গল্প: ফিরে আসা কিংবা থেকে যাওয়া: ইউসুফ শরীফ

1

ছবি:হীরক মুশফিক

চাচা বুঝলা, আছি তো আছি― নাই তো নাই― 

কথাটা বলে হাসল হাদি― ফিরে আসার পর কথায় কথায় এই অদ্ভুত হাসি। এই হাসির পেছনে কালচে ঢেউয়ের ভয়াল থাবা দেখে― স্বজন হারানোর রক্ষক্ষরণ দেখে মকবুল। তার ভয় হয় হাত-পা কুঁকড়ে আসে― খুব অসহায় লাগে। সে কাউকে বলে না― ভাবে ভয় আর হাহাকার এক সময় মিলিয়ে যাবে― আকাশের ওপারে চলে যাবে। ভাবনার সাথে বাস্তব একই সমান্তরালে এগোয় না― কমেও না বাড়েও না। ভয়-হাহাকার তার কাটেই না― হাদি কাটতে দেয় না। মাঝেমধ্যেই বাঁচা-মরার প্রসঙ্গ তোলে চোখ-মুখে অদ্ভুত অচেনা ভাষা ফুটিয়ে হাসে। হাসি মানুষকে আনন্দ দেয়― কিন্তু ওর এই হাসি মকবুলের শরীরে কাঁটা ফোটায়― তার সদ্যযুবক ছেলের মত মৃত্যুটা তারও হতে পারত― হয়নি।

দুয়েকবার ধমক দিয়েছে, ওই ছ্যামড়া এই রকম হাসবি না― এই হাসি ভালা না।

কাছাকাছি যারা সবাই চোখ তুলে তাকায়। তাদের দৃষ্টিতে বিস্ময় ও ত্রাস একাকার। হাদি কিন্তু নির্বিকার।

বিশ হাত পানির তোড়ে ভেসে যেতে অত ভয় হয়নি মকবুলের। ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে সাগরের নোনা পানি খাড়া পাহাড়ের মত তীব্র বেগে এসে পড়ল। হাত-পা-শরীর― আশপাশের জঙ্গল― প্রকৃতি কোনটাই নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে নেই। তখন আর ভয় ছিল না। ঘন সবুজ বিশাল সুন্দরবনই যদি ঝঞ্ঝা-তরঙ্গের তোড়ে দুমড়ে-মুচড়ে তলিয়ে গেল তো আর ভয় কী!

মকবুল বলে, আচানক ঘটনায় মেলা বিপদ থাকে তয় ভয় থাকে না। এইডা আল্লার কুদরত। ভয় পাইলে মানুষ বাঁচে না কিন্তুক বড় বিপদের পরও মানুষ বাঁচে― বাঁচবার পারে― এই যে আমরা বাইচা আছি―  

মকবুল থেমে যায় তার ছেলে আইনুল ছিল আরেক ট্রলারে― তারা ট্রলার নিয়ে পাড়ে পৌঁছতে পারলেও ওরা পারেনি― কি হয়েছে ওদের ভাবতেও পারে না― মনে হয় শরীর লবনের মত গলে সাগরে নাই হয়ে যাবে। পাড়ে আসলেই কি হত! সে কি বাঁচাতে পারত ছেলেকে? তার ভাতিজা ছমেদের কথা মনে পড়ে। যখন ঝড়ের তোড়ে ফুলেওঠা ঢেউয়ে নুয়েপড়া এক গাছ থেকে হাত ফসকে আরেক গাছে শাঁ করে ছুটে যাচ্ছিল তখন ছমেদ জাপটে ধরে তাকে। সে ছমেদকে ধরেনি― ধরার কোন ফুরসৎ ছিল না― ছমেদ কখন কোনদিকে ছিটকে গেছে তাও মনে করতে পারে না। ছমেদের বউকে পাওয়া গেছে এক গাছের ডালপালাবিহীন কংকালে রশির মত পেঁচিয়ে আছে― শাড়ির ছিন্ন টুকরা দেখে তাকে শনাক্ত করা গেলেও ছমেদের কি হল― এ প্রশ্ন করার আর কেউ নেই। আরও অনেকের মত কালাচানের বউয়েরও কোন হদিস পাওয়া যায়নি। ঝড়ের প্রথম তোড়েই এক ঝলকে বিশুর বউকে বাচ্চা নিয়ে দু’টা জটলাগা গাছের মাঝখানে আটকে যেতে দেখেছে― বাচ্চাটা ছিটকে কোথায় পড়েছে দেখার উপায় ছিল না। নিজের সতের বছরের তাগড়া ছেলে আইনুলের কী হল― জুলেখা সাগরপাড়ে ফেরার পর একবারও জানতে চায়নি। সে জানে ওর ভেতর কী হচ্ছে! সে অবাক হয়ে দেখছে, ছেলে হারানোর বেদনাভার অবলীলায় কোন শক্তিবলে বয়ে বেড়াচ্ছে জুলেখা―

মকবুল ওইদিনের কোন কথা ওদের না বললেও হাদির এই হাসি তীরবেগে ছুটে যাওয়া সেইসব দৃশ্যের বিভীষিকায় ছুঁড়ে দেয় তাকে। সে অস্বস্তি বোধ করে― শ্বাস নিতে কষ্ট হয়―

আজ দুপুরে খাওয়ার পর বিড়ি টানতে টানতে হাদি ওই কথাটাই আবারও বলে। মকবুল বুঝতে পারে সদ্য বিয়েকরা কচি বউটা কোথায় কোন গাছে-ঝোঁপে আটকে হারিয়ে গেছে― এই দুঃখ-হাহাকার হাদি ভুলতে পারছে না। জীবনটা তার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে― তারপরও সাগরের ডাক আবার নিয়ে এসেছে―

একটি বউ ছোট এক শিশু কোলে আর এক কিশোর কাঁধে পোটলা নিয়ে ভরদুপুরে সাগর পাড়ে এসে দাঁড়াল। মকবুলের চোখেই প্রথম ধরা পড়ে পূবদিকের সৈকতে ওদের নড়াচড়া। শিশুটিকে বালিতে নামিয়ে রেখে বউটি সাগর তরঙ্গ আর গর্জন সামনে নিয়ে হামা দিয়ে বসল। শিশুটি তখন দু’হাতে বালি নিয়ে খেলতে শুরু করেছে― ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। মকবুল এগোতে গিয়েও থেমে যায়। ওরা নিশ্চয়ই সিডরের পর ফিরে না যাওয়া কোন আপনজনের খোঁজে এসেছে। হাদি আর কালাচানও এসে দাঁড়ায় তার পাশে। এ ক’দিনে আরও কিছু মানুষ স্বজনের খোঁজে এসেছে এবং হতাশ হয়ে ফিরেও গেছে। হতাশ যে হতে হবে এতে সন্দেহ না থাকলেও আপনজনের টানে তাদের আসতে হয়েছে। তাদের ক্লান্ত দেহ-ফ্যাকাসে মুখমন্ডল আর নিথর চোখের অসহায় দৃষ্টির সামনে সান্তনা দেয়ার মত কোন কথা মকবুলদের ভাষায় নেই― এটা মকবুল যেমন জানে হাদি আর কালাচানও জানে। অসহায় মানুষের সামনে বা পাশে দাঁড়াবার শক্তি বা সামর্থ কোনটাই আসলে তাদের নেই। 

সূর্য পশ্চিমে গড়াতে শুরু করার পর জুলেখা বলে, আপনজনহারা মানুষরে কি কইবে― ক্যামনে সান্তনা দিবে এইটেই বড় কতা― তয় তার চাইতে বড় কতা ওরা লন্ডভন্ড সুন্দরবনখান পার হইয়ে অখন কেলান্ত ওগর দানাপানি পেটে পড়া দরকার―

জুলেখার এই কথা কেউ নাকচ করতে পারে না। মকবুল ভাবছে― সত্যিই তো কথাটা জুলেখারই মনে পড়ল তাদের কারও নয়। সে-ই এগিয়ে যায়। বউটির পাশে বসে পিঠে হাত রাখে। বউটি চমকে ফিরে তাকায়― তার দৃষ্টিতে শূন্যতা-শূন্যতার ভেতর হাহাকার-হাহাকারের মাঝখানে জমাট কান্না। সেই নিঃশব্দ কান্নার ধ্বনি শুনতে পেল জুলেখা― কিছুক্ষণ পর সে বউটিকে হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে এল। শিশুটি কিশোরের কাঁধে ঘুমিয়ে নেতিয়ে আছে―

জুলেখা সানকিতে ঢাকা তার খাবারটুকু ওদের ভাগ করে দেয়। ওরা চুপচাপ বসে আছে। শিশুটি সানকির দিকে তাকিয়ে মায়ের আঁচল ধরে টানছে― অল্পদূরে বসা কিশোরের চোখ-মুখে ক্লান্তি―

জুলেখা বউটির মাথায় হাত রাখে, গেন্দাটারে এট্টু খাইয়ে নিজে এট্টু মুখে দেও― মানুষের খেতি অয় বাচুনির লাগি― এই গেন্দার লাগি তুমার বাচুন লাগবি―

সারাটা বিকাল বউটি তার শিশুকে আঁকড়ে বালিতে শুয়ে ঘুমাল― কিশোর পূবদিকে একটু দূরে বসে থাকল― সাগর গর্জনের ফাঁকে ফাঁকে ওই কিশোর কথা বলে মকবুলের সঙ্গে― বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন কোনটার কিছুটা অর্থ হয় আবার কোনটা নিরর্থক― বলা না বলায় কিছু আসে যায় না। গত ক’দিন এরকম কথাবার্তাই মকবুলদের মাঝে ক্ষীণ আশার সলতে পাকিয়েছে। অল্পদূরে বাচ্চাটিকে বুকে জাপটে ধরে কান পেতে আছে বউটি― সাগর-গর্জনে কী তার জন্য কোন আশার বাণী আছে যা শোনার জন্য উদগ্রীব এই যুবতী বউ! বিপর্যয় মানুষকে কত রকম আশায়-নিরাশায় দোলায়― হতবুদ্ধি করে তোলে―

ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন― বড় ভাইটিই ছিল সবকিছু। এখানে পৌঁছার আগ-পর্যন্ত ভাবীর চোখেমুখে ক্ষীণ হলেও আশার আলো ছিল― এখন চোখ-মুখ শুকনো, তাতে স্থির হয়ে আছে কাফনের মত শূন্যতা― সে নিশ্চিত তার ভাই হয়ত কাফন পায়নি― দাফনও হয়নি তার। ক্ষিপ্ত ভয়াল সাগরের তোড়ে লন্ডভন্ড সুন্দরবনে নাকি সাগরে― কোথায় তার ভাইয়ের জান কবচ হয়ে গেছে! 

কিশোরটি ভাবীর দিকে― শিশুটির দিকে তাকাতে পারে না। ভাইয়ের খোঁজে এখানে আসার পর ভাবীর চোখে চোখ রাখা কঠিন হয়ে ওঠেছে। মায়ের আদর বলতে গেলে সে পায়ইনি― আদর যতটুকু পেয়েছে তা এই ভাবীর কাছেই― তার কোলে-পিঠেই কৈশোরত্ব লাভ করেছে― কেউ কিছু বলে না― কথা শেষ হয়ে গেলে যেমন ঝিম মেরে থাকে তেমনি স্তব্ধতায় ডুবে আছে। মকবুলও কথা শেষ না করে থেমে যায়। দেখে মনেই হয় না― একটু আগেই সে বিদ্যান মানুষের মত প্রকৃতি আর মানুষের সংঘাত বিষয়ক জীবন-দর্শনের কথা বলছিল। সে জানে সাগর-পাড়ে জীবন-জীবিকার মূলধন হল সাহস― সাহস হারালেই সব শেষ― একেকটি তরঙ্গ যেভাবে আরও বড় তরঙ্গের পরতে পরতে মিশে অস্তিত্বহীন হয়ে যায়―

একজন অনেকক্ষণ পর আপন মনে গজরায়, সঙ্গীসাথী কতজনরে গিইলে খাইলে ছিডর― বারোখানা টলারের মানুষ― অহন একখান টলার সাগরে ভাসান যাইবি কি না― কেডায় জানে― কিন্তুক কান্ডখান দেখ মহাজনরে খাইলে না ছিডরে― ট্যাকারে সবেই ডরায়―

হাদি বলে, এক মহাজন গেলে হইতে কী তার জা’গায় আরেক মহাজন খাড়া হইতে― মহাজন ছাড়া কী কুনু গতি আছে― তুমি একখান টলার ভাসাইবের পারবে― না আমরা সবে মিইলে পারবে এই জনমে?

হাদির এই প্রশ্ন অনেকক্ষণ ঘূর্ণির মত পাঁক খায় গাছ-বৃক্ষহীন হাহাকারে মোচড়ানো বিরান সাগর পাড়ে। কেউ টু শব্দও করতে পারে না। যে ট্রলার তারা জানবাজি রেখে গহীন সাগরে ভাসায়― টন টন রূপালি শস্য নিয়ে আসে মাছঘাটায় মহাজনের আড়তে― সেই ট্রলার তাদের নয়― এ কোন মানবজীবন জেলেপল্লীর মানুষদের!

কয়েক ফুট বালির আস্তরের নিচে সাইট-অফিস আর জেলেদের খুপড়িঘরগুলোর কিছু কড়ি-বরগার চিহ্ন থাকলেও থাকতে পারে। সাগরের পাড় ধরে ঘন গাছপালার সবুজ বেষ্টনী ছিল― সেই বেষ্টনীতে মানুষের দৃষ্টি প্রবেশ করতে পারত না― এসব বললে রিলিফ ওয়ার্কাররা অবাক চোখে তাকায়। তাদের মনে পড়তেই পারে― থাকলে কুন্দা হারাইলে নাও― হারিয়ে যাওয়া জিনিসের বিবরণ বড় করে দেয়ার প্রবণতা কমবেশি সবারই থাকে। ফিরেআসা মানুষগুলোর হাহাকার আছে― এই প্রবণতা নেই।

কয়েক মাইল পর্যন্ত গাছপালা বলে কিছু নেই― পুরো বালির স্তরে ঢাকা মাটি কত নিচে কেউ জানে না। এই বালির তলায় গাছের ছিন্নভিন্ন শিকড়বাকড়-বিচূর্ণ ডালপালা থাকলে থাকতেও পারে। মাইল খানেক দূরে ফরেস্ট অফিস ছিল এখন চিহ্নমাত্র নেই― আশেপাশে দুয়েকটা গাছ উপড়ে পড়ে আছে― সেও গাছ নয় গাছের চিবানো কংকাল। মাঝেমধ্যে যে দুয়েকটা কাত হয়ে আছে তা-ও কংকালসর্বস্ব― পত্রপল্লবহীন ন্যাড়া― মনে হয় কেউ হাত দিয়ে ছিঁড়েফেঁড়ে কচলে নিয়েছে সব ডালপালা-পাতা। বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই এগুলোও প্রাণবন্ত গাছ ছিল― সাগরের ঢেউ জোয়ারের সময় এই গাছেদের পত্রপল্লবের সঙ্গে কানাকানি করত।

ফেরার পথে মকবুল হাদিকে দেখিয়ে বলেছে, গাছবিরিক্ষেরও কংকাল হয়― দেখ― তাকায়ে দেখ―

তার কণ্ঠে মানুষ হারানোর শোকের সঙ্গে বৃক্ষ হারানোর শোক মিশে বিরান সৈকতে বেদনা ছড়িয়ে দিয়েছে। শিউরে ওঠেছে হাদি-কালাচান-ইন্নাস-বিশু ওরা। আসতে আসতে তারা মানুষের কংকাল দেখেছে― ক’জন মানুষ-পুরুষ মানুষ না মেয়ে মানুষ বোঝার কোন উপায়ই নেই। এতক্ষণ তারা দেখেছে পঁচেগলে ফুলেওঠা লাশ এখন সাগরের কাছাকাছি পৌঁছে দেখল কংকাল― মাথাভাঙা গাছের কান্ডের সাথে প্যাঁচিয়ে আছে― একটাও হতে পারে আবার একাধিকও হতে পারে। গাছের কান্ড যেন আগুনেপোড়া আর কংকাল ছিটকেপড়ে ছিন্নভিন্ন একগোছা পাট।

দুই

কেয়ামতের মত ওই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পর দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর ক’জন আবার ফিরে আসে― কেন আসে এ নিয়ে তাদের মধ্যে কখনও কখনও মৃদু তর্কও হয়― তারপরও এর জবাব ঠিক ঠিক ঠাহর করতে পারে না তারা। চেতন-অবচেতনের তাগিদ ভাষায় প্রকাশ তাদের সাধ্যের বাইরে হলেও এ প্রশ্নের জবাব নেই তাদের। তবে এটা ভালই জানে― এছাড়া তাদের আর উপায় কী! সাগরের সঙ্গে- সাগরের রূপালি ফসলের সঙ্গে তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস বাধা পড়ে আছে― মায় স্ত্রীলোক পর্যন্ত চেতনায়-ভাবনায়-অভ্যাসে সাগরমুখি। 

ফিরে আসার পর প্রথম কয়েকদিন কারা আছে কারা নেই― এই হিসাব-নিকাশ হা-হুতাশ সেইসঙ্গে স্মৃতি হাতড়েছে তারা। কুলকিনারাহীন সাগরে এক নৌযানে যারা থাকে তাদের মধ্যে পারস্পরিক গভীর সম্পর্ক বিরাজ করে― অবশ্য ট্রলার থেকে নেমে ডাঙায় উঠার পর বিভিন্ন কারণে নানা প্রসঙ্গে অহরহ সম্পর্কের অবনতি ঘটতেও দেখা যায়। তারপরও বিশাল সমুদ্রের উত্তাল বুকে ভাসতে থাকা অতি ক্ষুদ্র এক নৌযানে একসঙ্গে রুজি-রোজগারের লড়াইয়ে নামায় তাদের মধ্যে সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত বাঁচার লক্ষ্যে ঐক্যের― অস্তিত্বের।

একদিকে গর্জনশীল সাগর আরেকদিকে লন্ডভন্ড কংকালসর্বস্ব সুন্দরবন― এ দুয়ের মাঝখানে ওরা ক’জন অসহায় মানুষ স্তব্ধ। কবে সাগরে ট্রলার ভাসবে― তাদের রোজগারের পথ খুলবে এছাড়া আর কোন ভাবনা তাদের কাবু করতে পারছে না। এক সময় কারও কারও মধ্যে কোন রেষারেষি থেকে থাকলেও এখন সব ভুলে দু’টা বৃক্ষের কংকালের মাঝখানে আশ্রয় নিয়েছে― খাওয়া-দাওয়াও একসাথে তাদের―

জুলেখা প্রথমদিনই বলে, কয়জনই আর মানুষ― চিড়া-গুড়ও তো শেষ― রিলিফওলারা যা দিয়ে গেছে তা দিয়েই কয়টা দিন চালাতি হইবে― আবার কবে আইবে তানারা কেডায় জানে― এক লগে খাওনডাই ভালা রান্ধন-বাড়ন তো আমারই লাগবে― মায়ামানুষগুলান কংকাল হইয়ে কুন গাছের লগে লইটকে রইছে কেডায় জানে-

জুলেখার কথা বলার মধ্যে সব সময় এক রকম জোর থাকে কেউ সহজে অমান্য করতে পারে না। রুজি-রোজগারের জন্য সাগরপাড়ে ঠাঁইনেয়া মানুষগুলো তাদের বউরা কেউই জুলেখাকে মান্য না করে পারত না― যে কোন সংকট মোকাবিলায় তার উপস্থিত বুদ্ধি-ব্যবস্থাপনার দক্ষতাই সমীহটুকু আদায় করে নিতে পেরেছে।

সন্ধ্যার আগেই ওদের খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে হয়। জুলেখা ওই বউ আর তার দেবরকে আজ সন্ধ্যায় একমত জোর করেই খাইয়েছে। খাওয়ার পর সবাই যখন দূরে গোল হয়ে বসে বিড়ি ফুঁকছে তখন সে বউটির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হা-হু ছাড়া তেমন সাড়া পায়নি। জুলেখা বুঝতে পারে শূন্যতা-হাহাকার তার ভেতর বেদনার যে স্তব্ধতা সৃষ্টি করেছে তা সহজে ভাঙার নয়।

তামাটে রঙ মেদহীন সটান দীর্ঘাঙ্গিণী জুলেখা এই মাত্র তলিয়ে যাওয়া সূর্যের লাল আভায় চোখ রেখে আনমনে বলে, তোমগর মোহাজন কী ফেরত আইবে নাকি খামকাই সাগর পাহারা দিতিছো?

তার শাণিত কণ্ঠ অনেকের তন্দ্রাভাবে বড় ধরনের ঝাঁকি দেয়। এমনিতেই ঘুমের মধ্যে অনেকে সেই ভয়াল শব্দ শোনে― হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়েপড়া সিডরের সেই পিলে চমকান শব্দে জগৎ-সংসার-অস্তিত্ব সব মিসমার হয়ে যায়। নিশ্চিন্তে শরীর ছেড়ে দিয়ে ক্লান্তি-অবসাদ দূর করার ঘুম তারা ভুলে গেছে―

কালাচান লাফ দিয়ে উঠে বসে, কাকিগো এই কতাখান তো ভাবি নাই― ওই তুমরা কেউ ভাবিছো― কও দেহি― কাকির সওয়ালের জবাবখান দেও দেহি―

হাদি বলে, তাইতো চাচি মোহাজন ফিরত আইবে কি না― আমরা খামকাই সাগর পাহারা দিতিছি কি না― এইসব সওয়াল তো জাগে নাই মনে― কেন জাগে নাই― আমগর মনখান যে ছিডরে ছ্যাবড়া করি গেছে― হেইখান কি ঠিকমতন কাম করতিছে না!

মকবুল বলল, জাগে নাই কারণ আমগর বাচনের লাগি আয়-উপার্জন দরকার― সেইলাগি কাম দরকার আর মোহাজনেরও সেইলাগি আসন দরকার― টলার যোগাড় সবকিছু গোছগাছ করা দরকার― মোহাজন না আইলে তো কিছু হইবে না― কওয়া যায় আমগর বাঁচনের তাকিদই আমগরে এইখানে টাইনে আনছে― দেখবা কাইল বিহানেই আরও কয়জনা আইসে পড়িবে―

কালাচান বলল, কাকা এই কতাখান তুমি জাইনে কইলে না ঠাহর করি কইলে? এক টলারে আছিলাম ছয়তিরিশজনা― আসিলাম ছয়জনা― বাকিরা বাচি আছে না সিডরের পেটে গেছে― কেডায় জানে―

মকবুল ধমকে ওঠে, রাখ এইসব প্যাঁচাল― বাচন লাগবি না? আমরা সাগরের মানুষ― সাগরের নোনা পানির বাতাস-পাহাড়ের লাহান ঢেউ― ঝড়-ঝঞ্ঝা এইগুলানের লগে লড়াই করনছাড়া বাচিবে ক্যামনে?

অনেকক্ষণ চুপচাপ― কারও কোন কথা যোগায় না― এ নিয়ে তারা সহজে কথা বাড়াতে চায় না। ফের সাগরপাড়ে এসে জড়ো হওয়ার যুক্তিও তারা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না― সত্যটা তারা সবাই জানে― কিন্তু জীবন ধারণ-জীবিকা অন্বেষণ বলতে তারা সাগরকেই বোঝে। আসল কথা হল তারা কেউ আর পেছন ফিরতে চায় না― অনিশ্চয়তায় পড়তে চায় না― অভিজ্ঞতা থেকে তারা ভালই জানে― তাদের জীবিকা আর জানের নিরাপত্তা একই সমতলে স্থিত থাকে না― তাদের জীবন যেন পদ্মপাতায় জলের মত টলমল করছে― এসব কথা-ব্যাখ্যা তাদের সবার পেটে আছে মুখে আনে না কেউ― আনতে পারে না― শুধু কী ঝড়-জলোচ্ছ্বাস? দেশি-বিদেশি নৌদস্যুরাও তো মাছ আর জাল-যন্ত্রপাতি লুট করে তৃপ্ত হয় না― মুক্তিপণের জন্য তাদের জিম্মি করে নিয়ে যায়― ওদের কবলে কতজনের প্রাণ গেছে― তারপরও তারা সাগরের মানুষ― এই বাস্তবতা যখন মেনে নিয়েছে তখন তাদের বাঁচা-মরা হাত ধরাধরি করে চলবে― এটা আর না মানবে কী করে!

ঠিক তখনই ওই কিশোর কথা বলে ওঠে, চাচা তাইলে আলেক মিয়ারে আপনেরা কেউ চিনেন না― ওই যে কতায় কতায় গুরুর গান গায়- লালন শা’ গুরুর- খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়…আমার মনের মানুষের সনে মিলন হবে কতদিনে… হে তো কইতো নলগড় ফরেস বাংলার সুজা মাইল দুয়েক গেলেই নতুন ঘাট মানুষে সরগরম― বড় বড় টলার― বড় কুম্পানি―

মকবুল ওকে থামিয়ে দেয়, কি কইলে, মানুষে সরগরম ঘাট― বড় বড় টলার― বড় কুম্পানি― ওইটা তো পূবদিকে এই মাইলখানিক― কিন্তু ওইখানে তো মানুষ দূরের কতা অহন কাক-পক্ষিও নাই― একখান টলারও নাই― কুনু ঘর-ডেরার চিনও নাই― একজনও বাঁচে নাইরে বাপ―

আরেকজন বলল, আমরা গেছি― বেশি দূর আগাবার পারি নাই― অনুমান অর্ধেকখান পাড়ই নাই― সাগরে ঢুইকে গেছে― কুনুদিন জনমনিষ্যি আছিল এই কতাখানও মনে হয় না―

বরাবরের মত এই প্রসঙ্গ তাদের নিস্তব্ধতার চাদরে ঢেকে দেয়― ভেতরে চাপাপড়া রক্তক্ষরণ চাপাই থাকে―

সবাই বালির বিছানায় চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে― জেগে থাকে মকবুল আর জুলেখা। জোয়ারের আগে তরঙ্গ― ওরা বলে সাগর ডাকে― বালিতে শোয়ার পর নির্দিষ্ট সুর-তালে সাগরের গর্জন কিশোরটির ভেতর শূন্যতাকে আরও তীব্র করে তুলল।

জোয়ারের সময় আধাকিলো দূরে উঁচু ঢিবিতে উঠে যায়। বাকি রাতটুকু ওখানেই কাটায়। ভোরে সৈকতের ভেজা বালিতে প্রথম তাদের পায়ের ছাপ পড়ে― জোয়ার জলে-তরঙ্গে তাদের প্রতিদিনকার অস্থির পায়ের ছাপ মুছে যায়। প্রতিটা দিন বরাবর নতুন করে শুরু করতে হয়।

তিন

কিশোর আর বউটির ঘুম ভাঙে খুব ভোরে। সৈকতের এই অংশটা দক্ষিণে বাঁক নিয়ে সাগরের ভেতর ঢুকে গেছে। ভোরের সূর্য সাগরের ঢেউয়ের ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে উপরে ওঠে আসে। আজকের এই সূর্যোদয় বউটির জন্য একেবারেই নতুন। তার এতকালের সূর্যোদয় ছিল গাছবৃক্ষের ঘন সবুজ ঘের ডিঙিয়ে ছোট্ট উঠানে লাফিয়েপড়া। নতুন রকমের এই সূর্যোদয় তার জন্য নতুন কোন বার্তা বয়ে এনেছে কি না তা কিশোরটি ভাবেনি― ভাবেনি জুলেখাও। এ দু’জনই তাকে সাগর-তরঙ্গে সূর্যের বিস্তারে চোখ রেখে বসে থাকতে দেখেছে।

এই বউ আর কিশোর সন্ধ্যারাতে মকবুলদের ওইসব কথায় হতাশ হয়েছে বলে মনে হয়নি জুলেখার। বউটি তো ছিল আড়াগোড়া নীরব যেন বোবাই হয়ে গেছে। এসব কথা যত হতাশাই ছড়াক তবু তার চোখের কোণে একতিল আশা যেন জেগে আছে। রাতে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে― যাবে ওই জায়গায়― মাইলখানেক পথ তো আর বেশি নয়― এতদূর এসে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় না। খুব ভোরে বউটি তার শিশু সন্তানকে বুকে আঁকড়ে আর কিশোরটি কাঁধে পোটলা ঝুলিয়ে নির্বিকার চিত্তে পা ফেলে এগিয়ে গেল পূবদিকে―

সেদিন সন্ধ্যায় খেয়ে শোয়ার পর জুলেখা বলল, আমি তো বুইঝবার পারতেছি না তুমগর মোহাজন আসিবে― না তুমরা বেক্কলের লাহান সাগর পাহারা দিতিছো!

কেউ কথা বলে না― কারও কাছে এর নিশ্চিত কোন জবাব নেই।

জুলেখা বলল, সাগরের নোনতা পানি খাইয়ে পেট ভরিবে! ভরিবে না― আমার সওয়ালখান ভাইবে দেখি কি করিবে জলদি করিবে― রিলিফের লোকেরা আর আইবে বইলে তো মনে কয় না―

মকবুল বলল, অতো পেঁচাল পারিস না বউ― তুই ঘুমা―

জুলেখা বলল, আরে ধোন্দা বেডায় কয় কী! সিডর কি আমগর ঘুম রাইখে গ্যাছে?

মকবুল বলল, কইলাম তো অহন ঘুমা― মোহাজন বলিছে এই হপ্তার মধ্যি আসিবে― হইলে তো―

হাদি বলল, চাচি তুমি হইলে মিলিটারি মিজাজের আর আমগর সাব হইলে হুমিপেথি-

জুলেখা এবার মকবুলকে লক্ষ্য করে প্রসঙ্গ পাল্টাল, আমি ভাবি দেইখলাম, আর ডিডিটি দিবাম না শুটকিতে― ছিডরে মেলা মানুষ মইরছে― বিষ দিয়ে মানুষ মারা আর না―

মকবুল ভয়ে ভয়ে বলল, ডিডিটি ছাড়া শুটকি নিবে কারবারিরা?

জুলেখার সহজ জবাব, না নিক―

মকবুল প্রশ্ন করল, তাইলি চলবি ক্যামনে?

জুলেখা পাল্টা প্রশ্ন করল, আগেরদিনে মানুষ কি দিতে তহন তো ডিডিটি আছিলে না? তারা কি শুটকি বানায়া চলতি না? শুটকিতে এই বিষ আর দিবাম না আমি কইয়ে রাখলাম―

প্রসঙ্গ শেষ করার আগেই মকবুল উঠে প্রস্রাব করতে যায়। জুলেখার সঙ্গে পারা সম্ভব নয়, এটা সে ভালই জানে।

এরপর ওই বাচ্চাসহ বউ আর কিশোরটির কথা ওঠল। ওই বিরাণ সাগরপাড়ে ওরা কি করে রাত কাটাবে এই ভাবনায় জুলেখা অস্থির হয়ে ওঠল। সন্ধ্যা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করেছে― এই বুঝি ওরা ফিরে আসে। ওদের শোক আর হতাশা কাটাবার জন্য কি কি বলা যায় তাও ভেবে রেখেছে-

ওই কিশোর আর বউয়ের প্রসঙ্গ শেষ পর্যন্ত গড়াল নিজেদের ভবিষ্যত আলোচনায়।

পরদিন খুব ভোরে সাগরে গোসল সেরে ওরা দুপুরের পর ফিরে এল মকবুলদের কাছে। কিশোরটি মকবুলের কাছে এসে দাঁড়াল। মকবুল দেখল, ওর চোখে তারুণ্যের নিশ্চিত দৃষ্টি ঝলসে ওঠছে। প্রথমদিন ওকে যতটা কচি-কিশোর মনে হয়েছিল আজ তা মনে হচ্ছে না। চোয়াল শক্ত আর গোঁফের রেখাটা চনমনিয়ে ওঠছে― হাত-পায়ের মাংশপেশিতে টানটান ভাব। হতাশার তেমন কোন চিহ্ন দেখা গেল না চোখেমুখে। মকবুল ফিরে তাকাল বউটির দিকে। সে আগ্রহভরে তাকিয়েছিল এদিকে― ঠিক এদিকে বলা যাবে না― তাকিয়েছিল কিশোরটির দিকেই। বউটির চোখে নতুন করে আশার আলো ফুটছে― উচ্ছ্বাসের ঢেউ ভাঙছে। কিশোর বউটির দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারছে না।

কাল রাতে একটা গাছের কংকালের গোড়ায় শুয়েছিল ওরা। চোখে তো ঘুম আসে না― আকাশ-তারা-সাগর-তরঙ্গ আর দূরে ধ্বংসপ্রাপ্ত বনের ধূসরতা ছাড়া কোথাও আর কিছু নেই। অকস্মাৎ কিশোরটি দেখল সাগর তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে তার ওপর ঢেকে-গিলে ফেলছে তাকে― সে লাফ দিয়ে উঠে বসল। পাশে বাচ্চাটি অঘোরে ঘুমাচ্ছে― ওর ভাবী নেই―

অস্থির দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল― জোছনা নেই― ধূসর আলোতে দেখল জোয়ার আসায় সাগর অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। সাগর তরঙ্গের উপর কুয়াশার মত একরকম আলো লুটোপুটি করছে। ওখানে স্থির হয়ে আছে একটা ঘন ছায়া― উবু হয়ে আছে সাগরের দিকে―

সে এগিয়ে গেল― ঢেউয়ের তলায় অতল সাগরে কী দেখছে ভাবী? অনেকক্ষণ পর স্থির ছায়াটি নড়েচড়ে ওঠল― ফেনামাখা বালি আর পানিতে বসে হাত সাগরের পানি নাড়তে লাগল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও ভাবীর কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করল না। তার ভয় হল ভাবী কী সাগরে ঝাঁপ দেবে!

কিশোর জোর গলায় ডেকে ওঠল, ভাবী―

কোন সাড়া নেই। বিহ্বল কিশোর এবার ভাবীর একটা হাত ধরল, ভাবী―

ওর ভাবী আচমকা ঘুরে সোজাসুজি ওর চোখে তাকাল, যেখানে সাগর-তরঙ্গের ওপর জমেওঠা ফেনার আবছা আলোর ছায়া।

অনেকক্ষণ পর ভাবীর ভাঙা খসখসে কণ্ঠ ভেসে এল, সালেক― আমার কি মনে কয়― জানস তর ভাইয়ে আছে এইহানে সাগরের মধ্যিখানে― পলাইয়া পলাইয়া আমগরে দেখতাছে মজা করনের লাগি―

এত কাছে ভাবী অথচ তার মনে হল ভাবী যেন অনেকদূর থেকে সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে কথা বলছে― নাকি সাঁইজির সেই গান ধরছে― আমার মনের মানুষের সনে মিলন হবে কতদিনে― ঢেউয়ের পরতে পরতে ভেসেআসা ওই সুর কিছু বোঝা যায়― কিছু বোঝা যায় না অনেকটা স্বপ্নের মধ্যে শোনা কথার মত― ভাল লাগে আবার ভয়ও হয়―

সালেকের উদ্বেগ চরমে ওঠল, চল ভাবী― কাইল বিহানেই আমরা ফিইরা যাই―

ভাবীর কণ্ঠ উদাস, আমার মনডায় চাইতাছে নারে―

সালেক বলল, যাওন তো লাগবেই―

ভাবী সাগর-তরঙ্গের উপর লুটোপুটি কুয়াশার মত ফেনার আবছা আলোতে ওর চোখে দৃষ্টি রাখল, ক্যান যাইবাম কই যাইবাম―

থেমে একবার সালেক আরেকবার সাগরের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, ওই লোকগুলান বড় ভালারে― তাগর লগে থাইকা যাই― তুই সাগরে যাইবি― আমি জুলেখা চাচির লগে শুটকি বানাইবাম― পোলাডা বড় হইলে তর লগে সাগরে যাইবি― গেরামে ফিইরাও তো গতর খাটাইতে অইবি― হেইখানেও তো সাগর আছে― মানুষের চেহারায় হাঙ্গর-কুমির আছে― ঝড়-তুফানও আছে― তুই ক’ কই গিয়া শান্তিমতন থাকন যাইবি? এইখানে তর ভাইর কাছে থাকলাম― আমি-তুই আর এই পোলা― আমগরও তো পোলাপান আরও হইবি হইবি না―

ভাবী কী কথা বলছে বুঝতে না পেরে অবাক সালেক― সেই ছোট্টবেলায় মা মারা যাবার পর বাড়িতে ভাবী এল― তখন থেকে ভাবীর সব কথাই তো সে বুঝতে পেরেছে― মায়ের অভাবও সে টের পায়নি। বিস্মিত সালেক ভাল করে তাকাল ভাবীর দিকে― ভাবীকে অন্যরকম লাগছে― কী রকম সে ঠিক ঠাহর করতে পারছে না― মনে হচ্ছে জিনেধরা মানুষের মত― জিনে ধরলে মানুষ বিকৃত স্বরে অদ্ভুত কথা বলে― যা খুশি তা বলে। ভাবীর কাঁপা কাঁপা স্বর ঠিক বিকৃত মনে হচ্ছে না― কথাগুলো সরল অথচ সে বুঝতে পারছে না―

ভাবী হেসে ওঠল, কিরে কতা কস না ক্যান― তুই পারবি না―

সালেক চোখ নামিয়ে বলল, চল ভাবী―

ভাবী আবার হেসে ওঠল, পুরুষ মানুষের শরম মানায় নারে―

ভাবী কী চেনা-অচেনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার হাত ধরল― কাছে টানল― টেনে বুকে জড়িয়ে নিল!

কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, দেখ কত বড় সাগর মনে কয়― দুনিয়াডাই সাগর― এই সাগরের সামনে খাড়াইয়া আমরা এক হইয়া গেলাম― আর কুনু ফারাক নাই― তুই আর আমি এক হইয়া এইখানে বাচবাম― বাচন লাগবি― বাচন ছাড়া গতি নাইরে মানুষের―

ভাবীর চিকন কণ্ঠে বাজছে― আমার মনের মানুষের সনে― মিলন হবে কতদিনে.. শোনা যায় কি যায় না এমন করে সাগর-তরঙ্গের সঙ্গে মিশে সেই টানা দীঘল সুর ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের ঘিরে―

ছোটবেলায় ভাবী তাকে গোসলও করিয়েছে― অসুখবিসুখে সেবা করেছে― কই ভাবীর স্পর্শে তার শরীর তো এরকম শিহরিত হয়নি! ভাবীর শরীর এত মোলায়েম― শ্বাস-প্রশ্বাস এত উষ্ণতা― সালেক আর কিছু মনে করতে পারে না― সাগরের গর্জন কী করে শরীরে সঞ্চারিত হয়― শরীরের ভেতর তরল তাপ কী করে ফেটে পড়তে চায়― অনাস্বাদিত এই গোপন-মোহন অভিজ্ঞতা ছাড়া কিশোর সালেকের কাছে আর সবকিছু নাই― হয়ে গেল―

মনে আছে শুধু সাগরে জোয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমন্ত শিশুকে নিয়ে ওরা দু’জন সমান তালে হেঁটে উজানের দিকে সরে এসেছে মাত্র― বিচ্ছিন্ন হয়নি―

মকবুল কিছু না বলে ওদের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। কালাচান মাঝখান থেকে বলে ওঠল, কি মিয়া রাইতে আইলে না― আমরা চিন্তা করছি― সাগরের পাড়ে থাকনের অভ্যাস নাই― কী জানি হইলে―

সালেক গলায় বাড়তি জোর দিয়ে মকবুলকে স্পষ্ট বলল, চাচা আমারে আপনেগর লগে লন―

প্রথমদিন থেকে জবুথবু ও নিথর হয়ে থাকা বউটি যেন গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠেছে। চোখেমুখে নতুন স্বপ্ন ঝকমক করছে।

সে এগিয়ে এসে প্রাণবন্ত এক কিশোরীর মত বলে ওঠল, হ গো চাচা আমরা আর ফিইরা যাইতাম না― আমগরে রাখেন হে আপনেগর লগে সাগরে যাইবে― আমি চাচির লগে শুটকির কাম করবাম―

মকবুল কিছু বলার আগেই হাসতে হাসতে এগিয়ে এল জুলেখা, সাগর অনেক বড়― সাগরের ফসল বেশুমার― এই সাগর কাউরে ফিরায়া দেয় না― বুঝলা বউ―

তারপর কিশোর সালেককে বলল, সাগরে পুরুষ মানুষের খালি সাহস আর তাকদ লাগে― এই দুইখান থাকলে সাগর আর ডাঙ্গা এক বারবর- বিশ্বাস না হইলে জিগাও তুমার চাচারে-

এবারও মকবুল কিছু বলতে পারল না, জুলেখা রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে বলল, শোন মিয়া, একখান কতা কই, এইডা কুনু শরমের কতা না- ষোল বছরের পুরুষ আর ছয়তিরিশ বছরের পুরুষ এক বরাবর― মেয়েমানুষও তাই― এইসব নিয়া ভাববা না― আমরা আছি তুমরাও থাকবা―

এবার মকবুল বলল, তুমার চাচি যা কইছে তার কুনু জবাব নাই― শক্তি আর তাকদ হইলে আসল কতা― এই দুইখান থাকলে সাগরপাড়-জঙ্গল-গেরাম বেবাকই মানুষের বাঁচনের লাগি একরকম―

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী, ঢাকা।

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন