সাদিয়া সিদ্দিকা।। গল্প।। বৃষ্টি ও কদম ফুল

0

ছবি: অন্তর্জাল

রাত থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে, থামার নামগন্ধ নেই। চেয়ারম্যান বাড়ির উত্তর দিকের রাস্তায় হাঁটুপানি জমেছে।  ইস্ত্রি করা ধবধবে সাদা পাজামা-পান্জাবি পরা নাজিমুদ্দিন সাহেবকে ছাতা হাতে বারান্দায় পায়চারি করতে দেখা যাচ্ছে। দশ মিনিট যাবৎ এমন চলছে।  কোথাও বের হতে চেয়েছিলেন হয়তো। আরেকটু পর্যবেক্ষণ করে আসল হেতুটা বোঝা গেলো। ঠিক বৃষ্টি না, উত্তর দিকের রাস্তার হাটু পানিটাই যতো গন্ডগোল পাকিয়েছে। 

পায়চারির আরও মিনিট পাঁচেক পার হলো।  দেখা গেল- পাজামাটা কয়েকপরত ভাঁজ করে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত তুলে আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নাজিমুদ্দিন সাহেব। পা টিপে টিপে খানিকটা পথ যেতেই হাসমত ব্যাপারীর ছোট ছেলে হাসুর সাথে দেখা। বৃষ্টির পানি জমে থাকা ক্ষেতে কয়েকটা ছেলে মিলে মাছ ধরছে। পুরো শরীর কাদায় লেপ্টালেপ্টি হয়ে আছে।

নাজিমুদ্দিন হাসুকে ডাকলেন। ডাকের কণ্ঠটা বেশ ভারি হলেও কথার কণ্ঠ ফুরফুরে। কাছে ডেকে বললেন, ‘ওই হাসু কী কী মাছ পাইছিস দেখা দেখি!’

বোবা হাসু হাত মুখ চোখ দিয়ে খুশির ইঙ্গিত করে। মাছ রাখার পাত্রটা নাজিমুদ্দিনের সামনে এনে ধরে।

পুটি, ট্যাংরা, কানপনাসহ কয়েকজাতের ছোট মাছ প্রায় আধ পাতিল হবে। নাজিমুদ্দিন হাসুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বেশ উদাস দৃষ্টি। তারপর ভারি শ্বাস ছাড়েন। তারপর উঠে হাঁটতে থাকেন।

আজ হাসুর বোনকে নিয়ে শালিস। শালিস করতেই যাচ্ছেন নাজিমুদ্দিন সাহেব। অথচ হাসুর কোন কিছু যেন আসে যায় না। ‘কথা বলতে না পারাও আল্লাহর এক প্রকার আশীর্বাদ’ মনে হয় নাজিমুদ্দিনের কাছে। সমাজে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন মুখ খোলা যায় না তখন একবারে মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়াটা মন্দ না।

আজকের শালিসে কী রায় দিতে হবে সেটা ভেবে মুখ অন্ধকারে ঢেকে যায়।

বৃষ্টির গতিটা আরও তীব্র হয়েছে, একটু একটু বাতাসও শুরু হয়েছে, ছাতা দিয়ে আর বৃষ্টি আটকানো যাচ্ছেনা। রাস্তার দূরত্ব কমাতে তিনি জেলে পাড়ার ভেতর দিয়ে যেতে লাগলেন। খুব দ্রুত হাঁটতে গিয়ে পান্জাবির পিছন দিকে কাদার দাগ পড়তে লাগল। জেলে পাড়ার পরেই একটা মাঠ আর মাঠের পরেই হাসমতের বাড়ি। মাঠের দক্ষিণ পাশটায় একটা কদম গাছ। কদম গাছটায় নব যৌবনা তরুনীর মতো ফুলের বান এসেছে। কদম গাছটার দিকে চোখ পড়তেই সে দেখে একটা মেয়ে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির পানি তার চুল বেয়ে টপটপ করে পড়ছে, হাতে একগুচ্ছ বৃষ্টিস্নাত কদম ফুল। নাজিমুদ্দিন মেয়েটাকে ঠিক চিনতে না পেরে হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করে “কদম গাছের তলে কোন বাড়ির মেয়ে গো?

 নাজিমুদ্দিন তাকে চিনতে পারেনি এটা বুঝতে পেরে মেয়েটি উত্তর দেয়  “জেলে পাড়ার মাইয়্যা আমি, হোসেন মাঝি আমার বাপ”।

মেয়ের হাতের কদমফুল দেখে তার বৌ কুলসুমের কথা মনে পড়ে। কদম ফুল খুব ভালোবাসে কুলসুম। বিয়ের পরদিনই অনেক খু্ঁজে কদম ফুল এনে দিলে খিলখিল করে হাসতে হাসতে মাটিতে  লুটিয়ে পড়েছিল কুলসুম। সেসব কথা মনে হলে তার শরিরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। তার এই ষাট বছরের জীবনে কুলসুমই তাকে সকল পরিস্থিতিতে আগলে রেখেছে। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই কুলসুমের মিষ্টি মুখটার উপর মায়া পড়ে গিয়েছিল। তাই অনেক বছর হয়ে গেলেও যখন সন্তান হচ্ছিলনা তখনও সে কুলসুমের উপর রাগ করতে পারেনি। তারপর বিয়ের দশবছরের মাথায় শ্রাবণের ঘোর লাগা সন্ধ্যায় কোল আলো করে এসেছিলো তাদের মেয়ে রেণুকা। চাঁদের মতো রূপ ছিলো তার। ডাগর ডাগর চোখে যখন সে তাকাত, নাজিমুদ্দিনের মনে হত এ মনে হয় রাজার মেয়ে, ভুল করে তার ঘরে জন্মেছে। কিন্তু এই রূপে কালি পড়তে থাকে তেরো বছর বয়স থেকেই। অজানা এক অসুখে পড়ে ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের মতো রেণুকার জীবনপ্রদীপও নিভু নিভু করছিলো। তবে চেষ্টার ত্রুটি করেনি নাজিমুদ্দিন, বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু কেউ রোগ ধরতে পারেনি। তারপর আশ্বিনের শেষে শিউলি ঝরার সাথে সাথে রেণুকাও ঝরে পড়েছিল। আজ সেসব সুখ দুঃখের স্মৃতি মনে পড়লে সে ঘোরে চলে যায়। বাজ পড়ার শব্দে তার ধ্যান ভাঙলে দেখে মেয়েটা সবুজ ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে জেলে পাড়ার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। নাজিমুদ্দিনের ঝাপসা দৃষ্টিতে মেয়েটিকে একটা প্রজাপতি বলে ভ্রম হয়। সেও দ্রুত পায়ে হেঁটে হাসমত আলীর বাড়ির  উঠোন পেরিয়ে বৈঠক ঘরে ঢোকে। তাকে দেখে সেখানে উপস্থিত সকলেই দাঁড়িয়ে যায়, শুধু ঘরের দক্ষিন দিকটায় মাটিতে লেপ্টে বসা একজনের অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়না, সে হাসমত, যার মেয়েকে নিয়ে আজকে শালিস। সবাইকে হাতের ইশারায় বসতে বলে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে নাজিমুদ্দিন। মেয়েটার অপরাধ কী সেটা আগেই জানানো হয়েছে তাকে। তবু শালিসের নিয়ম অনুযায়ী একবার জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল মেম্বার রমজানের দিকে। সে দাঁড়িয়ে যা বলল তার মূল কথা মোটামুটি এই যে, মেয়েটা পাশের গ্রামের এক হিন্দু ছেলের সাথে তিনদিন আগে পালিয়ে গিয়েছিল আর কাল রাতে ফিরে এসেছে। ফিরে আসলে তার পরিবার মেয়েটাকে মেনে নিলেও আপত্তি করেছে গ্রামের মানুষ। তারা এ অপবিত্র মেয়েটাকে গ্রামে থাকতে দিবেনা, দরকার পড়লে হাসমত আলীর পরিবার সহ গ্রামছাড়া করবে। কিন্তু গ্রামের পরিবেশ কিছুতেই নষ্ট হতে দিবেনা। তাদেরও বৌ মেয়ে নিয়ে বাস করার একটা জব্বর বন্দোবস্ত না হলে ওরাও প্রশ্রয় পেয়ে যাবে। নাজিমুদ্দিন একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মেয়েটাকে এ ঘরে আনার আদেশ দেয়। মেয়েটি শালিস ঘরে এসে এক কোণায় কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখমুখ ভয়ে নীল হয়ে গেছে। নাজিমুদ্দিন অনুমান করে চৌদ্দ কি পনেরো বছর বয়স হবে মেয়েটার। ছিমছাম গোলগাল মুখটা যেন কচি পেয়ার মতো লাগে নাজিমুদ্দিনের কাছে। তার মেয়ে রেনুকার সাথে মুখের অবয়বটায় কোথায় যেন একটা প্রচন্ড মিল আছে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সে তা ধরতে পেরেছে, থুতনিটার নিচে ছোট মার্বেলের মতো একটা গর্ত আছে, ঠিক এরকম রেনুকার থুতনিতেও ছিলো। বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে কোন ধারণা না নিয়েই যে ভুল মেয়েটা করেছে, জীবনের এই তিক্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সুযোগ পেলে অনেক দূর যেতে পারবে সে। মেয়েটার দিকে তাকালেই তার মেয়ের মুখটাই বারবার ভেসে উঠছে। রেনুকাতো কি একটা অজানা অভিমানে পাড়ি জমিয়েছে পরপারে, এই  রেনুকাকে সে কিছুতেই কোথাও যেতে দিবেনা। শালিসের সবাই যখন একটা গুরুতর শাস্তির রায়ের অপেক্ষায় তখন সবাইকে চমকে দিয়ে নাজিমুদ্দিন বলে “হাসমত মিয়া, আইজ থ্যাইকা আমি তোমার মাইয়ার দ্বায়িত্ব নিলাম। আর আপনাগো সকলরে কই, এই মাইয়ারে আমি গ্রামে রাখুম না শহরে হোস্টেলে রেখে পড়ামু। এই মাইয়ার প্রভাব আপনাগো বৌ পোলাপানের উপর পড়ব না কথা দিলাম।”

কথা গুলা একদমে শেষ করে সম্মতির জন্যে হাসমতের দিকে তাকালে হাসমতের চোখে মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি দেখতে পায়। আর শালিস ঘরে একটা অস্পষ্ট চাপা গুন্জন ওঠে।

আকাশটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে গেছে, বৃষ্টি না কমলেও সূর্যের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। মেঘের আঁধার কাটিয়ে সূর্যের আলোতে চারদিক ঝলমল করে ওঠে। মানুষের মনের সাথে প্রকৃতির কি মিল! বৃষ্টি ও রোদের খেলার ভিতর দেখা যায় নাজিমুদ্দিন একটা মেয়ের হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা কদম ফুল তুলে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে মেয়েটার নাম জানতে চাইলে মেয়েটা ফুলটা হাতে নিয়ে  বলে “কদম, কদম আমার নাম, বাপজানে কদম ফুল কইয়া ডাকত।”

নাজিমুদ্দিনের মুখের হাসিটা এবার আর এক প্রস্থ বেড়ে যায়, ভাবে, অনেক বছর পর কুলসুমরে আবার কদম ফুল দিয়ে চমকে দিবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন