প্রবন্ধ: শেখ আব্দুল জলিলের প্রবন্ধ সাহিত্য ‘বাঙালি জাতীয়তা’: আবু সাইদ কামাল

1

অলংকরণ:ফারিনা আহমেদ

প্রবন্ধ বলতে সুসংবদ্ধ, অপেক্ষাকৃত গম্ভীরভাবে অনুশীলিত গদ্যরীতির সহায়তায় অভিব্যক্ত মনননিষ্ঠ রচনাকেই বোঝায়। কবিতা আদি মানুষের, গল্প সভ্য মানুষের আর প্রবন্ধ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন চিৎপ্রকর্ষবাদীর- এটা এমন মস্তিষ্ক ও বুদ্ধির উৎকর্ষের শৈল্পিক চর্চা, আবেগ, উচ্ছ্বাস ও কল্পনার দূরায়ণ বাসনার ডানা এখানে স্তব্ধ। এখানে যুক্তি, তর্ক ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভাব ও চিন্তাকে  সুশৃঙ্খল সূত্রে আবদ্ধ করে পরিমিত বাক ও সংযমিত আধারে বক্তব্যকে শিল্পরূপ দিতে হয়। তথ্য এখানে তত্ত্বে ঘনীভূত হয়।

বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা প্রবন্ধসাহিত্য যুক্তি-তর্ক ও বিচার-বিশ্লেষণের সার্থকতায়, ভাষার তীক্ষ্মতায় শাণিত ও ক্ষুরধার হয়ে উঠেছেঅত:পর বঙ্কিমের হাতে প্রবন্ধ সুষ্ঠু ও সার্থক পরিণতি লাভ করেছে

বাংলাদেশের প্রবন্ধসাহিত্য বিষয়বৈচিত্রে সমৃদ্ধ। জাতীয়জীবনের চিন্তাভাবনা, কামনাবাসনা রূপায়িত হয়েছে প্রবন্ধের মাধ্যমে। সাহিত্যের বিভিন্ন দিক, সংস্কৃতি, জীবনী, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়াবলম্বনে প্রবন্ধসাহিত্যের সম্প্রসারণ ঘটে। দেশবিভাগের পর থেকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষিতে শিক্ষা সংস্কৃতির নানামুখী বিকাশ ঘটেছে। ফলে সাহিত্যের পরিধি যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীন জীবনের প্রেক্ষিতে নানা বিষয় হয়েছে প্রবন্ধের উপজীব্য।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হলেও মৌলিক প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে আশানুরূপ বিকাশ ঘটেনি। আমাদের দেশের বিগত তিন যুগের প্রাবন্ধিক চিন্তার বৃহত্তর অংশকে সমাজ দর্শনের অন্তর্ভূক্ত দেখা যায়। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম এ তিনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলছে এ কালে। যাঁরা সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছেন তাঁরাই উৎকৃষ্ট ও অগ্রসর চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছেন। এঁদের অনেকের মাঝে প্রাবন্ধিক শেখ আব্দুল জলিলের নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মুক্ত চিন্তার অন্যতম দিশারি শেখ আবদুল জলিলের জন্ম ১১ মার্চ, ১৯৪১ খ্রি: জামালপুর জেলার অন্তর্গত ইসলামপুর উপজেলার নটারকান্দা গ্রামে। ১৯৭৫ এর ফেব্রুয়ারিতে কে বি হাই স্কুল, মযমনসিংহে সহকারি শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত হন। সে সময় থেকেই ময়মনসিংহে তাঁর অবস্থান। গত ২০মে, ২০১৬ তারিখে ময়মনসিংহ শহরের  ভাটিকাশরের নিজ বাসভবনে তিনি পরলোক গমন করেন।

মতাদর্শগত দিক থেকে যদিও তিনি ছিলেন বাম ঘেঁষা, তবে কমিউিনিস্ট রাজনীতি করতেন না। তিনি ছিলেন ন্যাপ(মোজাফফর) এর একজন বলিষ্ঠ নেতা। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বা এতদসংক্রান্ত বুদ্ধবৃত্তিক অবস্থান এতটাই উচ্চতায় ছিল যে, মফস্বল শহরে অবস্থান করলেও তাঁকে সেই দলের থিঙ্ক ট্যাংক বলা হতো। সে জন্যই বোধ হয় তাঁর সেই বুদ্ধবৃত্তিক চিন্তার স্ফুরণ ঘটেছে তাঁর এসব প্রবন্ধে, প্রবন্ধ গ্রন্থ সমূহে।

তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যের গ্রন্থসমূহ: (১) স্বদেশ আমার স্বজন আমার (প্রবন্ধ গ্রন্থ), ১৯৮০; (২) শিক্ষা ও শিক্ষার্থী (প্রবন্ধ গ্রন্থ), ১৯৯৬; (৩) একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ও বামপ্রগতিশীল শক্তি (প্রবন্ধ গ্রন্থ), ২০০০; (৪) বাংলাদেশের জীবন ও জীবিকা (গবেষণা গ্রন্থ), ২০০৩; (৫) জাতীয়তায় ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার (গবেষণাগ্রন্থ), ২০০৮; (৬) একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা (প্রবন্ধ গ্রন্থ), ২০১৩।

উপরের গ্রন্থসমূহ থেকে জাতীয়তায় ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার নামের গবেষণাগ্রন্থটি মনোনীত করে আলোচনা এগিয়ে নেয়া যায়। ১২০ পৃষ্ঠার ছোট কলেবরের বইটিতে ১২টি রচনা সূচিবদ্ধ হয়েছে। দেশ ও জাতির শেকড়সন্ধানে এই রচনাসমূহ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণাধর্মী রচনাসমূহ যথাক্রমে: ১. বাঙালি জাতীয়তা; ২. পলাশীর ও বাংলার স্বাধীনতা; ৩. সার্বভৌম অখণ্ড-বাংলাদেশ ও লাহোর প্রস্তাবের অলীক স্বপ্ন; ৪. ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বিবরণ;. ইংরেজি শিক্ষায় বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান; ৬. যুগান্তরের ঘূর্ণাবর্তে বাংলা-ভারত; ৭. বঙ্গ-ভঙ্গ: আগে ও পরে; ৮. দ্বিজাতি তত্ত্ব, বাংলাভাগ ও বাঙালির নেতৃত্বসংকট; ৯. একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য; ১০. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ: প্রেক্ষিত ও প্রাপ্তি; ১১. শহীদ বুদ্ধিজীবিদের উত্তরাধিকার; ১২. মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব: দ্বান্দ্বিকতা ও ছন্দোময়তা।

এ গ্রন্থপাঠে পাঠক-সমালোচকগণ শেখ আব্দুল জলিলের সৃজন ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন।

দুই

এই নিবন্ধে ‘বাঙালি জাতীয়তা’ শিরোনামের রচনাটির উপর আলোকপাত করা হলো:

বাংলাদেশের জাতীয়তা নিয়ে একটি বিতর্ক সম্পর্কে কম বেশি সবাই অবহিত। শেখ আব্দুল জলিলের সাহসী কলমে উঠে এসেছে জাতীয় জীবনের নানাবিধ সমস্যা এবং তার সমাধানের ক্ষেত্রে অন্তরায়ের বিষয়সমূহ। ‘বাঙালি জাতীয়তা’ শিরোনামের রচনার শুরুতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আধুনিক জাতি ও রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জাতীয়তা। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিরূপে গৃহিত জাতীয়তাবাদ থেকেই রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত নাগরিকতার প্রশ্নটি মীমাংসিত ও নির্ধারিত’।

জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে দেশী-বিদেশী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নানা রকম সংজ্ঞা রয়েছে। তাদের প্রায় সবাই অভিন্ন মত পোষণ করে বলেন, জাতীয়তাবাদ হলো একটি চেতনা বা মানসিক অবস্থার মানবগোষ্ঠী।  দৃঢ়তম প্রবৃত্তিই হলো এর উৎস। নিজেদের মাঝে ঐক্যবোধ এবং বিশ্বের অন্যান্য মানবগোষ্ঠী বা সম্প্রদায় থেকে পার্থক্যবোধই জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য।

তাঁর মতে, কোনো সমাজে জাতীয় ঐক্যবোধ, জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হতে পারে মৌলিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যেমন মাটির গন্ধমাখা কৃষক, শ্রমিক ও পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর শিল্প, সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, আশা-বিশ্বাস, সহজাত রুচি ও প্রবৃত্তির মাধ্যমে। এটি প্রাকৃতিক, স্বেচ্ছাধীন এবং ঐতিহাসিক। বিগত হাজার বছরের মাটির মানুষ বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বভাবসঞ্জাত আশা-বিশ্বাস-সংস্কৃতি-সভ্যতার নির্যাসের দ্বারা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় তিলে তিলে গঠিত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

অপরদিকে শাসকগোষ্ঠীর জবরদস্তিমূলক আরোপনের প্রক্রিয়াও রয়েছে। ১৯৭৫ সালে আগষ্ট এবং নভেম্বরের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়া সেনা ও আমলা শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থানুকূলে সাংবিধানিক পরিবর্তনের দ্বারা আরোপিত হয়েছে জবরদস্তিমূলক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এ দুইয়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বাংলাদেশের মানুষ চেতনাগত দিকে থেকে হয়েছে বিভক্ত।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে জড়িয়ে আছে রক্তধারা, জনসংমিশ্রণ তথা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়। বাঙালি জাতিসত্তা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমউৎসজাত বিধায় এটি কোনোকিছুর সঙ্গেই বিনিময়যোগ্য বা পরিবর্তনশীল নয়। বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও জাতীয় আত্মপরিচয়ের এটাই সারকথা। এ ক্ষেত্রে লেখক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লার প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি তুলে ধরেন এ গ্রন্থের লেখক। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লা বলেন, আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি দাড়িতে ঢাকবার জো পর্যন্ত নেই।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশবাসী জাতিগত সত্তা হিসাবে বাঙালি বলে চিহ্নিত হয় এবং এর দেশগত সত্তা হিসেবে স্বাধীনতার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক লে: জে: জিয়াউর রহমান বর্হিবিশ্বের বিশেষত জার্মান, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড পোল্যান্ড, মিশর ও সৌদি আরবের নানা উদাহরণ টেনে বলেন ‘…একারণেই আওয়ামীলীগাররা বাঙালি জাতীয়বাদের স্বপ্নে এখনো বিভোর রয়েছে। আবার মুসলিম লীগ, আইডিএল এবং জামাতীরা বলে ধর্মভিত্তিক জাতীয়বাদের কথা।

ব্যাখ্যামূলক বক্তব্যে তদানিন্তন সমারিক শাসক জিয়া বলেন, ‘… বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হলো সঠিক জাতীয়তাবাদ। আমাদের আছে জাতিগত গৌরব, রয়েছে সমৃদ্ধিশালী ভাষা এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য। ভৌগোলিক অবস্থান হিসেবে আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয়, তেমনি আবার ধর্মবিমুখও নয়।…’

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সমর্থনে রাজনীতিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার খন্দকার আবদুল হামিদের উদ্বৃতি টানা হয়। খন্দকার আবদুল হামিদ উল্লেখ করেন, আমাদের জাতীয়তাকে  বাংলাদেশী জাতীয়তা’ বলাই ‘এপ্রোপ্রিয়েট’ বা সঙ্গত। এর সমর্থনে তাঁর নিজস্ব ব্যাখা প্রদান করা হয়েছে।

একই সুরে সুর মিলিয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। তিনি ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, আধুনিককালে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রসত্তা লাভ করার পরে ভূখণ্ডগত রাষ্ট্রিয় জাতীয়তাই প্রধান ও পূর্ণাঙ্গ। সেই অর্থে বাংলাদেশী জাতীয়তা আমাদের রাষ্ট্রসত্তার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, জাতি সত্তাগত পরিচয়টি এখানে গৌণ হয়ে পড়েছে।…বর্তমানে পৃথিবীতে আমরা বাংলাদেশী এবং এটাই আমাদের অনিবার্য এবং একান্ত পরিচয়(পৃঃ ১২-১৩)।

জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মতামত তুলে ধরা হয়। তার মতে, … ধর্ম এক হলেও সকল মুসলিমের সাংস্কৃতিক ‘চেতনার ঐক্য’ এক জাতীয়তা হয়নি। তেমনি একই ভাষার দওলতে কোনো মানুষ এক জাতির হতে পারেনা। উভয় বঙ্গে এক ভাষা হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে নৃতত্ত্ব ও ঐতিহ্যগত প্রভেদ। এজন্যে একই মানবগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়া সম্ভবপর নয়। এ জন্যে বাংলাদেশী জাতীয়বাদের মতবাদের স্বীকৃতি এদেশীয় জনসমাজে হবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস (পৃঃ ১৩)।

তিন

শেখ আব্দুল জলিল ক্ষমতার রাজনীতির ধারেকাছে যাননি কোনদিন। ছিল না নিজ মতাদর্শের প্রতি অন্ধ আনুগত্যও। তাই তার মেধা, মনীষা, ব্যাপক পড়াশোনা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দ্বারা নিরপেক্ষ ও সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেছেন বিবেচ্য বিষয়ে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশী ইত্যাদি নামপদ নিরেট ভূখণ্ডগত, লোকায়ত এবং ইহাজাগতিক। এগুলো পরস্পর সংশ্লিষ্ট এবং নির্বিরোধ। মাতৃভাষা আমাদের বাংলা তাই আমরা জাতিতে বাঙালি। বাংলাদেশ নামক আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আমরা বাংলাদেশী।’

ধর্ম এবং ধর্মীয় ঐক্য, সমরাজনীতি এবং অর্থনীতি দ্বারা যে এক জাতি, এক রাষ্ট্র হতে পারেনা, তা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী লেখক অধ্যাপকেরা স্বীকার করেছেন, কেবল ধর্মীয় ঐক্য দ্বারা পাকিস্তান টিকে থাকতে পারেনি, ভৌগোলিক সংলগ্নতা না থাকার কারণটা প্রকট হয়ে উঠেছিল।

দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতিতে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এক্ষেত্রে তিনি বলেন যে, বাঙালি জাতীয়তা কোন সূত্রে হয়েছিল তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি চেতনাবিরোধী লেখক বুদ্ধিজীবীরা না বুঝলেও বাঙালি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে কারো উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয়নি।

স্বাধিকার ও স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন এবং পরিণামে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে ৬ দফা, ১১ দফা এবং চূড়ান্তস্তরে এক দফার আন্দোলনে। বাঙালি জনগণের কণ্ঠে তখন শ্লোগান ছিল ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের স্বীকৃতি লাভের পর বাঙালি জাতিসত্তাভিত্তিক জাতীয়তা যখন সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে, তখন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

এক্ষেত্রে লেখক উল্লেখ করেন, তারাই প্রথম বাঙালি জাতীয়তা এবং স্বাধীন পূর্ববাংলা ভূখণ্ডের নাম ‘বাংলাদেশ’ গ্রহণে আপত্তি ও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, সন্তোষ কুমার ঘোষ, বুসনাথ চ্যাটার্জী প্রমুখের লেখায় ও সংলাপে তার পরিচয় মেলে।…(পৃঃ ১৫-১৬)।

পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বাংলা, সংস্কৃতি বাঙালি হলেও ভূগোল, ইতিহাস যেমন পৃথক, ধর্ম-কর্ম-রাজনীতি-অর্থনীতির ভিত্তিও পৃথক। রাষ্ট্রিক পরিচয়ে তারা ভারতীয়, বহির্বিশ্বে বাংলাভাষী প্রাদেশিক পরিচয় দিলেও জাতীয়তা ও নাগরিকতায় নিরেট ভারতীয়। গোটা বিশ্বে বাঙালি জাতি বলতে বাংলাদেশের নাগরিকদেরই বোঝায়। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গন্ধুর নেতৃত্ব বাংলাদেশকে স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতা দান করে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার আগে বাংলাভাষা এবং বাঙালির রাষ্ট্রিয় ও জাতীয় মর্যাদা কখনো ছিলনা। কারণ চর্যাপদের কালে বাংলা ও বাঙালি ছিল ঘৃণিত ও উপেক্ষিত। ব্রাহ্মবাদীর আমলেও বাংলাভাষা ছিল পক্ষির ভাষা। মুসলিম শাসনামলে বাংলাভাষা ছিল নিকৃষ্টজনের ভাষা। বাংলার শেষ নবাব সিরাউদ্দৌলার বাহিনীতে বাংলাভাষী কোনো সেনাপতি ছিলনা। নবাব সিরাজ, মীরজাফর, জগৎশেঠ, উর্মিচাঁদ, মোহনলাল, মোস্তফা খান সবাই ছিলেন বিদেশী ও বিভাষী।

৭৫ এ পট পরিবর্তনের পর সেনা সমর্থিত শাসন পদ্ধতি দ্বারা শুধু সংবিধান সংশোধনীই আনা হয়নি, জাতীয়তা, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক চেতনা সম্পূর্ণ পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। বহির্বিশ্বের প্রভুদের তুষ্ট করতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে প্রথমে বিতর্ক সৃষ্টি এবং পরে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি জয়বাংলা, বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি নামশব্দ মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। সেনা শাসক এবং তাদের অনুগ্রহপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা ভেবেছিলেন, এতেই বুঝি বাংলা এবং বাঙালির চিরদিনের পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ইসলামী সম্মেলনে যোগদান করেন। সে সময়ে সৌদি বাদশার সাথে দেখা করলে বঙ্গবন্ধুকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নাম ইসলামী প্রজাতন্ত্র করা হলে সাহায্য-সহযোগিতার কোনো অভাব হবেনা। লিবিয়িার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফিও অনুরূপ পরামর্শ দেন। সৌদি আরব ও লিবিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধী এবং বঙ্গন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। ৭৫ পট পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী মোসতাক মুসলমানি জাতীয়তার প্রতীক টুপি পরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী মেজরচক্রের অব্যাহত চাপের মুখে মোসতাক বা জিয়া ইসলামী প্রজতন্ত্র ঘোষণা না করলেও সংবিধান পরিবর্তন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশী করা হয়। ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যার পর জেনারেল মঞ্জুরকে দিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ক্যু ব্যর্থ হওয়ায় সেই ঘোষণা টেকেনি। এরপর সেনা শাসন আমলে আবারও সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়।

চার

১৯৭২ এর সংবিধানে নাগরিকত্বকে বাঙালি বলা হয়েছে, আবার জাতীয়তাবাদকেও বাঙালি বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ‘বাংলাদেশী’ শব্দটি ১৯৭৯ সালে সংবিধানে এসেছে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে। এ প্রেক্ষিতে শেখ আব্দুল জলিল আহমেদ মুসার স্মারকগ্রন্থ থেকে উদ্বৃতি তুলে ধরেন। তাতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ইতিহাসের রায়। একটি শিশু জন্ম নেয়ার পর তার আকিকার পূর্ব পর্যন্ত তাকে অনেক নামেই ডাকা হয় কিন্তু আকিকা হয় একটি নামেই। বাংলদেশী হচ্ছে আকিকাসিদ্ধ পরিচয়।’ কিন্তু সে যুক্তি খণ্ডন করে শেখ আব্দুল জলিল বলেন যে, আকিকাসিদ্ধ জাতীয় পরিচয় হলে সেক্ষেত্রে শিশুরাষ্ট্রের পিতা-মাতার প্রসঙ্গ আসে। তাহলে পিতা কে? জবাব হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। মাতা বলতে তো দেশজননীকেই বোঝায়।

পক্ষান্তরে বাঙালির স্বভাবসিদ্ধ উদারতা, মানবতা ও গণতান্ত্রিকতার সুযোগ নিয়ে বরং বাংলদেশী হত্যাকামীরা বলদর্পী মতবাদ ও জাতীয়তার প্রকট বিভাজন সৃষ্টি করে গোটা জাতির কাছে চিহ্নিত হয়ে আছে। শেখ আব্দুল জলিল বলেন যে, এসবের জন্য অনেকে জে: জিয়াউর রহমানকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সৈনিক। সেনা শৃঙ্খলা এবং সংকটজয় সৈনিক জীবনের প্রধান ব্রত। রাজনীতির শিক্ষা, দীক্ষা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা সবই তার আকস্মিক। এদেশের কোনো রাজনৈতিক সংগ্রাম, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, অহসযোগ আন্দোলন ইত্যাদির সঙ্গে জিয়ার নাম খুঁজে পাওয়া যাবেনা। ৭১ এ মেজর জিয়ার বিদ্রোহ ও মুক্তিযুদ্ধে যোগদানও আকস্মিকভাবে। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাও প্রচার করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামীলীগ সরকারের অধীনেই সেনাবাহিনীতে দায়িত্বপালন করেন তিনি। ৭৫ এর পনেরো আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে ‘এ গ্রেড জব’ বলে খুনি মেজর চক্রকে অভিনন্দন জানান। নভেম্বরে জেলহত্যাকান্ডসহ সহকর্মী সেনা অফিসারদের হত্যার পর রক্তগঙ্গায় স্নান করে তিনি স্টাফ প্রধান এবং চিফ মার্শাল ল এডমিনিসট্রেটর হন।

রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা দখল করে তিনি বুঝতে পারেন সামরিক শাসন দিয়ে সাময়িকভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়, কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে দীর্ঘসময় দেশ পরিচালনা করা যায়না। তাই প্রথমে তিনি আওয়ামীলীগের সহায়তা চেয়ে সরকারে তাদের অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু আওয়ামীলীগ তা প্রত্যাখান করায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, রাজনীতিবিদের জন্য আমি রাজনীতি কঠিন করে তুলবো এবং তাদের তা করতে দেবোনা। তাই তিনি তার রাজনৈতিক মঞ্চে বিপরীত মেরু থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা চেতনাবিরোধীদের আহ্বান জানান। তার ধারাবাহিকতায় তিনি পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আজমকে বাংলাদেশে আগমনের ভিসা দিলেন। এ সিদ্ধান্ত যে রাজনীতি বিজ্ঞান ও ইতিহাস সম্মত ছিলনা তা তিনি বুঝতে পারেননি। তিনি বুঝতে পারেননি কী বিপদ ও কতবড় সাংঘাতিক অপশক্তিকে তিনি ঠাঁই দিলেন। একদা মুজিবভক্ত, উদার, ক্ষমাশীল ও মহত্ত্বের বিশেষণে বিশেষিত জিয়া ক্ষমতা দখলের পর সংকীর্ণতা, শত্রুতা, ভয়ঙ্কর জিঘাংসা, ধ্বংস ও হত্যাকান্ডের রক্তসাগর সৃষ্টি করে। শাসকশক্তিকে ঘিরে চিরদিনই সুবিধাভোগী স্বার্থচক্র গড়ে উঠে। জিয়ার আমলেও একশ্রেণির ক্ষমতালোলুপ মানুষ উদ্যত নৃত্য শুরু করে। এমন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে জিয়া তার সাফল্যের মহাসড়কে আরোহন করেন। কিন্তু হায়, বিধি বাম। ১৯৮১ সালে দৈনিক সংবাদে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে বসে আছি।

সেসময়ে ২৯ মার্চ, ১৯৮১ দৈনিক ইত্তেফাকে কর্নেল নুরুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে লেখেন, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে কিছুতেই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া যাবেনা। এ প্রসঙ্গে শেখ আব্দুল জলিল এ গ্রন্থে লিখেছেন, সেদিন ন্যাপ নেতা মোজফফর আহমদ আমাকে বলেছিলেন, এরপর দেখেন বাংলাদেশে কে টিকে থাকে। গোলাম আজম যদি টিকে যান, তবে জিয়ার বেহেস্ত গমন অনিবার্য। আর জিয়া টিকলে গোলাম আযম ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে বলতে পাকিস্তান বা সৌদিতে চলে যাবেন। (পৃঃ ২৪)

 এর মাত্র ২ মাস ৯ দিন পর ৩০ মে, ১৯৮১ চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হলেন জিয়া। এখানে উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু যে বাড়িতে বসে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেই ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতেই তাঁকে হত্যা করা হয়। অপরদিকে জিয়াউর রহমান যে চট্টগ্রামে থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেছিলেন, তাঁকে ঠিক সেই চট্টগ্রামে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী শেখ আব্দুল জলিল উপরে বর্ণিত সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে আরো উল্লেখ করেন, ‘… জিয়াউর রহমানের গড়া ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ বা বিএনপিতে গণতন্ত্রের রঙ লাগলেও রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় ও কর্মসূচী পরিচালনায় সেই পাকিস্তানি প্রবণতাই ক্রিয়াশীল আছে।’(পৃঃ ২৪)

পাঁচ

একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, পঁচাত্তরের আগষ্ট-নভেম্বরের বর্বর হত্যাকান্ডের পরপরই সেনা নায়কের সাহস, বুদ্ধিদৃষ্টি বৃদ্ধি পেয়েছিল বলেই ৭১ এর চেতনাকে পাল্টে দেবার পাকিস্তানি যুক্তি, বুদ্ধি, বোধ-বিবেচনা গ্রহণ করার প্রয়োজন বোধ করা হয় এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সাংবধিানিক স্বীকৃতি লাভ করে।

অথচ ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর গণপরিষদে গৃহিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তা সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং গণপরিষদ সদস্য কর্নেল ওসমানী বলেন, আমাদের জাতীয় চেতনার সূচনা হয়েছে কতগুলো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। জাতীয়জীবনের রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় যত ঘনিষ্ঠ হয়েছে, এই চেতনা ততই পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।

১৯৫১ সালে কর্নেল ওসমানী পাঞ্জাব রেজিমেন্ট থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটেলিয়ান-অধিনায়ক হয়ে যোগদান করেন। তখন সৈন্যরা গর্বের সাথে বলাবলি করছিল, আমরা বাঙালি, বাঙালি এসেছে আমাদের অধিকনায়ক হয়ে।

কর্নেল ওসমানী উল্লেখ করেন, সেদিন তাদের সেই আনন্দোল্লাসের মধ্যে আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমি কে, কী আমার জাতীয়তা, আমি কাদের মধ্যে জন্মলাভ করেছি, কারা আমার আপনজন।

দর্জি আবদুল ওয়াহাবের মতে দেশ ও জাতির নাম বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন; ভূমির প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক বিশিষ্টতা অনুসারে দেশের নাম ও দেশের নামানুসারে জাতির পরিচয় হয়। যার দৃষ্টান্ত বঙ্গদেশ, বঙ্গাল/বাঙ্গাল, বাঙালি। তেমনি প্রকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে কিছু নাম হয়েছে, কিন্তু অধিবাসী সে নামে পরিচিত হয়নি। যেমন, হিমাচল, মেঘালয়, অরুণাচল। তেমনি নদ-নদীর নামে নামকরণ হয়েছে, যেমন: সিন্ধি, পাঞ্জাবী। পেশাজীবী হিসাবে হয়েছে, যেমন: পেশাজীবী জলদস্যু এঙ্গেল গোষ্ঠী থেকে হয়েছে ইংলিশ জাতি, যাদের বসবাস ইংল্যান্ডে। ধর্মসূত্র থেকে এসেছে ইসরায়েল। বৌদ্ধ বিহার থেকে এসেছে বিহারি। আবিষ্কারকের নামানুসারে হয়েছে আমেরিকা।

দর্জি আবদুল ওয়াহাব বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির উৎস খুঁজে পেয়েছেন নদীবঙ্ক বা নদীর বাঁক ও বঙ্ক থেকে উৎসারিত জীবনধারার বিচিত্র জটিল প্রবাহমানতার মাঝে।

আবুল মনসুর আহমেদের মতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলা রাষ্ট্রের নাগরিকরা জাতিত্বে ও নাগরিকত্বে বাঙালি। তিনি স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নিরপেক্ষ বাঙালি বলেই বিশ্বাস করতেন। তিনি আমৃত্যু জাতীয়তাবাদী বাঙালি এবং আওয়ামীলীগার ছিলেন। দলীয় নেতা হিসাবে তিনি এমপি, মন্ত্রী হয়েছিলেন। কারাবরণও করেছিলেন তিনি।  

আসলে বাঙালি জাতিসত্তা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্বের সূত্রে বাধা পড়ে এক হয়ে গেছে। এমন একত্ব ও সমত্ব ভূখণ্ডগত ভাষিক এবং ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতার জন্যই ঘটেছে, কারো একক নেতৃত্বে, আজ্ঞা বা নির্দেশে ঘটেনি।

কিন্তু ‘বাংলাদেশী’ শব্দটির আগমণ সম্পূর্ণ আকস্মিক। বাংলার আমজনতার মন-মানসিকতা, চিন্তাবুদ্ধি, স্বভাব-সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত নয়। পঁচাত্তরে পট পরিবর্তনের পর সেনা শাসকগোষ্ঠী, পাকিস্তানবাদী রাজনীতিক, আমলাদের দ্বারা গঠন লাভ করে বলদর্পী সংশোধন মারফত সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উৎস তাই বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ নয়। বরং উপযোগিতাবাদী শাসক-শোষক, সিভিল সমাজ ও আমলাতন্ত্রের স্বার্থানুকুলে একটা বিদেশী প্রেরণা ও ধারণা সঞ্জাত ব্যাপার

শেখ আব্দুল জলিল ‘বাঙালি জাতীয়তা’ শিরোনামের নিবন্ধের শেষে উল্লেখ করেন, বাঙালিকে অবশ্য বুঝতে হবে এবং বুঝতেই হবে যে মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত হয়নি। …। সংগ্রামের ইতিহাস এবং মুক্তির দুর্মর চেতনা বাঙালি জাতিকে নিশ্চয়ই আবারও পথ দেখাবে।

তাঁর সৃজনশীলতা, পাণ্ডিত্য, মৌলিকত্ব এবং নিখুঁত বিশ্লেষণ আলোচ্য প্রবন্ধটিকে অনন্য একটি উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছে। এখানেই একজন দক্ষ প্রাবন্ধিক হিসাবে শেখ আব্দুল জলিলের শক্তিমত্তার পরিচয়। বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যে তাঁর অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়। তার লেখার মধ্যেই আমরা পেতে পারি আমাদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কথাশিল্পী, ময়মনসিংহ।

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন