গল্প : উইদিন অ্যান্ড উইদাউট : হেরমান হেস : ভাষান্তর- নাহিদুল ইসলাম

1

অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

লেখক পরিচিতিঃ নোবেল বিজয়ী লেখক হেরমান হেস’র জন্ম ১৮৭৭ সালে, জার্মানির ছোট্ট শহর কালভ-এ। আমাদের দেশে তার ‘সিদ্ধার্থ’ বইটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। গৌতম বুদ্ধের জীবন দর্শনের উপর লিখিত বইটি বুদ্ধের সামগ্রিক জীবন, পথচলা, সাধনা ও নির্বাণের এক অনবদ্য বয়ান। দয়া, ক্ষমা, করুণা, ধৈর্য, প্রেম, জ্ঞানপিপাসা, সন্ন্যাস, সংসার সবকিছুর চমৎকার মিশেলে বুদ্ধের জীবনের ওপর আলকোপাত করা হয়েছে এই বইতে। সিদ্ধার্থ’র সাথে এখানে ভাষান্তরিত ‘উইদিন এন্ড উইদাউট’ গল্পটির বিষয়বস্তুর অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যকার সংঘাত, ভুল বা সঠিকের বিতর্ক, একধরনের বিশ্বাসের সাথে অপর বিশ্বাসের টানাপোড়েন, বন্ধুত্ব, বিচ্ছেদ, অভিজ্ঞতা অর্জন এবং মিলনের বিস্ময়কর বর্ণনা যেন এই ছোট্ট গল্পটি। উইদিন এন্ড উইদাউট মানুষের মন নিয়ে কথা বলে; ভেতরকে বাহিরে এনে মুক্ত করা, আর বাহিরকে ভেতরে ধারন করা; মানুষের চুড়ান্ত মুক্তির পথ মনের মধ্যেই নিহিত আছে- এই সত্যই মুখর হয়ে উঠেছে এই গল্পে। জার্মানীর মহান এই লেখক ১৯৪৬ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬২ সালে।    

একদা একসময় ফ্রেডারিক নামে একজন মানুষ ছিল; সে নিজেকে বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনায় উৎসর্গ করেছিল, প্রশস্ত পরিসরে জানাশোনাও ছিল তার। কিন্তু সকল শিক্ষাই সমান ছিল না তার কাছে, ছিল না এক ধরনের চিন্তা অন্য চিন্তার মতই ভাল; সে একটা নির্দিষ্ট ধাঁচে ভাবতে ভালবাসত, অবজ্ঞা আর ঘৃণা করত চিন্তার অন্যান্য দিকগুলোকে। সে যেটা সম্ভ্রমের সাথে পছন্দ করত, সেটার নাম ছিল ‘যুক্তি’, এটা সেই প্রশংসনীয় পদ্ধতি, সাধারণভাবে যাকে সে ‘বিজ্ঞান’ বলে ডাকত।  

‘দুই দুগুণে চার,’ সে বলত, ‘এটাই আমি বিশ্বাস করি এবং মানুষকে অবশ্যই এই সত্যের ভিত্তিতে চিন্তা করতে হবে।’

নিশ্চিতভাবেই, চিন্তার এবং জ্ঞানের যে আরও রকমফের আছে, সেটা তার অবিদিত ছিল না। কিন্তু সেসব ‘বিজ্ঞান’ নয়, এবং সেগুলো সম্পর্কে সে নিচু অভিমত পোষণ করত। একজন স্বাধীনচেতা মানুষ ছিল সে, ধর্মের প্রতিও অসহনশীল ছিল না। বিজ্ঞানীদের মধ্যে ধর্ম একটা মৌন সন্ধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যা কিছুর অস্তিত্ব আছে পৃথিবীতে এবং যা কিছু জানাটা ছিল জরুরি, বিগত কয়েক শতকে একটি জিনিস বাদে তার সবকিছুই ধরা দিয়েছিল বিজ্ঞানের সামনে, আর তা হল মানুষের আত্মা। সময়ের সাথে সাথে এটাকে ধর্মের হাতে ছেড়ে দিয়ে এবং আত্মা নিয়ে সকল রকমের জল্পনাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং সেসবের প্রতি সহনশীলতার মনোভাব পোষণ করা একপ্রকার নিয়মেই পরিণত হয়েছিল। তাই ফ্রেডারিক নিজেও ধর্মের প্রতি সহনশীল ছিল। কিন্তু যা কিছুকে সে কুসংস্কার বলে মনে করত সেগুলো তার কাছে ছিল চরম ঘৃণ্য এবং অচ্ছুত।  বহিরাগত, অপরিশীলিত এবং শ্লথ মানুষজন হয়তো এসব নিয়ে পড়ে থাকতে পারে, হয়তো প্রাচীনকালে রহস্যময় ঐন্দ্রজালিক চিন্তাভাবনাও ছিল, কিন্তু বিজ্ঞান এবং যুক্তির উন্মেষের পরে এসব সেকেলে দ্বিধাগ্রস্থ জিনিসপত্র নিয়ে ভাবার কোনই মানে নেই।  

এরকমই মনে করত সে, এরকমই বলত, এবং যখন কোন কুসংস্কারের লক্ষণ দেখত, সে রেগে যেত আর এমন ভাব করত যেন কোন শত্রু তাকে ছুঁয়ে দিয়েছে।

তারই মত বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার নীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কোন শিক্ষিত মানুষের মধ্যে এসব লক্ষণ দেখলে সে সবচেয়ে বেশি রেগে যেত। এর মত বেদনাদায়ক এবং অসহ্য তার কাছে আর কিছুই ছিল না যখন কখনও কখনও সে সেইসব মানহানিকর বিশ্বাসে কোন রুচিশীল সংস্কৃতিবান মানুষকে হাস্যকরভাবে বলতে শুনত যে, ‘বৈজ্ঞানিক চিন্তা’ পরমভাবে কোন শ্রেষ্ঠ বা অশেষ বা চিরায়ত বা দৈবনির্দিষ্ট অথবা প্রশ্নাতীত কোন চিন্তার ধরন নয়, নয় পরিবর্তন বা পতনের অতীত কোন ব্যাপার। এই অভক্ত, ধ্বংসাত্মক এবং বিষাক্ত বিশ্বাস চারদিকে ছেয়ে গিয়েছিল, এমনকি ফ্রেডারিকও এসব অস্বীকার করতে পারত না। পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ, বিপ্লব এবং ক্ষুধার ফলে একটা সতর্কবাণীর মত, একটা সাদা দেয়ালে একটা সাদা হাতের ভৌতিক লেখনীর মত এসব বিশ্বাস এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।

যতই এসব ধারণার অস্তিত্ব নিয়ে ভেবে ফ্রেডারিক ভোগান্তি পোহাত, যতই এসব তাকে পীড়া দিত, ততই সে এগুলোকে তীব্রভাবে আক্রমণ করত, এবং সেইসব মানুষ যারা গোপনে এসবে বিশ্বাস করে বলে সে মনে করত, তারাও নিস্তার পেত না। সত্যিকার অর্থে শিক্ষিতদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক মানুষই অকপটে যুক্তিবিজ্ঞানের আধুনিক মতবাদকে স্বীকার করত। এই মতবাদকেই তার কাছে পরম বলে মনে হয়, এটা প্রচারিত হওয়া দরকার, হওয়া দরকার এর ক্ষমতায়ন যাতে তা পৃথিবীর আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো থেকে উৎপন্ন বিশৃঙ্খলাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। যাই হোক, বিষয়টা এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছয়নি, এবং প্রকাশ্যে বিজ্ঞানে বিশ্বাসী ব্যক্তির সংখ্যা এত কম ছিল আর তারা এত বিচ্ছিন্ন ছিল যে তাদেরকে অদ্ভুত খাপছাড়া এবং খামখেয়ালি মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হত। কিন্তু গরলের একটি ফোঁটা, নতুন ধারনার একটা উত্থানকে প্রথমে এইভাবেই বিবেচনা করা হত, পরে অন্যভাবে। জনমানুষ ও অর্ধশিক্ষিতদের মধ্যে এই নতুন চিন্তার ধরনটার কোন শেষ খুঁজে পাওয়া যেত না; গুঢ় মতবাদসমূহ, সম্প্রদায়সমূহ এবং সাগরেদবৃন্দে ভর্তি ছিল পৃথিবী। সবকিছুতেই কুসংস্কার, অতীন্দ্রিয়তাবাদ, আধ্যাত্মবাদী অর্চনা এবং অন্যান্য রহস্যময় শক্তির গন্ধ খুঁজে পেত মানুষ। এসবের বিরূদ্ধে লড়াই করা সত্যিই প্রয়োজন ছিল কিন্তু এসবের কাছে বিজ্ঞান যেন ছিল বর্তমান স্বাধীনতার লাগাম টেনে দেয়া এক ব্যাপার, মানুষের দূর্বলতার ব্যক্তিগত অনুভূতিতে হস্তক্ষেপের মত।

একদিন ফ্রেডারিক তার এক বন্ধুর বাড়িতে গেল, তার সাথে সে প্রায়ই পড়াশুনা করত। অনেকদিন হয় বন্ধুর সাথে দেখা নেই তার। সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার সময় সে মনে করার চেষ্টা করল শেষ কবে এবং কোথায় তার সাথে বন্ধুর দেখা হয়েছিল, কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে গর্বভরে মনে করার মত এত কিছু ছিল যে সে সেই স্মৃতি মনে করতে পারল না। একটা নির্দিষ্ট বিরক্তিতে সুক্ষ্মভাবে নিমজ্জিত হল সে এবং তার মেজাজ বিগড়ে গেল, ফলে সে যখন বন্ধুর দরজায় এসে দাঁড়াল, তাকে জোর করে সেই চিন্তা থেকে মুক্ত হতে হল।

এরুয়িনের মুখে এক অমায়িক প্রশান্ত হাসি দেখে তাকে অভিবাদন জানাতে ভুলে গেল ফ্রেডারিক। এরকম সে আগে কখনও দেখেনি। এবং এই হাসি দেখেই, যে হাসি বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হওয়া সত্ত্বেও কিছুটা বিদ্রুপের আর প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ঠেকছিল তার কাছে, সাথে সাথে তার মনে পড়ে গেল, এতক্ষণ ধরে সে যা মনে করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিল যে গতবার কখন তার সাথে এরুয়িনের দেখা হয়েছিল। তার মনে পড়ে গেল, তাদের শেষ দেখা হয়েছিল নিশ্চিতভাবে কোনরকম ঝগড়া ছাড়াই, তবে একধরনের অনৈক্য আর অসন্তুষ্টির বোধ সাথে নিয়ে, কারণ তার মনে হয়েছিল, এরুয়িন সেইসময়ে কুসংস্কারের রাজত্বকে আক্রমণ করে বলা তার কথাগুলোকে তেমন কোন গুরুত্ব দেয়নি।

এটা অদ্ভুত লেগেছিল তার কাছে। কীভাবে সে এসব পুরোপুরি ভুলে গেল? এখন সে বুঝল একারণেই সে অনেকদিন ধরে তার বন্ধুর খোঁজ রাখে না, শুধুমাত্র এই অসন্তুষ্টির জন্যই, এবং এটা সে সবসময়ই জানত, যদিও বার বার সাক্ষাত এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এরুয়িন কতগুলো অজুহাত আবিষ্কার করে নিয়েছিল।

এবার তারা মুখোমুখি হল; ফ্রেডারিকের মনে হল যেন সেদিনের সেই ক্ষীণ ফাটল ইতোমধ্যেই ভয়াবহরকমে বিস্তৃতিলাভ করেছে। সে উপলদ্ধি করল এই মুহুর্তে তার এবং এরুয়িনের মধ্যে এমন কিছুর শূণ্যতা বিরাজ করছে যা পূর্বে কখনো ছিল না। একটা নির্ভরতার বাতাবরণের মতই স্বতঃস্ফুর্ত ছিল তাদের বোঝাপড়া, এমনকি মমতারও। তার পরিবর্তে এখন সেখানে একটা শূণ্যস্থান তৈরি হয়েছিল। তারা একে অপরকে অভিবাদন জানাল; কথাবার্তা বলল আবহাওয়া নিয়ে, পরিচিতজনদের নিয়ে, তাদের স্বাস্থ্যের কথাও হল; এবং ঈশ্বরই জানে কেন!, প্রত্যেক আলাপেই ফ্রেডারিক উদ্বেগভরে অনুভব করল সে তার বন্ধুকে বুঝতেই পারছে না, তার বন্ধু তাকে যেন চেনেই না, তার কথা কোন ছাপ রাখতে পারছিল না, তারা প্রকৃত কথাবার্তা চালানোর ক্ষেত্রে কোন মতৈক্যেই আসতে পারছিল না। তার উপরে এরুয়িন তখনো মুখে সেই বন্ধুসুলভ হাসিটি ঝুলিয়ে রেখেছিল যেটা ফ্রেডারিক রীতিমত ঘৃণা করতে শুরু করেছিল।

এই পরিশ্রমসাধ্য আলাপচারিতার একফাঁকে ফ্রেডারিক এরুয়িনের কর্মশালার দিকে চোখ ফেরাল এবং দেখল দেয়ালে একটা কাগজ হালকাভাবে পিন দিয়ে গাঁথা। এই দৃশ্য তাকে অদ্ভুতভাবে তাড়িত করল, জেগে উঠল অতীতের স্মৃতি, তার মনে পড়ল, অনেক আগে তাদের ছাত্রজীবনে এরকম একটা অভ্যাস ছিল এরুয়িনের, এভাবে কখনও কখনও সে কোন চিন্তকের বাণী অথবা কোন কবিতার চরণ পরিষ্কারভাবে মনে রাখত। সে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং কাগজটা পড়ার জন্য দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল।

সেখানে, এরুয়িনের সৌম্যলিপিতে, সে এই কথাগুলো পড়লঃ ‘কিছুই বাইরে নয়, কিছুই নয় অভ্যন্তরে, কারণ যা বাইরে আছে তা আছে ভেতরেও।’

পাণ্ডর হয়ে সে এক মুহুর্ত নিশ্চল দাঁড়িয়েছিল। এই তাহলে ব্যাপার! সে যা আশঙ্কা করেছিল সেটারই মুখোমুখি হতে হল! অন্য সময় হলে সে এই কাগজের পাতার কথা এড়িয়ে যেত, এটাকে একটা বাতিক বলে কৃপাভরে সহ্য করত। যে কারোরই এরকম একটা ক্ষতিহীন দুর্বলতা থাকতে পারে, আনুকূল্যপ্রার্থী একটা তুচ্ছ ভাবপ্রবণতা হিসেবে দেখত পারত এটাকে সে। কিন্তু এখন এটা ভিন্ন কিছু হয়ে পড়েছিল। সে বুঝল এই কথাগুলো কোন ক্ষণজীবী কবিসুলভ খেয়াল থেকে আসেনি, এরুয়িন বহুবছর পর তার যৌবনের একটা অভ্যাসে ফিরে গিয়েছিল, এটা খেয়ালি ছিল না। এখানে যা লেখা আছে, তার বন্ধুর বর্তমান চিন্তারই প্রতিফলন তা, অতীন্দ্রিয়বাদ! এরুয়িন অবিশ্বাসী ছিল!

সে ধীরে এরুয়িনের দিকে ফিরল, সেখানে আবারও হাসির দীপ্তি খেলে গেল।

‘আমাকে এটা ব্যাখ্যা কর!’ সে দাবি করল।

এরুয়িন বন্ধুসুলভ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ‘তুমি কি এই প্রবাদ আগে কখনও পড়নি?’

‘নিশ্চয়।’ ফ্রেডারিক রাগতস্বরে বলল, ‘নিশ্চয়ই আমি এটা জানি। এটা আধ্যাত্মবাদ, এটা রহস্যবাদ। এটা কাব্যিক হতে পারে, কিন্তু- বেশ, যাই হোক, আমার কাছে প্রবাদটা ব্যাখ্যা কর, এবং বল কেন এটা তোমার দেয়ালে ঝুলে আছে!’

‘সানন্দে,’ এরুয়িন বলল। ‘প্রবাদটা একটা জ্ঞানতত্ত্বের প্রথম সূত্র যা আমি অনেক দেরিতে পড়েছি, তবে এটা ইতিমধ্যেই আমাকে অনেক সুখি করে তুলেছে।’

ফ্রেডারিক নিজেকে সংবরণ করল। জিজ্ঞেস করল, ‘একটা নতুন জ্ঞানতত্ত্ব? এরকম কিছু আছে? তাহলে এটার নাম কী?’

‘ওহ,’ এরুয়িন জবাব দিল, ‘এটা আমার কাছে নতুন। আদতে এটা অনেক পুরনো এবং প্রাচীন। এটাকে ম্যাজিক বলে।’

আসল কথাটা উচ্চারিত হল। এরকম খোলামেলা স্বীকারোক্তিতে প্রবলভাবে বিস্মিত ও সচকিত হল ফ্রেডারিক, কেঁপে উঠল সে, মনে হল যেন তার বন্ধুর মধ্যে সশরীরে কোন দুষ্টবুদ্ধি শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে সে। বুঝতে পারল না, সে ক্রোধান্বিত না অশ্রুসিক্ত, অপূরণীয় ক্ষতির তিক্ত অনুভূতি গ্রাস করল তাকে। অনেকক্ষণ সে কথা বলতে পারল না।

তারপর কণ্ঠস্বরে একটা সিদ্ধান্তের ভাণ করে সে শুরু করল, ‘তাহলে তুমি এখন একজন যাদুকর হতে চাচ্ছ?’

এরুয়িন দ্বিধাহীনভাবে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, সেটাই।’

‘এক ধরনের কুহকি শিক্ষানবিশে আছ তাহলে, হাহ?’

‘একদম।’

পাশের ঘর থেকে ঘড়ির টিকটিক শোনা যাচ্ছিল, এতটাই নীরব ছিল সবকিছু। ফ্রেডারিক বলল, ‘তার মানে, তুমি জানো যে তুমি বিজ্ঞানের সাহচর্য পরিত্যাগ করতে যাচ্ছ, আর আমার সাথেও তাহলে সব সংস্রব শেষ হতে যাচ্ছে।’

‘আমি আশা করি সেরকম নয় ব্যাপারটা।’ এরুয়িন উত্তর দিল। ‘কিন্তু যদি সেটাই হওয়ার হয়, তাহলে আমার কী-ই বা করার থাকে?’

‘কী করতে পারো তুমি?’ ফ্রেডারিক ফেটে পড়ল। ‘কেন, ভেঙে ফেল এসব, শিশুসুলভ এইসবকিছু ভেঙে ফেল, যাদুমন্ত্রের এই নিকৃষ্ট ঘৃণ্য বিশ্বাসকে ভেঙে ফেল! যদি আমার সম্মান পেতে চাও, এটাই করতে পার তুমি।’

এরুয়িন সামান্য হাসল যদিও তাকে আর আগের মত প্রফুল্ল মনে হল না। সে বলল, এতটাই নম্রভাবে যে তার শান্ত কথাগুলো ফ্রেডারিকের রাগন্বিত কন্ঠস্বরের মধ্যে ঘরময় প্রতিধ্বনিত হল যেন, ‘তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন এসব আমার অভিলাষের অধীন ব্যাপার, যেন আমার কাছে কোন উপায় ছিল। ফ্রেডারিক, ব্যাপারটা এমন নয়। আমি ম্যাজিক বেছে নেইনি, ম্যাজিকই আমাকে বেছে নিয়েছে।’

ফ্রেডারিক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘তাহলে বিদায় জানাই তোমাকে,’ সে ক্লান্তভাবে বলল, তারপর করমর্দন না করেই উঠে দাঁড়াল।

‘এভাবে নয়!’ এরুয়িন কেঁদে বলল, ‘নাহ, তুমি এভাবে আমার কাছ থেকে যেতে পার না। এমন করে যেতে পার না যেন আমাদের মধ্যে একজন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে, আমাদের অবশ্যই ভালভাবে বিদায় নিতে হবে।’

‘কিন্তু এরুয়িন, আমাদের মধ্যে কে শুয়ে আছে মৃত্যুশয্যায়?’

‘আজ সম্ভবত আমিই সে, বন্ধু আমার। যে নতুন করে জন্মাতে চায়, তাকে অবশ্যই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।’

আরও একবার ফ্রেডারিক সেই কাগজের কাছে গেল এবং ভেতর বাহির সম্পর্কিত লেখাটা আবার পড়ল। ‘খুব ভাল,’ অবশেষে বলল সে, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, রাগ করে কিছুই হবে না। তুমি যা চাও আমি তাই করব; আমি ধরে নেব আমাদের মধ্যে একজন মারা যাচ্ছে। তবে যাওয়ার আগে আমি একটা শেষ অনুরোধ করতে চাই তোমায়।’

‘আমি সত্যিই আনন্দিত হলাম।’ এরুয়িন বলল, ‘বল আমাকে, বিদায়বেলায় আমি কী সেবা করতে পারি?’

‘আমার প্রথম প্রশ্নটাই আমি করছি, এটা আমার অনুরোধও বটে, যতটুকু পারো এই প্রবাদটাকে আমার কাছে ব্যাখ্যা কর।’

এরুয়িন একমুহুর্ত চেয়ে রইল, তারপরে বলল, ‘কিছুই বাইরে নয়, কিছুই নয় ভেতরে। তুমি জানো এর ধর্মীয় মানে, ঈশ্বর সবজায়গায় বিরাজমান। তিনি মানসে যেমন আছেন, তেমনই আছেন প্রকৃতিতে। সবকিছুই স্বর্গীয়, কারণ ঈশ্বর সবখানেই আছেন। অতীতে এটাকে সর্বেশ্বরবাদ বলা হত। আর এর দার্শনিক মানে হচ্ছে, আমরা আমাদের চিন্তাকে ভেতর থেকে বাহিরের সাথে বিচ্ছিন্ন করতেই অভ্যস্ত, কিন্তু সেটা জরুরি নয়। আমরা আমাদের মননের যে সীমা বেঁধে দিয়েছি তা থেকে আমাদের আত্মা মুক্ত হতে সক্ষম, সক্ষম সীমানার বাইরের ভেতরে বিচরণ করতে। আমাদের পৃথিবী যে যুক্তি দিয়ে নির্মিত তার বাইরে একটা নতুন ও ভিন্ন জ্ঞানের সূচনা হয়……কিন্তু প্রিয় বন্ধু আমার, আমার অবশ্যই তোমার কাছে স্বীকার করতে হবে, যখন থেকে আমার চিন্তাভাবনার মধ্যে এই পরিবর্তন এসেছে তখন থেকে কোন শব্দ বা কথাই দ্ব্যর্থহীন নয় আমার কাছে, প্রতিটা শব্দই দশ রকমের অথবা শত শত অর্থ বহন করে। এবং এখানেই শুরু হয় যাদু, যেটাতে তোমার এত ভয়।’

ফ্রেডারিক ভ্রুকুঞ্চিত করল এবং বাধা দিতে চাইল, কিন্তু এরুয়িন তাকে থামিয়ে দেয়ার দৃষ্টিতে চেয়ে বলে গেল আরও স্পষ্ট করে, ‘একটা উদাহরণ দিয়ে বলতে দাও আমাকে। আমার যেকোন একটা কিছু তুমি নিয়ে যাও তোমার সাথে, যেকোন বস্তু, এবং সময়ে সময়ে সেটা যাচাই করে দেখ। শীঘ্রই ভেতর বাহিরের এই নীতিমালার অনেক অর্থের একটা প্রকাশিত হবে তোমার সামনে।’ সে ঘরের মধ্যে চোখ ফেরাল, দেয়ালের তাক থেকে একটা মাটির মূর্তি নিয়ে ফ্রেডারিককে দিয়ে বলল, ‘আমার বিচ্ছেদের উপহার হিসেবে এটা নিয়ে যাও। আমি যা তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি আজ তা যখন তোমার বাহিরকে সন্তুষ্ট করবে আর তোমার ভেতরেও যদি তা খুঁজে পাও তাহলে আমার কাছে এসো। কিন্তু এটা যদি তোমার বাইরেই থেকে যায়, যেমন রয়েছে এখন, সবসময়, তাহলে তোমার সাথে আমার এই বিচ্ছেদও হবে চিরদিনের জন্য।’

ফ্রেডারিক আরো অনেক কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু এরুয়িন তার হাত ধরল, সামন্য চাপ দিয়ে এমন অভিব্যক্তিতে তাকে বিদায় জানাল যেখানে আর কোন আলাপের সম্মতি ছিল না।

ফ্রেডারিক চলে গেল; সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নামল (আগে কত স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে সিঁড়িগুলোতে আরোহণ করত!); হতবুদ্ধি হয়ে এবং ভগ্ন হৃদয়ে মাটির জিনিশটাকে হাতে নিয়ে সে রাস্তায় নেমে নিজের ঘরের অভিমুখে রওনা হল। বাসার সামনে এসে সে থামল, যে হাতে সে মূর্তিটিকে ধরে ছিল সেই মুষ্ঠিকে প্রচণ্ডভাবে একটা ঝাঁকি দিল এবং হাস্যকর জিনিশটাকে মাটিতে ছুড়ে ভেঙেচুরে ফেলার একটা তাগিদ বোধ করল। তবে তা করল না সে। ঠোঁট কামড়ে ধরে সে ঘরে প্রবেশ করল। দ্বন্দ্বমুখর আবেগের এমন বিক্ষুদ্ধ পীড়ন সে আগে কখনও বোধ করেনি।

বন্ধুর উপহারের জন্য একটা জায়গা ঠিক করল সে, জিনিশটাকে একটা বইয়ের তাকের উপরে রেখে দিল। আপাতত ওটা সেখানেই থাকল।

মাঝে মাঝে, দিন যেভাবে পার হয়ে যাচ্ছিল, সে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকত, ওটার উৎস নিয়ে চিন্তা করত এবং নির্বোধ জিনিশটা তাকে কি দিতে পারে তাই ভাবত। এটা ছিল একটা ছোট্ট মানুষের অথবা একজন ঈশ্বরের অথবা বিগ্রহের আকৃতির এক মূর্তি, রোমান গড জানোসের মত দুটো মুখাবয়ব ছিল ওটার, অশোধিত পোড়ামাটির চকচকে আবরণে তৈরি একটা মূর্তি। অমসৃণ আর অগুরুত্বপূর্ণ লাগত ছোট্ট জিনিশটাকে; নিশ্চিতভাবেই কারুকাজটা রোমান অথবা গ্রীকদেশীয় ছিল না, সম্ভবত আফ্রিকা বা দক্ষিণ সাগরের কোন সেকেলে অদক্ষ জাতির কাজ ওটা। মুখাবয়ব দুটো দেখতে একদম একইরকমের; একটা নিস্পৃহ, অলস আর দুর্বল বাঁকা হাসি ঝুলে ছিল সেখানে। নিতান্তই কুৎসিত ছিল ওই বামন মুখের মূঢ় হাসিটা।

ফ্রেডারিক জিনিশটাকে নিতে পারছিল না আর। এটা তার কাছে স্বভাববিরূদ্ধ আর অসন্তুষ্টির হয়ে উঠছিল, বিরক্ত করে তুলছিল তাকে। পরদিনই সে ওটা নামিয়ে চুলার ওপরে রেখে দিল, এবং তার কয়েকদিন পরে সেটাকে সরিয়ে ফেলল থালাবাসনের আলমারির মধ্যে। বারবারই এটা তার কল্পনায় হানা দিতে লাগল যেন ওটা তার ওপর চেপে বসছে; তার দিকে ঠান্ডা অপ্রতিভ হাসি ছুড়ে দিচ্ছে, বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছে, চাইছে তার মনযোগ। কয়েক সপ্তাহ পরে সে ওটাকে অভ্যর্থনাকক্ষে নিয়ে চোখে পড়ে না এমন একটা ইতালিয় ছবি আর মামুলি একটা স্মারকগ্রন্থের মাঝখানে রেখে দিল। এখন সে অন্তত বিগ্রহটাকে তখনই দেখত যখন সে বাইরে যেত বা ফিরে আসত, এবং সেটাকে আরও কাছ থেকে না দেখেই দ্রুতই পার হয়ে যেত। কিন্তু এভাবেও জিনিসটা তাকে বিরক্ত করত, যদিও তা নিজের কাছে স্বীকার করত না সে।   

মৃতপাত্রের ভাঙা টুকরোর মত এই দুমুখো বিকট মূর্তিটা বিক্ষোভ এবং উৎপীড়নসহ তার জীবনে প্রবেশ করেছিল।

একদিন, কয়েকমাস পরে, সে একটা সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ শেষে ফিরেছিল, সে প্রায়ই এজাতীয় ভ্রমণ করত, যেন কিছু একটা তাকে ক্লান্তিহীনভাবে চালিত করত, সে বাসায় ফিরল, অভ্যর্থনাকক্ষের ভেতর দিয়ে গেল, গৃহকর্মীর সম্ভাষণ গ্রহণ করল, এবং অপেক্ষমান চিঠিপত্রগুলো পড়ে ফেলল। কিন্ত সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারছিল না, যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভুলে যাচ্ছিল সে, কোন পুস্তক তাকে উজ্জীবিত করতে পারেনি, কোন আসনই আরামদায়ক হচ্ছিল না। সে তার চিন্তাকে চাপ দিতে শুরু করল- এসবের কারণ কী? সে কি অবহেলা করে ফেলেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু? খেয়ে ফেলেছে এলোমেলো কিছু? প্রতিফলনে সে বুঝল, এপার্টমেন্টে প্রবেশ করার পর থেকে এই বিরক্তিকর অনুভূতিটি হচ্ছে তার। সে অভ্যর্থনাকক্ষে ফিরে গেল এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে তার প্রথম দৃষ্টি মাটির জিনিসটার দিকেই গেল।

একটা অদ্ভুত ভয় প্রবাহিত হল তার মধ্যে যখন সে দেখল, মূর্তিটা নেই। এটা তিরোহিত হয়ে গিয়েছে। এটা ছিল না। ওটা কি তার ক্ষুদ্র মৃন্ময় পায়ে হেঁটে চলে গিয়েছে? উড়ে চলে গিয়েছে? যাদুর মাধ্যমে?

ফ্রেডারিক নিজেকে টেনে তুলল, নিজের স্নায়ুচাপে হাসি পেল তার। তারপর সে চুপচাপ পুরো ঘরে খুঁজতে শুরু করল। কিছুই না পেয়ে গৃহকর্মীকে ডাক দিল। সে আসল কিছুটা বিব্রত হয়ে এবং স্বীকার করল যে পরিচ্ছন্নকাজ করার সময় জিনিসটা পড়ে গিয়েছিল।

‘কোথায় ওটা?’

ওটা আর সেখানে ছিল না। পাক্কা বোঝা গেল, সে প্রায়ই ছোট্ট জিনিশটাকে হাতে তুলে নিত, আর সেটা শত শত খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গিয়েছিল, এবং সেগুলো আর ঠিকঠাক করা যায়নি। গৃহকর্মী ভাঙা অংশগুলোকে একজন কুমোরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল যে কিনা ওগুলো দেখে তার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল শুধু, আর তারপর সে ওগুলোকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল।

ফ্রেডারিক গৃহকর্মীকে নিস্তার দিল। সে হাসল। এটা তার জন্য একেবারে ঠিক হয়েছে। মূর্তিটার জন্য তার খারাপ লাগল না, ঈশ্বরই জানেন। জঘন্য ব্যাপারটা চুকে গেছে, এখন সে শান্তি পাবে। সে যদি প্রথম দিনেই ওটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলত! এতদিন তাকে কী ভোগান্তিই না পোহাতে হল! কেমন মন্থরভাবে, অদ্ভুতভাবে, চাতুর্য নিয়ে, অশুভ ভঙ্গিতে, শয়তানি চালে ঐ মূর্তিটা তার দিকে তাকিয়ে হাসত! বেশ, এখন যখন ওটা চলেই গিয়েছে তখন নিজের কাছে বলতে বাধা নেই, সে ওটাকে, ঐ মাটির ঈশ্বরকে ভয় পেত, সত্যিকার এবং অকপট ভয়। ওটা কী সেইসব আপত্তিকর ব্যাপারের প্রতীকী নিদর্শন ছিল না যা তার কাছে একদম বেমানান এবং অসহনীয়? যা কিছুকে সে সম্পূর্ণ ক্ষতিকর, স্বভাববিরূদ্ধ এবং অপলাপের সামিল মনে করে- কুসংস্কারের প্রতিফলন সবকিছু, সকল অন্ধকার, এসব কী মনন আর বিবেকের ওপর বলপ্রয়োগের সমান নয়? এটা কী সেই ভয়ানক শক্তিকেই প্রকাশ করে না যা মাটির পৃথিবীতে প্রচণ্ড ক্রোধে উপলদ্ধি করে মানুষ, সেই দূরবর্তী ভূকম্পন, সেই আসন্ন সংস্কৃতির বিলোপ, সেই আশংকাজনক বিশৃঙ্খলা? ঐ জঘন্য জিনিশটা কী তাকে তার বন্ধুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়নি, না, শুধু ছিনিয়ে নেয়া কেন, তা কী তার বন্ধুকে শত্রুতে পরিণত করেনি? যাক, এখন ওটা নেই। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে। ভাল হয়েছে। আরও ভাল হত যদি সে নিজেই ওটাকে ধ্বংস করে ফেলত।

সে এমনই ভাবল, বলল নিজেকে। এবং পূর্বের মতই তার কাজবাজে ডুবে গেল।

কিন্তু এটা একটা অভিশাপের মত ছিল। সে কমবেশি ঐ হাস্যকর জিনিশটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, অভ্যর্থনাকক্ষের জায়গাটায় ওটার অস্তিত্ব ক্রমশ স্বাভাবিক এবং অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল তার কাছে, এখন সেটার অনুপস্থিতি তাকে পীড়ন করতে শুরু করল! হ্যাঁ, সে প্রত্যেকবারই ঘরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় ওটার অভাব বোধ করতে লাগল। জিনিশটা আগে যেখানে ছিল সেখানে এখন শূন্যতা; এবং সেই শূণ্যতা নিঃসৃত হয়ে অদ্ভুতভাবে ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছিল।

ফ্রেডারিকের জন্য দিনগুলো খারাপ আর রাতগুলো অধিকতর খারাপ হয়ে দেখা দিল। দুমুখো মূর্তিটার কথা না ভেবে, ওটার জন্য শূণ্যতাবোধ না করে সে আর অভ্যর্থনাকক্ষে যাতায়াতই করতে পারছিল না, তার মনে হচ্ছিল তার চিন্তাগুলো ঐ মূর্তির শেকলে বাঁধা পড়ে গিয়েছে। এটা যেন তার উপর বলপ্রয়োগের মত অসহ্য মানসিক যন্ত্রনাময় হয়ে উঠেছিল। ব্যাপারটা আর এরকম ছিল না যে সে যখন ঘরের মধ্যে যেত শুধু তখনই বাধ্যতামূলকভাবে তাকে এটা গ্রাস করত, না, তা নয়। যেভাবে অভ্যর্থনাকক্ষের টেবিলের ওপরের জায়গাটা রিক্ততা ও শূন্যতায় বিকীর্ণ হয়ে ছিল, সেরকমই এই ভাবনার বাধ্যবাধকতা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, ক্রমশ অন্য সবকিছুতে ছেয়ে গিয়েছিল, থিতিয়ে উঠেছিল, অদ্ভুত শূণ্যতায় পুর্ণ করে তুলেছিল তাকে।

মূর্তিটার জন্য শোক করা তার জন্য কতটা অসঙ্গত সেটা নিজের কাছে পরিষ্কার করে তুলতে বারবার সে ওটার পরম বিশেষত্ব নিয়ে ভাবল। সে দেখতে পাচ্ছিল ওটার সকল গর্দভসুলভ কদর্যতা আর বর্বরতা, শূণ্য অথচ ধূর্ত হাসি, প্রকৃতপক্ষে বক্রভাবে আঁকা দুটো মুখ যেন কারারূদ্ধ, ঘৃণাপূর্ণ। সে আবিষ্কার করল সে নিজেই এখন সেই হাসিটি নকল করার প্রয়াস করছে। মূর্তিটার দুটো চেহেরা একদম একইরকম ছিল কি না সেই প্রশ্নে জর্জরিত হল সে। তাদের মধ্যে একটার কী সম্ভবত চকচকে ফাটল বা অমসৃণতার কারণে একটু আলাদা অভিব্যক্তি ছিল না? কিছুটা জিজ্ঞাসু ছিল না? কিছুটা ফিনিক্সসুলভ ছিল না সেটা? এবং কেমন যেন অদ্ভুত রঙ ছিল ওটার গ্লেজের! সবুজ এবং নীল এবং ধূসর, কিন্তু কিছুটা লালচেও, এমন একটা চকচকে রঙ যা সে এখন অন্য বস্তুর মধ্যে খুঁজে ফিরছিল, জানালায় সূর্যের রশ্মির ছটায়, ভেজা শানের প্রতিবিম্বে।

রাতের বেলায়ও সে সেই পালিশের গ্লেজ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করল। সে এটা ভেবেও তাড়িত হল যে এই ‘গ্লেজ’ শব্দটা কী অদ্ভুত, ভিনদেশি, প্রাণহীন, অপরিচিত আর প্রায় মারাত্মক একটা শব্দ। শব্দটা নিয়ে বিশ্লেষণ করল সে, এবং একবার সে এই বর্ণগুলো উলটো করেও সাজালো। তারপর পড়ল ‘এজাল্গ।’ উচ্চারণটা এরকম অভিশপ্ত হল কীভাবে? সে চিনত এই ‘এজাল্গ’ শব্দটা, সে নিশ্চিতভাবেই জানত, উপরন্তু এটা ছিল একটা বৈরী আর খারাপ শব্দ, একটা কুৎসিত আর বিরক্তিকর অর্থপূর্ণ শব্দ। দীর্ঘ সময় ধরে সে এই প্রশ্নটা নিয়ে ভেবে নিজেকে পীড়া দিল। শেষমেষ সে মনে করতে পারল, ‘এজাল্গ’ শব্দটা তাকে একটা পুস্তকের কথা মনে করিয়ে দিল যা সে অনেক আগে এক ভ্রমণকালে কিনে এনে পড়েছিল। বইটা তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল, বিরক্ত করে করে তুলেছিল আর তবুও গোপনে মোহগ্রস্থ করে তুলেছিল তাকে, ওটার নাম ছিল ‘প্রিন্সেস এজাল্কা’। এটা একটা অভিশাপ ছিল; প্রস্তরমূর্তিটির সাথে সম্পর্কিত সবকিছুই, ঐ গ্লেজ, ঐ নীল-সবুজ, ঐ শত্রুতাপ্রবণ হাসি, সবই তাকে কষ্ট দিচ্ছিল, তাকে বিষাক্রান্ত করে তুলছিল। এবং তার বন্ধু এরুয়িন, তার পূর্বকালের বন্ধু, তার হাতে মূর্তিটা তুলে দেয়ার সময় কী অদ্ভুতভাবেই না হেসেছিল! কী চরম অদ্ভুতভাবে, কী চরম উল্লেখযোগ্যভাবে, কী চরম শত্রুতাপূর্ণভাবে!

ফ্রেডারিক সাহসভরে এই অমোঘ ভাবনার ঘোরকে দমন করতে চাইল, অনেকদিন ধরে, অব্যর্থভাবে। বিপদটা সে পরিষ্কার আঁচ করতে পেরেছিল; সে পাগল হয়ে যেতে চায় না! না, তার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। কারণ জানাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, জীবন বিসর্জন দেয়া নয়। এবং সে ভাবল এটাই তাহলে সেই যাদু, ঐ এরুয়িন ঐ মূর্তির সাহায্যে তাকে কোনভাবে বশীভূত করেছে, এবং যুক্তি ও বিজ্ঞানের একজন যোদ্ধা হিসেবে এই অন্ধকার শক্তির কাছে তাকে বলি হয়ে যেতে হবে। কিন্তু যদি তাই হয়, যদি এটা তাকে ধরে নিতেই হয়, তাহলে তো সত্যিই যাদুতন্ত্র আছে, মায়াবিদ্যা আছে। না, এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল!

একজন ডাক্তার তাকে বেশি করে হাঁটা আর গোসলের পরামর্শ দিল। কখনও কখনও আনন্দের খোঁজে সন্ধ্যাটা পান্থশালায় কাটাতো সে। কিন্তু তা খুব কাজে আসত না। সে এরুয়িনকে অভিসম্পাত করল, নিজেকেও।

অধিকাংশ দিনের মতই একদিন সে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে ক্লান্তিহীনভাবে বিছানায় শুয়ে ছিল, নির্ঘুম। তার খারাপ লাগছিল, অস্বস্তি লাগছিল। সে ধ্যানমগ্ন হতে চাইল, নিজেকে প্রবোধ দিল, কিছু বলতে চাইল নিজের কাছে, ভাল কিছু, সান্ত্বনামূলক কিছু, আশ্বস্তবাণীর মত, একদম ‘দুই দুগুণে চার’ এর মতই নির্মল আর প্রাঞ্জল কিছু। কিছুই মাথায় আসল না তার, কিন্তু একেবারে লঘুচিত্তে সে নিজের সাথে অস্পষ্ট শব্দে কিছু বলতে চাইল। ধীরে ধীরে ঠোঁটে কথা ফুটল তার, কয়েকবার সেগুলোর অর্থই বুঝল না সে, আবার নিজের ভেতর থেকে উৎসারিত ক্ষুদ্র বাক্যটাই নিজের মুখে আওড়াল সে।  বিড় বিড় করে বলে গেল যেন নিজেকেই প্রবঞ্চনা করল, যেন কথাগুলো অন্ধের মত খুঁজে ফিরছিল সে। একটা প্রাচীরের সংকীর্ণ পথে পলায়নপর নিদ্রার পানে যেন হেঁটে যাচ্ছিল সে, সেই সংকীর্ণ পথ যা অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছে।

কিন্তু হঠাৎ, যখন সে একটু উচ্চস্বরে কথা বলে উঠল, যে শব্দগুলো সে বিড় বিড় করে বলে যাচ্ছিল তা অর্থপূর্ণ হয়ে উঠল। সে জানত এটা, কথাটা ছিল, ‘হ্যাঁ, এখন তুমি আমার ভেতরেই আছ!’ তাৎক্ষণিক সে বুঝে ফেলল এটা। সে বুঝতে পারল কথাগুলোর মানে, ঐ মাটির বিগ্রহটার দিকেই ইঙ্গিত করে এটা, আর এখন, এই ধূসর রাতে, সেই অপার্থিব দিনে এরুয়িনের বলা ভাববাণীর অর্থ বুঝে গেল সে, অর্থাৎ এখন ঐ জিনিশটা, যেটা সে সেদিন ঘৃণাভরে তুলে নিয়েছিল হাতে, সেটা এখন আর বাইরে নয়, তা আছে তার ভেতরে! ‘কারণ যা বাইরে আছে, তা আছে ভেতরেও।’

বদ্ধাবস্থা থেকে লাফ দিয়ে উঠল সে, বরফ আর আগুনের একটা প্রবাহ সঞ্চারিত হল তার মধ্যে। দুনিয়াটা ঘুরপাক খেল তার সামনে, গ্রহমন্ডলী উন্মাদ চোখে তাকালো তার দিকে। সে একটা বস্ত্র ঝুলিয়ে নিল, আলো জ্বালালো, বাড়ি থেকে বের হল আর সেই মধ্যরাতেই এরুয়িনের বাসায় হাজির হল। পরিচিত কর্মশালাটির বাতি জ্বলে রয়েছে তখনও, প্রবেশদ্বারটি রয়েছে উন্মুক্ত, সবকিছু যেন তারই প্রতীক্ষায় জেগে আছে। সে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠল, টলতে টলতে এরুয়িনের ঘরে গেল, কম্পিত হাতে টেবিল ধরে নিজেকে স্থির করল। এরুয়িন বাতির সামনেই বসে ছিল, স্নিগ্ধ আলোয়, স্মিত, চিন্তামগ্ন।

বিনীত ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়াল। ‘তুমি চলে এসেছ। খুব ভাল।’

ফ্রেডারিক ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তুমি কি আশা করেছিলে আমাকে?’

‘তুমি জানো, আমার দেয়া সেই ছোট্ট উপহারটিকে নিয়ে তুমি যখন চলে গিয়েছিলে সেই মুহুর্ত থেকেই আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। আমি তখন যা বলেছিলাম তা কি ঘটেছে?’

‘হ্যাঁ,’ ফ্রেডারিক বলল, ‘মূর্তিটা এখন আমার ভেতরে, আমি আর এটাকে বহন করতে পারছি না।’

‘আমি কি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?’ এরুয়িন প্রশ্ন করল।

‘আমি জানিনা। তোমার যা খুশি কর। তোমার ম্যাজিক সম্পর্কে বল আমাকে। বল কীভাবে আমি ওটা বের করে ফেলতে পারি।’

এরুয়িন বন্ধুর কাঁধে হাত রাখল। তাকে চেয়ারে বসাল। তারপর ভ্রাতৃত্বসুলভ আন্তরিকতার সাথে কথা বলল, ‘ওটা আবার তোমার বাইরে চলে আসবে। আমাকে বিশ্বাস কর। নিজেকে বিশ্বাস কর। তুমি এটাতে বিশ্বাস করতে শিখে গেছ। এখন এটাকে ভালবাসতে শেখো! এটা তোমার ভেতরেই আছে, কিন্তু এখনও তা মৃত, এটা এখনও একটা মায়ামূর্তি তোমার কাছে। তাকে জাগাও, কথা বল, প্রশ্ন কর! কারণ এটা আসলে তুমিই! তাকে ঘৃণা কর না আর, ভয় কর না, কষ্ট দিও না, যেভাবে তুমি বেচারা মূর্তিটাকে অত্যচার করেছ, সে তো ছিলে তুমি নিজেই! কীভাবে তুমি নিজেকে এতটা কষ্ট দিলে!’

‘এটাই তাহলে সেই যাদু?’ ফ্রেডারিক জিজ্ঞাসা করল। সে চেয়ারের মধ্যে সেঁধিয়ে বসল আরও, যেন সে বৃদ্ধ হয়ে গেছে, কণ্ঠস্বর নেমে গেছে তার।

‘হ্যাঁ, এটাই,’ এরুয়িন জবাব দিল, ‘এবং তুমি সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন ধাপটি পেরিয়ে এসেছ। তুমি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জেনেছঃ বাহিরটাই ভেতর হয়ে যেতে পারে। পরস্পরবিরোধীতার সীমানা অতিক্রম করে গিয়েছ তুমি। এটা তোমার কাছে নরকসম মনে হয়েছে; বুঝতে চেষ্টা কর, বন্ধু আমার, এটা আদতে স্বর্গ! এই স্বর্গ তোমার জন্য প্রতীক্ষা করছে। দেখো, এটাই যাদুঃ ভেতর এবং বাহিরকে বিনিময় করা, জোর করে নয়, যন্ত্রণা সয়ে নয়, যেভাবে সয়েছ তুমি, বরং মুক্তভাবে, স্বেচ্ছায়। অতীতকে ডাকো, ডাকো ভবিষ্যতকেঃ দুটোই তোমার মধ্যে আছে! আজ পর্যন্ত তুমি ছিলে তোমার ভেতরের দাস। তার প্রভু হয়ে ওঠ। এটাই হচ্ছে ম্যাজিক।’

অনুবাদক: শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন