গল্প: হলুদ বুনিয়া: তুষার সরকার

1

অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

সন্ধ্যার বৈশাখী আকাশ কালো মেঘে ভারি হয়ে আছে। বাতাসে পাকা বোরো ধানের ঝনঝন শব্দ, মৃদু সোনালী গন্ধ রফিক মিয়ার মনে পরম শান্তি নিয়ে এসেছে একই সাথে কালো মেঘের মত মনের আকাশে কিছু ভয় ও দুশ্চিন্তাও ঘুরছে। ধান কাটার সময় হয়ে এসেছে, কিছু দিনের অপেক্ষা। বৈশাখী ঝড় সব তছনছ করে দিতে পারে, কেড়ে নিতে পারে বাংলার কৃষকের ক্লান্তির ঘুম। ধান ক্ষেতের পাশে বসে রফিক মিয়ার দুচোখে ভেসে চলছে এইসব চিন্তা, আকাশের কালো মেঘ ভেদ করে ভেসে যাচ্ছে উড়োজাহাজ।

হারিকেনের ঢিম আলোয় রিয়াজুল তার বাবাকে ডাকতে বেরিয়েছে। রাতের খাওয়ার সময় হয়েছে। আসলে সুন্দরবনের হলুদ বুনিয়া গ্রাম এখনো বিদ্যুতের দেখা পায়নি, এখানে মানুষের ঘরে ঘরে এখনো টিভি আসে নি, এখানের মানুষ এখনো ফেসবুকে একাউন্ট খুলে উঠতে পারে নি, তবে তারা পেরেছে আউশ, আমন, বোরো ধানের চাষ করতে, বাংলার মাটি থেকে সোনালি, উজ্জ্বল আভা ফলিয়ে তুলতে। এই গ্রামের নাম হলুদ বুনিয়া হয়েছে তার কারণ বহু আগে এই গ্রামে হলুদের চাষ হত।

রিয়াজুল ক্ষেতের পাশে ওর বাবাকে দেখেছে।

–এ আব্বা, আব্বা।

– এ কি হইছে ক।

–বাড়িত যাবানা। আম্মায় ভাত বাড়ি বইসে আছে, এহানে কি করতিছো?

– হরে চল। খিদায় পেডে লাড়া দিচ্ছে।

বাবা আর ছেলে জোঁনাকি পোকার ঝিঁ ঝিঁ আওয়াজের ভেতর দিয়ে, বৃষ্টিতে ভেজা কাঁদা মাটির সোঁদা গন্ধ বুকে নিয়ে শান্তির দিকে যাচ্ছে।

–আব্বা এগডু আগে এ্যাগডা পেলেন গেছিলো দেহিছো তুমি?  আমিতো এহন কেলাস সিক্সে পড়ি, পেলেন চালাতি গেলি কুন কেলাস পর্যন্ত পড়তি হয় আব্বা?

– কি জানিরে বাপ, আমি কি ওত্ত পড়ালেহা করতি পারছি। কাইলকে তুই এক কাজ করিস ইস্কুলে যায়া তোর মাইস্টাররে জিগাইস। বাজান তুইকি পেলেন চালাইতে পারবি। গরিব মাইশের কি হেইডা হতি পারে?

– তই আমার স্যার যে কলো পরালেহা করলি পরে সবাই সব হতি পারে।

এমন স্বপ্নের বীজের বপন ঘটছে রিয়াজুলের মনের জমিনে। এই স্বপ্নের অঙ্কুর এখন আলো বাতাসের অপেক্ষারত।

ভোরের আলো ফুটে গেছে। রাজ মোরগের ধ্বনি ভেসে আসছে কানে। রিয়াজুল চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে উঠেছে। স্কুলে যাবে, তার জন্য রয়েছে অনকে প্রস্তুতি। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় সারে চার কিলোমিটার। প্রতিদিন ৯ কিলোমিটার হেটে রিয়াজুল স্কুলে আসা যাওয়া করে। এঞ্জিও থেকে অনেক ছাত্র ছাত্রীদের সাইকেল দেওয়া হয়েছে কিন্তু রিয়াজুল এখনো পায়নি, ক্লাস সেভেনে উঠলেই পেয়ে যাবে এমন বলেছিল, সেই আশায় আছে এখনো।

সূর্যাস্ত হয়েছে ঘন্টা তিন হয়ে গেছে।  খেতে বসেছে রিয়াজুলরা। হারিকেনের আলোয় মাজরা পোকা আর সবুজ পাতা ফড়িং ভনভন করে ঘুরছে চারদিকে।

–আব্বা, আমি স্যাররে জিগাইছি, যারা পেলেন চালাতি পারে তাগরে কি কয় জানো? পাইলট। আমিও হতি পারবো।

–খাচ্ছিস খা, খাওয়ার সময় ওত্ত কথা কতি নাই।

মায়ের এই ভারি কন্ঠ রিয়াজুলের কথা থামিয়ে দেয়, সাথে মনটাও ভারি করে দেয়।

ওদিকে আকাশে বিদ্যুত চমকাচ্ছে।  আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে তিন নম্বর বিপদ সংকেত দিয়েছে। রফিক মিয়া বাজারে গিয়ে এই খবর শুনে এসেছে আজকে। বাতাসের গতিবেগ বেড়েই চলছে। রিয়াজুল ঘুমিয়ে পড়েছে, রফিক মিয়ার ঘুম উড়ে গেছে সবুজ পাতা ফড়িংএর মত। ঝড় উঠেছে প্রবল, চারদিক অন্ধকার করে এসেছে, এই অন্ধকার রাত যেন শেষই হচ্ছে না, শেষই হচ্ছে না, ঝড়ের সাথে উড়ে যাচ্ছে রফিক মিয়ার চোখের জল, হাতের ফসল।

শান্ত সকাল। উঠানে বসে আছে রফিক মিয়া। দূর থেকে হাসেমের গলা শোনা যাচ্ছে।

– এ রফিক ক্ষেত ত ভাসি গেছেরে ভাই। কি সর্বনাশটাই হইলো রে, কি সর্বনাশটাই হইলো, আল্লাহ।

আরও অনকে কিছুই বলে হাসেম, রফিকের কান পর্যন্ত তা পৌঁছায় না।

ঘুম থেকে উঠে রিয়াজুল দেখে বাবা উঠানে বসে। স্কুলে আজকে যেতে পারবে কি পারবে না, তা বুঝতে পারছে না, জল জমে আছে চারদিকে।

–আব্বা আজইকে মনে হয় ইস্কুলে যাওয়া হবি না। 

– পেডে ভাত না থাকলি পরে ইস্কুলে যায়া কি করবি?  ইস্কুল কি তরে খাতি দেবেনে। আমার সাথি চল ক্ষেতে যাতি হবি। ম্যালা কাইজ আছে ক্ষেতে। চল।

এমন ঝড় সুন্দরবনের মানুষের জীবনে নতুন নয়, তেমনি নতুন নয় রিয়াজুলের মত কোমল দুচোখের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়াটাও৷ প্লেনে বসে মাঠ দেখতে না পেলেও রিয়াজুল মাঠ থেকে প্লেন দেখতে সে পাবেই। সাইকেলে করে স্কুলে যাওয়া হয়তো হবে না রিয়াজুলের কখনো। হলুদ বুনিয়া গ্রামের এমন অনকে স্বপ্ন–ফসল ঘরে তোলা হয় না, কিছু অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়, তাদের গাঁ’য়ে আলো বাতাসের ছোঁয়া লাগে না কখনো, কালো মেঘের উপর উড়োজাহাজের মত উড়তে পারে না হয়তো কখনো।।       

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন