প্রবন্ধ: ডুব— সম্পর্ক, স্বাধীনতা ও সংকট: ছালমা জান্নাত ঊর্মি

0

ছবি: ফেসবুক

অনেক আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ডুব চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশে মুক্তি পায় ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর। চলচ্চিত্রের গল্প এসময়ে কম—বেশি আামাদের সবার জানা। মধ্যবিত্ত—জীবনের সম্পর্ক—প্রত্যাশা—স্বাধীনতা—সংকটকে কেন্দ্র করেই মূলত এই চলচ্চিত্রের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। একসময়ে ছোটপরিসরের চলচ্চিত্র নির্মাতা জাভেদ হাসান, টিউশনি করাতে গিয়ে প্রেমে পড়েন ছাত্রী নুরুন্নাহার মায়ার। পালিয়ে বিয়ে করেন দুজনে এবং আশ্রয় পান শাশুড়ির (মায়ার মা) বাড়ির স্টোররুমে। মায়ার রাগী বাবা পুলিশের সহায়তায় মেয়ের খোঁজ পান এবং একপর্যায়ে মেনে নেন তাদের সম্পর্ক। সময়ের পরিক্রমায় জাভেদ হাসান হয়ে ওঠেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। মেয়ে সাবেরি ও ছেলে আহিরকে নিয়ে আপাত দৃষ্টিতে মায়া ও জাভেদের সংসার সুখের মনে হলেও ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয় সম্পর্কের ফাটলগুলো। মায়া বিশ্বাস করতে পারে না জাভেদকে। সাবেরির সহপাঠী—বন্ধু, একইসঙ্গে নিজ ছবির অভিনেত্রী নীতুর সঙ্গে জাভেদ হাসানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে মানসিকভাবে মায়া ও জাভেদের বিপর্যস্ত হওয়ার দৃশ্যায়ন বারবার চলচ্চিত্রের পর্দায় ফিরে আসে। অসহায় ও এলোমেলো হতে দেখি সন্তানদেরও। একপর্যায়ে নীতুকে বিয়ে করে জাভেদ। শুরু হয় নতুন টানাপোড়েন। সাবেরি ও আহিরের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগের চেষ্টায় ব্যকুল জাভেদ প্রশ্নের সম্মুখীন হয় নীতুর কাছে। একদিকে জাভেদের জীবন থেকে মায়া—সাবেরি—আহিরকে মুছে ফেলতে উদ্যত নীতু, অপরদিকে সাবেরি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় জাভেদকে যে, বাবা হিসেবে সে আর কখনও তার সন্তানদের কোনো খবর পাবে না। ফারুকীর নির্মাণে একাধিকবার উঠে আসে পিতা হিসেবে জাভেদ হাসানের অসহায়ত্ব, মায়া—সাবেরি—আহিরের বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং নীতুর একান্তই ক্ষুদ্র—ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক ভাবনার প্রকাশ। নীতুর কোলে একটি সন্তান রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন জাভেদ। মৃত্যু জাভেদের কাছে ফিরিয়ে দেয় সাবেরি ও আহিরকে, যারা জীবিত জাভেদকে ক্ষমা করতে পারেনি। মৃত্যু জাভেদকে আপন করে তোলে মায়ার কাছেও, কারণ মৃত জাভেদের উপর আর কারো একক অধিকার নেই। এই গল্প নিয়েই পরিবেশিত হয় মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ডুব, ইংরেজিতে নো বেড অব রোজেস।

ডুব চলচ্চিত্রে জাভেদ হাসান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভারতের অভিনেতা ইরফান খান। মায়া, সাবেরি ও নীতু চরিত্রে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে বাংলাদেশের রোকেয়া প্রাচী, নুসরাত ইমরোজ তিশা এবং ভারতের পার্ণো মিত্র। আহিরের চরিত্রে অভিনয় করেছে রাহাদ হোসেন।  

বাংলাদেশের ফর্মুলাভিত্তিক বা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলো একবোরেই পুরুষাধিপত্যশীল ধারার বা নায়ক—প্রধান চলচ্চিত্র। এসব চলচ্চিত্রে সমস্ত নারী চরিত্রের পরিবেশন হয় শুধুমাত্র নায়কের গুরুত্ব, সাহসিকতা, বীরত্ব, শক্তি, নেতৃত্ত্ব, বুদ্ধিমত্তা, প্রভাব—প্রতিপত্তি চিত্রায়ণের জন্য। এমন নায়ক তথা পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য উপস্থাপনের জন্য স্বভাবতই তাই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে— বোকা, নির্বোধ, দূর্বল, অসহায়, ভীতু চরিত্রের নারীর পরিবেশন। যেসব চলচ্চিত্রে নারীকে সাহসী কিংবা বুদ্ধিমতী হিসেবে দেখানো হয়, সেখানেও নারীর পরিবেশন পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা দ্বারাই নির্ধারিত। নায়কের বীরত্ব প্রকাশে অসীম সাহসী নারীও তাই বাংলা চলচ্চিত্রে অহরহ বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার কিংবা নারীরা তখনই কৌশলী—বুদ্ধিমতী, যখন তাদের উপস্থাপন কোনো না কোনো কুটিল চরিত্রে অথবা কারো ক্ষতিসাধনের জন্য। ফারুকী নির্মিত ডুব চলচ্চিত্র পুরোপুরি বাংলাদশের ফর্মুলানির্ভর চলচ্চিত্রভুক্ত হয় না। ফর্মুলা মেনে পাঁচটা গান, তিনটে মারামারি, এক বা একাধিক প্রেম, বিরহ, বিয়ে এসব নিয়ে চিত্রায়িত হয়নি ডুব। বরং ডুব—এর কাহিনীপটে উঠে এসেছে— সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক সমস্যা ও পারিবারিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত পরকীয়া ও তার পরিণতিতে প্রতিষ্ঠিত একটি সংসারের ভাঙ্গনের চিত্র। স্ত্রী—স্বামীর বিচ্ছেদ ও তার পরিণতির চেয়েও শক্তিশালীভাবে এখানে দৃশ্যায়িত হয়েছে, কন্যা ও পিতার সম্পর্কের মমতা—বিশ্বাস—গভীরতার চির। স্ত্রী মায়া কিংবা পুত্র আহিরের বিচ্ছেদ—ব্যাথা, তাদের সামাজিক সমস্যা বা অর্থনৈতিক চাপের চেয়েও ক্যামেরায় প্রবল প্রকাশ ঘটেছে লজ্জা—অপমান—সব হারানোর ব্যাথায় জেদী—দৃঢ় প্রত্যয়ী সাবেরি ও তার অসহায় পিতা জাভেদের— যিনি বারবার সন্তানদের সঙ্গলাভ কিংবা তাদের একটু কন্ঠ শোনার জন্য কাতর হয়েছেন। এ—দৃশ্যায়ন ঠিক বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ফর্মুলা মেনে রচিত বলে মনে হয় না।

ডুব—এ উপস্থাপিত নীতুর চরিত্রে শৈশব থেকে তারুণ্য পর্যন্ত যে বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত তাতে তুলনাপ্রিয়, পরশ্রীকাতর, প্রতিযোগিতাসুলভ, হিংসাপ্রবণ ও স্বার্থপরতাই মূলত ফুটে ওঠে। নীতুর এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রকাশ যেন পরিস্থিতির শিকার হিসেবে নিশ্চুপে বৈধতা দিয়ে চলে জাভেদের সিদ্ধান্তগুলোকে, সাবেরির অভিমান ও ক্রোধকে। ঠিক ফর্মুলার চলচ্চিত্রের হিসাবে না মিললেও ডুব—এর পরিবেশনায় খুব পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়, এর কেন্দ্রীয় চরিত্র জাভেদ, যাকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে মায়া, সাবেরি, আহির ও নীতুর জীবন। জাভেদের সমস্ত সিদ্ধান্ত, কাজ, অসহায়ত্ব ও সবশেষে মৃত্যুর পরিণামেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকায় রয়েছে তার জীবনের নারীরা— এমন পরিবেশনাই ঘুরে ফিরে আসে চলচ্চিত্রজুড়ে। এই চলচ্চিত্রের মূল ভূমিকায় কোনো নারী নয়, একজন পিতা, স্বামী ও ব্যক্তি পুরুষের জীবন—সম্পর্ক—স্বাধীনতা—সৃষ্টিশীলতার দ্বন্দ্বই আলোড়িত হয়েছে বিভিন্নভাবে। আর সে আলোড়ন সৃষ্টির কারণ হিসেবে পরিবেশিত হয়েছে নারীরা। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় খুবই প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত এই ডিসকোর্স। এ আলোচনার পরবর্তী পর্যায়ে জাভেদকে ঘিরে মায়া, সাবেরি বা নীতুকে নয়, বরং জাভেদের ভূমিকা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে একবার মায়া, সাবেরি ও নীতু চরিত্রগুলোর পরিবেশনা বোঝার চেষ্টা করা হবে।

মায়া— জাভেদ হাসানের প্রথম স্ত্রী। প্রেম করে, পালিয়ে বিয়ে করেছিল তারা। জাভেদের স্মৃতিচারণে মায়ার মা—বাবা ও তৎকালীন পরিস্থিতির যে বর্ণনা পরিবেশিত হয়—তাতে বুঝে নিতে দর্শকের কোনো সমস্যাই হয় না যে, স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ একজন প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়ে ওঠার পথচলাটা তাদের খুব স্বাচ্ছন্দ্যের ছিল না, সংগ্রামেরই ছিল। প্রতিষ্ঠিত জীবনের সঙ্গীদের নিয়ে রাঙ্গামাটির পথে যখন মায়া, জাভেদ, সাবেরি, আহির গান গাইতে গাইতে বেড়াতে যায়— তখনও মনে হয় না, কোথাও কোনো সমস্যা আছে। মায়া ও জাভেদের দূরত্ব দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করে যখন, সাবেরি বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আদেশের সুরে অনুরোধ জানায় যে, কাল সারাদিন মা—বাবা দুজনকে তারা আর ভিলায় দেখতে চায় না, বেড়াতে—ঘুরতে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে চায়। সাবেরি যখন মায়াকে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্ততি হিসেবে শাড়ি—ব্লাউজ—মালা—দুল গুছিয়ে দেয়, তখন মায়াকে বেশ বিরক্তি নিয়েই তৈরি হতে দেখি। ব্লাউজ ম্যাচিং হচ্ছে কিনা, দুল কানের সঙ্গে মানাবে কিনা— এমন সব বিষয়কে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া এবং ম্যাচিং না হওয়ার আশঙ্কায় প্রয়োজনে বেড়াতে না যাওয়াটাও যৌক্তিক বলে মন্তব্য করতে শুনি মায়াকে।

চলচ্চিত্র শেষ হতে হতে মনে প্রশ্ন জাগে, যেখানে এই ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্যই স্বামী—স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে আবারও সম্পর্কের স্বাভাবিকতায় ফিরে আসা, সেখানে ম্যাচিং এর অমিল কি সম্পর্কের অমিলের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ? একজন নারী কি সত্যিই এতোটা সৌন্দর্যসচেতন যেখানে সম্পর্কসচেতনতা ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে! নাকি একজন পুরুষ নির্মাতা অপর এক পুরুষ নির্মাতার জীবনে দ্বিতীয় নারীর আগমনের বৈধতা সৃষ্টির জন্য সম্পর্কের চেয়ে পোশাকের প্রতি তাকে (মায়াকে) বেশি সচেতন করে তোলেন? নাকি মায়া তার দীর্ঘদিনের লালিত সংসার—স্বামীর প্রতি এতোটাই বিরক্ত কিংবা বিতশ্রদ্ধ যে তারই ছাপ এসে পড়ে যখন সেই স্বামীর সঙ্গে লং ওয়াকে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে পোশাক বা দুল নির্বাচনের প্রয়োজন পড়ে। জীবন—সংসারের তাল মেলাতে মেলাতে মায়াও ক্লান্ত—বিরক্ত, জাভেদের নতুন অভিরুচিতে।

পরবর্তী দৃশ্যে চোখে পড়ে, পাহাড় বেয়ে মায়া—জাভেদ হেঁটে চলেছে। জাভেদ মগ্ন তাদের বিয়ের স্মৃতিচারণে। জাভেদ বলে, ‘মাঝে মাঝে দূরে যেতে হয় কাছে আসার জন্য।’ জাভেদের এ আত্মোপলব্ধি বুঝিয়ে দেয় শহর থেকে দূরে পহাড়ঘেরা রাঙ্গামাটি হয়তো আবারও তাদের সম্পর্ককে নতুন করে বুঝে নেওয়ার সুযোগ দিবে। জাভেদ প্রকাশ করে তাদের প্রেম—পালিয়ে বিয়ে—শ্বাশুড়ির বাড়ির স্টোররুমে বাসর বাসর খেলা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। এর মাঝেই মায়া ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে এগিয়ে দেয় জাভেদকে। হঠাৎ বিরক্ত হয়ে মায়া প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, বারবার অতীতে কেন ফিরে যেতে হচ্ছে জাভেদকে, তাহলে কি তাদের সম্পর্কের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই? বিরক্তি মেশানো কন্ঠের প্রশ্ন জাভেদকেও বিরক্ত করে তোলে। জাভেদ আর চা ছোঁয় না। মায়ার চোখে—মুখে স্পষ্ট বিব্রতবোধ, আরও পরিষ্কার করে বললে অপরাধবোধ। চলচ্চিত্রে এ পর্যন্ত মায়ার চরিত্র পরিবেশনা তাকে গতানুগতিক অভিযোগপ্রিয় স্বভাবের স্ত্রী হিসেবেই ফুটিয়ে তোলে।

রাঙ্গামাটি যাওয়ার সময় গাড়িতে যে মায়া ও জাভেদকে পাশাপাশি বসতে দেখি, সেই তাদেরই ফেরার পথে দেখি পৃথক সিটে বসতে। জাভেদ সামনে। মায়া পিছনে। যে দূরত্ব মেটাতে এই রাঙ্গামাটি ভ্রমণ জরুরি ছিল, ভ্রমণ শেষে ফেরার পথে চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন পরিষ্কারভাবে সেই দূরত্বের গভীরতাকে আরও বাড়িয়েই তোলে। প্রলেপ পড়ে না সম্পর্কের ক্ষততে, বরং তা যেন আরও বেশি উন্মোচিত হয়ে পড়ে। আর সে উন্মেচনের জন্য পরোক্ষভাবে জাভেদের প্রতি মায়ার অসহানুভূতিশীল অভিপ্রকাশই যেন দায়ী হয়ে ওঠে ফারুকীর নির্মাণে।

এর পরের দৃশ্যায়নে আমরা দেখি, জাভেদের সঙ্গে নীতুর বন্ধুত্ত্বের সম্পর্ক আছে এধরনের মন্তব্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ায়, জাভেদকে কিছু না জানিয়ে সাবেরি ও আহিরকে নিয়ে খুব সকালে তার মায়ের বাসায় চলে যায় মায়া। জাভেদ তাদেরকে আনতে যাওয়ার পথে নীতুর সঙ্গে ফোনে রাগারাগি করে। এবং ফেরার পথে মায়ার পাশে বসে গাড়ি ড্র্রাইভ করতে করতে সংবাদপত্রের সম্পাদককে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। একজন অসহায়—দূর্বল মানুষ যেমন তার সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের উপলব্ধিতে কিছু না করতে পারার হতাশায় কাঁদে, প্রিয়জন বা আপনজনের কাছে অভিযোগ করে, ঠিক তেমনই মায়াও এধরনের একটি স্পর্শকাতর সংবাদ জানার পর সন্তানদের নিয়ে মায়ের বাড়িতে চলে যায়। মানসিকভাবে শক্তিশালী একজন ব্যক্তি সবসময় তার সঙ্গে হওয়া যে কোনো অন্যায়ের বিচার চাইতে পারে, সমস্যা মেটানোর জন্য উভয়পক্ষ বসে কথা বলতে পারে, কিন্ত কখনো অন্যের ভুল বা অপরাধের উপলব্ধিতে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া বা নিজেকে শাস্তি দিতে উদ্যত হয় না। জাভেদের প্রতি অভিমানেই হোক কিংবা অপমানে, ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্ত বারবার মায়াই নেয়। এমন কি নয়নতারা ফিল্মসিটিতে জাভেদের সঙ্গে নীতুর রাত্রিযাপনের বিষয়টি জানার পর মায়া তার ব্যাগ গুছিয়ে আবারও বাড়ি ছাড়তে উদ্যত হন। সেসময় জাভেদ বলে, অন্যায় তার সুতরাং বাড়ি ছাড়তে হলে সে ছাড়বে, মায়া নয়। আবারও মায়া পরিবেশিত হয় পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর ডিসকোর্সের ভিতর থেকে। যেখানে সব মায়ারা অসহায়, দূর্বল, আবেগপ্রবণ। যারা তাদের জীবনসঙ্গীর অবহেলা বা অন্যায়ের সুযোগসৃষ্টিকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়, কিন্তু তাদের কাছে সম্পর্কের অধিকার নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। পারে না সমস্যা সমাধানের জন্য গঠনমূলক আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে, বরং মায়ারা ঘর ছাড়বে কিনা শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তও বিদায়ী সম্পর্কের কাছ থেকেই তাদের নিতে হয়। সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতাও এই মায়াদের হাতে নেই।

স্বামী—সন্তানদের নিয়ে জগিং এ গিয়েও সেই অমীমাংসতি বিষয়কেই আবারও আলোচনায় নিয়ে আসেন মায়া, একপর্যায়ে বিরক্ত জাভেদ চাবিসহ গাড়ি রেখে চলে যান তার নয়নতারা ফিল্মসিটিতে। যাওয়ার আগে জাভেদ অভিযোগ করে যায়, এ প্রসঙ্গ বারবার এনে মায়া সবসময় নীতুকে তাদের দুজনের মাঝে দাঁড় করিয়ে রাখছে। হতভম্ব মায়া হতাশ হয়ে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে, ‘আমি?’ দুই সন্তানকে নিয়ে খানিকটা অস্বস্তিসহ গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সাবেরির কাছ থেকেও কথা শুনতে হয় মায়াকে এতোদিন অতিআরামে জীবন উপভোগ করা ও দীর্ঘদিন গাড়ি চালানোর অনুশীলন না করায়। জাভেদ সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার পর একদিন বাহিরে যাওয়ার সময় মায়া যখন সাবেরিকে তার জন্য শাড়ি নির্বাচন করে দিতে বলে, সেসময় নিজের শাড়ি নিজে নির্বাচন করার পরমর্শ দিয়ে সাবেরি মাকে একটু স্মার্ট হতে বলে। সত্যিই তো মায়ারা স্মার্ট নন বলেই, ঘরের ইস্যুকে জগিং এর পার্ক পর্যন্ত নিয়ে চলেন মীমাংসার জন্য, স্বামীর কাছে সম্পর্কের অধিকার চাওয়ার বা বজায় রাখার পরিবর্তে অতিসহজেই সিদ্ধান্ত নেন ঘর ছাড়ার, পরনির্ভর জীবনের উপর এতোটাই বিশ্বাস রাখেন যে কখনো ভাবেনই না, নিজের শাড়ি, দুল কিংবা স্বামীর উপরে অধিকারের জায়গাটা একান্তই নিজের। কেননা এমন নারীই তো বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর কাঙ্ক্ষিত, আদর্শ উদাহরণ। তাই বর্তমান স্ত্রী—সংসার—সম্পর্ক ছেড়ে নতুন সম্পর্কের দিকে ধাবিত জাভেদ হাসানদের এমন পদক্ষেপও বৈধ হয়ে ওঠে আনস্মার্ট স্ত্রীদের নির্বোধ স্বভাবেগের কারণে। যদিও মায়াদের স্বাবলম্বী হতেই হয়, যেভাবে কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়ে সেই অর্থে পরিচালিত হতে দেখি মায়া—সাবেরি—আহিরকে।

সাবেরি— মায়া ও জাভেদের প্রথম সন্তান কলেজপড়ুয়া সাবেরি। মা—বাবার সম্পর্কের ভাঙ্গনে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হতে দেখি এই মেয়েটিকে। চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখি মা—বাবার মাঝের দূরত্ব কমানোর চেষ্টায় ব্যস্ত সাবেরি বিভিন্নভাবে মায়ের সঙ্গে বাবাকে এবং বাবার সঙ্গে মাকে যুক্ত করার জন্য উদ্যোগী হতে। যদিও উদ্যোগগুলো সফলতার মুখ দেখে না। সহপাঠী নিতুর সঙ্গে বাবার সম্পর্কের কথা জেনেও কোনো প্রশ্ন তোলে না সাবেরি। কান্না চেপে বাবাকে চলে যেতে দেয়। মায়ের প্রতি ভালোবাসা কিংবা আত্মমর্যাদার লড়াই অথবা নৈতিকতার প্রশ্নে বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদকেই বেছে নেয় মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই স্কুল ও পর্যায়ক্রমে কলেজের সহপাঠী ও বন্ধু নীতুর প্রতি উদারতারই প্রকাশ ঘটে সাবেরির আচরণে। স্কুলজীবনে নীতু যখন সাবেরির কাছে জানতে চায় জাভেদের সব চলচ্চিত্রে শুধু সাবেরিকে নেয় কেন, সাবেরি হেসে জানায় পরের ছবিতে নীতুকেও যেন নেওয়া হয়— সে অনুরোধ বাবার কাছে রাখবে। পতুল খেলার সময়ও দেখি খেলার ছলে ঈদের দিনের দাওয়াতে নীতুকেই আগে তার বাসায় আসতে আমন্ত্রণ জানায় সাবেরি। এমনকি বাবার মৃত্যু—পরবর্তীসময়ে কলেজের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যখন সাবেরির সঙ্গে কথা বলার জন্য নীতু তার কাছে যায়, তখনও সাবেরিকে শান্ত থাকতেই দেখি। এক অস্বস্তিকর নীরবতা মাঝে রেখেই শেষ হয় চলচ্চিত্র।

মায়াকে বিভিন্নভাবে বারবার ব্যথিত করে সাবেরি। কোনো কোনো মুহূর্তে সাবেরিও যেন হয়ে ওঠে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের এক কঠিন রূপ, যে রূপ তার বিভিন্ন শব্দ ও অভিব্যক্তি ব্যবহারে মায়াকেই দায়ী করে তার সম্পর্ক—বিচ্ছেদ—পরিণতির জন্য। বিভিন্ন বিষয়ে, কাজে জাভেদের উপর নির্ভশীল থাকার জন্য, গাড়ি চালানোর অভ্যস্ততা না রাখার জন্য, নিজের পোশাক নিজে নির্বাচন করতে না পারার জন্য, স্মার্ট হওয়ার জন্য যেমন মাকে আহত করেছে সাবেরি, আবার একসময় মাকে প্রশংসা ও সাহসও দিয়েছে সে। মাকে আরও স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য নিজেদের গাড়ি বিক্রি করে নিজস্ব কোচিং সেন্টার খোলার পরামর্শও দেয় সাবেরি। একই সঙ্গে আবেগ ও বাস্তবতার এক যৌক্তিক রূপের সমন্বয়ে পরিবেশিত সাবেরি চরিত্রটি নির্মাতার এক শক্তিশালী সৃষ্টি। মাকে শক্ত করে তোলার জন্য আবেগীয় কথা বা আচরণ থেকে বের হয়ে কখনো কখনো কঠোর অবস্থানে দাঁড়াতে দেখি মেয়েকে। উপলব্ধি হয়, স্বনির্ভরতা কত জরুরি প্রতিটি মানুষের জন্যই, বিশেষত প্রশ্ন যখন আত্ম—মর্যাদার।

সব ছেড়ে চলে যাওয়ার আগমুহূর্তে ছেলে আহিরকে ডেকে তার কাছ থেকে কোনো সাড়া পায়না জাভেদ। এসময় জগে পানি না পেয়ে, পিপাসার্ত জাভেদ শূণ্য জগ রেখে বাসা থেকে বের হয়। সাবেরি বুঝতে পেরে এক গ্লাস পানি হাতে ছুটে গিয়ে বাবার সামনে পানির গ্লাসটা ধরে রাখে। বাবার দিকে তাকাতে পারে না মেয়ে। জাভেদ পানি খেয়ে নীরবে চলে যায়। কান্না আটকে বাবার নীরব প্রস্থান দেখে, কিন্তু সে মুহুর্তে সাবেরির চোখেমুখে বাঁধভাঙ্গা কান্নার অভিব্যক্তি, একবার বাবার পথের দিকে একবার পেছনে বাড়ির দিকে তাকানো তার প্রবল দ্বান্দ্বিক অনুভূতিকে তুলে ধরে। কয়েক মুহূর্তের ক্যামেরা ফোকাসে ফুটে ওঠে মা—বাবার বিচ্ছেদে একজন সন্তানের অসহায়—দ্বান্দ্বিক অভিব্যক্তি—পরিস্থিতি—পরিণতি।

নীতুকে বিয়ের পর এবার বাবাকে প্রথম ও শেষবারের মতো বিদায় জানাতে যায় সাবেরি। নীতুকে অ্যাটেনশন—সিকার অভিহিত করে, সাবেরি জাভেদকে জানায় একজন বাবা হিসেবে সে আর কখনও তার সন্তানদের কোনো খবর পাবে না, মুখ দেখতে পাবে না, এবং এটাই হবে জাভেদ হাসানের সবচেয়ে বড় শাস্তি। বাবার কৃতকর্মের জন্য সাবেরিরা সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না এমন ভুল ধারণা যেন জাভেদ পোষণ না করে সে কথার পাশাপাশি বাবাকে অন্ধকারে পচে বাঁচার অভিশাপও দিয়ে যায় মেয়ে। জাভেদ বারবার মেয়ের জন্য উপহার নিয়ে গেছে, সাবেরি ফিরিয়ে দিয়েছে প্রতিবার। সাবেরিকে ফোন করে যেকোনো কিছু বলার জন্য অনুরোধ করেছে জাভেদ, নিশ্চুপ সাবেরি ফোন ধরিয়ে দিয়েছে আহিরের হাতে। গভীর অভিমানে বাবার কাছ থেকে দূরে সরে থেকেছে সাবেরি। কিন্তু জাভেদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সাবেরির অভিমানও যেন মরে যায়। শেষবারের মতো বাবাকে বিদায় জানাতে উপস্থিত হয় নীতু—জাভেদের বাড়িতে। জাভেদের মৃতদহকে ধরে অভিমান—ব্যাথা—অভিযোগ ভুলে, কান্নায় আকুল সাবেরিকে দেখি পিতার জন্য ভালোবাসার অভিপ্রকাশ ঘটাতে। অনুভূত হয় বাবাকে কখনোই ত্যাগ করেনি কিংবা ফিরিয়ে দেয়নি সাবেরি, বরং বারবার প্রত্যাখান করেছে, দূরে ঠেলেছে বন্ধু—সহপাঠী নীতুর স্বামী জাভেদ হাসানকে।

নীতু— স্কুল ও কলেজ জীবনে সাবেরির সহপাঠী ও বন্ধু এবং পরবর্তীতে জাভেদ হাসানের প্রেমিকা ও স্ত্রী হিসেবে চিত্রায়িত হয় নীতু। চলচ্চিত্রজুড়ে নীতু পরিবেশিত হয়েছে কখনো সাবেরির বাবা, কখনো মায়ার স্বামী— জাভেদ হাসানকে অধিকার করার চেষ্টারত। ছোটবেলায়, স্কুলজীবনে সাবেরির কাছে নীতুর প্রশ্ন ও প্রত্যাশা তার শৈশবের এক ভিন্ন রূপকে উপস্থাপন করে দর্শকের সামনে। কেন জাভেদ তার চলচ্চিত্রে শুধু নিজ মেয়ে সাবেরিকে নেয়— নীতুর এমন প্রশ্নে সাবেরি যখন প্রস্তাব দেয় যে, সে তার বাবাকে বলবে যেন এরপর নীতুকেও চলচ্চিত্রে নেওয়া হয়, তখনও নীতুকে দর্শক আনন্দিত বা সন্তুষ্ট হতে দেখে না। বরং নীতু প্রতিউত্তরে জানায়, ‘না থাক, লাগবে না, আমার বাবা আমাকে নিজের টাকা দিয়ে ছবি বানায় দিবে।’ দশ বা বারোবছর বয়সী একজন শিশু হিসেবে নীতুর সংলাপটি অনেক পরিণত ও আত্মকেন্দ্রিক। পরবর্তীতে কলেজপড়ুয়া নীতুর সঙ্গে জাভেদের ফোনালাপ থেকে বোঝা যায়, জাভেদের সঙ্গে বন্ধুত্ত্বের বিষয়টি মিডিয়ার কাছে নীতুই প্রকাশ করেছে, যা নিয়ে জাভেদের সংসারে ঝড় ওঠে। স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে জাভেদ যখন নয়নতারা ফিল্ম সিটিতে সময় কাটাচ্ছে, নীতু সেখানে খাবার পাঠায়। জাভেদ সে খাবার গ্রহণ করার পাশাপাশি যার হাত দিয়ে নীতু খাবার পাঠিয়েছে, তাকেও খেয়ে যেতে আমন্ত্রণ জানায়। বন্ধুত্ত্বের সম্পর্ক মিডিয়ার কাছে প্রকাশের জন্য নীতুর প্রতি ফোনে বিরক্তি প্রকাশ করলেও তার পাঠানো খাবার গ্রহণে জাভেদের কোনো অনীহা কাজ করে না।

বেশ রাতে নয়নতারা ফিল্মসিটির দেওয়াল টপকে নীতু প্রবেশ করে জাভেদের ঘরে। ব্যাগ থেকে সিগারেট নিয়ে বারান্দায় বসে ধোঁয়া ছাড়ে নীতু। নিকোটিন কিংবা নীতু যার আকর্ষণেই হোক জাভেদ উঠে এসে জানতে চায় আরও সিগারেট আছে কিনা। বাড়তি সিগারেট থাকা সত্ত্বেও নীতু জানায় সিগারেট চাইলে তার সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। সম্মত হয় জাভেদ। কখনো জাভেদ, কখনো নীতুর হাতে একের পর এক শেষ হয় সিগারেট এবং রাত। পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর ছায়ায় বেড়ে ওঠা মিডিয়া ডিসকোর্স সময়ের সঙ্গে আধুনিক নারীর পরিবেশনে তার ঠোঁটে তুলে দিয়েছে সিগারেট, গায়ে জড়িয়েছে জিন্স, হাতে তুলে দিয়েছে গাড়ির চাবি ও অবাধ স্বাধীনতার ছোঁয়া, কিন্তু এখনও সতী আর অসতী কিংবা ভালো আর মন্দ নারীর পার্থক্য রূপায়ণে সেই আদিম প্রবণতাগুলোই জিইয়ে রেখেছে গভীর যত্নে। যে নারী অনেক রাতে, একা, গাড়ি চালিয়ে, দেওয়াল টপকে, নিকোটিনের ধোঁয়ার আবরণে অন্যের স্বামী কিংবা বান্ধবীর বাবাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়, তার প্রেম যতই সৎ কিংবা মহৎ হোক সমাজে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে না।

একবিংশ শতাব্দীর অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এই আলোকময় আধুনিক যুগেও তাই মন্দ মেয়ের চরিত্র নির্মাণে নির্মাতাকে বেছে নিতে হয় ধূমপায়ী, দুঃসাহসী, বেপরোয়া, আত্মকেন্দ্রিক নীতুকে, তা না হলে জাভেদ হাসানের পদস্খলন বৈধ হয়ে ওঠে না। নীতু ধূমপান করে বলেই, জাভেদ সে ধোঁয়ায় ডুব দিতে বাধ্য হয়। নীতু গভীর রাতে ফিল্মসিটির প্রাচীরের সীমারেখা অতিক্রম করে বলেই, জাভেদের জন্য সম্পর্কের সীমারেখা অতিক্রম করা সহজ হয়। নীতু খাবার পাঠায় বলেই, জাভেদ তৃপ্তি করে খেতে পায়। নীতু মিডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাভেদ হাসানের সঙ্গে নিজের বন্ধুত্ত্বের কথা প্রকাশ করে বলেই, জাভেদের জন্য প্রকাশ্যে নীতুর সঙ্গে সম্পর্কে যাওয়ার সাহস দেখানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। নীতু শৈশব থেকে জাভেদের চলচ্চিত্রে নিজেকে দেখতে চেয়েছে বলেই, জাভেদের জীবনে নীতুর প্রবেশ বৈধ হয়। চলচ্চিত্রের চরিত্র নির্মাণে নির্মাতার এই সুদক্ষ দৃশ্যায়ন তাই জাভেদের সমস্ত অসহায়ত্ব, পরিস্থিতি, পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্তের জন্য জাভেদের চেয়েও অনেক বেশি অভিযুক্ত করে তোলে নীতুকে। এ দৃশ্যায়ন নীতুকে কারণ ও জাভেদকে পরিণাম হিসেবে উপস্থাপন করে বারবার। যে জাভেদ, স্ত্রী মায়াকে সিদ্ধান্ত দিতে পারে যে, অন্যায় বা ভুল যেহেতু তার সুতরাং বাড়িও সেই ছাড়বে, সেই একই জাভেদ নিজে ভুল না করার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। সেকারণেই চলচ্চিত্রজুড়ে নীতুর পরিবেশনা শুধুমাত্র অন্যের সুখ—সমৃদ্ধি—সম্পদ—সম্পর্ক কেড়ে নেওয়ার ভূমিকাই দৃশ্যায়িত করে।

জাভেদের সঙ্গে বিয়ের পরে নীতুকে আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে দেখি। জাভেদের খাবারের দায়িত্ব নিজে নিয়ে নেয়। বেছে বেছে মাছ কেনে। মায়ার পছন্দে লাগানো বাড়ির পর্দাসহ অন্যান্য বিষয় পরিবর্তনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সাবেরির জন্য কেনা উপহার গাড়ির পেছনে ট্রাংকে লুকিয়ে রাখায় জাভেদের উপর রাগ প্রকাশ করে নীতু। সবকিছু ছেড়ে জাভেদকে বিয়ে করে কী পেলো জীবনে সেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় নীতুর মুখে। জাভেদের বাড়িতে এসে সাবেরি যখন বিভিন্নভাবে বাবাকে কথা শুনিয়ে যায়, তখনও নীতু জাভেদের প্রতি সহমর্মী না হয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, ‘আমার দুঃখটা কি জানো, আমাকে এমন একজন মানুষের সঙ্গে ঘর করতে হবে, যে কিনা সারাজীবন তার মেয়ের জন্য কেঁদে যাবে। যে মেয়ে আমাকে ঘৃণা করে।’ আবারও ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক নীতু। জাভেদ তার মেয়ের জন্য কাঁদবে এটা সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে জাভেদ সেই মেয়ের জন্য কাঁদছে, যে মেয়ে নীতুকে ঘৃণা করে। এখানে জাভেদের কান্না এবং সাবেরির ঘৃণা দুটোই নীতুর জন্য অগ্রহণযোগ্য। স্বাভাবিক। যে চরিত্রটি বন্ধুর পিতা কিংবা অন্যের স্বামীকে অধিকৃত করার আগে বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়নি, তার জন্য পরবর্তী বাস্তবতা অগ্রহণযোগ্যই হওয়ার কথা।

কন্যা এবং বর্তমান স্ত্রী— উভয়ই জাভেদকে অপদস্ত করে এবং পরিস্থিতিবিন্যাস জাভেদের বিপর্যস্ততাকেই প্রকাশ করে, তার অসহায়ত্বকেই তুলে ধরে। কিন্তু প্রকাশ করে না যে, এই পরিস্থিতির জনকও স্বয়ং জাভেদ হাসান। বরং অমানবিক, স্বার্থঘনিষ্ট হিসেবে নীতু হয়ে ওঠে আরও স্বচ্ছ। জাভেদ হাসানের মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই মৃতদেহকে নিজ বাসভবনে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয় নীতু। তা অস্বাভাবিকও নয়। বরং খুবই যৌক্তিক। কিন্তু সে মুহূর্তে চাচার কাছে সাবেরি ব্যাথাতুর অভিযোগ জানায়— জাভেদ হাসান শুধু তার মাকেই ডিভোর্স দেয়নি, তার সন্তানদেরও ডিভোর্স দিয়েছে। নীতু সারাজীবন তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ মনোভাব নিয়ে চলেছে বলেই আজও বাবার মৃতদেহ শেষবার তাদের দেখতে দিতে চায় না। আবারও সাবেরির অসহায় কান্নার জন্য অভিযুক্ত হয় নীতু।

ফারুকীর নির্মাণে নীতু চরিত্রের বিকাশ শৈশব থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত এমনভাবে দৃশ্যায়িত হয়েছে যে, নীতুর প্রতিটি কথা, ইচ্ছা, পদক্ষেপ, অভিব্যক্তি জাভেদ, মায়া, সাবেরি ও আহিরের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। জাভেদ হাসানের জীবনের চিরস্থায়ী অমাবস্যা হিসেবে পরিবেশিত হয়েছে নীতু। এ চরিত্রটির সৃষ্টিই হয়েছে মায়া, জাভেদ, সাবেরির সম্পর্কের স্বাধীনতা ও বাঁধন ভেঙ্গে ভিন্ন কোনো মাত্রায় নেওয়ার জন্য। নীতু একটি কারণ যা জাভেদ হাসানের বুদ্ধিমত্তা, সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা, বিবেচনাবোধকে নষ্ট করার জন্য অনেক বেশি শক্তিশালী। মায়ার সংসার ভেঙ্গে ফেলার জন্য যথেষ্ট সক্ষম। সাবেরি—আহিরের জীবনকে এলোমেলো করার জন্য উদগ্রীব। এক নীতু, চারজন ঘনিষ্ট সম্পর্কাবদ্ধ মানুষের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতাবান তাদের সম্পর্ক নষ্টের জন্য, যে একটি সংসারকে ভেঙ্গে বিভক্ত করে দিলো, অথচ চারজন মিলে সেই সংসার রক্ষা করতে পারলো না। সক্ষমতা নীতুর নাকি দূর্বলতা মায়া—সাবেরি—জাভেদ—আহিরের সে প্রশ্ন থেকে যায় চলচ্চিত্র শেষ হওয়ার পরও।

মায়া, সাবেরি ও নীতুর জীবনে জাভেদের ভূমিকা ও চরিত্র বিন্যাসে চলচ্চিত্র জুড়ে মূলত এই টানাপোড়েনই দৃশ্যায়িত হয় যে, জাভেদ সংসার ছাড়ে মায়ার অবহেলা, অবিশ্বাস, অভিযোগপ্রিয় স্বভাবের কারণে। নীতুকে গ্রহণ করলেও পৃথিবী ছাড়তে হয় প্রিয়জন অর্থাৎ সাবেরি—আহিরের অভাব ও দূরত্বে। বিপরীতে মায়ার সংসার ভাঙ্গে নীতুর কারণে। সাবেরি বাবা হারায় নীতুর অশেষ প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাবের কারণে। অর্থাৎ ঘুরে—ফিরে জাভেদ হাসানের জীবনের চরম পরিণতির কারণ মায়া, সাবেরি, নীতু। স্বয়ং জাভেদ হাসান শুধুমাত্র পরিস্থিতির শিকার হিসেবে অসহায় স্বামী, পিতা ও ব্যক্তিরূপে প্রতীয়মান।   

জাভেদের মৃত্যুসংবাদে, নিজের ভাবনাতেই আত্ম—প্রকাশ করে মায়া, সে খুশিই হয়েছে, কারণ জাভেদ আর তখন কারো অধিকারে নেই, নীতুর অধিকারেও না। চোখ বন্ধ করলেই তাই জাভেদকে এখন দেখতে পায় মায়া। ডিভোর্সের পর যতদিন জাভেদ বেঁচে ছিল, সে ছিল নীতুর স্বামী। মৃত্যু জাভেদকে শারীরিকভাবে নীতুর কাছ থেকেও দূরে সরিয়েছে। মায়া তালাকপ্রাপ্ত হলে, নীতুও বিধাবা হয়েছে। এটা ভিন্ন বিষয় যে, জীবিত ব্যক্তিরা মানসিকভাবে নিজ—জীবনে কাকে স্মরণ রেখেছে বা রাখেনি। কিন্তু প্রশ্ন যখন বৈবাহিক চুক্তির এবং যে সমাজে একগামীতাই স্বীকৃত, সেই সমাজে, সেই জীবনে মৃত্যুই একমাত্র সহজ উপায় হয়ে ধরা দেয় বিবাহ—বিচ্ছেদের পর মানসিকভাবে কাওকে ভালোবাসার জন্য, নিজ জীবনে লালন করার জন্য। এর বাহিরে না মানুষের মন উদার হতে পারে, না সমাজ। সেই একই কারণেই বোধহয়, জীবিত জাভেদকে অসংখ্যবার প্রত্যাখান করলেও, দাফনের আগ—মুহূর্তে বাবার প্রাণহীন দেহের কাছে ভালোবাসার প্রকাশ করতেই হয় সাবেরিকে। জীবনের চেয়েও যেখানে অনেক বেশি শক্তিশালী মৃত্যু। আহারে জীবন! 

চলচ্চিত্র শেষ হতে হতে দেখি, জাভেদের মৃত্যু শুধু সাবেরি কিংবা মায়ার অভিমানকেই দূরীভূত করেনি, বরং উভয়পক্ষের দুই সন্তানকে জানাজার এক কাতারে শামিলও করে। মানুষ কি সত্যিই এতো স্বার্থপর, যেখানে শুধুমাত্র মৃত্যুর পর কাওকে ক্ষমা করা যায়, গ্রহণ করা যায়, জীবিত অবস্থায় যাকে গ্রহণ বা ক্ষমা করা যায়নি। সত্যিই কি মৃত্যু সম্মান ফিরিয়ে দেয়? নাকি স্বার্থঘনিষ্ট সম্পর্কগুলো মৃত্যুর পর জাভেদকে গ্রহণ করতে পারে কারণ, জাভেদ তখন আর কারো একক ব্যক্তি—স্বার্থ পূরণেই সক্ষম নন। কোনো একক ব্যক্তি—অধিকৃত নয়। ফারুকী কি সেই সত্যই বলে যেতে চেয়েছেন তার ডুবে যাওয়া বিভিন্ন সম্পর্কের রূপায়ণের মাধ্যমে।  

লেখক: শিক্ষক, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন