গল্প: বাইরের মানুষ: জাফর জয়নাল

0

অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

 অফিসে ঢোকা মাত্রই, কাণ্ডটা ঘটে গেল। ধাক্কা লাগলো অরুনিমার সঙ্গে। এ নিয়ে চার বার হল, ধাক্কাকাণ্ড। অরুনিমা চৌধুরী আরিফের দিকে ফিরে বললেন, বেশতো! নিয়ম করে ধাক্কা দিতে পারেন আপনি? তা ধাক্কা দেওয়ার বিষয়ে মেয়েদেরকে কেন বেছে নিতে হবে, মিস্টার আরিফ?

না, মানে আমি আসলে চেষ্টা করছিলাম..

হ্যাঁ, তা ক’বার চেষ্টা করতে হয়! ধাক্কা দেওয়ার? পছন্দ হয়েছে বলুন। ন্যাকা সাজার দরকার কী? প্রয়োজন পড়লে বলুন সরাসরি।

কি যা তা বলছেন! আপনার সঙ্গে এমন করতে যাবো কেন? তাছাড়া এটা অফিস। সময় মত পৌঁছানোর তাড়া ছিল। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এমন হয়ে গিয়েছে।

অরুনিমা আর কোনো কথা বলল না। খানিকটা নিষ্প্রভ হয়ে চলে গেল। আরিফ ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে মেয়েটার জন্য মায়া অনুভব করছে। কিন্তু বলার সাহস পেল না। দুজনেই যার যার ডেস্কে চলে গেল।

পাঁচটায় অফিস থেকে বের হয় আরিফ। প্রতিদিন ক্যাফেতে একবার আসতে হয় তাকে। রুটিন করে এই আসা, ঠিক সাতটায় ক্যাফের কোণের জানালার পাশে বসে থাকা। এককাপ কফি পেটে চালান দিতে দিতে, ল্যাপটপে কাজ করা। কলেজ জীবনের বন্ধু রজত বসে থাকে। রজত ফোন টেপে অনবরত। বিরামহীন তার  মেসেজ লেখা। তারপর বিল মিটিয়ে সন্ধ্যায় নিজ নিজ বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা। রজত পেশায় সাংবাদিক, দৈনিক সাত সকালের ফরেন বিটের দায়িত্বে আছে। দেশের রাজনীতির খবর ও ভালো রাখে। কার কখন মন্ত্রী হওয়ার পথ খুলছে, কিংবা মার্কিনদেশের প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন, এসবের খবর তার কাছে পাওয়া যায়।

বাড়ি ফিরে আগেই ফ্রিজ খুলে ঢকঢক করে গলায় ঠাণ্ডা পানি ঢালে আরিফ। মা নাহিদা আক্তার চেয়ার টেনে বসলেন, তারপর  যথারীতি অভিযোগ – ‘‘আশিক তো আজ কাজে আসে নাই। বাজার না করে দিলে রান্না করবো কী? এমন ছেলে কে তো বাড়িতে কাজের জন্য রাখা যায় না। বেতনের বেলায় তো ঠিকই নেবে কিন্তু কাজের বেলায় দুইদিন পর পর অসুখ। আমরা কি মানুষ না! আমাদের তো আত্মীয় স্বজন এতো মরে না। সপ্তা ঘুরতে না ঘুরতে কেউ না কেউ তার মরবেই! ওকে কাল থেকে আসতে হবে না বলে দে। সকাল থেকে কল দিচ্ছি মোবাইল বন্ধ। আসতে পারবি না, বলেই তো হয়। মোবাইল বন্ধ রাখার দরকার কী!’’ নাহিদা আক্তারের প্রতিদিনকার কাজ, এটা ভালো না, ওটা ভালো না, বলা। আরিফ অবশ্য এসবে কান দেওয়া মানুষ না। তার কাছে সংসার কীভাবে চলবে, সেটাই বড় বিষয়। রোজ রোজ কাজের লোক ছাটাই করলে, এই শহরে কাজের লোক পাওয়া যাবে না। তার মা হয়েছে খুঁতখুঁতে মানুষ!

‘‘কেন মা। একটু মানিয়ে চলতে পারো না। জানো তো কাজের লোক পাওয়া কতটা যন্ত্রণার। আর তাছাড়া ওর ভিতর তো চুরি-চামারির ব্যাপারটা নেই। যেটা আগেরটার বেলায় ছিল।’’ ক্লান্ত কণ্ঠে আরিফ কথাগুলি বলল।

নাহিদা আক্তারের খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণে এই বাসায় কাজের লোক টেকে না। প্রথম দুই মাস ভালোই যায় তৃতীয় মাসে এসে শুরু হয়– অভিযোগ আর অভিযোগ। তখন বাধ্য হয়ে বাদ দিতে হয়। এর আগেরজনকে বাদ দিয়ে যে হ্যাঁপা পোহাতে হয়েছে তা আর বলার মত না। অফিস আর বাড়ির কাজ করতে করতে মরো মরো অবস্থা হয়েছিল। ভাগ্য ভালো, বাজার করতে গিয়ে আশিককে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। ড্যাবড্যাবে চোখ ছোকড়ার। বললাম বাসায় কাজ করবি? অমনি রাজি হয়ে গেল।

‘‘চুরি-চামির ব্যাপার নেই বলছো তো? তাহলে আমার মখমলের সোয়েটারটা পাওয়া যাচ্ছে না কেন, শুনি?’’ চেয়ার ঘুরিয়ে নাহিদা আক্তার বলল।

‘‘তোমার যদি না পোষায় মা, তবে বিদায় করে দিলেই তো পারো। রোজ রোজ এই বকবক ভালো লাগছে না। অফিস বাদ দিয়ে কাজের লোক খুঁজে বেড়ানো!’ বলে পায়ের মোজাটা জুতোর বক্সের উপর রেখে, নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেল আরিফ।

নাহিদা আক্তার বিদ্যুৎ চলে যাওয়া বাতির মত হঠাৎ চুপ করে গেলেন। বুঝতে পারছেন তার বয়স বাড়ছে, এই বয়সে ছেলেই একমাত্র ভরসা। আত্মীয়-স্বজন তো দূরে দূরে থাকে, কাউকে ডাকলে তারপর আসে, কারো সাথে তেমন যোগাযোগ নেই।

শুক্রবার সকালে দেরি করে ঘুম ভাঙে আরিফের। বিছানা ছাড়তে ছাড়তে এগারোটা বাজে। আজ সকালে চড়া গলার আওয়াজ আসছে…

‘‘… তা বাজার করতে এত দেরি হলে চলবে? ছোট মাছ আনতে বলেছিলাম। নিয়ে এসেছো বড় মাছ। তা আনলে যখন কেটে নিয়ে আসতে পারতে … কাজ করার ইচ্ছে নেই বললেই হয়… হারামজাদা মিনসে… ’’

মোবাইলের ইন্টারনেট চালু করা মাত্রই টিং করে উঠলো। অরুনিমা মেসেজ দিয়েছে, “স্যরি!’’ আরও অনেক মেসেজ এসেছে, একটি মেসেজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রজত লিখেছে- “তোর সঙ্গে আজ বিকেলে শ্যামা দেখা করতে চায়। আসতে পারবি?’’ শ্যামার নাম দেখেই আরিফের দীর্ঘদেহী সুন্দরী শ্যামা মেয়েটার কথা মনে পড়লো। নাম শ্যামা হলেও সে মোটেই শ্যামা নয়। কলেজের সবচেয়ে লাস্যময়ী মেয়ে শ্যামার পেছনে কত ছেলেই না ঘুরলো, শেষে শ্যামা আমেরিকা প্রবাসী ভাস্কর চৌধুরী নামের এক ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করে চলে গেল। আজ কিনা সেই শ্যামার প্রত্যাবর্তন! সে আবার আরিফের সঙ্গে দেখা করতে চায়! পুরনো সেই চিরকুট কী শ্যামার কাছে এখনো আছে? আরিফ তাতে লিখতে পারেনি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। লিখেছিল, তুমি অনেক সুন্দর শ্যামা। প্রেম ভালোবাসার কথা বলার সাহস হয়নি। উত্তরে শ্যামা বলেছিল তুমিও বেশ সুন্দর আরিফ। কথাগুলি বলার সময় আরিফের মাথা হাত বুলিয়ে দিয়েছিল শ্যামা। সে ছোঁয়া এখনো অনুভব করে আরিফ!

আশিক চা, বিস্কুট সামনে এনে রাখে। মুখে বিরক্তির ছাপ, বোঝা যায় কিছুক্ষণ আগে সাইক্লোন বয়ে গেছে। এখন মনে হয় বৃষ্টি হবে। বিরামহীন বৃষ্টি যাকে বলে, দুই মিনিট পর থেমে যাবে। তারপর বলবে, “ভাইজান। আমার কী দুষ্? আত্মীয়-স্বজন থাকলে তো যাইতে হবোই।’’ আরিফ মিষ্টি দুচারটা কথা বলে, তাতে কাজ হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এমন কাজ প্রায় করতে হয় আরিফকে, তাছাড়া কে পোহাবে রোজকার ঝামেলা!

রোজ ক্যাফের কর্নারের টেবিলে একজন সুন্দর তরুণী বসে আছে। চেনা মুশকিল, এই সেই শ্যামা, যার জন্য একসময় মন কেমন যেন হাহাকার করে উঠত। দীর্ঘ দেহী সেই শ্যামা আগের চেয়ে আরো বেশি সুন্দরী হয়েছে, রূপ যেন ফেটে পড়ছে। কালো চশমায় চোখ ঢাকা, পরনে কালো শাড়ি, তাতে গোলাপি-সবুজ-সাদা রঙের বাহারি কারুকাজ। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, কালো দীর্ঘ খোলা চুল পিঠে ছড়ানো। হাতের আঙ্গুলে লাল রঙের পাথর বসানো আংটি। টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল- “বসো আরিফ।”

“ভালো আছো তো?” আরিফের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল শ্যামা।

“এই তো দিন চলে যাচ্ছে।তুমি কেমন আছো?”

“মন্দ না। নতুন ব্যবসা শুরু করেছি, ঢাকায়, সু মানে জুতার আউটলেট দেওয়া হয়েছে। কাল মিরপুরের শাখা উদ্বোধন হবে। তুমি থাকতে পারবে, বিকেল পাঁচটায়?’’

“হুম, থাকবো। ভাস্কর চৌধুরী থাকছেন তো কাল?”

“না। আমরা আলাদা থাকি, আরিফ। ভাস্কর আর আগের ভাস্কর নেই। মেয়ে দুইটি আমার কাছে বড় হচ্ছে।” বলেই প্রসঙ্গ বদল করলো শ্যামা। “সে আমার কাছে এখন বাইরের মানুষ।”

“ওহ!” আরিফের কণ্ঠে একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল।

বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ক্যাফের জানালা দিয়ে তারা বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য দেখছে। কি যেন মিল খুঁজে বেড়ায় তাতে।

কিছুক্ষণ আনমনা থেকে, শ্যামা ভাবছিল, জীবনের কত কিছুই না হারাতে হলো কিছু পাওয়ার জন্য। আজকাল পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের খুব বেশি মনে পড়ে তার। গতসপ্তাহে মিলার সঙ্গে দেখা হল। মিলার বেশ সুখে আছে বলে মনে হল। মিলা একা একা বড় হয়েছে, বাবা-মার ডিভোর্স হওয়ার পর মায়ের কাছে বড় হয়েছে। তখন মিলার জন্য মায়া হত! আর এখন নিজের জীবনে এমন হল।

আরিফ কফিতে চুমুক দিয়ে জানতে চাইলো, “শুনেছি তোমার মেয়ে দুটি বেশ বড় হয়ে গেছে!”

“হ্যাঁ, বড়জন এবার কুড়িতে পড়ল। ছোটটা ষোল চলছে।” উচ্ছ্বাসহীন ভাষায় জানালো শ্যামা। ভালো ঘর দেখে মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে, সে ভাবনা তাকে বেশ পীড়া দেয়। বলা যায় না সে কথা, কাকেই বা বলবে সে? এক সময় মা বেঁচে ছিলেন, তাঁকে কিছু না কিছু বলে হাল্কা হওয়া গিয়েছে। এখন আর সে সুযোগ নেই। ভাইদের আলাদা সংসার, তাদের এসব কথা বলা যায় না। আরিফের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই বিয়ে করছিস না কেন?”

“বিয়ে! আমি কেন?”

“তা বিয়ে করবি না?”

“আর কিছুদিন যাক, নিজেকে গুছিয়ে নেই। তারপর বিয়ে…”

“আটত্রিশে এসে বলছিস আর কিছুদিন!” অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শ্যামা।

হাসি দিয়ে বিষয়টা আড়াল করে আরিফ। সব কথা কী বলা যায় শ্যামাকে? যা বলা হয়নি কলেজ জীবনে? যাকে ভালোবাসা যায় তাকে শুধু ভালোই বাসা যায়। শেষ থেকে আবার শুরু করার ইচ্ছে তার, শ্যামা কী তা ভাবে? হয়ত ভাবে, হয়ত ভাবে না।

ক্যাফে থেকে বের হয়ে নিজ নিজ গাড়িতে এগিয়ে চলে তারা। এপ্রিল মাস, ঢাকার রাস্তায় আগুন লেগে আছে। ভীষণ জ্যাম ঠেলে উত্তরায় যাওয়া। শ্যামা থাকে গুলশানে, তার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে।

কঠিন রোগ আক্রান্ত রোগী আবার বাঁচার চেষ্টা করে। খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকাই জীবন। নয়ত কেমন করে, পুড়ে যাওয়া হকার্স মার্কেট আবার জমে ওঠে… একমাত্র সন্তান হারানো পিতা কেমন করে ঘুরে দাঁড়ায়। শ্যামাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গাড়িতে ফিরতে গিয়ে রাত দশটা বেজে গেলো শ্যামার। কলিং বেল বাজাতে গেট খুলে দাঁড়ালো নীল কামিজ পড়া বড় মেয়ে অরপা।

বড় মেয়েটার এবার সিক্স সেমিস্টার চলছে, বিবিএ পড়ে, অফিসের কাজে সাহায্য করে নানাভাবে। তাতে করে ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনা শেষ করে মায়ের ব্যবসার হাল ধরতে চায় ও। ছোটটা একটু অন্য রকম। সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে থাকে, কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত।

খাবার টেবিলে বসে চার থেকে পাঁচ বার ডাকা হলো, অর্ষা… অর্ষা.. বলে। মেয়েরা খেয়ে নিলে, নিজে খায় শ্যামা। তারপর রাত জেগে চলে ব্যবসার ছোট ছোট কাগজ ঠিক করা। সারাদেশ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করা। এভাবেই চলছে বছর পাঁচেক ধরে। ভাস্করের সঙ্গে ওর বিচ্ছেদ অনেক আগেই হয়ে যেত, শুধু মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি হয়ে গেল। স্বাধীনতা আর দায়িত্ব যে পাশাপাশি চলে একটা যেমন ভাস্কর বুঝতে পারেনি, পারেনি শ্যামাও নিজেও। কিন্তু কী আর করা। জোড়াতালি দিয় আর অভিনয় করে তো জীবন চলে না। শেষ মেষ সিদ্ধান্ত নিতেই হলো। ভাস্কর এখনো আমেরিকায় থাকে, বিচ্ছেদের পরপরই শ্যামা দেশে চলে আসে। এটা ওটা করতে করতে ভাইদের সাহায্যে এই ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। বড় ভাই বিজিএমইয়েরর সদস্য হওয়ায় বেশ কিছুটা সুবিধা পায় শ্যামা।

আলো নিভে আসছে সারা শহর জুড়ে। বাড়িগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। সকালের আশায়। আবার সকাল হয়, গাড়ি বের হয়ে পড়ে রাস্তায়। কোলাহল শুরু হয়। আরিফের মোবাইলে মেসেজ আসে। শ্যামার মেসেজ, পাঁচটায় মিরপুরে হাসান টাওয়ারে অনুষ্ঠান।

আরিফ যথা সময়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয় ‘শ্যামা সু-কালেকশন’। লাল-সাদা রঙের নান্দনিক নকশা করা শো-রুমের বেশ বাহারি সবকিছু। বেশ ভালো লাগে আরিফের।

“বেশ তো সাজিয়েছো শ্যামা!” আরিফ বলে।

“পছন্দ হয়েছে তাহলে। ছোট মেয়ের ডিজাইন করা। আমি আর কিছু করতে পারলাম কই।” শ্যামা হাসি মুখে বলে। পাশে দুই মেয়েকে নিয়ে। মেয়েরা হাসি মুখে থ্যাংকস জানায় আরিফকে। আরিফ মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়।

শ্যামা একটু রঙ মিশিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,“অর্ষা জানে না, যে তার আংকেল চারুকলার ছাত্র। রঙ সম্পর্কে তার ধারণা বেশ উঁচু মানের!”

একসময় রঙের জীবন ছিল আরিফের। সারাদিন রঙ দিয়ে খেলা, ওয়াটার কালার, জেল রঙ, পেস্ট রঙ আরও কত রকমের পরীক্ষা চলত। এখন এই সময়ে রঙের দারুণ অভাব! তাই বাইরে রঙের বাহার! কিন্তু ভিতর সাদা-কালো।

অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরতে রাত নয়টা। মা নাহিদা আক্তার অপেক্ষা করছিলেন হয়ত, কলিং বেলে টিপ দিতেই দরজা খুলে দিয়ে গেলেন। ডাইনিংয়ে হাটতে হাটতে বললেন,“ তোর ছোটখালা আর খালু আলাদা থাকছেন। খবর পেয়েছিস?”

“কেন আবার কী হলো?” কাতর স্বরে আরিফ জানতে চায়। মাঝে মাঝে যে এই রকম ঘটনা ঘটে তা তো ব্যতিক্রম কিছু নয়।

নাহিদা আক্তার গলায় খাটি সরিষার তেলের ঝাঁঝ চড়িয়ে বলে বসলেন, “তোর খালুর আবারও সেই জিনিস গেলা শুরু করেছে। সেটা নিয়ে গালাগালি চলছে। তোর খালা তো আর ছেড়ে কথা বলার পাত্র না। চলে গিয়েছে সাদিয়ার বাড়ি। ওখানেই তিনদিন ধরে আছে। তোর খালু ফোন দিয়েছিল।”

“তুমি কী বললে?”

“কী আর বলবে! বললাম ছাইপাশ খান কেন?” বিরক্তিভরে বলে নাহিদা আক্তার।

“খালু কী বলল,তোমাকে মা?”

“কী আর বলবে,আগের মতই, “ছেড়ে দেবো আপা।” এটুকুই বলেই শেষ। আবার কোন একদিন খেয়ে বসে বাড়িতে অশান্তি বাধাবে।”

পরিবারের এটা-সেটা নিয়ে আর কিছুক্ষণ আলাপ চলে। তারপর খেয়ে মায়ের রুমে মশারী টানিয়ে, বাতি বন্ধ করে নিজের রুমে ফেরে আরিফ। মনে মনে ভাবে এই যে বাইরের ঝামেলা, বাইরের মানুষ বলে চেঁচায়, ফল হয় কী? সব মানুষ সমস্যা তো ঘর অবদি রোজ সময় মত হাজির হচ্ছে, চাইলেও আসে, না চাইলেও চলে আসে। মিথ্যে মিথ্যে দূরে থাকার অভিনয় করে যাচ্ছি। লাভ তো হচ্ছে না।

আরিফ ঘুমিয়ে পড়ে কিছুক্ষণের ভিতর। গভীর ঘুমে স্বপ্ন দেখে। একট বিশাল বড় কুয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে, তাতে একটা মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে। স্বাভাবিক নিয়মে তার নিজের মুখ দেখার কথা কিন্তু তেমনটি হচ্ছে না। সে ভালো করে লক্ষ করল সেই মুখের ছবি আসলে তার বাবার মুখের প্রতিচ্ছবি। বাবা যেন কি একটা কথা বলতে চায়। খুব ধীরে তিনি কথা বলছিলেন, শোনা যাচ্ছিল না কিছু। আরিফের পায়ের ধাক্কায় একটা পাথর কুয়ায় পড়ে গেল, কুয়ায় তরঙ্গ উঠল। তাতে করে সব কিছু মিলিয়ে গেলো। এমন সময় আরিফের স্বপ্ন ভেঙে গেলো। আরিফ ঐ রাতেই দ্বিতীয় একটা স্বপ্ন দেখলো- শ্যামা দাঁড়িয়ে আছে, কাজী অফিসের সামনে। রজত পাঞ্জাবি পড়ে শ্যামার পাশে দাঁড়িয়ে। আরিফ নিজেও একটা লাল পাঞ্জাবি পড়ে দাঁড়িয়ে। ঠিক কার বিয়ে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। রজত তো বিবাহিত। তাহলে কী শ্যামার সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে।

ভোর রাতের দিকে আরিফের গায়ে জ্বর আসল। জ্বরের ঘোরে আরিফ একবার শ্যামা আর একবার অরুনিমার নাম ধরে ডাকছে। জানালা দিয়ে তখন সুবহেসাদিকের হাওয়া আসছে। দুএকটা জোনাক পোকা হাল্কা সবুজ আলো জ্বেলে ওড়াওড়ি করছে খুব স্বাভাবিকভাবে। ঝিঁঝিঁ ডাকার সঙ্গে পালা দিয়ে দেয়ালে বেড়ে ওঠা ছোট ছোট গাছগুলো দুলছে। পাশের বিল্ডিং থেকে আওয়াজ আসছে কোরআন পাঠের। সূরা আল আর-রাহমান থেকে একটু পরপর ‘ফাবিআইয়্যি আ-লা-ই রাব্বিকুমা তুকায্যিবা-ন।’ ‘ তোমরা আমার কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে?’’

লেখক: শিক্ষার্থী, জাককানইবি

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন