মুহাম্মদ বেলাল।। গল্প।। আজগর মেম্বার

2

 আর্টওয়ার্ক: দিদারুল লিমন।

১৯৯৩ সালের দিকের কথা। আজগর মিয়া নামে এক রিকশাঅলা তখন পরিবারের ক্ষুধার প্রয়োজন মেটাতে চট্টগ্রামে থাকত। এছাড়াও যদি রিকশার বাজার ভাল না থাকতো তবে অন্য যেকোনো কায়িক শ্রমের কাজই করতো। তার পরিবার থাকত গ্রামে। দক্ষিণ বঙ্গের পিরোজপুরে। সেখানে তার বিবি করিমন বেগম তিন সন্তান নিয়ে স্বামীর কষ্টে রোজগারের সামান্য টাকায় কোনমতে দিনাতিপাত করতো। যখন যা রিজিক জুটতো তাই খেয়ে চলত নিত্যদিন। 

আজগর মিয়ার তিন সন্তানের মধ্যে বড়টি ছিল ছেলে; পড়ত ক্লাস সেভেনে। আর বাকী দুজন মেয়ের একজন পড়তো ক্লাস থ্রি-তে বাড়ির পাশে প্রাইমারি স্কুলে। অন্য মেয়েটির বয়স তখন সবেমাত্র তিন বছর। 

আজগর মিয়া মেসে থাকত। তার সাথে থাকত তার অঞ্চলেরই গোটা কতক মর্দ। এদের মধ্যে আজগর মিয়াই ছিল কিছুটা মুরুব্বি সমেত। তবে, রসিকতার সম্পর্কও ছিল তাদের মধ্যে। সে কাজ থেকে ফিরলে কেউ কেউ মশকরা করে বলত- ‘ও আজগর ভাই, বাড়িতে যাইবা কবে?’ সেও রসিকতায় কম ছিল না। বলত, ‘যেন্না যামু হেন্না তো ঘুমাইতে পারবা না, এমনেই দেখতে পারবা।’ কারণ, সে যেদিন বাড়িতে যেত তার আগের রাতে তার চোখে ঘুম আসত না। ঘুম না আসাটা অন্যায় কিছু তো না। কিন্তু তার একটা বদ অভ্যাস ছিল। বাড়িতে যাওয়ার আগের রাতে বাতি জ্বালিয়ে বসে থাকত আজগর মিয়া। কারণ, তার মনে একটা  ভয় কাজ করত। ভাবতো, যদি ঘুমের প্রকোপে গাড়ি ধরতে না পারে! সেজন্য সবকিছু গুছিয়ে রাখত। আর, ভোর হওয়ার সাথে সাথেই চলে যেত স্টেশনে। এদিকে তার এই কীর্তির ফলে অন্যদের চোখের আর চেহারার বেহাল দশা হয়ে থাকত। কেউ কেউ পরদিন কাজেই যেতে পারত না। অথবা কেউ কেউ কর্মস্থলে পৌঁছাতে কালবিলম্ব করে ফেলত।

আজগর মিয়া ছিল বেশ সন্তান বাৎসল্য। তারা মেসের সবাই এক বাসায় গিয়ে খেয়ে আসতো। তাদেরকে খোরাকির বিনিময়ে রান্না করে খাওয়াতো আবুলের বউ মিনারা। মিনারার রান্নার হাত ভাল ছিল। আর প্রতিদিন দুপুর কিংবা রাতে মাছ অথবা মুরগির মাংস রাখার চেষ্টা করত মেন্যুতে। শুক্রবার বাজারের ফর্দে গরুর গোশতের নাম আগেই উঠে থাকত। সবাই তো মিনারার রান্না আর খাবারের মেন্যুর প্রশংসায় একাকার। তবে, ঘটনা একটু ভিন্ন। যেদিন ভাল খাবার থাকত সেদিন আজগর মিয়া খেতে গররাজি থাকত। সে শুধু ডাল আর কোন ভাজি থাকলে তা দিয়েই খেয়ে শেষ করত। না খেতে চাওয়ার কারণ খুঁজলে বলত- ‘আমার পোলা-মাইয়া বাড়িতে বইসা নুন-লঙ্কা দিয়া খায় আর আমি বাপ হইয়া মাছ-গোশত ক্যামনে গলায় চালান করি?’ মিনারাকে বলত- চিন্তা কইরো না, তোমার খোরাকির ট্যাকা সম্পূর্ণই পাইবা।’ 

এভাবে আজগর মিয়ার বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। এখন সে বাড়িতেই থাকে। গতর খেটে কিছু পয়সা-কড়ি যোগাড় করেছে। জমি-জিরাত আর নগদ পুঁজি পাতি মিলিয়ে আজগর মিয়া এখন গাঁয়ের দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের কাতারে নেই। একজন স্বচ্ছল মানুষের তালিকায় তার নাম উন্নীত করলে বাড়াবাড়ি হবে না। বড় মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন করেছে স্বচ্ছল ঘরে। ছেলের বাড়ির গৌরব আশপাশে দশ গাঁয়ে কম নয়। তাছাড়া, আজগর মিয়া বংশের গৌরবের দিকে বোকার মতো নজর না করে মেয়ের জামাইয়ের কর্ম ভাল দেখেই সোপর্দ করেছে মেয়েকে। বড় ছেলেটা শহরের এক মেয়েকে বিয়ে করে বেশ ভালোই দিন কাটাচ্ছে। বাবা-মায়ের খোঁজ খবর নিতে সময়ের বড্ড সংকীর্ণতা তার। তবে, আজগর মিয়ার আফসোস তেমন নেই। সেও ছোট মেয়ে আর করিমন বিবিকে নিয়ে বয়ে চলেছে ধীরগতিতে কিন্তু প্রবহমান সময়ের সাথে শক্ত বোঝাপড়া করে।

হঠাৎ একদিন করিমন বেগম কোনপ্রকার পূর্ব সংকেত না দিয়েই এক ভোরে দেহ ত্যাগ করেন। এই সময় আজগর মিয়া তার ছেলে আবু সালেহকে দেখতে পান। কিন্তু করিমন বেগম ছেলের মুখদর্শন মৃত্যুর আগে কবে করেছেন তার হদিস হয়তো বেঁচে থাকলে করতে পারতেন না। অবশ্য তিনি বড় মেয়ে রেশমা আর ছোট মেয়ে ময়নাকে দেখে মরতে পেরেছেন। 

আবু সালেহ ঢাকা চলে যায় দুদিন বাদেই। বড় মেয়ে বেড়াতে এসে মায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে কয়েকবার মুর্ছা যায়। সপ্তাখানেক থেকে পরে চলে যায় স্বামীর বাড়ি। আজগর মিয়া কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায়। ছোট মেয়ে ময়নাকে বিয়ে দিয়ে সে যে একেবারে একা হয়ে যাবে এই ভেবে। 

করিমন বিবির ইন্তেকালের মাস তিনেক পরেই দু-চারজনের পীড়াপীড়িতে আজগর মিয়া আবার বিয়ে করলেন। কনের নাম চাঁদনী। সে অবশ্য এত বয়োবৃদ্ধা কনের এত যুবতী সমেত নাম আশা করেনি। তবে, নতুন বউ দেখতে কিছুটা সুন্দরীও ছিল এবং পাশাপাশি আচার-ব্যবহারও ছিল যথেষ্ট মার্জিত। 

এর কয়েক বছর পর মেয়ে ময়নাকে বিয়ে দিল আজগর। এদিকে আজগর মিয়ার দ্বিতীয় বিবির ঘরে দুইটি ছেলে হয়। আলাল আর দুলাল রাখা হয় তাদের নাম।

আজগর মিয়ার দিন সুখেই কাটছিল। আরও কিছু অর্থ বিত্তের বৃদ্ধি ঘটল। ছোট থেকে পুষে রাখা একটা আশা এখন পূরণের বুঝি সময় হলো। আজগর মিয়ার অনেক বছরের একটা শখ ছিল গাঁয়ের মেম্বার হবেন। আজন্মকাল মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন এই স্বপ্ন। কিন্তু কারো কাছে মুখ ফুটে বলতে পারেননি পাছে অলীক স্বপ্ন বলে ঠাট্টা করে বসে কেউ।

সিদ্ধান্ত মাফিক কাজ শুরু করে দিল আজগর মিয়া। অনেক কষ্টে নমিনেশন পেল। বেশ প্রচার প্রচারণা চালানো হল। অর্থ ব্যয়ও করল যখন যা প্রয়োজন। দিনশেষে ফলাফল আসলো নান্নু মির্জার পক্ষে। নান্নু মির্জা ছিল আজগর মিয়ার দোকানের নিকটতম মির্জা বাড়ির ছেলে। আজগর মিয়ার মন খারাপ কিন্তু দমে গেলেন না। এর পরবর্তী নির্বাচনে আবার চেষ্টা করলেন সেবারও ফলাফল ব্যর্থতার। 

দুইবার মেম্বার নির্বাচন করে আজগর মিয়া নিঃস্ব প্রায়। এখন সামান্য জমিজমা আর দোকানটা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না তার।

আজগর মিয়া দিনকে দিন ভাবে কী করা যায়। হঠাৎ তার বিবি এসে বলল, ‘এত সাত-পাঁচ না ভেবে আবার নির্বাচন করেন এবার আমার বিশ্বাস আপনি জিতবেন।’ এই শুনে পুনরায় নির্বাচনের সময় আসলে অন্যান্য প্রার্থীদের সাথে আজগর মিয়ারও টাকা দাখিল সম্পন্ন হয়। মার্কাও আগেরটাই পেল- ঘুড়ি মার্কা। এবার আরও ভালভাবে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা চালায়। নির্বাচনের দিনটি যতই নিকটবর্তী হতে থাকে আজগর মিয়ার দুশ্চিন্তা ততই বাড়তে থাকে। অন্যান্যের মতো প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার বাড়িতে সমাবেশ হয়। 

শেষ সমাবেশে ঘটল এক কাণ্ড। আজগর মিয়া তার সমাপনী বক্তব্য শেষ করে এলাকাবাসীর কাছে ভোট চায়, মার্কাটা আবারও সবার মগজে ঢুকিয়ে দেয়-ঘুড়ি মার্কা। এবং সবশেষে উপস্থিত সকলকে দেখিয়ে তার পায়ের কাছে চেয়ারের নিচ থেকে বের করে এক থান কাফনের কাপড় আর একটা বিষের বোতল। 

আজগর মিয়া বলল, ‘আমি যদি এইবার মেম্বার না-ই হইতে পারি, তাইলে এই বিষ খাইয়া জীবন দিমু।’ এই বলে সকলকে দেখিয়ে ঘরের পিড়ায় কাফনের কাপড় আর বিষের বোতল রাখে এবং সভার সমাপ্তি ঘটে। লোকজন যার যার বাড়ি ফেরার পথে এই ব্যাপারে আলোচনা করতে লাগলো। কারো কারো খুব মায়া লাগল। কাউকে বলতে শোনা গেল, ‘ইশ! আল্লাহই জানেন কী না কী কইরা বসে। উনার তো আবার রাগ বেশি।’ কেউ কেউ বলে, আজগর মিয়ার মুখে সাদা দাড়িগুলান দেখলেই তো মায়া লাগে।’ আবার কোনো কোনো পক্ষ ব্যাপারটাকে হাস্যকর ভাবেই নিল। এবং বেশ তিরস্কার জানালো এমন মেম্বারি শখের। 

পরদিন সারা এলাকায় ছোট বড় সকলের মুখেই ঘটনাটা থই পেয়ে গেল। ছড়িয়ে পড়লো অন্য গাঁয়েও। অন্য গাঁয়ের মানুষের মনে মায়াই লাগল। কেউ কটুক্তি করল না।

নির্বাচনের দিন আজগর মিয়ার চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অনেকেই তার দিকে সহানুভূতির চোখে তাকিয়ে দেখে আর ভাবে লোকটা গরীব কিন্তু কী আশ্চর্য আকাঙ্ক্ষা তার  -একবার শুধু মেম্বার হবে। 

সারাদিন বাদে ফলাফল আসলো। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে। সবাই উৎসুক ভঙ্গিতে কান খাঁড়া করে রেখেছে কী ঘোষণা আসে শোনার জন্য। কেউ কেউ আগেই আল্লাহ আল্লাহ করছে যেন ঘুড়ি মার্কাই হয়। লোকটার একটা শখ অন্তত পূরণ হোক। এরপর সত্যিই অনেকে নিজেদের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিল না। তারা আশপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়। ২ নং ওয়ার্ডের মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন আজগর মিয়া। অর্থাৎ ঘুড়ি মার্কা বিজয়ী। সংবাদটা শুনে আজগর মিয়া যারপরনাই খুশি হয় যা বলার ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে না। লোকজন বলাবলি করতে লাগলো, ‘আজগর মিয়ার হায়াৎ আছে। নইলে যেই ঝুঁকি নিছিলো এইবার। সব জমিজমা বন্ধক রাইখা টাকা যোগাড় করছে। মেম্বার না হইলে উনিও মরতো আর পোলাপান গুলিরেও রাস্তায় নামা লাগত। কিছুই করার থাকত না। 

কিন্তু নিয়তি কী নির্মম! আজগর মিয়া মেম্বার হয়েছে সবেমাত্র নয় মাস। এর মধ্যেই মৃত্যুর ফেরেশতা তার দরজায় অদৃশ্যমান অবয়বে পৃথিবী ত্যাগের পরোয়ানা নিয়ে হাজির। পুরোদস্তুর অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিঃশব্দে নিভে গেল একজন আজগর মেম্বারের জীবন প্রদীপ। 

সবেমাত্র ফলের গুটি ধরা একটি বৃক্ষের গল্পের ইতি নামলো। কিন্তু  সত্যিকারের বৃক্ষের মতো এর পাতাগুলোও কি নেতিয়ে পড়বে, এর ডালপালাগুলো কি শুকিয়ে মড়মড়ে হয়ে ভেঙে পড়বে? হয়তো বা! কে-ই বা রাখে এসব বৃক্ষের হারিয়ে যাওয়ার নিঃসঙ্গ ভারাতুর স্মৃতি।

লেখক: গল্পকার, শিক্ষার্থী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

2 মন্তব্যগুলো

  1. জীবনকে ঘিরে মানুষের কত স্বপ্ন কত পরিকল্পনা। অথচ মৃত্যু কারো জন্য থেমে থাকেনা। যথাসময়ে উপস্থিত হয়। সুন্দর গল্প।

  2. অনেক অনেক ধন্যবাদ, বন্ধু। মূল্যবান মতামতের জন্য। ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমার হাতেখড়ির সময়ে যার উৎসাহ অনুপ্রেরণায় আজ এমন একটি প্ল্যাটফর্মে আমার লেখা এসেছে সে-ই হলে তুমি।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন