প্রবন্ধ : তারুণ্যের জবানবন্দি : নাহিদ হাসান

0

অলংকরণ:ফারিনা আহমেদ

এমবিএ’র একটি ক্লাসের ফাঁকে আমাদের একজন শিক্ষক একবার বলেছিলেন, ‘যদি কোনো শিক্ষক জরুরি কারণে একটি ক্লাস নিতে না পারেন তবে শিক্ষার্থীরা মিলে সেই শিক্ষকের গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছেড়ে দেয়। ঠিক ঐ শিক্ষকই যদি আবার নিয়মিত ক্লাস নেন, তখন ছাত্ররা প্রতিনিয়ত বিরক্তি আর অবসাদে ফুঁসতে থাকে। যখন ক্যাম্পাস টানা ছুটি থাকে তখন শিক্ষার্থীরা ছুটিকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের প্রতি নানান বাজে মন্তব্য করে চলে। আবার ছুটি শেষে ক্লাস শুরু হতে না হতেই ছাত্রদের বিষাদময় চেহারার দিকে যেন তাকানো যায়না। মনে হয় জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক সকল প্রত্যাশা জুড়ে কেবল একটা তীব্র বিষাদের ঢেউ থৈ থৈ করছে। আমার ছাত্ররা এটা চায়না ওটা চায়না, তাহলে তারা চায় কী?’

উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ শিক্ষালয় থেকে এমন প্রশ্ন উঠে আসাটা খুব স্বাভাবিক হলেও মজার কোন বিষয় নয়। আপাতদৃষ্টির বাইরে যে সহজ-সরল জীবন আছে, সেখানে তরুণ এবং প্রৌঢ়দের মাঝে একটা সুক্ষ্ম মানসিক দূরত্বকে ইঙ্গিত করে এটা। এটা কেবল আমার উল্লেখিত একটি ঘটনা মাত্র। এর চেয়েও অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক ইস্যু টেনে টেনে আমাদের প্রবীণরা তরুণদের জড়িয়ে বিভিন্ন মিডিয়া মাধ্যমে তাদের বক্তব্য পেশ করে থাকেন। যেখানে একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে মুখরোচক ও আদি কিছু শব্দ ব্যবহার করে তরুণদের সমালোচনা; শুধু থাকেনা আলোচ্য সমস্যাটা নিয়ে কোন বাস্তবসম্মত সমাধানের পথ।

একটা সময়ে কর্তৃত্ব বজায় রেখে কথা বলা, আদেশ, উপদেশ ইত্যাদি বিষয়গুলো ছিল অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার। বড়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত এই বিষয়গুলো মর্যাদার আসনে ধরে রাখত তরুণরাই। বর্তমানে এসে এটি একেবারেই পাল্টে গেছে। তরুণরা সত্যি বলতে এখন আর আদেশ-উপদেশে বিশ্বাস করেনা এবং প্রজন্মের মানসিকতায় এই  পরিবর্তনের নেপথ্যেও রয়েছে তরুণদের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষন লব্ধ জ্ঞানের প্রভাব। তারা অন্তত একটু বুঝেছে যে নীতিকথা ফলানো সুধীজন আর পথ দেখানো গুনীজন দুই মেরুর মানুষ। তরুণদের নিয়ে বিশিষ্টজনরা মিডিয়ার সামনে স্বপ্ন দেখতে ও আশার বাণী শোনাতে যেমন আনন্দ পান, ঠিক একই রকম ভাবে নিন্দা করেও আনন্দ পেয়ে থাকেন। কেননা, সেই স্বপ্নের মাঝে তাঁদের না থাকে কোন দায়িত্ব আর সমালোচনার পেছনে না থাকে কোন দায়বদ্ধতা। একজন শিক্ষক নিন্দার ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুড়তেই পারেন, ‘আমার ছাত্র আসলে কী চায় বা তরুণ সমাজ আসলে কী চায়?’ কিন্তু তিনি ছাত্রের কাছে জানতে চাইবেন না যে তাঁর ছাত্র আসলে কী চায়। শিক্ষক যদি ছাত্রের বিষাদময় চেহারা দেখে আহত হন তবে সেই ছাত্র কেন আনন্দ পাচ্ছেনা সেটা ভেবে উৎকণ্ঠিত হওয়াও তো শিক্ষকের দায়িত্ব। যাহোক, এটা শুধুমাত্র একটি উদাহরণ ছিল। প্রকৃত পক্ষে তরুণদের প্রতি দায়িত্ববোধের দায় শুধু শিক্ষকের নয়, দেশের প্রত্যেক বিশিষ্টজনের। অথচ এই জায়গাটি এখনো পর্যন্ত নূন্যতম পর্যবেক্ষণের বাইরের বিষয়।

আমাদের আবেগ ও পরম শ্রদ্ধা বিজড়িত যে দিবসগুলো রয়েছে যেমন, আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসে আমাদের বিশিষ্টজনরা বিভিন্ন মিডিয়াতে তরুণদের অসচেতনতা, মাতৃভাষার শুদ্ধ ব্যবহারে উদাসীনতা, আন্তরিকতার ঘাটতি ইত্যাদি বিষয়ে আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে মগ্ন থাকেন। অথচ জাগতিক যে বিষয়গুলো এসবের পেছনে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত সেগুলো নিয়ে কথা বলেন না। স্কুল পর্যায় থেকে ভাষাচর্চার বলয় সৃষ্টিতে অক্ষমতা, মিডিয়াগুলোর একের পর এক বিকৃত ধারার অনুষ্ঠান বজায় রাখার দুঃসাহস, বাণিজ্যিক স্বার্থে অপসংস্কৃতির অবাধ প্রচার প্রচারণার তীব্র প্রবণতা, এগুলোর মূল উৎস নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করার শক্তি মতো বিবেচনাবোধ কোথাও নেই। তরুণদের নিয়ে তাদের সমালোচনা শুনলে মনে হয়, একজন তরুণ আজই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটা বিকৃত বস্তু কুড়িয়ে পেল আর সঙ্গে সঙ্গে সেটি হাতে তুলে নিল। অথচ একটা বিকৃত ধারা কীভাবে এই দেশে কালো ছায়া প্রসারিত করে দুর্দমনীয় গতিতে সমাজের শিরা উপশিরায় বাহিত হয়ে চলেছে তা নিয়ে তো কেউ কথা বলেইনা, তার ভালো-মন্দ তরুণদের সামনে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজনবোধ কেউ করে বলে মনে হয়না। শুধু দূর থেকে সমালোচনার আঘাতে তরুণদের জর্জরিত করলেই সমস্যার সমাধান হবেনা।

এছাড়াও বিশেষ কিছু মৌসুমের সাথে সাথে আমাদের বুদ্ধিবিদগনের তারুণ্য বিশ্লেষণেরও একটা সিজনাল সময় আসে। ‘বাঙ্গালী সংস্কৃতি ভুলে অপসংস্কৃতি দিয়ে আমাদের তরুণরা দিকবিদিক মাখিয়ে ফেলল’ পহেলা বৈশাখ এলে কেবল এটুকু বলেই দায়িত্ব শেষ করেন অনেকে। শুধুমাত্র একুশে বইমেলায় এসে তরুণদের মানসিক উৎকর্ষ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। শুধু তাই নয়, যুগোপযোগী কর্মদক্ষতার ঘাটতি নিয়েও কথা শুনতে হয় তরুণদেরই। আর এদিকে যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলজুড়ে একটি পোকা লাগা সিস্টেম সারাটা জীবন থেকেই গেল, যেটা সকল অসুস্থতার উৎস, সেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনদিন তরুণদের নিয়ে সংগঠিত রুপে শিক্ষক বা বুদ্ধিজীবীদের কেউই আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদে বের হননি। উল্টো এখন প্রতিবাদের ধরণটাকেও সাম্প্রদায়িকতায় মোড়ানো হয়েছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষকের কোন সমস্যা হলে শুধু শিক্ষকরা প্রতিবাদ করেন। অন্যদিকে ছাত্রদের কিছু হলে শুধু ছাত্ররা প্রতিবাদ করে। উভয় স্থানেই ছাত্র-শিক্ষকের সমন্বয় ও সহায়তা একেবারেই দায় সারা গোছের। তরুণ আর বড়দের মাঝে এই অদ্ভুত কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ খুব সচেতন ভাবেই দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে।

খুব অল্প সংখ্যক সাদা মনের মানুষ আছেন যাঁরা তরুণদের নিয়ে একেবারে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে থাকেন। যেমন, বিভিন্ন সামাজিক ও সাহিত্য সংশ্লিষ্ট সংগঠন, বিষয় ভিত্তিক গবেষণা, মঞ্চ নাটক বা থিয়েটার ইত্যাদি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের সম্পন্ন ও বিশিষ্ট মানুষগুলো তরুণদের সঙ্গে ক্রমাগত মানসিক দূরত্ব নির্মাণ করে চলেছেন। এখন প্রশ্ন হলো এই মানসিক দূরত্বের কারণ কী? আসলে যুবাদের জীবন ঘনিষ্ঠতায় শৈশব এবং কৈশোরে যে শিক্ষা, বিশ্বাস, ধারণার বীজ উপ্ত হয়, সেগুলো তরুণ বয়সে গিয়ে হিসাব-নিকাশের আওতায় আসে। একজন তরুণ শৈশব এবং কৈশোরে বড়দের কাছ থেকে যা শিখেছে তরুণ বয়সে এসে সেই আলোকে অগ্রজদের কথা এবং কাজের মধ্যেই তার সাথে এক বিরাট অমিল খুঁজে পায়। ফলে প্রতিনিয়ত একজন তরুণ অনেক কিছুকে মেনে নেয়া ও না-নেয়ার একটা দোদুল্যমান চাপা আক্ষেপের মাঝে নিজেকে বারবার আবিষ্কার করতে থাকে। এই মানসিক চাপটা সব কালের তরুণদেরই সহ্য করতে হয়েছে এবং একটা সময়ে পৌঁছে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়ে প্রবীণ হতে হয়েছে। তবে আমার ধারণা, এই ধরনের মানসিক চাপ আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগেও এতটা চরম আকারে হয়তো ছিলনা। কেননা এখনকার তরুণদের হাতের মুঠোয় খুব দ্রুত সারা পৃথিবীর খবর চলে আসে। ফলে তারা দ্রুতই নিজেদেরকে বৈশ্বিক একটা প্লাটফর্মে নিয়ে তুলনা করে ফেলে। এরপরই তারা উপলব্ধি করে, পরিবার থেকে শুরু করে বৃহত্তর রাষ্ট্র পর্যন্ত যে আদর্শ কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে তাতে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রচুর সমন্বয়হীনতা রয়েছে যেটার মূল জায়গা ধরে কথা বলার দায়িত্বটুকুও আমাদের বিশিষ্ট মানুষগুলো তাদের বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলী বক্তব্য দ্বারা এড়িয়ে যান।

দূরত্বের আরো একটি বড় কারণ হলো তরুণদের প্রত্যাশার জায়গাটিতে বারবার আঘাত লাগা। মাঝে-মধ্যে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধ নিয়ে আমাদের বড়রা যেভাবে প্রতিবাদ করেন, তার নিরিখে তরুণদের মাঝে একটা প্রত্যাশার জায়গা তৈরি হয়। তারা চায় সামাজিক অপরাধ নিয়ে প্রতিবাদের পাশাপাশি এই মানুষগুলো যেন বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় সংকট নিয়েও কথা বলেন। এই সম্পন্ন মানুষদের তারা দেশের অভিভাবক বলে মনে করে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের তরুণ সমাজ দেশের লিডার ভাবলেও একই সাথে অভিভাবক হিসেবে খুব অল্প সংখ্যক নেতা তরুণদের মনে স্থান করে নিতে পেরেছেন। সেই জন্য রাষ্ট্র কাঠামোর কোন স্তরে সংকট সৃষ্টি হলে তরুণরা কোন নেতার মুখের দিকে না তাকিয়ে সবার আগে প্রত্যাশা করে রাষ্ট্র কতৃক মর্যাদা প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ কথা বলুক। কিন্তু বড় বড় সংকট কালে অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে ষোল আনা পাশে পাওয়া যায়নি তাদের। এমনকি রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক প্রাপ্ত ব্যক্তিরাও মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছেন। কখনোবা বোধ-বিবেকহীন কথাবার্তার মাধ্যমে যুবা মহলে হাসির পাত্র হয়েছেন। গত ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ঐ দশকের সবচেয়ে বড় দুটি রাষ্ট্রীয় সংকটের উদাহরণ, যেখানে এরকম অনেক লজ্জাজনক চিত্র গেঁথে আছে।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর লেখা সংগঠন ও বাঙ্গালী’ বইটিতে এক জায়গায় লিখেছেন, আমাদের দেশের সম্পন্ন মানুষদের অনেকেই যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন অনিয়মের পক্ষে দালালি করে গেছেন। জাতীয় দালালদের এই প্রজাতি এখনো বিলুপ্ত হয়নি। এখনো আমাদের দেশের সর্বোচ্চ মানুষদের মধ্যে এই দালালি মন-মানসিকতা দেখা যায়।

স্যারের এই কথাটি যে তরুণরা কখনো পড়েনি, তারাও এটার সারবস্তু বেশ ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। সবাই বুঝে গেছে বিশিষ্ট মানুষগুলোর এমন আচরণ হঠাৎ করেই প্রকাশ পায়না। বরং একটা পরিক্রমার ভেতর দিয়ে তা প্রবাহিত হয়। সেই পরিক্রমার মাঝে সম্পন্ন মানুষদের কেউ গা ভাসিয়ে চলেন, কেউ জান বাঁচিয়ে চলেন, আবার কেউ পিঠ বাঁচিয়ে চলেন। কাজেই সচেতন নাগরিক হিসেবে কিছু তরুণ নিজেদের উদ্যোগেই বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদেরকে সুস্থ ধারার চর্চার মধ্যে জিইয়ে রেখেছে। অনেকেই ছন্নছাড়া ভাবে চলছে কিন্তু সুস্থ ধারার আবেদন তরুণদের মাঝ থেকে ফুরিয়ে যায়নি। একই সাথে বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞান চর্চা, শুদ্ধ ভাষা চর্চা, সাহিত্য চর্চা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয়কে তরুণরা নিজেদের প্রচেষ্টাতে শুরু থেকেই এগিয়ে নিয়ে আসছে। তবে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তায় এ বিষয়গুলো এখন স্কুল পর্যায় থেকেই আরো সহজ ও শক্ত হতে শুরু করেছে। যেমন সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান চর্চার বিষয়টি সিলেবাসে গুরুত্ব পেয়েছে, স্কুলে স্কুলে আধুনিক মানের ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ক্রীড়ানুরাগী পরিবেশ বজায় রাখতে রাষ্ট্রীয় ভাবে বিভিন্ন ধরনের টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে; এরকম অনেক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে আমাদের শিক্ষালয়গুলোতে। হয়তো খুব দ্রুতই আমাদের দেশ এর একটি ইতিবাচক ফলাফল পেতে যাচ্ছে। আমাদের প্রবীণদের এখন উচিত হবে এসব জায়গাগুলো নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা এবং বিভিন্ন রূপরেখা প্রণয়ন করা। এই সময়ে এসে আর কিছু না হোক অন্তত এটুকু করলেই তাঁদের সম্মানের জায়গাটার প্রতি সুবিচার রক্ষা করা হবে।

লেখক:সাবেক শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

   

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন