গল্প: মুক্তি: রাফিদুল রাফি

0

অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

বাতাসটা ক্রমশ শীতল থেকে শীতলতর হয়ে আসছে। থেমে থেমেই জোর হাওয়া দিচ্ছে। জৈষ্ঠ্য মাসের শেষের দিক। আষাঢ় আসবে আসবে করছে। প্রচুর গরম পড়েছে এবার। সারাদিনের  আগুনরোদ সবকিছুকে পুড়িয়ে কয়লা করে দিচ্ছে যেন। আবার, সন্ধ্যা হলেই শুরু প্রচন্ড বেগে হাওয়ার দাপট, ঝড়-তুফান-বৃষ্টি। সন্ধ্যারাত, চারপাশে জমাট অন্ধকার। আকাশে কোনো আলো নেই তারপরও প্রগাঢ় কালো মেঘের উপস্থিতিটা ঠিকই ঠাহর করা যাচ্ছে। আঁধারে পথ চলতে খুব একটা অসুবিধা হবার কথা নয় শামছুর। এতোদিন আঁধারেই ছিলো সে। এক যুগেরও ঢের বেশি দীর্ঘ সময়ে  দিব্যি সেই আঁধার সয়ে গেছে তার। একটা আবদ্ধ প্রকোষ্ঠ আর এক পৃথিবী আঁধার। এই ছিল তার সঙ্গী। ঘরের একপাশে প্রায় অকেজো একটা বিজলী বাতি ছিলো অবশ্যি, তাতে কি আর কালো যায়! এতো আঁধার সরাতে পারে তেমন আলো কই! দিনরাত সব সমান। শুধু আঁধারের কালো আর কালো। কখনও কখনও ঐ আঁধারটাকে মায়ের জরায়ুর মতো নিরাপদ মনে হয়েছে। আবার, কখনও মনে হয়েছে তার চোখের ‘কানা অসুখ’ করেছে। এই অসুখ নিয়তি প্রদত্ত দুরারোগ্য অসুখের মতো অখন্ডনীয়, এ অসুখের শত চিকিৎসা করা হলেও আলো ফিরবে না! অবশ্যি, একবার কেন জানি তার এও মনে হয়েছিল যে, আলো ভয়ংকর, অন্ধকারই নিরাপদ। আলোতে ভরা পৃথিবীটা মিথ্যার ভয়াবহতায় ঠাসা। আঁধারই আপন, আলোটা অতি দূরের পর কেউ। অন্ধকারের সাথে কেমন যেন একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তার। তবে, আজ আঁধারে পথ চলতে একটু অসুবিধাই হচ্ছে। তার স্পষ্টভাবে মনে পড়লো বছর পনের আগে এ রাস্তাটা সরু ছিলো, বর্তমানে বেশ অনেকটা চওড়া। আগে ছিলো কাঁচা রাস্তা, জায়গায় জায়গায় ভাঙাচোড়া, খানাখন্দ। কৃষ্ণপক্ষের রাতে প্রতিটা পা ফেলার আগে দশবার করে ভাবতে হতো। এখন রাস্তার গায়ে ইটের নয়া সলিং, কোথাও ভাঙা মনে হচ্ছে না। অনেক চেনা এই রাস্তাটাকে আজ খুব অচেনা লাগছে শামছুর। পথ ভুল হয়নি তো? না না, ভুল হতেই পারে না। ঠিক পথেই সে এসেছে।

শামছু এগিয়ে যাচ্ছে। প্রবল হাওয়ার স্রোত তার রোগাপাতলা লিকলিকে শরীরটাকে ঘুড়ির মতো উড়াতে চাইছে যেন। তবুও শামছু যাচ্ছে। তাকে যেতেই হবে। বহুদিন পর, বহুবছর পর সে আজ তার জন্মভিটা তেনুয়া গ্রামে যাচ্ছে। গুনে গুনে অনেক দিন, অনেক ক্ষণ পার। এই দীর্ঘ আঁধারের জীবনে বহমান সময়ের প্রতিটা মুহুর্ত সে ভীষণ বিষন্নভাবে অনুভব করেছে। তারপর আজকের এই ফেরা, অন্ধকারের স্বজনহীন সংসার থেকে মুক্তিলাভ। শামছুর মনে একটা শিশুসুলভ চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। ছোটোবেলায় মামাবাড়ি বেড়াতে যাবার আগের রাতে এমনটা হতো। বহুদিন পর আজ ফের এরকম অনুভূতি হচ্ছে।

হাওয়ার জোর হঠাৎ করে অনেকখানি পড়ে গেছে। এবার থেমে থেমেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশ বেশ ঘনঘন গর্জন করে উঠছে। বিদ্যুৎ চমকানোর সেই আলোয় অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে শামছু। হিরণপুর থেকে তেনুয়া যেতে এখনও দুই মাইল পথ বাকি। ধীরে ধীরে চলে যাওয়া যাক। রাস্তাঘাটে কেউ নেই। এমনকি কোনো কুকুর, ব্যাঙও নেই। ঝড়ো হাওয়া আর প্রবল বৃষ্টিপাতের ভয়ে মানুষ ঘরে ঢুকে ঘাপটি মেরে আছে আর বাকি সব প্রাণীও হয়তো ভীত হয়ে কোনো না কোনো আশ্রয়ে লুকিয়ে আছে। শামছু হাঁটার গতি কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবল ঝড় শুরু হবে সাথে বৃষ্টিপাত উপরি উপদ্রব হয়ে আসবে। বহুকষ্টে আকাশের বিজলী আলোয় পথ দেখে দেখে এগিয়ে যাচ্ছে শামছু। তার শরীর ক্লান্ত, সে পরিশ্রান্ত।

শামছু যেই না লুনুই গ্রামের বড় ব্রিজটা পার হয়েছে  অমনি প্রবল বর্ষণ শুরু। সে কোনোরকমে দৌড় দিয়ে অদূরে একটা বটগাছের নিচে দাঁড়ালো। অল্পক্ষনেই কাকভোজা ভিজেছে সে। ভেজা হাত দিয়ে চুল, দাঁড়ি মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করছে শামছু, লাভ হচ্ছে না। প্রকান্ড বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে যা একটু রক্ষা আরকি। বৃষ্টিজল এতোটাও তার শরীরে লাগছে না এখন আর। তবে ভয় ভয় লাগছে একটু। বটগাছে হাওয়ার বেশ জোর মনে হচ্ছে। ডাল-টাল ভেঙে গায়ে পড়লে সর্বনাশ। পড়লে পড়ুক। জীবনে হারানোর মতো আর দুটো জিনিসই বাকি তার। এক, তার বৃদ্ধা মা এবং দুই, নিজের প্রাণ। শামছুর হঠাৎ মনে পড়ে গেলো, আরে এটা তো সেই বটগাছ! হ্যা, ঘটনাটা এখানেই ঘটেছিলো পনেরো বছর আগে। না না, শামছু ওসব আর মনে করতে চায়না। বিশ্রী একটা ব্যাপার। খুব বাজে। এসব কথা থাক। সেই অতীত এই ঝড়ে শুকনো পাতার মতোই উড়ে যাক। সে সব ভুলে যেতে চায়। শামছু মনে না করতে চাইলেও, ভুলে থাকতে চাইলেও সে ঘটনাটা কোনো প্রকারেই ভুলতে পারেনা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বারবার, আনমনেই মনে পড়ে যায়, তাকে  পাষাণ ধাতব আঘাত করে, ভেতরে ভেতরে পোড়ায়। বোধ হয়, সব মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ছায়ার মতোই সবসময় সাথে লেগে থাকে। এদের এড়ানো যায়না কোনোমতে। তাদের থেকে পালিয়ে বাঁচার দুইটা উপায় হলো- পাগল হয়ে যাওয়া এবং মৃত্যু। ঝড়ের গতি বাড়ছে, সেইসাথে বাড়ছে বৃষ্টির মিছিল। শামছুর চোখে তার ফেলে আসা অতীত জীবনটা আরো একবার ভেসে উঠেছে। চলচ্চিত্রের মতো একের পর এক ঘটনা-দুর্ঘটনা তার চোখে ভাসছে, মনে বাজছে। ছেলেবেলার জীবন, শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন সব যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। ঐ তো তার অভাবে ভরা স্বপ্নীল শৈশব, ঐ তো দস্যু কৈশোর…

ছেলেবেলায় পড়াশোনা বেশিদূর করা হয়ে ওঠেনি শামছুর। ক্লাস ফাইভ নাগাদ পড়েছিলো। তারপর বাবার সাথে চায়ের দোকানে লেগে গেলো। কৈশোরে বেশ কিছুদিন বাসে হেলপারিও করেছে। তাতে পোষালো না। দিনরাত খেটে কয়েক টাকা পেতো। রোজ প্যাসেঞ্জার আর ড্রাইভারের কিল-ঘুষি-লাথি খেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে শেষমেশ হেল্পারিও ছাড়লো। যৌবনে সে মায়ের নাকফুলটা বেচে সেই টাকায় হিরণপুর স্টেশনের পাশে রুটির দোকান দিয়েছিল। শামছু সব পারতো। সব মানে সব। একেবারে ‘জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ’ যাকে বলে আরকি। কি হাডুডু, কাবাডি, ফুটবল খেলা  অথবা কোনো যাত্রাপালা, পালাগান এমনকি ওয়াজ-মাহফিল আয়োজনের দায়দায়িত্ব সবকিছুতেই শামছু সবার আগে ডাক পেতো। এলাকায় বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ ছিল সে।

শামছু যখন কেবল কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছিলো তখন তার বাবা মারা গেলেন হুট করেই। সংসারে তার মা আর তিনটা বিবাহযোগ্য বোন আছে। তার রুটির দোকানের আয়ের উপর ভরসা করেই পুরো সংসার চলছিলো। অভাব অনটন ওদের ঘিরে ধরতো প্রায়শই। তবুও বেশ ভালো না হলেও মোটামুটি ভালোই চলছিলো দিনকাল। শামছুর গতরে খাটাখাটনি সইতো খুব। বছর দুয়ের মধ্যে তিন বোনের বিয়েও দিয়েছিল সে। দিনভর রুটির দোকান চালিয়ে মাঝরাত নাগাদ শামছু যাত্রাপালার রিহার্সাল করতো। অভিনয়ে তার ছিলে রাজ্যের দুর্বলতা। বেশিরভাগ সময়ই সে ‘লখীন্দর’ এবং ‘সিরাজউদ্দৌলা’ চরিত্রে অভিনয় করতো।

এক রাত্রে ‘শাহজাহান’ নাটকের নামচরিত্রে অভিনয়ের রিহার্সাল শেষ করতে করতে মাঝরাত হয়ে এলো। হিরণপুর থেকে তার তেনুয়া যাওয়া লাগবে হেঁটে হেঁটে। পথ কম নয়। সেদিন কৃষ্ণপক্ষের রাত ছিলো। আকাশে ছিলো না  চাঁদ-তারা। শামছুর খিদে পেয়েছিল বেশ। মাকে শুকনা মরিচ দিয়ে কাঁঠাল বিচির ভর্তা করে রাখতে বলে এসেছিল সেই সকালে এবং সাথে একটু পাতলা মসুরডালও। মা সম্ভবত এখনও না খেয়ে তার পথ চেয়ে বসে আছেন। সে গেলে খাবে। তাই শামছু দ্রুত পথ চলছিলো। লুনুই গ্রামের দুই মৌজার এই সংযোগ ব্রিজটা তখনও হয়নি। লম্বা একটা বাঁশের সাঁকো ছিলো। এই মগরা নদী পার হতে গেলে এই সাঁকোতেই ভরসা রাখা লাগতো। শামছু তাড়াতাড়ি সেটা পার হলো। এরপর বটগাছটার কাছে আসতেই শামছু একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলো। ব্যাটারি টর্চটা সে শব্দের উৎসের দিকে ঘুরালো। একি! মেম্বার চাচা না? তার বুকে ছুরি বসানো। কি করে হলো এটা! কারা করলো? এতো ভাবার সময় নেই। লোকটা এখনও বেঁচে আছে। তাড়াতাড়ি হিরণপুর নিয়ে যাওয়া লাগবে। সাঁকোতে যারা উঠতে পারে না বা ভয় পায় তাদের জন্য সাঁকোর নিচে একটা কলাগাছের আধভাঙা ভেলা বাঁধা রাখা ছিলো। দ্রুত সেটাতে মেম্বারসাহেবকে কোলে করে নিয়ে তুললো শামছু। জোরসে লগি মেরে নদী পেরিয়ে চাচাকে কোলে তুলে হিরণপুর রওনা হলো। সাধন ডাক্তারের কাছে নিয়া যাওয়া লাগবে। মেম্বারের বাড়িতে খবর দেয়া দরকার। লোকটার এই অবস্থা! মেম্বারের বড় ছেলে মজিদের সাথে অবশ্য তার সমস্যা আছে একটু। কুস্তি খেলায় বাজি ধরে হেরেছিলো মজিদ। সে বাজির টাকাটা শামছুকে দেয়নি। শামছু চেয়েছিলো। টাকা চাওয়ার পর কথা কাটাকাটির জেরে হাতাহাতি, কিল-ঘুষাঘুষি পর্যন্ত হয়েছে। ‘তোরে দেইখ্যা লমু’ বলে শাঁসিয়েছেও মজিদ। সেদিন থেকে আর কোনো রা নেই দুজনের। একে অপরকে এড়িয়ে যায়। তবে, শামছু যাত্রাদলে কাজ করে বলে নানান অপবাদ রটায় মজিদ। কখনও ‘নটিবেটির দালাল’ কখনওবা ‘গান্জাখোর’ আখ্যা দিয়ে এর-ওর কাছে এটা-সেটা বলে বেড়ায়।

সাধন ডাক্তার সাধ্যমত চেষ্টা করলেন। ছুরিটা সিনা ভেদ করে কিছুটা পিঠের দিকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সেটা বের করলেন। সেলাই করে ব্যান্ডেজ করলেন। কাজ হলো না। হওয়ার কথা না। মেম্বার সাহেবকে ময়মনসিংহ নিয়ে যেতে বলেছিলেন তিনি। নেওয়া সম্ভব হলো না। অনেক কষ্টে একটা ভ্যানগাড়ি ম্যানেজ হয়েছিলো। রওনা করার আগেই ঘটনা শেষ।

মেম্বার সাহেব মারা গেলেন ভোরবেলা। ‘মোরগডাকা’ ভোর। ফজরের আজান তখন সবে পড়েছে। মরার আগে তিনি করে গেলেন বিরাট সর্বনাশ। উনি অর্ধচেতন ছিলেন। চোখ আধেক খোলা, আধেক বন্ধ।

তার স্ত্রী বারবার জানতে চাচ্ছিলো,

‘এইডা কেডা করছে? কাউরে চিনসেন?’

আর মেম্বার সাহেব বিড়বিড় করে বারবার বলছিলেন,

‘শামছুরে, শাম….ছু,শামছু’

মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন,

‘তওবা পড়েন। আমার লগে লগে কন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু….’

মেম্বার সাহেব বললেন, ‘শাম…ছু ‘

সবাই ধরে নিলো শামছুই খুনী। মিথ্যা সাক্ষী সাজলো মজিদ। সে নাকি খুন করতে দেখেছে। বাবাকে বাঁচাতে ছুটেও গিয়েছিলো সে কিন্তু শামছু নাকি রামদা দিয়ে দৌড়ানি দিয়েছে তাকে। এরপর প্রাণ হারানোর ভয়ে বাবাকে সে দ্বিতীয়বার বাঁচাতে যায়নি। এ কাজটা তার ভুল হয়েছে বলেও সে স্বীকার করে! তবে হিরণপুর নিয়ে গিয়েছিলো মজিদ নিজেই। সাধন ডাক্তার মজিদের চাকুর ভয়ে পুলিশকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিলো। আদালতে কাঁপতে কাঁপতে তিনি বলেছিলেন যে, সে রাতে মজিদই তার বাবাকে নিয়ে এসেছিল তার কাছে। শামছু এসেছিল মারা যাবার একটু আগে। তাছাড়া মেম্বার সাহেবের স্ত্রী বলেছিলেন,

‘মানুষটা কালেমাও  পইড়া মরে নাই। খালি শামছুর নাম নিতাসিলো। ওর নাম কইতে কইতে মারা গেছুইন গা। স্পষ্ট কইয়া গেছে ওর নাম। ও মারছে মজিদের বাপেরে।  শামছুর কোনো কথা কেউ শুনলো না। আর মজিদের করা মামলায় শামছুর নামে পরিকল্পিত খুনের দায় চাপলো। রায় গেলো তার বিপক্ষে । বিচারে ওর সাজা হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।  একটানা বহুবছর জেল কেটে আজই জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। বাড়িতে তার বৃদ্ধ ভিখারী মা ছাড়া আর কেউ নেই। মিছেমিছি জেল না কাটলে আজ সে সংসারী হতো। কোনো এক রমণী তার ঘরণী হতো, বাচ্চার মা হতো। তার মাকে ভিক্ষা করে বাঁচা লাগতো না। থাক, এখন এসব আফসোস করে লাভ নেই। ‘নিয়তির লিখন না যায় খন্ডন।’ মজিদ নিয়তির লিখনের বলি বলে প্রবোধ দেয় নিজেকে।

খুনটা করেছিলো মজিদ নিজে। মেম্বার সাহেবের কাছে সে ব্যবসার টাকা চেয়েছিল। মেম্বার সাহেব টাকা না দিয়ে বলেছিলেন,

“সবার লাইগ্যা ব্যবসা না। তোর মতো পোলা করবো ব্যবসা? মদ-গান্জা খাইয়াই তো পারস না। যা ক্ষেতে যা। হালচাষ কর।”

মজিদ বললো,’বিয়া করাইন আমারে। আলগা কইরা দেইন। আমার ভাগ আমারে বুঝায়া দেইন।’

ছেলের কথা শুনে মেম্বার সাহেব গেলেন ভয়ানক রেগে।

চিৎকার করে বললেন,

‘তোরে ত্যাজ্য করমু। বাড়িছাড়া করমু। সামনেত্তে যা হারামির পোলা’।

মজিদের মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। মদ খেতে গেলো আজগরের সাথে। আজগর দিলো কুবুদ্ধি।

‘হুদাই চিন্তা করিস না। ঐ বুইড়া বাঁইচা থাকলে তোর কিছু হইবো না। ঐডারে সরানি লাগবো।’

নেশার ঘোরে মজিদের জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে গেলো। গরুর চামড়া কাটা একটা পুরনো ছুরি নিয়ে বটগাছটার নিচে দাঁড়ালো। তার বাবা বাজার থেকে বাড়ি ফেরার সময়ই সিনায় ছুরিটা ঢুকিয়ে দিলো। এরপর নিজে বাঁচতে শামছুকে বানিয়ে দিলো খুনি।

জলহাওয়ার তান্ডব এখন কমে গেছে। শামছুর ভাবনায়ও ছেদ পড়েছে। ঝড়বৃষ্টি থেমে এসেছে একদম। শামছু আবারও পথচলা শুরু করেছে। সামনেই তেনুয়া বাজার। বাজারে আসতেই আলো পাওয়া গেলো। দোকান থেকে একটা বিড়ি নিয়ে ওটা কাঁপা কাঁপা হাতে দেয়াশলাইয়ে জ্বালিয়ে প্রথম টানটা দিয়েছে মাত্র এমন সময় একজন কে যেন পেছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।

‘দোস্ত আইছস তুই, কি অবস্থা হইসে তোর চেহারার। দাঁড়িডা ফালাইবি না রাইখা দিবি? সোনা দোস্ত আমার,আয় এদিকে চা খাইবি। গামছাটা ল, শইলডা মুছ। জ্বর বান্ধাইবি তো।’

কথাগুলো যে বললো সে রহিম মিয়া, শামছুর বাল্যবন্ধু। রিকশা চালায়। জেলেও কয়েকবার সে শামছুকে দেখতে গিয়েছে।

রহিমের সাথে চা খেতে বসলো শামছু। তার শরীর কাঁপছে ঠান্ডায়। একটার পর একটা বিড়ি জ্বালিয়ে শরীর গরমের ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে। রহিম হঠাৎ বলে উঠলো,

‘হুন, মর্জিনার তো বিয়া হইসিলো। সংসার করছে সাত বছর, পরে জামাই গেলো মইরা। পোলাপান হয়নাই। এহন বাপের ভিডায় থাহে। তুই তো ভালা পাইতি ওরে। বিয়া শাদী কিন্তুক ওরে করতারস।’

শামছুর লজ্জা লজ্জা লাগছে। মর্জিনা মেয়েটা তাদের যাত্রাদলেই ছিলো। গান গাইতো। একটু-ভাবও হয়েছিলো ওর সাথে। মাকেও সে বলেছিলো বিয়ের কথা। কিন্তু তারপর শামছুর জেল….।

শামছু আবারও মর্জিনার ভাবনায় অতীতে ডুবে গিয়েছিলো। একটা হট্টগোলে সে ভাসলো বর্তমানে। তাকে ঘিরে দশ-বারোজন দাঁড়িয়ে। ছেলেবুড়ো অনেকেই। শামছু কাউকে কাউকে চিনতে পারছে না, কাউকে চেনা যাচ্ছে। ঐ তো খাটো করে লোকটা, ফজলু মিয়া। ঐ তো, ঐ তো কাশেম ব্যাপারি।

শামছু, রহিম, কলিমুদ্দি, হোসেন, ফজলু বাড়ি ফিরছে। শামছুর হাতে দুটো বনরুটি। তার মা বনরুটি পানিতে ভিজিয়ে খেতে ভালোবাসে। মাকে ঘুম থেকে তুলে খাওয়াবে সে। মা খুশি হবে।  মাকে বহুদিন দেখে না সে। মায়ের খুশি হওয়াও বহুদিন দেখে না শামছু।

বহুক্ষণ ধরেই শামছুর প্রশাবের বেগ হচ্ছে। কাজটা সারতে পারছে না। এবার না করলে আর হবেনা, কাপড়চোপড়ে সর্বনাশ হবে। সবাইকে সামনে আগাতে বলে সে প্রশ্রাব করার জন্য রাস্তার একপাশে সরে গেলো। আকাশে তারার আলো জ্বলছে, কোনো চাঁদ নেই, মেঘও নেই।  শামছু লুঙ্গি গুটিয়ে প্রশ্রাব করতে বসবে এমন সময় তার পায়ে কিসের যেন একটা তীক্ষ্ণ আঘাত লাগলো। ছোট্ট একটা মুখ নিয়ে কিছু একটা কামড়ে ধরে আবার ছেড়েও দিলো তার বাম পায়ের পাতাটা।  আচমকাই তীব্র যন্ত্রণা। প্রচন্ড ব্যথায় শামছু চিৎকার করে উঠলো। আবছা আলোয় এবার চলমান দড়ির মতো কি যেন একটা দেখলো সে। রহিম, কাশেম, ফজলুরা খানিকটা সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। ওরা পেছনে দৌড়ে এলো। সবাই বুঝতে পারলো শামছুকে সাপে কামড়েছে। ফজলু গামছা দিয়ে ওর পায়ে ভীষণ শক্ত এক গেরো দিলো। দ্রুত বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। মাথাং গ্রাম থেকে ওঝা ডেকে আনা হলে। শামছুর প্রশ্রাবের বেগ বেড়েই যাচ্ছে। কিন্তু সে এখন আর প্রশ্রাব করতে পারছে না। প্রশ্রাবের চাপে পেট ফেটে যাচ্ছে যেন। ধীরে ধীরে শরীরে অবশতা ভর করছে যেন।

শামছু তার বৃদ্ধা মায়ের কোলে শুয়ে আছে। সে প্রায় অচেতন। তবে সে সবকিছুই শুনছে, বুঝতে পারছে। তার মা আহাজারি করছেন। দুইবার ছেলের জানের বিনিময়ে তার জানটা নিয়ে নেবার ফরিয়াদ জানালেন তিনি উপরওয়ালার কাছে। মদনপুরের দর্গায় মুরগিও মানত করলেন তিনি।

ওঝা ঘন্টা দুয়েক নানান কসরত করলো, কিছুতেই কিছু হলো না। শামছুর মুখ বেয়ে লালা পড়তে পড়তে বুক ভেসে গেলো। ঢোক গিলতে পারছে না সে। শরীর কলাগাছের মতো ফুলে উঠেছে। তার দৃষ্টি প্রথমে ঝাপসা হয়ে তারপর ধীরে ধীরে চোখও বন্ধ হয়ে এলো। সে এখন প্রায় নিস্তেজ। শুধু চোখগুলি পিটপিট করে উঠছে মাঝে মাঝে। মাঝরাত পেরিয়ে যেতে লাগলো। ঘরে কুপিবাতি  জ্বলছে। শামছুর মা ভাঙা গলায় আহাজারি করছেন, আল্লাহকে ডাকছেন।  ওঝা মন্ত্র পড়ছে। ফজলু আর রহিম মিয়া হাত তুলে পরম করুণাময়ের কাছে শামছুর প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। কুপির আলো নিভু নিভু। সে আলোয় শামছুর চোখ দুটি শেষবারের মতো একবার পিটপিট করে তারপর চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো। শামছুর মুক্তি মিলেছে আজ। একেবারে চিরমুক্তি। সে জীবন থেকে ছাড়া পেয়েছে। সে এখন মুক্ত। 

লেখক: শিক্ষার্থী, জাককানইবি।  

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন