প্রবন্ধ: কবি আল মাহমুদ: তৌফিক আহমেদ সজীব

0

ছবি: ফেসবুক

রবীন্দ্র প্রভাবে যখন কবিদের মাঝে ঘুরেফুরে একই ধারার শব্দ ব্যবহারে শব্দের জীর্ণতা চলে এসেছে, অন্যদিকে বোদলেয়ারি প্রভাবে পাশ্চাত্যর অন্ধ অনুকরণে যখন আধুনিকতার নামে কবিদের লেখায় জগাখিচুড়ি অবস্থা তখন আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করে কবিতায় নিজস্বতা তৈরি করে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন যে কবি তার নাম আল মাহামুদ। পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহামুদ। জন্ম ব্রাক্ষণ বাড়িয়ায়। তার এলাকায় কবিতা লেখাকে বলা হত দুর্লভ গুণ। শহর থেকে আসা পত্রিকায় কবিতা দেখে দেখে আল মাহামুদের মনে হতো তিনিও পারবেন। সেই থেকে শুরু। দুর্লভ গুণকে আয়ত্তে আনবার চেষ্টা। কবিতার পথে পথচলা। নিরন্তর।।

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে পাজামা, খদ্দেরের পাঞ্জাবি আর বগলের নিচে ফুলতোলা বাক্সের ভেতর নদী, গাছপালা, নর নারী, প্রকৃতি ও নৈসির্গকতা নিয়ে ঢাকায় আসেন তিনি। তার সমসাময়িক তরুণদের বাহুর ভাঁজে শোভা পেতো তখন ইউরোপিয়ান কবিদের সিলেক্টেড পয়েমস। আলগা সে সকল ভাব নিয়ে তারা সকলে ঝরে গেছেন। তার ফুলতোলা বাক্সের ভেতরের সরলতা নিয়ে তিনি থেকে গেছেন। হয়ে উঠেছেন বাংলা সাহিত্য আধুনিক কবিদের প্রথম সারির একজন।

প্রথম প্রথম তিনি পয়ার ছন্দে কবিতা লিখতেন। মধ্যযুগীয় প্রণয় উপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এসবের প্রভাব কবিতা কাঠামোয় প্রচুর। আট ছয় মাত্রার অক্ষর বৃত্ত স্টাইলে প্রথম চরণের সাথে তৃতীয় চরণ দ্বিতীয় চরণের সাথে চতুর্থ চরণের মিল রেখে কবিতা। পয়ার ছন্দের কবিতা গুলোই প্রথম পত্রিকায় ছাপা হয়। মাঝে মাঝে কিছু সনেটও লিখতেন। তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ লোক লোকান্তর পয়ার কবিতা মালার সমষ্টি। নিজস্ব আংগিকে ফুটিয়ে তোলেন প্রকৃতি, প্রেম, যৌন আবেদন, মানব মনের ভেতরকার আলোড়ন। তবু মনে হয় কিছু একটা নেই কবিতায়। ছন্দের ভেতর আটকে যাচ্ছে ভাব। ছন্দ আর ভাবের সাথে দ্বন্দ কাটিয়ে ছন্দ থেকে বের হয়ে এসে প্রকাশ করেন তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কালের কলস। প্রথাগত কোন ছন্দ নয় আধুনিক গদ্য কবিতাও নয়। নিজস্ব ভংগিমায় বোধের উপস্থাপন। প্রার্থনার শব্দমালা যেন বের হয়ে আসে কবিতা থেকে বর্ষণধারার মতন। তীব্র অথচ মাটির কাছে এলে কোমল। লোক লোকান্তর কাব্যগ্রন্থ যদিও তাকে প্রথমসারির বাঙালি আধুনিক কবিদের কাতারে নিয়ে যায়। কালের কলস কাব্যগ্রন্থটি তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়।।

আমরা যেখানে যাবো শুনেছি সেখানে নেই

বাঁচার মতো জল, জলস্রোত, বর্ষণ হবেনা

নি-পাখি ভীষণ নীল দগ্ধদেশে উদ্ভিদহীনতা

হাহা করে দিনমান। বাতাসের বিলাসী বিরোধে

বিহঙ্গ বিব্রত হয়, সূর্য থাকে সর্বদা মাথায়

নিঃশব্দে চলতে হয় রুদ্ধশ্বাসে, অসহ্য গরম

ভেদ করে অন্ত্রনালী, গাত্রবর্ণ কালো হয়ে যায়,

জ্বরের লক্ষণ ফুটে ওঠে সর্বাঙ্গে তখন।

আমরা ক’জন এই সমান বয়সী সহোদর

যাইনি নদীর পথে জল দেখে ভয় লাগে বলে

তরলে তর্পণহীন চিরদিন তৃষ্ণার্ত থেকেছি

তরণী বোঝাই তাই নিলেন না গম্ভীর পাটুনী

শস্যের উদ্বৃত্ত আঁটি পড়ে আছি ডাঙ্গার ওপর

আমরা প্রতীকহীন হাতে কোন পতাকা নিইনি

আমাদের সঙ্গে এক বাউলের বিধবা যাবেন

উষ্ণ বয়সীনি এই বঙ্গ নাম্নী বৈষ্ণবটি ছাড়া

তৃষ্ণার রাস্তায় আর কোন যুবতী যাবেনা।

জল দেখে ভয় লাগে,কালের কলস।।

তবে তার সেরা সৃষ্টি হলো সোনালি কাবিন। চৌদ্দটি চতুর্দশপদী কবিতা সহ বেশকিছু কবিতা নিয়ে এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। এই কাব্যগ্রন্থটি তাকে বাংলা সাহিত্য অমরতা দান করেছে। ছন্দ ও ভাবের প্রগাঢ় মিলনে কবিতা যেন কোন দৈব ব্যাপার। সনেট বাদ দিলেও এ গ্রন্থের কবিতাগুলো কবি জীবনের চূড়ান্ত সৃষ্টি। গ্রামীণ জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হঠাৎ নাগরিক বনে যাওয়ার বিরানবিশ্বে প্রবেশের টানাপোড়ন ও আক্ষেপ তার এ কাব্যগ্রন্থে বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে । সোনালি কাবিন সনেটমালার একাংশ;

সোনার দিনার নেই, দেনমাহর চেয়ো না হরিণী

যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,

আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি

আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;

ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,

ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি;

দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন

আমার তো নেই সখী, যেই পণ্যে অলংকার কিনি।

বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল

পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না;

তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিয়ো সেই ফল

জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা

পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;

দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা

ব্যক্তিজীবনের শুরুতে তিনি ছিলেন বাম ধারার অনুসারী। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে জাসদের কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের মাঝে তিনিও গ্রেফতার হন। একবছর তাকে জেলে থাকতে হয়। এ সময় তার স্ত্রী তাকে একটি কোরআন মাজীদ পড়বার জন্য দেন। জেলখানার ভেতরে কোরআন মাজীদ পড়বার সময় তার ভেতর অভাবনীয় পরিবর্তন আসে। তার মাঝে ধর্মীয় উপলব্ধির জন্ম নেয়। জেল থেকে বের হয়ে তার সাহিত্য নির্মাণেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ নিয়ে সমসাময়িকদের কাছে তীব্র সমালোচনার শিকার হন তিনি। পরিবর্তনের উদাহরণ হিসেবে কিছু পংক্তিমালা দেয়া প্রয়োজন।

মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে

মনে হয় রক্তেই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি

আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে ডেকে উঠি……

এখানে অনেকে দাবি করেন কবিতার মাঝে জেহাদ শব্দ ঢুকিয়ে কবি অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন। তবে এখানে জেহাদের বদলে যদি বিপ্লব বিপ্লব বলে জেগে ওঠার কথা কবি লিখতেন, তাহলে বাহবা পেতেন নিশ্চিত। অনান্য সমসাময়িকরা তার যে ধর্মীয় সংকীর্ণতার কথা বলেন, আল মাহামুদ কবিতাকে ধর্মের সীমারেখার মাঝখানে টেনে ধরেছেন এ অভিযোগ তোলেন, তারা নিজেরাও মূলত একই সংকীর্ণতায় ভোগেন। বিপ্লব, প্রেম, প্রকৃতির মাঝে কবিতাকে কি তারা সীমাবদ্ধ করে ফেলেন না?

তবে ব্যক্তি জীবনে মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন সুবিধা বাদী। রাজনৈতিক ছায়ায় ছায়ায় তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন জীবন। তেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও পরিচালক হতে পেরেছিলেন শিল্পকলা একাডেমীর। জামাতের সাথে সংশ্লিষ্টতারও গুঞ্জন রয়েছে। এর জন্য পরবর্তীতে তাকে ভুগতেও হয়েছে বেশ। কবি হিসেবে হতে হয়েছে একঘরে। তবে আমরা কবি হিসেবে তার জীবন দেখবো। তার বিরুদ্ধে যে যতো কথাই বলুক। তার কবিতার কাছে যেয়ে সবাইকে নত হয়ে যেতে হয়। রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে অনেকেই তো ছিলেন বামপন্থার অনুসারী, তাদের কেউ কি লিখতে পেরেছেন আল মাহমুদের মতো:

“আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,

পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,

এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ

যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ

কবি আল মাহামুদকে অনেকেই অস্বীকার করতে চান। একঘরে করে ফেলতে চান। তাকে অস্বীকার করতে গেলে বাংলা সাহিত্যর এক অংশকে অস্বীকার করতে হয় পুরোপুরি। কবি প্রতিভা তার মাঝে ছিলো প্রাকৃতিক। অভিজ্ঞতা, ভাষা ও বোধ তিনটির সমন্বয়ে হয় একটি যথার্থ কবিতা। তার কবিতায় তিনটির বাইরেও ছিলো যেন অন্যকিছু। দৈব আলৌকিক কোন ব্যাপার। দীর্ঘদিন সমালোচনার শিকার হয়ে প্রায় আশি বছরের ক্লান্তি চোখে নিয়ে অবশেষে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ২০১৫ সালে। তার কবিতা কবুল হয়েছে যেন তার প্রার্থনারই মতো। তার মৃত্যু হয় এক চমৎকার শুক্রবারে;

কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে

মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;

অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে

ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন