গল্প: দাঁড়কাকের মায়া: ইসতিয়াক আহমেদ জিহাদ

0

অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

সন্ধ্যাতারা সুবিশাল আকাশে উঠেছে কি উঠে নাই। সূর্যাস্তের লাল আভা সবে মাত্র ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। প্যাঁ পোঁ শব্দ করে ছুটে চলছে স্বার্থপর শহরের মানুষখেকো কুৎসিত যানবাহনগুলি।  
রাস্তার দুধারের ফুটপাতগুলো মুখরিত হয়ে আছে মধ্যবিত্তদের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ দুরন্ত পদভারে। হুট হাট করে দু একটা বিদঘুটে দাঁড় কাক উড়ে যাচ্ছে নীড়ের খোঁজে।


আতিয়া দ্রুত পায়ে হেঁটে চলছে। একটু দেরি হলেই বাসটা মিস হয়ে যাবে । তখন আবার বেশী টাকা ভাড়া দিয়ে রিকশা করে যেতে হবে।
পুট করে শব্দ হয়ে আতিয়ার সেন্ডেলের ফিতে ছিঁড়ে গেল। এই নিয়ে ১০ বার ছিঁড়ল। প্রত্যেকটা ফিতেই ইতিমধ্যে তিনবার করে সেলাই করা হয়ে গেছে।
কি আর করা! আতিয়া জুতা জোড়া খুলে খাবারের ব্যাগে রেখে দিল। বাড়িতে গিয়ে তার বাবার কাছ থেকে সেলাই করে নিবে। শুধু শুধু টাকা খরচ করার কি দরকার। এমনতেই অভাবের সংসার। তার একার উর্পাজনের উপর বেঁচে আছে তার বাবা, রুগ্ন মা, ছোট ছোট দুটো ভাই বোন।
এই সন্ধায় বাসগুলো একেবারে লোকজনে ঠাসা থাকে। আতিয়ার এসব বাসে ঝুলে যেতে একদম ভালো লাগে না। বাসের সব লোক কেমন যেন ড্যাব ড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর বসার জায়গা না পেয়ে যখন দাঁড়িয়ে যেতে হয় তখন কত লালায়িত পুরুষ যে তার শরীরে হাত দিয়ে তাদের পৌরুষত্বের জানান দেয় তার হিসাব নেই। প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি লাগত অপমানবোধ তার ভেতর টাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। কিন্তু এখন ওসব গা সওয়া হয়ে গেছে। আতিয়া মেনেই নিয়েছে, যেন এটাই স্বাভাবিক শিক্ষিতদের এই ভদ্র সমাজে।
আজও বাসে সিট পেল না আতিয়া। পুরো বাস মানুষে গিজ গিজ করছে। অতি কষ্টে একটু ঠেলে ঠুলে জায়গা করে দাঁড়ালো সে। নিত্যকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে বেশি সময় লাগল না। শরীরের সব স্পর্শকাতর জায়গাগুলতে চলতে থাকল পশুদের খসখসে হাতের অবাধ বিচরণ। আজ কেন জানি আর সহ্য হল না আতিয়ার। অস্বস্তিতে পুরো শরীর গুলিয়ে উঠল। কোন রকমে ড্রাইভার কে বাস থামাতে বলেই নেমে পড়ল বাস থেকে।
পাশের ডাস্টবিনের কাছে যেতেই শরীর গুলিয়ে সব বাইরে বেরিয়ে আসল।
মাথা ধরে ঝিম মেরে ফুটপাতে কিছুক্ষন বসে থাকল আতিয়া।

সে ভেবে পেল না কেন সে এই পশুদের বিরোধিতা করছে না?

কিসের আশায় সে নীরবে সব সহ্য করে যাচ্ছে ?

সে ভালো করেই জানে তার অভাবের এই অন্ধকার জীবন কখনই সুখের আলো দেখবে না। তবে কেন সে পশুদের হাতে বারবার নির্যাতিত হবে?

কেন মুখ বুজে সব সহ্য করে যাবে?
নাহ এ কিছুতেই হতে পারে না।
পাশের দোকান থেকে ৫ টাকায় একটা শার্প ব্লেড কিনে হাতের মুঠোয় রেখে দিল আতিয়া।

নতুন আরেকটা বাসে উঠল। এবারও বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়েই থাকলো।

আবারও পশুদের অত্যাচার শুরু হল। কিন্তু এই আতিয়া তো সেই আতিয়া না। ক্রোধে ধিক ধিক করে চোখ জোড়া জ্বলে উঠল আতিয়ার। ব্লেডের খোসা ছাড়িয়ে সজোরে চালিয়ে দিল।
পশুটার হাত কেটে ফিনকি দিয়ে পড়া শুরু হল রক্ত। পশুটার গগনবিদারী চিৎকারে ড্রাইভার ব্রেক কষল। তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে সামনে পড়ে গেল আতিয়া । শুধু একটা কথা কানে আসল তার।

পকেটমার ! পকেটমার !

পকেট কাটতে গিয়ে হাতে ক্ষুর মেরেছে।
এরপর অতিয়ার পুরো শরীরের উপর চলতে থাকল অবিরাম কিল ঘুষি লাথি।

অতিয়া অতি কষ্টে চোখ দুটো মেলে নিজেকে আবিষ্কার করল একটা রোড লাইটের নিচে। তার ওড়নাটা দিয়ে পিছমোড়া করে বেধে রাখা হয়েছে তাকে। চারদিকে গোল হয়ে দাড়িয়ে আছে কিছু উৎসুক মানুষ।
আতিয়া হাটু দুটোকে বুকের কাছে মুড়ে নিয়ে বুকটা আড়াল করে রাখল উৎসুক জনতাদের থেকে।
একটু পরেই একজন এসে তার চুলে ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে কাচি চালাতে লাগল ।এক গোছা করে চুল ফুটপাতে পড়তে থাকল আর আতিয়ার বুকটা ফেটে যেতে থাকল তীব্র যন্ত্রনায়।
আতিয়া চিৎকার করে বাধা দিতে চাইল। কিন্তু একটু শব্দ গলা দিয়ে বের হলো না। আর একবার চেষ্টা করতেই বেরিয়ে এল তাজা রক্ত।
অপমান আর যন্ত্রণায় চোখ থেকে ঝরতে থাকল অশ্রু। যে অশ্রুর থামবার কোন নাম নেই। সেই জলরাশি সোডিয়াম লাইটে চিকচিক করে জ্বলতে থাকলো মুক্তার মত।

রেলস্টেশনের পাশের ডাস্টবিন থেকে অধখাওয়া একটা রুটি ঠোঁটে করে নিয়ে মোমেনা পাগলীর কাছে গিয়ে ফেলল একটা দাঁড়কাক। গাপুস গুপুস করে পরম শান্তিতে সেই রুটি ছিঁড়ে খেতে লাগল মোমেনা পাগলি ।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাককানইবি।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন