিয়া কিনা এসব কিচ্ছু জানি না।’

যাই হোক আবার গল্পে চলে যাই। প্রতিবাদ প্রয়োজন হলে আবার যথাস্থানে তুলে ধরব। তো ঘটনা হইছে, একবার তাবিউরের জ্বর হল। গায়ে তাপ আর তাপ। গরম! ভিজা কাপড় দিয়ে মুছলেও কাপড় শুকিয়ে যাচ্ছে এমন! তাপ বেশি হলে তো বুঝাই যায়! পুড়ে যাওয়ার মত তাপ। ইশশিরে। ওইসময় বেচারা ফোন দিয়ে রিয়ার মাকেও পাচ্ছে না। কারণ ফোন দেওয়ার কিছুক্ষণ আগে মায়ের সাথে কি একটা কথা কাটাকাটি হয়ে ফোন দিল আছাড়। ভেঙ্গে খান খান! কই গেল ব্যাটারি, কই গেল গেলাস! কে আর খুঁজে পায়? তারপরে, শেষমেষ, না পেরে তাবিউর তার জ্বরের কথা বলে যে চিঠি লিখল সেটা যখন রিয়া হাতে পেল এবং পাল্টা চিঠি লিখল এবং তাবিউর হাতে পেল ততদিনে সে সুস্থ।

কিন্তু জ্বরের খবর একটা উপকার করে দিয়ে গেছে রিয়ার, অল্প বয়সে কেন বিয়ে দিল এই খোটা দিয়ে মাকে বকত আর ঝগড়া করত, সেই সূত্রেই  তো ফোনটা ভাঙল। অথচ জ্বরের খবর পেয়ে সব ভুলে গেল। যেন তার বিয়ে ঠিক সময়েই হইছে। হইছে বলেই স্বামীর জ্বরের খবরে তার এত কষ্ট। কান্না পাচ্ছে। কান্না পাচ্ছে বলেই স্বামী ঠিক আছে, জ্বরও ঠিক আছে। সব ঠিক আছে। মায়ের সিদ্ধান্তও ঠিক আছে। কিন্তু এসব ঠিক কতদিনের জন্য ঠিক রিয়ার সাময়িক জগতে সেটা তার মা বলতে পারছেন না। তিনি আছেন নতুন ফোন কখন কিনবেন সে উদ্বেগে। জামাই টাকা পাঠালে সেখান থেকে কিছু কিছু জমাতেন। তাই দিয়েই হয়ে যাবে। রিয়া ফোন ভেঙেছে এটা বলা যাবে না। স্ত্রীরা রাগে কী ভাঙলে স্বামীরা খুশি হন রিয়ার মা ঠিক জানেন না। সে তালিকায় যদি ফোনসেট না থাকে? দরকার নাই!

ঘটনা হইতেছে, গল্পের এই অংশটুকুরও প্রতিবাদ চোখে পড়ল। কে প্রতিবাদ করল? হয়তো যাকে নিয়ে গল্পটা সেই প্রতিবাদ করল! গল্পের লেখককে ম্যাসেঞ্জারে লিখে পাঠাল। রিয়াকে নিয়ে নাকি গল্প তাই সেই প্রতিবাদ করল। লিখে পাঠাল : ‘ফোন আমিও ভাঙি তবে মা নয় প্রেমিকের সঙ্গে রাগ করে। আপনার কল্পনার রিয়ার সঙ্গে আমার মিল অতটুকুই। আপনার রিয়াকে আমার উপর চাপালে আপনার কি সুবিধা হয়? তা আগে বলেন তো! এত বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে পারেন আপনি! আল্লা!’

যাই হোক আবার গল্পে চলে যাই। প্রতিবাদ প্রয়োজন হলে আবার যথাস্থানে তুলে ধরব। তো ঘটনা হইছে, কোন একদিন নতুন চিঠি পেল রিয়া। তাবিউর লিখেছে, তার পদোন্নতি হয়েছে কর্মক্ষেত্রে, সেইসাথে চাকুরিও স্থায়ী হয়েছে। সেই সুবাদে রিয়াকেও নিতে পারবে। তাই অবশ্যই রিয়াকে মালয়েশিয়া যেতে হবে। কিন্তু রিয়া উত্তরে লিখল, মাকে ছাড়া সে পাশের জেলায়ও পা দিবে না! তাবিউর ফোন করে শাশুড়িকে বোঝায়, ‘আম্মা, আম্মা, ও আম্মা! আপনিও চলে আসেন। কিন্তু চিন্তা করতেছি, আপনি এলে দেশের সব কিছু উচ্ছন্নে যাবে। বেদখল হয়ে যাবে। রিয়া চলে আসুক। চাকরি পারমানেন্ট এখন। ছয়মাসে একবার এসে আপনাকে দেখে যাব আমরা। ভিডিওকলে কথা বলব। মনেই হবে না আপনি আমাদের সাথে নাই। এই ভাঁজে শাশুড়িও মেয়েকে বুঝানোর দায়িত্ব নেয়। কিন্তু সুবিধা করতে পারে না। মেয়ের সাফ কথা, মাকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।

ঘটনা হইতেছে, গল্পের এই অংশটুকুরও প্রতিবাদ চোখে পড়ল। কে প্রতিবাদ করল? হয়তো যাকে নিয়ে গল্পটা সেই প্রতিবাদ করল! গল্পের লেখককে ম্যাসেঞ্জারে লিখে পাঠাল। রিয়াকে নিয়ে নাকি গল্প তাই সেই প্রতিবাদ করল। লিখে পাঠাল : ‘আমিও চাইনা খুব দূরে ফ্যামিলি রেখে যেতে, জানিনা ভবিষ্যতে কি করব! নাম নয় কাজেও কিছু মিল আছে দেখি তাবিউরের রিয়ার সঙ্গে। তবে সে যাক বা না যাক তা জেনে আমি কি করব! হু ইজ তাবিউর! হু ইজ রিয়া! আবার নাকি শাশুড়ি! আর আমার শোনা ছেলেটার নাম শামীম! তার ক্রোকারিজের দোকানটা বা বাড়িটার এখন কি অবস্থা ততটুকুও আমি জানিনা। আমি রিয়া! আপনার গল্পের রিয়া নই আমি। আপনি মানুন আর নাই মানুন।’

যাই হোক আবার গল্পে চলে যাই। প্রতিবাদ প্রয়োজন হলে আবার যথাস্থানে তুলে ধরব। তো ঘটনা হইছে, কোন এক বৃহস্পতিবার। তাবিউর নিজের বাড়ির দরজায় তালা ঝুলতে দেখে তখুনি শ্বশুর বাড়ি গেল। সেখানেও দেখল তালা। এভাবে না জানিয়ে হুট করে আসা ঠিক হয় নি। তাবিউর ইন করা শার্ট প্যান্ট নিয়ে ঘরের দুয়ারে বসে ঘামছে। পানির ফোয়ার মতো ঘাম। পিঠ-পেটের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কেন এত ঘাম? এই ভেজার অনুভূতি কী সবাই পায়? পায় না। যার এমন হয় সেই পায়। তাবিউর সেরকম আরকি। ফোন দিয়েও বন্ধ পাচ্ছে শাশুড়ির নাম্বারে। মোজা খুলে ঢুকিয়ে রেখেছে জুতার ভিতরে। পাক্কা তিন ঘণ্টা পর হাজির হল রিয়া। তাবিউরকে দেখে কি বলবে বুঝতে পারছে না। তবুও সামলে নিয়ে বলল, ‘চিঠির আগে তুমি চলে আসলা!’ তাবিউর বলল, ‘না, সারপ্রাইজ।’  রিয়া বলল, ‘দুয়ারে কেন! ঘরে যাও নি?’

এবার তালা দেখে রিয়া ভড়কে গেল। মা কোথায় গেল?

তাবিউর জানতে চাইল, ‘তুমি কই থেকে ফিরলা?’

রিয়া বলল, ‘তোমার থেকে শুধু শুধু টাকা নিতে ছোট ছোট লাগে। তাই একটা কুরিয়ার সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আজ জয়েন করার জন্য ডেকেছিল। এই যে জয়েনিং লেটার। তাবিউর কি বলবে বুঝতে পারছে না। তালা ভাঙতে বলবে? শাশুড়ির কেন ফোন অফ তা বলবে? স্ত্রী কেন চাকরিতে যোগ দিল সেই কৈফিয়ত চাইবে? সে কিছুই বলল না। চুপ করে বসে থাকল। হঠাৎ রিয়া দেখল দরজার নিচে একটা চিঠি। কার চিঠি? খুলে দেখল তার মায়ের। যিনি শুরু থেকে ফোন ব্যবহার করছিলেন তিনিই কিনা লিখলেন চিঠি! আর রিয়া? যে শুরু থেকে চিঠি। সেই চাকরির শর্ত মতে কিনে নিয়ে এল একটা ফোনসেট! যাই হোক, চিঠি পড়ে তার মুখ শুকিয়ে গেল। এক্কেরে শুকনা। কেমনে বুঝাইতাম। তাবিউরের হাতে দিল চিঠিটা। তাতে অনেক কিছু লেখা। মূলকথা হল, শরমের ব্যাপার হলেও সত্য সে কোথায় গেছে তা বলার মত না। তার দরকার আছে, তাই সে গেছে! এ নিয়ে রিয়া যেন পেরেশানিতে না থাকে। আর ফিরবে না। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। আজ রিয়া নাই দেখে পালিয়েছে!

ঘটনা হইতেছে, গল্পের এই অংশটুকুরও প্রতিবাদ চোখে পড়ল। কে প্রতিবাদ করল? হয়তো যাকে নিয়ে গল্পটা সেই প্রতিবাদ করল! গল্পের লেখককে ম্যাসেঞ্জারে লিখে পাঠাল। রিয়াকে নিয়ে নাকি গল্প তাই সেই প্রতিবাদ করল। লিখে পাঠাল : ‘হাউ ননসেন্স ইউ আর! জাস্ট সাট আপ!! আপনি ভাবছেন আপনার গল্পে আমি মুগ্ধ! নো! আমার মাকে নিয়ে বাজে কথা লিখলেন! আপনার স্টোরি আপনার কাছে রাখুন। আমার মাঝে আপনার রিয়া খোঁজার বিন্দুমাত্র চেষ্টা আর কোনদিন করবেন না।’

যাই হোক আবার গল্পে চলে যাই। প্রতিবাদ প্রয়োজন হলে আবার যথাস্থানে তুলে ধরব। তো ঘটনা হইছে, রিয়ার মা আর ফেরে না। দিন যায় মাস যায়। এলাকায় নানান কথা। ফিসফিস, ফিসফাস! চোখ ফুটে নাই এমন লোকেরও মুখে কথাটা। তাবিউরের আর ভালো লাগছে না এখানে। নিজের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি একটাই ত এলাকা। ঘর থেকে বের হলেই লোকের নানান কথা। অন্যদিকে রিয়া কুরিয়ার সার্ভিসে বেশ সাফল্যের সঙ্গে চাকরি করছে। শুধু তাই নয়। ফেসবুকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে নিয়মিত! এখন তাকে হোয়াটস এপে বা ম্যাসেঞ্জারে কল দিলেও রিসিভ করে। অন্যদিকে রিয়ার মার ফোন বন্ধ। কেউ না জানে ঠিকানা। এই পরিস্থিতির মধ্যেই তাবিউর বউয়ের কাছে বিদায় নিয়ে ফুরুৎ করে মালয়েশিয়ায় ফেরত গেল। রিয়া তাকে বুঝিয়েছিল, দেশেই থেকে যেতে। কিন্তু তাবিউর বলে, মালয়েশিয়ায় তার ব্রাইট ফিউচার। দেশ তাকে কি দিচ্ছে এখন? কানা ঘুষা আর পরচর্চা ছাড়া। তার শ্বাশুড়িকে পালানোর জন্য কি সে প্রেমিক ঠিক করে দিছিল! বুঝে আসে না। কেমন এলাকা! কার দোষে কে ভোগে? তবুও তাবিউর এলাকার লোকেরে বুঝায়, আরে ভাই! শাশুড়ি ঠিকই ফিরে আসবে। তাকে ছেড়ে তার মেয়ে কিছুতেই মালয়েশিয়া যাবে না, সেজন্য মেয়েরে শিক্ষা দিতে অন্তরালে আছে। মেয়ে মালয়শিয়া যাওয়ার মত দিলে ঠিকই ফিরা আসবে। কিন্তু লোকেরা বিশ্বাস করে না তার কথা। তাই মূলত সেই পালিয়েছে। রিয়া শক্ত থাকে। পাত্তা দেয় না এসব। মা যখন অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিল তাকে তখন ত কেউ বাধা দেয় নি। এখন কেন তাদের পরিবার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে সবাই। অল্প বয়সী মেয়ের বিয়ে মেনে নিল সমাজ। বেশি বয়সী মায়ের বিয়ে কেন মেনে নিতে পারছে না!

ঘটনা হইতেছে, গল্পের এই অংশটুকুর প্রতিবাদ চোখে পড়ল না। কে প্রতিবাদ করল না? হয়তো যাকে নিয়ে গল্পটা সেই প্রতিবাদ করল না! গল্পের লেখককে ম্যাসেঞ্জারে লিখে পাঠাল। রিয়াকে নিয়ে নাকি গল্প তবুও সে প্রতিবাদ করল না এবার। লিখে পাঠাল : ‘এই রিয়া যেই হোক তার সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়েছে আমার। আপনার রিয়া আমি না হলেও গল্পের শেষাংশ ভালো লেগেছে আমার। সত্য উপলব্ধি! সুন্দর!’

দুই

লেখক জানেন গল্প গল্পই। কারো জীবনের সঙ্গে মিল থাক বা না থাক। মিলেও যেতে পারে আবার বেশিরভাগই মিলে না। কিন্তু রিয়ার প্রতিবাদমুখর টেক্সটগুলো ম্যাসেঞ্জারে সিন করে অবাক হলেন লেখক। আদৌ উত্তর দিবেন কিনা ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবুও রিয়াকে উত্তর দিলেন, ‘দেখুন, আপনার টেক্সটগুলো আমি পড়েছি। পড়ে বিব্রত হয়েছি। আপনি ঠিক কীসের প্রতিবাদ করলেন আমি বুঝতে পারলাম! আপনি গল্পের জন্য আমাকে দুষছেন। কিন্তু আমি তো এমন কোনো গল্প লিখি নি। আপনি কোথায় পড়লেন এই গল্প? আর আমি আপনার কয়েকটি গল্প পড়লেও আপনাকে তেমন জানি না। কখনো সরাসরি কথাও হয় নি আপানার সঙ্গে। হয়েছে কি? রিয়া, রিয়ার মা, তাবিউর, জুন, গণিতের স্যারÑএই নামের চরিত্র, আমি, আমি সিউর আমার কোনো লেখায় নেই। আপনি কোথাও ভুল করছেন! আমি দুঃখিত।’  

লেখকের এমন উত্তরে রিয়া নতুন করে বিভ্রমে পড়ে যায়। তাহলে কি সে এক মহা বিভ্রমের মধ্যেই আছে? লেখক অস্বীকার করছেন, এমন কোনো গল্প তিনি লেখেন নি। আর এসব নামের চরিত্র তার লেখা তন্ন তন্ন করে ঘাঁটলেও পাওয়া যাবে না। তাহলে রিয়া কোন গল্পের কথা বলছে? কোন সে গল্প, যার প্রতিবাদ করছিলেন নতুন এই লেখক রিয়া তাবাসসুম। বিষয়টা নিয়ে রিয়া তাবাসসুম কী নতুন করে ভাববেন? আসলেই কি তিনি ভাবতে পারার মতো অবস্থায় আছেন আর? কী হয়েছে এই লেখকের? লেখকদের অনেক কিছুই হয়। রাইটার্স ব্লক হয়, লেখকদের জীবনদেবতা থাকেন, লেখকরা আত্মনিমগ্ন থাকতে ভালোবাসেন সময়ে সময়ে, লেখকরা লাজুক হন, নির্লজ্জও হন, লেখকরা ধান্দাবাজও হন, লেখকরা নিষ্পাপও হন, লেখকরা বদমায়েশও হন, লেখকরা ওভাররেটেড হন, আন্ডাররেটেড হন, লেখকরা প্রচারবিমুখ হন, লেখকরা প্রচারবাজও হন, লেখকরা দালাল হন, লেখকরা নৈঃসঙ্গপীড়িত হন, আসলে লেখকরা আর সব মানুষের মতোই গুণ সম্পন্ন! এরমধ্যে রিয়া তাবাসসুম কোনটা? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সে হতাশও হয়ে থাকতে পারে। হতে পারে কোনো রোগে আক্রান্ত। হতেই পারে। আসলে কী হয়েছে তার? এই রহস্যের উদঘাটনে আমাদের পরিচিত হতে হবে রিয়া তাবাসসুমের ডায়রির সঙ্গে। সেখানে একটা নতুন গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন রিয়া। শুরুটা এরকম : ‘একবার এইচএসসি তে যখন পড়ি দুই ফ্রেন্ড ম্যাথ করছিলাম। এক্সাম! মাঝে আমি ছিলাম, ডানপাশে স্যার, বামপাশে জুন। তো আমি একটা সূত্র ভুলে গেছি। আমি ম্যাথ করতে করতে বারবার স্কেল দিয়ে খোঁচাচ্ছিলাম। অনেকক্ষণ পর দেখলাম স্যার আমার দিকে চোর ধরার ভঙ্গিতে তাকায় আছে। মানে আমি স্যারকে মারছিলাম।’ একটা পৃষ্ঠায় রিয়া তাবাসসুম এইভাবে গল্পটা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি সেটাকে আর বাড়ালেন না। উল্টো অংশটুকু কেটে দিলেন। এর অর্থ লেখা মনমতো হয় নি তার। ডায়রির পরের পৃষ্ঠাগুলোতেও গল্পটা লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, তবে একইভাবে জোরালো ক্রস চিহ্ন এঁকে কেটে দেওয়া। গল্পটা শুরু করলেও লিখতে পারছিলেন না তিনি। মনমতো হচ্ছিল না। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা নষ্ট করেছেন নিজেই!

এখন কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় রিয়ার বিষয়ে? আপনারা বলেন! আমি বলব, একলা বিভ্রমে!   

লেখক: শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ ।

2 মন্তব্যগুলো

  1. লেখকের মনের ভেতরের মন পড়ার দায় থাকে। লেখকদের অনেক কিছুই হয়। রাইটার্স ব্লক হয়, লেখকদের জীবনদেবতা থাকেন, লেখকরা আত্মনিমগ্ন থাকতে ভালোবাসেন সময়ে সময়ে, লেখকরা লাজুক হন, নির্লজ্জও হন, লেখকরা ধান্দাবাজও হন, লেখকরা নিষ্পাপও হন, লেখকরা বদমায়েশও হন, লেখকরা ওভাররেটেড হন, আন্ডাররেটেড হন, লেখকরা প্রচারবিমুখ হন, লেখকরা প্রচারবাজও হন, লেখকরা দালাল হন, লেখকরা নৈঃসঙ্গপীড়িত হন, আসলে লেখকরা আর সব মানুষের মতোই গুণ সম্পন্ন! এর মধ্যে মেহেদী উল্লাহ কোনট?

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন