তাহমিনা রহমান।। প্রবন্ধ।। স্মরণীয় বরণীয় – আনন্দমোহন বসু

0

আর্টওয়ার্ক: নগরবাসী বর্মন

 ১৭৬০-১৮৪০ খ্রিঃ পর্যন্ত চলমান শিল্পবিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন বিস্ময়কর ভাবে গতিশীল তখন অধিকৃত ভারতীয় উপনিবেশে স্থানীয় শিল্পের পতন ঘটেছে, এমনকি স্বাধীন ভাবে অর্থনীতি নির্ধারনের সুযোগ পর্যন্ত নেই। এমনই এক দুঃসময়ে ১৮৪৭  সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আনন্দমোহন বসু জন্ম গ্ৰহণ করেন বাংলাদেশের বর্তমান কিশোরগঞ্জের ইটনা থানার জয়সিদ্ধি গ্ৰামে । এর বহু পরে জন্ম নিয়ে সুকান্ত লিখেছিলেন  — 

       অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি

       জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি।

কিন্তু আনন্দমোহন কবি ছিলেন না তবে ভাবুক ছিলেন। তাঁর ভাবনা জুড়ে ছিল স্বদেশ। 

তিনি দেখেছেন একটি সমাজে কিভাবে শ্রেণীবৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে কৃষকের জমির মালিকানা তুলে দেয়া হয়েছে খাজনা আদায়কারী জমিদারদের হাতে। অর্থাৎ এক শ্রেণী শোষণ করবে আর এক শ্রেণী হবে শোষিত। এক শ্রেণী বিলাসবহুল জীবন যাপন করবে আর এক শ্রেণী কপর্দকহীন অনাহারে অর্ধাহারে কোন ভাবে বেঁচে থাকবে। ধনীক শ্রেণীর কাছে বিকাবে তাদের শিল্প কারখানায় উৎপাদিত পণ্য। এভাবেই বাড়বে পুঁজি , বাড়বে ব‍্যবসা বানিজ্য।

তিনি দেখেছেন একটি অশিক্ষিত, অন্ধকার, কুসংস্কার নিমজ্জিত সমাজ যেখানে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ, জাতিতে জাতিতে বিরোধ,ধর্মে ধর্মে,বর্ণে বর্ণে বিরোধ।  

তিনি দেখেছেন প্রতিবাদের ভয়াবহ পরিণতি । ১৮৫৭ সালের সিপাহী যুদ্ধ ,কৃষক সন্তানদের প্রবল প্রতিরোধ দেখেছেন এবং তাদের করুন পরিনতিও দেখেছেন।দেখেছেন বিদ্রোহ দমনের নামে নিরপরাধ নরনারী , শিশু বৃদ্ধদের নির্বিচারে হত‍্যাযজ্ঞ। দেখেছেন বিচারের নামে প্রহসন।

 বালক বয়সে পিতৃহারা হয়ে তিনি দেখেছেন সামাজিক আচারের নামে মমতাময়ী মায়ের শারীরিক এবং মানসিক হেনস্থা।

 উচ্চ মেধাসম্পন্ন আনন্দমোহন বুঝতে পেরেছিলেন এই দুর্দশাগ্রস্ত সমাজের জন্য কিছু করতে হলে সর্বাগ্ৰে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে, যোগ্য করে তুলতে হবে নিজেকে। তিনি তাই করেছিলেন।

আনন্দমোহন পাঠ‍্য ব‌ইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে শুরু করেন একেবারে স্কুলজীবন থেকেই। প্রতি ক্লাসে মেধার স্বাক্ষর রেখে স্কুল-কলেজ জীবন সম্পন্ন করেন এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। কিন্তু তাঁর জীবনের লক্ষ্য অন‍্যত্র।

তিনি উচ্চশিক্ষার প্রয়াসে- প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন এবং ক‍্যামব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তির উদ্দেশ্যে দেশ ত‍্যাগ করেন। দেশ ত‍্যাগের আগে তিনি ব্রাহ্মবাদে দীক্ষা নেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে বিদ‍্যমান কুসংস্কার দূর করা ছিল তার জীবনের  অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার।

ক্রাইস্ট কলেজ থেকে গণিতে নবম স্থান অর্জন করেন এবং তিনি ভারতবর্ষের প্রথম র‍্যাংলার হ‌ওয়ার গৌরব অর্জন করেন। পাশাপাশি তিনি আইন বিষয়েও ডিগ্ৰী অর্জন করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি জনসমক্ষে অনর্গল কথা বলার অনুশীলন করতেন। তিনি ইউনিভার্সিটি ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এবং নিয়মিত বিতর্কে অংশ নিতেন। সেখানেও তিনি পেয়েছিলেন তার‌ই মতো যোগ্য এবং সাহসী একমাত্র ভারতীয় সহপাঠী সৈয়দ মাহমুদকে।

তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন বহু উঁচু মানের অধ্যাপক এবং বিভিন্ন পার্টির নেতাদের। তিনি তাদের সাথে এতটাই ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিলেন যে তারা তাকে মেম্বার ফর ইন্ডিয়া ভাবতে শুরু করেন।

পাঁচ বছর ইংল্যান্ডে অবস্থান কালে তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন ব্রিটিশ নারী মিস সুফিয়া ডবসান কলেটকে । সুফিয়া ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের এক অকুণ্ঠ, উদ্দীপনাদীপ্ত প্রচারক। উভয়ের উদ্দেশ্য এবং মানসিকতা অভিন্ন হ‌ওয়ায় পরস্পর পত্রযোগাযোগ ছিল নিয়মিত।সুফিয়া এই সব পত্র সযত্মে সংরক্ষণ করেছিলেন বলেই পরবর্তীতে আনন্দমোহন বসুর জীবন বৃত্তান্ত লেখা অনেকাংশে সহজসাধ‍্য হয়েছিল।

ইংল্যান্ডের লিবারেল পার্টির খ‍্যাতিমান নেতা প্রফেসর হেনরি ফসেটের সাথে তার সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল বন্ধুতুল‍্য।আনন্দমোহন প্রায় সময়ে তাকে সঙ্গ দিতেন এমনকি নেতার অনুপস্থিতিতে তিনি ফসেটের পক্ষে বক্তব্য রাখার‌ও অনুমতি পেয়েছিলেন।এভাবেই তিনি ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব‍্যবস্থাপনা রপ্ত করে নিয়েছিলেন। দেশে ফেরার আগে তিনি ইংল্যান্ড ও ওয়েলস এর বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করেন। অতঃপর তিনি ১৮৭৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ড ত‍্যাগ করেন। ফেরার পথে তিনি কয়েক সপ্তাহ ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও ইতালিতে কাটান। ইতালিতে তিনি রোম, মিলান‌‌ ও নেপলস ভ্রমণ করেন।

রাজধানী কলকাতায় ফিরে এসে জনসাধারণের সান্নিধ্য পাওয়ার লক্ষ্যে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। তখন থেকেই শুরু হয় জনসেবামূলক বহুমুখী কর্মজীবন । তাঁর কর্মকাণ্ড বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হলেও সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল ভারতবর্ষে একটি কুসংস্কারমুক্ত প্রগতিশীল উন্নত সমাজ গঠন। প্রথমেই ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে – স্টুডেন্ট’স এসোসিয়েশন নামে একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন ১৮৭৫  সালে। পরের বছরই  ১৮৭৬ সালে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান – ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। এক‌ই সময়ে নারী শিক্ষার উন্নয়নে কলকাতায় — বঙ্গমহিলা বিদ‍্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের প্রথম নারী চিকিৎসক কাদম্বিনী বসু এই বিদ‍্যালয়ে অধ‍্যয়ন কালে সরকারের বিশেষ প্রস্তাবে বিলুপ্ত প্রায় বেথুন স্কুলটি এর সাথে একীভূত হয়। কাদম্বিনীর কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রান্স পাস করায় বিদ্যালয়টি মহাবিদ‍্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।

রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত আদি ব্রাহ্মসমাজ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের  তত্ত্বাবধানে থাকা কালে পরস্পর মতবিরোধ দেখা দেয় এবং কেশবচন্দ্র সেন ভারতীয় ব্রাহ্ম সমাজ নামে পৃথক সমাজ গঠন করেন।পরবর্তীতে স্বয়ং কেশবচন্দ্র সেন গঠণতন্ত্র উপেক্ষা করে নিজের নাবালক কণ‍্যাকে কোচবিহারের নাবালক মহারাজার সাথে বিয়ে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অন্য সদস্যদের দ্বারা পরিত্যক্ত হন।অবশেষে সর্বসম্মতিক্রমে ১৮৭৮ সালে আনন্দমোহন বসু সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ নামে পৃথক সমাজ গঠণ করেন। ধর্মকে তিনি বাস্তব কর্মজগতের সাথে সম্পৃক্ত করে বলেছেন – আরাধনা কর এবং কাজ কর।

ব্রাহ্ম সমাজ নিষিদ্ধ করেছে বাল‍্যবিয়ে এবং হিন্দু বিধবাদের যথাসম্ভব বিয়ের ব‍্যবস্থা করেছে ।এছাড়া এটি একেশ্বরবাদ ও অযৌক্তিক ধর্মীয় আচার ও পীড়নমূলক ধর্মীয় বিধানকে নিরুৎসাহিত করেছে।

আনন্দমোহন এক‌ই সময়ে অর্থাৎ  ১৮৭৮  সালে  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের ফেলো নির্বাচিত হন। এসময়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক যুগান্তকারী বিষয় সংযোজন করেন। যে প্রতিষ্ঠানটি শুধু মাত্র পরীক্ষা গ্ৰহনকারী প্রতিষ্ঠান ছিল সেখানে শিক্ষাপ্রদান বা পাঠদান কর্মসূচি সংযুক্ত করেন।

১৮৭৯ সালে তিনি কলকাতায় সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।এরই ধারাবাহিকতায়  ১৮৮৩  সালে ময়মনসিংহে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে সিটি কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।  ১৯০১  সালে এক‌ই স্থানে ময়মনসিংহ সিটি কলেজ স্থাপন করেন।  ১৯০৮  সালে স্থানীয় গন‍্যমান‍্য ব‍্যক্তিবর্গের বিশেষ উদ্যোগে এটি আনন্দমোহন কলেজ নামে কাঁচিঝুলিতে বিশাল আয়তনের জমির উপর পুনঃস্থাপিত হয়।

ভ্রাহ্ম সমাজ ছিল তার সৎকর্ম এবং কর্মোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত মানব সম্পদ তৈরির কারখানা সরূপ।তিনি ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাগনের‌ও একজন ছিলেন।

আনন্দমোহন বসু  ১৮৮২  সালে শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। এসময়ে অপেক্ষাকৃত উদার লর্ড রিপন অত্যন্ত যুগোপযোগী এবং সার্বিক জনমতের ভিত্তিতে বেশ কিছু নির্দেশনা প্রনয়ণ করেছিলেন যা ছিল চলমান শিক্ষাকার্যক্রম অপেক্ষা উন্নত।আনন্দমোহন ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাসে এই  হান্টার কমিশনের সদস্য হিসেবে আন্তরিক ভাবে কাজ করছেন এবং একটি অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাযুগের সূচনা করেছিলেন।

আনন্দমোহন বসুর আজীবনের লালিত‍ সুপ্ত বাসনা ছিল উপনিবেশে ব্রিটিশ সরকারকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করা। তিনি দেশে ফিরে কালবিলম্ব না করে ইংল্যান্ডের আদলে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন এবং অত্যন্ত ফলপ্রসূ ভাবে সমস্ত ভারতবর্ষে এর শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সমাজের মধ‍বিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তরাই ছিল তাঁর দলের উল্লেখযোগ্য সদস্য।কৃষক শ্রেণীকে নামমাত্র চাঁদার বিনিময়ে তিনি দলের সদস্য করে নিয়েছিলেন কারণ তিনি কৃষকদের শক্তি সম্পর্কে অবগত ছিলেন।

রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে।যেমন:  ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহনের বয়সসীমা কমানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভার্নাকুলার প্রেস এক্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন , ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন  এছাড়া মধ‍্যবিত্তের অধিক সংখ্যক চাকুরির দাবী ( সিপাহী বিদ্রোহের পর কৃষক সন্তানদের ম‍ধ‍্যে চাকুরী প্রার্থীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল) বানিজ‍্যে সংরক্ষণ নীতি ও দেশী শিল্পের বিস্তারের দাবী , ব‍্যয়বৃদ্ধি ও করবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সর্বোপরি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের দাবী  ইত‍্যাদির মাধ্যমে শাসনযন্ত্রে অধিকতর কর্তৃত্ব লাভ রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

দেশী ভাষার সংবাদপত্রগুলো এই সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ফলাও করে প্রচার করতে থাকায় সরকারের টনক নড়ে যায়। বিভিন্ন গ্ৰুপের পরামর্শে কট্টরপন্থী লর্ড লিটন দেশী ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন । এই কালা কানুনের বিরুদ্ধে ব‍্যপক আন্দোলনের এক পর্যায়ে  ১৮৭৮ সালের  ২৩  জুলাই এটি বাতিল করা হয়।

এছাড়া ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ সরকারের ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের বয়সসীমা  ২১  থেকে  ১৯  বছর করার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল যেন অপেক্ষাকৃত দূর্বল

ভারতীয়রা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারে।শুধু তাই না বর্ণবৈষম্য এতটাই ব‍্যপক হয়ে উঠেছিল যে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী নিজে সাহেব নাহলে কোন ম‍্যজিস্ট্রেট , দায়রা জজ  সাহেবদের বিচার করতে পারতোনা।  ১৮৮৩  সালের ২ ফেব্রুয়ারি কোর্টনি ইলবার্ট ভারতীয় সিভিলিয়ানদের মফস্বলের ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার ক্ষমতা দিতে চেয়ে একটি বিল আনেন। এই বিলকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয়ান এবং এ্যংলো ইন্ডিয়ানরা একটা ডিফেন্স এসোসিয়েশন গঠন করে খোদ লর্ড রিপনের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা নেপথ্যের নায়ক আনন্দমোহন বসুকে নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে।

১৮৮৫  সালে ব্রিটিশ নাগরিক অ্যলান অক্টোভিয়ান হিউম আনন্দমোহন বসু এবং ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের অন‍্যান‍্য কর্মকর্তাদের পাশকাটিয়ে–ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামে অপর একটি দল গঠন করেন। আনন্দমোহন বসুর –ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ততদিনে আট বছর অতিক্রম করেছে। শুধু তাইনা আপামর জনসাধারণ এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। তবে — ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন নামে অপর একটি সংগঠন  ১৮৬১ সাল থেকে ধনীক শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছিল।এটি জমিদার ব্রাহ্মণ ও গোঁড়া হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত হতো তাদের ব‍্যাক্তিগত চাওয়া পাওয়া নিয়ে সরকারের সাথে দরকষাকষিই ছিল এদের কাজ।সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো কাজের সাথে এদের সম্পর্ক ছিল না।অপর দিকে আনন্দমোহন বসুর সহযোগীরা ছিলেন উদার প্রগতিশীল ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী। সহযোগীদের অধিকাংশ‌ই পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ থেকে আগত হ‌ওয়া সত্ত্বেও তারা সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে কাছে টানতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

আনন্দমোহন বুঝতে পেরেছিলেন ভারতীয়দের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিই হিউমের উদ্দেশ্য।তিনি ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং হিউম প্রবর্তিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন।এভাবেই আনন্দমোহন জাতির বিভাজনের অপকৌশল রুখে দেন। বস্তুত হিউমের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আনন্দমোহন বসুর ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের‌ই নামান্তর।

ধারণা হয় আনন্দমোহন বসুকে উন্মুক্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে  ১৮৮৫  সালেই তাকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের ( বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল  )  সদস্য মনোনীত করা হয়। আনন্দমোহন ভেবে চিন্তে শেষ পর্যন্ত উক্ত পদে যোগ দেন এবং চৌকিদারি বিল ও এডাল্টারেশন বিলে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনেন এবং এগুলো বাংলার সকল পৌরসভার জন্য উপযোগী করে তোলেন।

আনন্দমোহনের সংযমী ও দৃঢ়চেতা স্বভাবের জন্য পরবর্তী আরো দুই মেয়াদে তিনি এই পদে ( মনোনীত নয় ) নির্বাচিত হন।

১৮৯৪  সালে তিনি বাতজ্বরে আক্রান্ত হন কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা তাকে তার প্রিয় দেশকর্ম থেকে বিরত রাখতে পারেনি । ডাক্তারের বারণ উপেক্ষা করে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো ইংল্যান্ডেযান এবং ১৮৯৭ সালে তৃতীয় বার ইংল্যান্ড গমন করেন।

ইংল্যান্ডে তিনি পুরোনো সুহৃদদের দ্বারা মহাসমারোহে সংবর্ধিত হন। ইউনিটেরিয়ান এসোসিয়েশন কতৃক আয়োজিত বিভিন্ন সভায় একেশ্বরবাদিতার উপর বক্তৃতা করেন। এছাড়া ভারতের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য ইংল্যান্ডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত প্রচারণা শুরু করেন । ব্রিটিশ ভোটারদের মধ্যে ভারত বিষয়ে উল্লেখযোগ্য আগ্ৰহ তৈরী করতে সক্ষম হন। এভাবে প্রায় বিরামহীন ভাবে সপ্তাহের প্রতিদিন‌ই কোন না কোন জনসভায় বক্তৃতা করেছেন। তিনি জোরালো ভাবে দাবী করেছেন যে তাঁর দেশের সরকারে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত।

এভাবে বিভিন্ন সমাবেশে প্রদত্ত বক্তৃতার মূল সুর ছিল -ভারত সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের নীতির কড়া সমালোচনা।

১৮৯৮  সালে আনন্দমোহন বসু মাদ্রাজ অধিবেশনে – ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস -এর সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯০৫  সালের শুরু থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে । তিনি সেরিব্রাল  প‍্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হন। এই সময়ে লর্ড কার্জন কতৃক আনীত – বঙ্গভঙ্গ  প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতা করেন।

১৮৫৭  সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর আনন্দমোহন বসু আমৃত্যু ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতিমালার বিরুদ্ধে যে প্রত‍্যক্ষ এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সফল আন্দোলন সংগ্ৰাম পরিচালনা করেছেন তা ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

১৯০৬  সালের  ২০ আগস্ট মাত্র ৫৯ বছর বয়সে এই মনীষী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।

লেখক: আহ্বায়ক, আনন্দমোহন বসু স্মৃতি সংসদ।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন