সৌমিত জয়দ্বীপ।। প্রবন্ধ।। হুমায়ূন আহমেদ: একটি ‘পক্ষপাতমূলক’ পর্যালোচনা

0

ছবি: অন্তর্জাল

অনেককেই আগেও দেখতাম, এখনও দেখি লিখছেন : জোৎস্না, বৃষ্টি, পূর্ণিমার আলো, বর্ষা, বসন্ত ইত্যাদির রোমান্টিক ভাবপ্রকল্পটি তারা হুমায়ূন আহমেদের কাছে শিখেছেন। শিখতেই পারেন। শিখে সেই ঋণ স্বীকার করাও একটা মহৎগুণ।

কিন্তু আপনাদের কাছে অপ্রিয় হওয়ার মতো একটা কথা এবার বলতেই হচ্ছে। বাঙালি মধ্যবিত্তকে যিনি এসব সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছেন, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুরই আসলে বিষয়গুলো কোয়েন করেছেন। তাঁর সৃষ্টির পরতে পরতে এসব ছুঁয়ে গেছে।

হুমায়ূনের অসংখ্য উপন্যাস ও লেখা আছে, যেগুলোতে তিনি সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ঋণ স্বীকার করেছেন। হুমায়ূনের লেখা পড়লেই বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথকে তিনি কী গভীর অনুধ্যান ও মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেছেন এবং শিখেছেন নিরন্তর। রবীন্দ্রনাথের ওপর গবেষণা করলেও হুমায়ূন বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা বড় উপকার করতে পারতেন বলে মনে হয়!

‘সাবঅল্টার্ন স্ট্যাডিজে’র অন্যতম পুরোধা রণজিৎ গুহ তাঁর শিষ্যদের বলতেন, তুমি যাঁকে পাঠ করছ, তিনি কাকে পাঠ করতেন, তাঁকে জানাও একই রকম জরুরি।

হুমায়ূনভক্ত বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কি এই কথাটা মানবেন?

ভাষার কথা বলবেন তো? এটা তো কালের বিধান। রবীন্দ্রনাথ ভাষাটা গড়ে না দিলে আমরা আজও কোথায় থাকতাম, হুমায়ূন কোথায় থাকতেন সেটা ভাবাই যায় না!

আর আমরা কি না প্রাইমারি সোর্স বাদ দিয়ে সেকেন্ডারি সোর্স নিয়ে মাতামাতি করি! হুমায়ূনের অন্তত সেই সততাটুকু ছিল, কিন্তু তাঁর ভক্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সেই সততাটা নেই বললেই চলে!

আমরা কাকে হাইড করে কাকে গাইড মানছি বুঝতে পারছি কি? আমাদের মনোজগতে নজরুলের মতোই, হুমায়ূনকেও ঠাকুরের সমানুপাতে ভাবার প্রবণতা শুরু হয়নি তো?

২.

ইতিহাস থেকে একটা উদাহরণ অনেকেই টানতে পারেন, আমিও টানছি অন্যভাবে।

জার্মানিতে ১৪৮৩ সালে জন্মেছিলেন একজন অধ্যাপক ও ধর্মসংস্কারক, নাম তাঁর মার্টিন লুথার। তো লুথার ল্যাটিন ভাষায় লিখিত বাইবেলের অনুবাদ করবেন। সিদ্ধান্ত নিলেন এই অনুবাদের ভাষাটা হবে জার্মান কৃষকদের মুখের ভাষার মতো, সহজ-সাধারণ ভার্নাকুলার ভাষা। চিন্তাটা স্কুপ করে গেল। লুথারের বাইবেল বিক্রি হলো হাজার হাজার কপি। তাঁর জীবদ্দশাতেই দেখে গেছেন ৩৭৭টি সংস্করণ! ইমাজিন ৩৭৭!!!

প্রায় তিনশ বছর পরে, ১৭৭২ সালে ভারতে একজন সমাজসংস্কারক জন্মালেন। নাম রামমোহন রায়। তো রাজা মশাই ‘বেদান্ত’ অনুবাদ করবেন বলে মনস্থির করলেন। কিন্তু বাঙালির জন্য তিনি সংস্কৃত গ্রন্থ অনুবাদ করতে গিয়ে সংস্কতবহুল বাক্যের আশ্রয় না নিয়ে পারলেন না। সংস্কৃতবহুল শব্দে, বাক্যে বাঙালি কথা বলে না, বলতেও পারে না। কারণ, যোগাযোগের জন্য এটা ঠিক উচিত ভাষা নয়। ফলাফল হলো, রামমোহনের জীবদ্দশাতে এই অনুবাদের দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়নি!

তিনশ বছর পরেও, লিখিত ভাষা স্রেফ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুখের কথা বলতে পারল না বলে হেরে গেল!

আবার, আপনি লালনের কাছে ফিরে যান। দেখবেন লালনের চেয়ে বড় বিজয়ী কেউ নেই। লালনকে সাহিত্য বিভাগগুলো, সাহিত্যবেত্তারা সাহিত্যিক হিসেবে চর্চা না করলেও টিকে আছেন। লালনকে আসলে টিকিয়ে রেখেছেন বাউল-আউল-কৃষক-শ্রমিক-মুটে-মজুর। বব ডিলান নোবেল জেতার পর, লালনও যে সাহিত্য পদবাচ্য মানুষ, এই আলাপ আমাদের উপনিবেশি মন শুরু করেছে। এই আলাপ না তুললেও, লালন-হাছন টিকে থাকতেন। থাকাটাই ভবিতব্য। বাঙালি নাগরিক মধ্যবিত্ত যতই কর্পোরেটের গলায় ঝুলে ফোক-ফেস্ট করে দরবারের মোঘল সাজার চেষ্টা করুক আর বলার ভান করুক যে, ‘আমিই এখন তোমার পৃষ্ঠপোষক’, শেষ পর্যন্ত পথের মানুষই বাংলার লোকগুরুকে রাজতিলক পরিয়ে উচ্চাসনে রাখবে।

৩.

তো লালন বা লুথারের প্রেক্ষিতে হুমায়ূন এদিক থেকে জয়ী অবশ্যই। তাঁর ভাষাটা মানুষের সহজবোধ্য মনে হয়েছে। কিন্তু সেই মানুষ তো বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নয়, মাত্র একটা শ্রেণির প্রতিনিধি তারা – মধ্যবিত্ত শ্রেণি। হুমায়ূনের লেখায় মোটাদাগে এই শ্রেণিটিরই উপস্থিতি। বৃহৎ মানুষ ঔপন্যাসিক হুমায়ূনকে চেনেনই না হয়তো!

তাঁর কোন উপন্যাসটি ‘বাজারি’, কোনটি ‘অপন্যাস’, সেগুলো অন্য বিতর্কের বিষয় এবং এসব শব্দকে ধরে উপন্যাসের সমালোচনা করাও আসলে কোন মানদণ্ড নয়। উপন্যাস বৃহৎ মানুষের জীবনের কথা বলতে পেরেছে কি না সেটাই হলো সমালোচনার জায়গা। আমাদের সমাজব্যবস্থায় আজকে শিক্ষিত ও কর্পোরেট মধ্যবিত্তই যেহেতু স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে দেয়, সেহেতু সে নিজেকে ‘বৃহৎ’ মনে করতে পারে। তাতে ‘হ্যাপোক্রেসি’ আছে, কিন্তু গায়ের ও কলমের জোরের তো একটা দাম আছে বৈকি!

সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। হুমায়ূনের ভেতরে গেলে কি পুরোটাই ফাঁপা মনে হয়? এও কি সম্ভব? এই বিশ্লেষণ একপাক্ষিক ও অবিবেচকসুলভ হবে। ‘মধ্যবিত্তের ছবিয়াল’ হিসেবেও তো তিনি একটা বড় ক্যানভাসে বিচরণ করবেন কালের যাত্রায়। এটা সংখ্যা দিয়ে নয়, মনের জেদ ও জল্লাদ দিয়ে নেয়, বিচারটা করতে হবে তাঁর যৌক্তিক প্রভাব দিয়ে, তাঁর হালকা চালের উপন্যাসগুলো, প্রকাশকের ব্যবসা বাঁচানো উপন্যাসগুলোকে বাদ দিয়ে হলেও।

যে নাগরিক মধ্যবিত্ত সত্তর ও আশির দশকে রাজনৈতিক ডামাডোলে পড়ে দিশেহারা জীবনে ও জাগরণে, যে নাগরিক মধ্যবিত্ত অনেক বেশি পার্থিব, যার ভাবনাগুলো স্পর্শকাতর, লঘু ও মৃদু, সে আসলে আশ্রয় চেয়েছিল একটা কোথাও। হুমায়ূনে সেই আশ্রয়ের খোঁজ পেয়েছিল সে।

মধ্যবিত্ত তার শ্রেণি ও বয়সের জ্ঞানে যেভাবে ভাবতে পছন্দ করে, হুমায়ূন তাকে সেখানে বেঁধে ফেলেছিলেন তাঁর রসবোধ ও গল্প বলার অসাধারণত্ব আর লঘু-অগভীর ভাবনার চরিত্রগুলো দিয়ে। এটাই হলো হুমায়ূনের হিপ্টোনাইজেশন। এটাই হলো তাঁর মায়ার খেলা! সেই মায়া দিয়ে তিনি এমন এক ছায়া তুলেছিলেন, যা তাঁকে শ্রেণিবিশেষের কাছে ‘অবতার’ বানিয়ে দিয়েছে! যেটা আগে কেউ তাঁর মতো করে তুলেননি এবং এখানেই তাঁর তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার রহস্যটা লুকিয়ে আছে।

এমনকি পিরিয়ডিক্যাল নোভেলগুলোতেও হুমায়ূন এই ছাঁচটা কাজে লাগিয়েছেন। রাজনৈতিক উপন্যাস ও রাজনীতির উত্তাল-জটিল সময়কেও যে রসবোধের মাধ্যমে সরল ও কনটেম্পোরারি বানিয়ে ফেলা যায়, মনে করিয়ে দেওয়া যায়, যেন গতকালকের ঘটনা, সেটার সার্থক প্রয়োগকর্তা তিনি। সুনীল-শীর্ষেন্দুদের পিরিয়ডিক্যাল উপন্যাস অন্য মাত্রার, তবে, হুমায়ূন একাই তাঁর গল্পের অভ্যস্ত সারল্য দিয়ে তাঁদের চ্যালেঞ্জ করে ফেলেছেন!

৪.

মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বড় দোদুল্যমানতা হলো, সে এমন একটা পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থায় বাস করছে, যেখানে সে তার নায়ক না বদলে টিকতে পারে না। আজ নতুবা কাল, নায়ক সে বদলাবেই; সেই পরিবর্তিত নায়ক হুমায়ূনের সমসাময়িক মৃত বা জীবিত কেউ হতে পারেন, আবার পরের প্রজন্মেরও কেউ হতে পারেন! হুমায়ূন তাকে বই পড়তে শিখিয়েছেন, এই কথা গর্বের সঙ্গে বলার পরও সে নায়ক বদলাবে, মিডিয়া তার মন বদলাবে।

এই প্রজন্মটি মূলত নব্বইয়ের পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও মুক্তবাণিজ্যের যুগে মহীরুহ হয়ে গত ২৫ বছরে শাখা-প্রশাখা মেলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এদেশে প্রগতি প্রকাশনীর বইও আসা বন্ধ হয়ে গেল নব্বইয়ের শুরুতে; অথচ এদেশের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রজন্ম, আমাদের বাবা-মা বা তাদের পূর্বপ্রজন্ম, প্রগতির বই পড়ে বড় হয়েছেন। দেশজ পুস্তকের পাশাপাশি, প্রগতির বইগুলো পাঠ করতে করতেই মূলত এদেশের একটা বড় অংশের সিরিয়াস পাঠক তৈরি হয়েছিল। নব্বইয়ের পরে সেই পাঠকচিত্তও তার পাঠ অনভ্যস্ততার দরুণ হালকা চালের পুস্তক চাওয়া শুরু করেছে, কারণ নয়ে-ছয়ে সে নানা বৈষয়িক কাজে ব্যস্ত; সময় তাকে অনেক যান্ত্রিক করে ফেলেছে। গভীর বিষয় পড়ার সময় কোথায়!

তো প্রকৃতি যেহেতু শূন্যস্থান পছন্দ করে না, সেহেতু সে কাউকে চাইছিল। হুমায়ূন তো তৈরিই ছিলেন তাঁর গল্প বলার জাদুশক্তি নিয়ে। তিনি নতুন প্রজন্মকে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণি থেকে উপন্যাস তথা বই পড়া শেখাতে দৃশ্যমঞ্চে হাজির হলেন, যে প্রজন্ম এক ধরনের রোমান্টিকতা ও অগভীরতার বশবর্তী হয়ে এমনকি রাজনীতিকেও ‘না’ বলতে শিখেছে! অথচ, খুঁজে দেখুন, হুমায়ূনেও রাজনীতির গভীর ছাপ রয়েছে। রাজনৈতিক বোধ ছাড়া কোন লেখকই শেষ পর্যন্ত আর কালের বিচারে লেখক হিসেবে টিকতে পারেন না।

কিন্তু, বিশ্বায়নের যুগে সিভিল-কর্পোরেট-এনজিও-মিলিটারি পুঁজিবাদ চেয়েছে নতুন মধ্যবিত্ত পাঠক রাজনৈতিকভাবে অসচেতন-অগভীর হোক, সে তার ব্যক্তিগত স্পর্শকাতরতা আর অভাব-অনুভূতিগুলো নিয়েই শুধু ব্যস্ত থাকুক, সে ‘টুগেদারনেসে’র বদলে ‘সেলফ’ নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। হুমায়ূনের চরিত্রগুলোর মধ্যে যেহেতু এসব মধ্যবিত্তীয় প্রবণতা প্রচুর পরিমাণে আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, সেহেতু তিনি পুঁজিবাদের এই পারপাসটা সার্ভ করে ফেললেন, আরও জনপ্রিয় হলেন। নব্বই-পরবর্তী মুক্তবাজারি মার্কেটও তাঁকে গিলে ফেলল। এই মার্কেটের সীমা ডিঙানো তাঁর পক্ষে আর কখনই সম্ভব হয়নি। তিনিও তাই আর রাজনৈতিকভাবে সচেতন প্রজন্ম বা পাঠক তৈরি করতে পারেননি। তাঁর রাজনৈতিক লেখার মূল মাজেজাটাও এমনকি বিশাল এক রাজনীতির ফাঁদে পড়ে পাঠক মন থেকে লোপাট হয়ে গেছে!

৫.

হুমায়ূন যেহেতু একটা শ্রেণির, যে শ্রেণির বিহ্ববলতা, দোদুল্যমানতা, রোমান্টিকতা, স্পর্শকাতরতা পারদের মতো ওঠা-নামা করে; হুমায়ূন যেহেতু একটা বয়সের, যে বয়স গভীর ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে রসজ্ঞ বিনোদন চায়; সেহেতু এই সীমাবদ্ধতা নিয়েই তাঁকে কালের সঙ্গে লড়তে হবে।

সেই লড়াইয়ে তাঁর নাটকগুলো জ্বলজ্বল করবে, ছোটগল্পের জাদুকরি বাঁকগুলো ‘অন্তরে অতৃপ্তি’ দিবে, কিছু গান ও কবিতাও থাকবে, আর অন্তত গোটা দশেক উপন্যাস তাতে ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে নেতৃত্ব দেবে।

৬.

লেখা শেষ। খেলাও শেষ। শেষ করার আগে কৈশোরে তাঁকে ও তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে কেমন ভাবনা ভাবতাম, তারই একটি নমুনা পেশ করছি, যেগুলোকে কালের বিচারে আজও সত্য বলে মানি।

মনে পড়ে যখন স্কুল কিংবা কলেজে পড়তাম তখন আমাদের প্রেরণার নাম ছিল হিমু! হিমু হওয়ার চেষ্টা করতাম আমরা। হিমু হয়ে যেতাম কখনও কখনও। ঐ বয়সে সেটা বেশ মানিয়ে যেত। সবাইকেই মানায়। কেউ হতো, কেউ হতো না। জীবনের অমন বয়সে হিমু হতে হয় মাঝে মধ্যে। ওতে আনন্দ আছে। হুমায়ূন আহমেদ সেই আনন্দের স্রষ্টা। আমরা অনেকেই তাঁর বিশেষ ভক্ত নই মোটেও। ভক্ত না হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু বিনোদনদায়ী শিল্পী হিসেবে তিনি অতুলনীয়। এজন্য এবং আরও কয়েকটি বিশেষ কারণে তাঁকে মনে রবে। মনে রাখতে হবে। অতল শ্রদ্ধা হিমু!

ড. সৌমিত জয়দ্বীপ: লেখক ও গবেষক

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন