তৌহিদুর রহমান তুহিন।। প্রবন্ধ।। বাংলা উপন্যাসে জেলে জীবন ও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

0

আর্টওয়ার্ক: নগরবাসী বর্মন

“বিদ্যার চেয়ে ক্ষুদার দেবীর আনাগোনা বেশী”- এই প্রবাদটি জেলে সমাজে খুবই প্রচলিত। যেখানে দারিদ্র ও প্রকৃতির সঙ্গে নিয়মিত যুদ্ধ করে বাঁচতে হতো। প্রান্তিক জেলে সমাজের একটা বিশাল অংশ এখনো দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। তাদেরকে নিয়মিত সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়, নতুন দিনের স্বপ্ন দেখতে হয়। যার ফলে সেখানে জন্ম নেয় নানা ঘটনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এক মিলনমেলা। যুগে যুগে সাহিত্যিকরা তাদের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে জেলে জীবনের নানা ঘটনার পথ-পরিক্রমা। বাংলা সাহিত্য জেলে সমাজের বিশাল জীবন আলেখ্য বিস্তৃত পাঠককে জানার সুযোগ করে দিয়েছে।

জেলে সমাজ ব্যবস্থা বা জীবন ধারা নিয়ে যে কয়জন লেখক বিখ্যাত তাদের সৃষ্টি কর্ম দিয়ে তারা হল- মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’, ঘনশ্যাম চৌধুরীর ‘অবগাহন’, হরিসংকর জলদাসের ‘জলপুত্র’ ইত্যাদি। একটি বিষয় আলোকপাত না করলেই নয় যে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এবং ‘জলপুত্র’ উপন্যাসের লেখক দুজনের জেলে পরিবার থেকে উঠে আসা। তারা তাদের উপন্যাসে দেখিয়েছে জেলে সমাজের নিরেট বাস্তবতা। নদী-জীবনের রূঢ় বাস্তবতার নিখুঁত অবলোকন তারা সামনে নিয়ে এসেছে।

প্রতিটি জেলে ভিত্তিক উপন্যাসে কিছু বিষয় বারবার সামনে এসেছে তা হল অশিক্ষা ও শোষণের হাহাকার। যে বয়সে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সময় সেই সময়ে তারা তাদের পরিবারকে সাহায্য করতে অন্য সদস্যদের সাথে মাছ ধরতে বের হয়। তবে তাদের মধ্যে শিক্ষার এক বিশাল আগ্রহ জন্মে । তাদের পিতা-মাতারা চায় তাদের সন্তান শিক্ষিত হোক কিন্তু অভাবের তাড়নায় তা আর হয়ে উঠে না। বালক বয়সেই জাল ও জল এর সাথে সম্পর্ক গড়তে হয়। অন্যথায় তাদের অধিক সদস্যের পরিবারের জীবন যাপন কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। অনেকটা বাধ্য হয়েই শিক্ষাকে বিসর্জন দিতে  হয় তাদের। তবে ‘দহনকাল’ উপন্যাসে শিক্ষায় অংশগ্রহণের এক তুমুল চিত্র ফুটে উঠেছে। উপন্যাসের ভাষায় বাপ রাধানাথ ছেলের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। ছেলে বাবার হাঁটার সাথে তাল মেলাতে পারছে না তারপরেও ছুটছে। ‘জলপুত্র’  উপন্যাসে লেখক অন্যতম চরিত্র ‘গঙ্গা’ কে পড়াশুনায় আগ্রহের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তার হাই স্কুলটি ছিল প্রায় চার মাইল দূরে। সেখানে উল্লেখিত গঙ্গার মা ‘ভুবনেশ্বরী’, তিনি কখনো চান নি তার সন্তান সমুদ্রে মাছ ধরুক কেননা মাছ ধরতে গিয়েই গঙ্গার বাবা চন্দ্রমণি হারিয়ে গেছে। তাই ‘ভুবনেশ্বরী’ তার পরিবারের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হারাতে চায় নি।

পদ্মানদীর মাঝিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে কুবের, মালা, সেতলবাবু কিংবা কপিলা। সেখানে লেখক জেলে জীবনের কুটচাল থেকে শুরু করে জীবনের রুঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে পাঠককে। গঙ্গা উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র হল হিমি, বিলাস, পাচু, নিবারণ। সেখানে বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরার সময় জেলে জীবনের নানা ঘটনা অকপটে উল্লখ করেছেন। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দ, বোধাই মালো, জমিলা, দীননাথ- এদের মাধ্যমে লেখক কিছু সামাজিক সমস্যার পাশাপাশি হাসি, কান্না এবং তাদের অপ্রকাশিত অংশ রন্ধ্রে রন্ধ্রে দেখিয়েছে।

‘গরিবের মধ্যে সে গরিব, ছোটলোকের মধ্যে আরও বেশি ছোটলোক’ মানিক বন্দপাধ্যায় যেন এই লাইনের মাধ্যমে পুরো জেলে জীবনের বাস্তবতা সামনে নিয়ে এসেছে। একজন মানুষ কত অভাবি হলে সে গরিবের মধ্যে গরিব হতে পারে- তা আমাদের ভাবতে হবে। জেলে সমাজ ব্যবস্থায় এখনো সংকীর্ণতা কে সঙ্গে করে জীবন যাপন করছে- যার মূলে রয়েছে বর্ণ, সম্প্রদায় প্রথা। সেখানে কৈবর্ত বা জেলে সমাজকে দেখা হয় নিন্মশ্রেণীর সম্প্রদায় হিসেবে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তার উপন্যাসে অভাব-অনটন কে বাস্তবতার নিরিখে প্রকাশ করেছে। উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র- আর্থিক অনটনে ক্লিষ্ট দুই ভাই গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ বিজয় নদীর তীরে বাস করত। কিন্তু গৌরাঙ্গের বউ অনাহারে মারা গিয়েছিল।

‘ঈশ্বর থাকে ঐ গ্রামে, ভদ্র পল্লীতে- এখানে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর’। কেননা পল্লীতে জন্মে কখনো আনন্দ হয় না, রোগে-শোকে কাটাতে হয় জীবন সায়াহ্ন, বর্ষায় জল তাদের ঘরে প্রবেশ করে, কালবৈশাখী এসে তাদের আবাস স্থল চুরমার করে দেয়। এতদ সত্যেও তাদের জায়গা হয় না জেলে পল্লীতে মহাজন-জোতদার-বহদ্দার দের কাছে। সেখানেই যত শান্তি- আর এতেই জেলেদের অন্তর থেকে বের হয়ে আসে আক্ষেপ।

বঞ্চনার ইতিহাস, শোষণ, ত্রাস- এগুলো যেন জেলে পল্লীর সাথে অবিচ্ছেদ্য অংশ্য হয়ে দাড়িয়েছে। প্রতিটি উপন্যাসেও রয়েছে তার সামগ্রিক কার্যক্রমের হয়ত কিছু অংশ। জেলে সমাজের বা জেলেদের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয় কখনো মহাজন কিংবা তার রক্তচক্ষু, কখনো উত্তাল নদী কিংবা সমুদ্র। তবে জলের প্রতিপক্ষের চাইতে বহুলাংশে ভয়ংকর রুপ ধারণ করে স্থলের প্রতিপক্ষ। এখানে জেলেরা তাদের প্রাপ্য পাওনা নিয়ে আশা হারায় আবার মহাজনদের কাছে তাদের পরম স্বপ্নকেও হার মানাতে হয়।

জাল এবং জল- এই নিয়েই জেলে জীবনের সমগ্র জীবন আলেখ্য। তাদের জীবন সংগ্রামে ভরপুর। এক মুহুর্ত ঠাই নেই স্থির থাকার। প্রকৃতির নিজস্ব ভুবনে তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময় প্রতিবাদী। ‘গঙ্গা’-র বিলাস চরিত্র থেকে ‘জলপুত্র’-র গঙ্গা , তারা কেউই অন্যায়ের সাথে আপোস করে নি। তারা একেক জন ছিল জেলে সমাজের সাহস। কিন্তু সেই সাহসই তাদের জীবনে কাল হয়ে যায়, হতে হয় রক্তচক্ষুর মুখোমুখি। জলপুত্র উপন্যাসে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে- ‘গঙ্গা দাঁড়িয়ে জেলেদের অসহায়ত্বের কথা, বেশী সুদে শুক্কুর শশিভূষণের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার কথা, গেল বছর কামিনীর অপমানিত হওয়ার কথা ঘুছিয়ে বলল’। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে তাদের বিচার কোন কাজে আসে না। ফলে গঙ্গা সবাইকে উদ্দেশ্য করে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘যার কাছত্তোন সাহায্য পাওনর কথা, হেই চেয়ারম্যান যখন সাহায্য নো গইল্য, তখন আরার অধিকার আরাত্তোন আদায় গরি লওন পড়িবো’ । কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না জেলেদের, তারা কখনো তাদের উদ্দেশ্যে সফল হতে পারে না মহাজনদের কূটচালের কারণে। সে কারণে গঙ্গাকেও মৃত্যু দিয়ে তাদের অধিকার সচেতনতার সমাপ্ত হয়। কিন্তু জেলে সমাজ আবার স্বপ্ন দেখেতে শুরু করে, অন্য কেও আবার জন্ম নিবে, আবার তারা অধিকার নিয়ে কথা বলবে।

জেলে সমাজে বিভিন্ন ধরণের কুসংস্কার রয়েছে যা তারা তাদের নিজস্ব আচার হিসেবে মনে করে। তাদের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত এইসব কুসংস্কার কে আরও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ধরতে সাহায্য করে। যার কিছু অংশ বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায় বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে।

জেলে পারায় যেমন রয়েছে অতি দরিদ্র, সহায় সম্বলহীন জেলে তেমনি রয়েছে স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষও। তারা অন্যদের তুলনায় সচ্ছল। তাদের জীবন-যাপন অন্যরকম। তাদের নৌকা আছে, ছোট বড় নানান রকমের জাল রয়েছে, রয়েছে বড়শি বাওয়ার নানা রকম সরঞ্জাম। তাদেরকে কখনো বলা হয় মহাজন, উত্তর পতেঙ্গায় বলা হয় বহদ্দার। তারা প্রান্তিক জেলেদের বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে মাছ ধরতে পাঠায় এবং বিনিময়ে যা পায় জেলেরা তা যথসামান্য।

ভালবাসা প্রতিটি সমাজের একটি অন্তর্নিহিত অংশ। জেলে সমাজ যার বাহিরে যেতে পারেনা। বাংলা সাহিত্যে লেখকগণ প্রেম-ভালবাসা অতি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছে। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ তে কুবের ও কপিলার আদিম প্রেম দেখিয়েছে, গঙ্গা উপন্যাসে সমরেশ মজুমদার ‘হিমি ও বিলাস’ এর নিখাদ প্রেম দেখিয়েছে। ভালাবাসায় মত্ত বিলাস হিমির জন্য তার এই আহ্বান ‘এই তেঁতলে বিলাসকে তুমি যা দিয়েছ, তা আর কেউ কাড়তে পারবে না, সে যে মহারাণীর দান গো, মহারাণীর দান। আমার প্রাণ জুড়িয়েছ তুমি, জুড়িয়েছ বলেই আমি সমুদ্রে যাব।’

মৃত্যু এবং অস্তিত্বের সংগ্রাম জেলে সমাজকে সারাক্ষণ এক অস্তিরতার মধ্যে রাখে। প্রতিটি পরিবারকে বাঁচতে হয় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে- যাদের অধিকাংশ হারিয়ে যায় মাছ ধরতে গিয়ে। জেলে সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে যে- যখন মাছ ধরতে গিয়ে কেউ নিখোঁজ হয়, তার পরবর্তী ১২ বছর পরিবার থেকে তাকে মৃত বলে গ্রহণ করা হয় না। তখন সে কেবলই নিখোঁজ। এখানে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে- পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রিয় মানুষকে ফিরে পেতে কতটা আশাবাদী। কখনো কখনো কোন সদস্য ফিরে আসে কিন্তু অধিকাংশ সময় আশায় গুরেবালি। তখন তাদের জীবন কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থার শোচনীয় অবস্থার করুণ প্রকাশ পায়।

তবে শ্রাবণ মাস জেলেদের জীবনে অন্যতম সুখের মাস। এই মাসেই জেলেদের জালে উঠে নানা রকমের মাছ। হরিসংকর জলদাস তার উপন্যাসে এই বিষয়টি অত্যন্ত গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করেছে। তিনি উল্লেখ করেছেন- দুর্দিনের দারিদ্র্যের যন্ত্রণা তারা শ্রাবণ মাসে তোলে। আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন এই চার মাস জেলে পরিবারে ভাত থাকে, পরনে নতুন পোশাক থাকে, মুখে হাসি থাকে। আর বাকি আট মাস তাদের খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটে। যা জেলে সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার নির্মম বাস্তবতা ফুটে উঠেছে।

পাশাপাশি নারী সংগ্রাম জেলে উপন্যাসে খুবই গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত হয়েছে। নারী সংগ্রাম যেন প্রতিটি জেলে সমাজের অবর্ণনীয় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবারের সকল দায়িত্ব নারীদের পালন করতে হয়, কারণ পুরুষরা মাছ ধরার তাগিদে তাদের দিনের অনেকটা অংশ নদীতে কাটাতে হয়। আবার যেসব জেলে সমুদ্রে যায় মাছ ধরতে তারা কখনো সপ্তাহ থেকে তিন মাস পর্যন্ত সমুদ্রে থাকে। এই সময়ে পরিবারের সকল দেখাশোনা নারীদের করতে হয়। বিশেষ করে যেসব জেলে মাছ ধরতে গিয়ে আর না ফিরে তাদের পরিবারের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থা ধারণ করে। উপন্যাসের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে নারীরা মাথায় মাছের আটি রেখে গ্রামে গ্রামে মাছ বিক্রি করছে। যা থেকে যতসামান্য লাভ হয়, এতে করে তাদের জীবন সংগ্রাম পরিচালনা দুর্বিষহ হয়ে উঠে।

বাংলা সাহিত্যে জেলে সমাজ নিয়ে কাজ হয় হাতে গোনা। ইট পাথরের জীবন ধারা নিয়ে কিংবা গ্রামীণ মধ্যবিত্ত সমাজ নিয়ে সাহিত্যে যতটুকু আলো ছড়িয়েছে ঠিক তেমনি ভাবে জেলে সমাজ অনেকটা অন্ধকারে রয়ে গিয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিভিন্ন চরিত্র। কিন্তু সামগ্রিক নদী কেন্দ্রিক বা সমুদ্র উপকূল কেন্দ্রিক জেলে সমাজ তাদের সাংস্কৃতিক, সমাজ প্রকৃতি ও জীবন ধারা বাংলা সাহিত্যে আলোচনা-র অন্যতম দাবীদার।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন