গল্প: অপবাদ: মুহাম্মদ বেলাল

0

অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

সকাল বেলা। নয়টার কাছাকাছি। তুহিন স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। বাবা গেছেন কাজে। ঘরে আর কেউ না থাকায় সে ঘরের দ্বার রুদ্ধ করে বের হল। তার মা তাকে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে বাড়িতে রেখে গেছেন। আর তিনি অন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন কাজের খোঁজে, পেটের ক্ষুধার তাগিদে। তুহিন স্কুলে যাওয়ার পথে শুনতে পায় বাবুল মিয়ার ফোন চুরি হয়েছে। তুহিন আর সেখানে দাঁড়ালোনা। সে ভাবল, এতক্ষণে বোধহয় ক্রিকেট খেলা শুরু হয়ে গেছে। সপ্তম শ্রেণি আর অষ্টম শ্রেণির নাকি টুর্নামেন্ট আছে।

তার স্কুলটা টিনশেড। সামনে ছোট একটা মাঠ। তুহিনের খুব ভাল লাগে স্কুলে যেতে। যেদিন স্কুল বন্ধ থাকে সেদিন খুব খারাপ লাগে তার। স্কুল শেষে সে বাড়িতে ফিরে দেখে বাবা রান্না-বান্না শেষ করে রেখেছেন। আর বাবার আসতে দেরি হলে প্রায়শই সে নিজেই সংক্ষেপে কিছু রান্না করে। আজ তার আর দরকার নেই। সে ভোজন সেরে ঘরের পিছনে মাঠে খেলতে চলে যায়। খেলাধুলা শেষে সন্ধ্যায় নামাজ আদায় করে পড়তে বসে। মাঝে-সাঝে স্কুল বন্ধ থাকলে কাপড়-চোপড় ধোয়। এভাবেই তুহিনের নিত্যদিন গড্ডালিকা প্রবাহের মত অতিবাহিত হতে থাকে। গায়ের সাধারণ কৃষাণ কৃষাণীর জীবন যেমন দিনের আলোর সাথে শুরু হয় আর সন্ধ্যার আঁধার নামার সাথে সাথে সমাপ্ত হয়, তুহিনের নিত্যকর্মও তেমনই ঠেকে নিজের কাছে।

বাবুল মিয়ার ফোন চুরির আজ চার দিন চলে। এর মধ্যে তুহিন খেয়াল করল সবাই যেন তার দিকে কেমন করে তাকায়। সামনে থেকে সরে এলে টিপ্পনী কেটে হাসে। সে বুঝতে পারছিল না, ব্যাপারটা ঠিক কী?

এর ঠিক দুদিন বাদে হঠাৎ রবি কাকার ছেলে রাহাতের সাথে তুহিনের ঝগড়া হয়। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রাহাত তাকে বলে বসল-চোর, বাবুল কাকুর ফোন চোর।

হঠাৎ তুহিন বুঝতে সক্ষম হল। তার কচি কিশলয়ের মত কিশোর মনে হঠাৎ ধারালো ছুরির আঘাতের মত সবেগে চিনচিন করে উঠল। কেন সবাই তার দিকে অমন ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, টিপ্পনী কাটছিল সব স্পষ্ট হয়ে গেল তার কাছে। সে দ্রুতপদে আয়শা বুয়ার কাছে গিয়ে কেঁদে ফেলল। আয়শা বুয়া তাকে ছোট ভাইয়ের মতো আদর করে। এখানে আয়শা বু’র মত আপন আর কাউকে তার মনে হয় না। তাকে সে বড় বোনের মতই জানে। সে তুহিনকে কারণ জিজ্ঞেস করলে তুহিন কেঁদে কেঁদে বলল- রাহাত বলে আমি নাকি বাবুল কাকার ফোন চুরি করেছি।

আয়শার মাথায়ও যেন বাজ ভেঙে পড়ল।আয়শা বুয়া তুহিনের বাবাকে ডেকে তুহিনকে সাথে করে রবির ঘরে যায়। গিয়ে রবির বউকে বলে-ও ভাবী, তোমার পোলা তুহিনরে কি কইছে হুনছ?

রবির বউ জিজ্ঞেস করল-“কি করছে আমার পোলা?”

-তোমার পোলায় নাকি কয়, তুহিন বাবুল ভাই’র ফোন চুরি করছে? এই পোলা কি এমন পোলা। ও আমাগো ঘরের পাশে দুই বছর ধইরা আছে। কই কখনও তো এমন কোন বদনাম শুনলাম না?

-হ আমরাও তো কই ওর কথা। আহারে! পোলাডা একা একা থাকে। কই আমাগো ঘরের বজ্জাত পোলাডা কই? ওরে ধইরা আইজকা ধোলাই দিমু। তোমরা যাও। আমি ওর বাপ আইলে কমুনে।

আয়শা বুয়া তুহিনকে নিয়ে ঘরে চলে আসে।

পরে তুহিনের বাবা তুহিনকে ঘরে যেতে বলে। তারপর আয়শাকে জিজ্ঞেস করে-আয়শা, তুমিই কও মা। আমার পোলা কি এমন? তোমাদের চোখের সামনেই তো আছে দুই বছর যাবৎ।

আয়শা বুয়া বলে-খালু কি বলমু? ওরা তো আমার কাছে আইসাও বইলা গেছে। সেদিন নাকি ফকির বাড়ি গেছিল। ফকির নাকি তুহিনের নাম বলছে। আমি বইলা দিছি এই ছেলে এমন না। ফকির ভুল গণকদারি করছে। তোমরা ভুল করতাছো।

সেদিনের পর থেকে আর আশপাশের কেউ তুহিনের সামনে এ ব্যাপারে তেমন কোন কথা-বার্তা বলেনি। শুধু বাবুলের স্ত্রী একদিন তুহিনকে খোঁচা মেরে  বলেছিল-“আমি চাউল পড়া আইনা খাওয়ামু, চোর যাইব কই?

তুহিন তাতে কোন ভয় পায়না। সে শুধু ভাবে তার মায়ের একটা কথা-“সাপ যারে ছোবল মারে, বিষে তারেই ধরে।” তুহিন ভাবে, অপরাধ যেহেতু আমি করিনি, সুতরাং শাস্তিটাও আমার প্রাপ্য নয়। আর পাবোও না। এ আমার অটুট বিশ্বাস। সে আবার চিন্তা করে, সবাই কেন আমাকেই সন্দেহ করে। এর রহস্যটা আমাকে বের করতেই হবে।

সেদিনও স্কুলের পাশে গাজীর দোকানে বাকীর জন্য গিয়েছিল। কিন্তু গাজী বলেছে তাকে আর কখনও বাকী দেবেনা। এর একটু আগে বাবুলের বউ বাপের বাড়ি থেকে ফেরার পথে গাজীর দোকানে বসে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়ানো তুহিনকে দেখিয়ে কি সব যেন বলে গেল। তার ঠিক পরক্ষণেই গাজী তাকে বাকী দিতে নাকোচ করে দেয়। তুহিন স্কুল থেকে ফিরে আয়শা বুয়ার কাছে গেল। স্কুলের ঘটনাটি বলার পরে বলল-“আয়শা বু, আমি তো চুরি করিনাই তাহলে এরা সবাই আমার কথা বলে কেন? আমার খুব খারাপ লাগে বুবু। আমার মা নেই কাছে। এমনিতেই মায়ের কথা খুব মনে পড়ে!

বলে সে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। আয়শা বু’ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল-“শোন ভাই, তোদের স্কুলের কাছে বানকি ফকির আছে না?”

-‘হুম’

-তার কাছে নাকি বাবুল আর তার বউ গেছিল। বানকি ফকিরতো ঝাড়-ফুঁক ছাড়াও গণকের কাজও করে। সে-ই নাকি তোর কথা বলছে।

-বুবু আমি শুনছি গণকরা নাকি নাম বলে না।

-হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু যা যা বর্ণনা দিছে সবই নাকি তোর সাথে মিলে যায়।

তুহিনের হঠাৎ খুব কাঁদতে ইচ্ছে করল। বুকে কষ্ট চেপে নিয়ে সে বলল, ‘মানুষ কতটা অসচেতন, কতটা বোকা হলে এসব আজেবাজে ফকির-ফাকরা বিশ্বাস করে, বুবু। আমি আগে ভাবতাম এরা সঠিক না। কিন্তু প্রমাণ ছিল না। আর আজ আমি নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও যখন আমার নাম বলেছে, তাতে আর বুঝতে বাকি নেই এরা কতটা অসফল, এবং কপটতাপূর্ণ। ধোঁকাবাজির বিষয়গুলোকে মানুষও কত সহজে বিশ্বাসের সঙ্গে মর্যাদা দিচ্ছে। জাতির মগজে কুসংস্কারের বিষ ঢেলে দিয়ে স্বার্থ হাসিলের পায়তারা করছে এই স্বার্থান্বেষী মহল।’

তুহিনের ভিতর থেকে ঘৃণা তেতে উঠছিল। আয়শা তার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল কিন্তু ব্যর্থ হল। সে আবার বলল,-ওই ভণ্ড ফকিরের দল এতদিন খোলস আবৃত ছিল। এখন আমার চোখে এসব আরও স্পষ্ট হল। যাই হোক বুবু, আমিতো চুরি করিনি। তাই আমার বিশ্বাস আমার কিছু হবেনা।

-শুনছি আগামীকাল নাকি চালপড়া খাওয়াবে। তোরেও থাকতে বলছে।

-অবশ্যই থাকব বুবু। শুনেছি মজনু মেম্বারও নাকি আসবে। আসুক। আমি নিঃসঙ্কোচে বলতে পারব। আমি চুরি করিনি, আমি চোর না।

আয়শা সকালবেলা তুহিন আর তার বাবাকে নিয়ে একসাথেই গেল। তুহিন চাল মুখে নিয়ে চিবোচ্ছে। সবাই তার দিকে উৎসুক ভঙ্গিতে দেখছে। জাকিরের বউতো নিজের চাল চিবানো বাকি রেখে তুহিনের চাল চিবানো দেখতে লাগল। সন্দেহকৃত চোরের চিবানো চাল কতটা মিহি হয় দেখার জন্য!

এসব জিনিস তুহিন বিশ্বাস করেনা। তবুও সবাই যখন তাকেই সন্দেহ করে তাই সে গেল। সে জানে চালপড়া দিয়ে চোর ধরা পড়বেনা। যদিও কেউ কেউ বলে অনেক জায়গাতেই তো ধরা পড়েছে। কিন্তু তা অন্য ব্যাপার। চালপড়ার কথা যখন চোর শোনে তখন তার মধ্যে একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয় এবং ভয়েই সে স্বীকার করে ফেলে। অথবা চালপড়ার ব্যাপারে মানুষের মনে আরেকটা ধারণা আছে। চোর নাকি এই চাল চিবিয়ে গলধঃকরণ করতে গেলেই গলা দিয়ে রক্তক্ষরণ হবে এই ভয়েও অনেক চোর তার দোষ স্বীকার  করে।

তুহিন ভাবে তার তো এমন কোন ভয় থাকার কথা না। কারণ সে নির্দোষ।  চালপড়া আনার ব্যাপারটাকে তুহিন স্বাভাবিকভাবে নিলেও বানকি ফকিরের মিথ্যা ও ভুল গণনার জন্য তুহিনের মনে খুব কষ্ট। এই একটা কারণেই আজ তার গায়ে অপবাদের কালো ছায়া পড়েছে। আসল চোর ধরা না গেলে এই অপবাদের কালি কেউ কি মুছে দিতে পারবে? কেউ পারবে একটা নির্দোষ কিশোরের মনের ক্ষতের দাগ মুছে ফেলতে?

সেদিন চালপড়া খাওয়ানো হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু এরপর আর কিছু নেক-বদ আলাপচারি শোনা গেল না। তুহিন ভাবনায় পড়ে গেল, এরা কি তাহলে বুঝতে পেরেছে সে আসলেই চুরি করেনি। আর তা-না হলে এত চুপসে গেল কেন এ পাড়ার মানুষগুলো। যার ফোন হারিয়েছে সেও তো মিইয়ে পড়েছে। নাকি আসল চোর স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে। কি জানি! এসব চিন্তা করে কাজ নেই তুহিনের। আল্লাহ তার ফরিয়াদ হয়তো কবুল করেছেন। তাই সে বিনা অপরাধে অপরাধী হওয়ার হাত থেকে রেহাই পেল।

তুহিনের ধারনা ফলে গেল। আয়শা এসে তুহিনকে খবর দিল, তুহিন, সবকিছু স্বাভাবিক। তোর যেহেতু কোন অন্যায় নাই, তাই তোকে আল্লাহ হেফাজত করবেন নিশ্চিন্ত থাক।

কিছুদিন পর সবাই বুঝতে পেরেছে আসলে কাজটা তুহিন করেনি। সুতরাং সবাই তখন তুহিনের সাথে ভাল আচরণ করতে শুরু করে। তুহিনও পাড়ার সব ছেলেদের সাথে মিশতে লাগল। কিন্তু এ ব্যাপারে তুহিনের বাবা তাকে ঘরে এনে বলে-যারা তোরে চুরির অপবাদ দিল তাদের সাথে খেলতে যাস কেন? তুহিন কিছু বলেনা। তার মনেও কষ্ট। কারণ আসল চোরটা ধরা যায়নি।

বাবুলসহ সবার একটাই কথা- ‘চোরটা আসলে আমাগো পাড়ার না, তাইলে ধরা পড়ত। অযথাই ছেলেটারে খারাপ ভাবছি। কারণ একটা ছোট মানুষ চুরি করে এমন নিঃশঙ্কচিত্তে হাঁটতে পারে না। নির্ভয়ে চলতে পারে না।

তারাও এখন খুব লজ্জিত। কেন তারা শুধু শুধু তুহিনকে দোষারোপ করল। আবার ভাবে, তারাই বা কি করবে? বানকি ফকিরের এমন ভুল তথ্যই তো এমন একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্য দায়ী।  এসব কথা আয়শা তুহিনকে বলে। তুহিনের মনের গহনে স্বস্তির ভাব উদয় হয়। মহান প্রভুর কাছে শুকরিয়া জানায়।

তুহিন এখন বড় হয়েছে।  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আজও মনে পড়ে সেদিনের কথা। ভণ্ডগুলোর প্রতি জেগে ওঠে তীব্র ত্যক্ত ভর্ৎসনা। অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন স্বাভাবিক দিনযাপনকারী গ্রামীণ মানুষগুলোর সচেতনতা সৃষ্টির জন্য, কুসংস্কারাচ্ছন্ন গাঁয়ের সাধারণ চঞ্চল প্রাণগুলোকে অন্ধ বিশ্বাসের ঘোর অনামিশা থেকে আলোয় আনার সদিচ্ছা মস্তিষ্কে ধারণ করে খুঁজে বেড়ায় সহজ কোন উপায়।

আজও তুহিন তার চারপাশে কোন চৌর্যবৃত্তি সংঘটিত হলে আনমনেই আঁতকে ওঠে। তবুও ভাবে, চোর না হয়ে চোরের অপবাদ কাঁধে নিয়ে একদিকে একটি অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হল, সেটা মন্দ কিসে? এর বদৌলতে জীবন সংসারের দুটি ভিন্ন রকমের বিন্যাসের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত হল। একটি পক্ষ স্বার্থের মোহে দৃষ্টিশূন্য; আর অন্যপক্ষ নিতান্তই সরলতায় নতজানু। দুটি পক্ষেরই ত্রুটিগুলো যদি পরিবর্তন সাধন করা যায় তাতে অপবাদের গ্লানিবোধটুকু মানুষের চরিত্রে আলো ছড়াতে পারবে, সোনা ফলাতে স্বার্থক হবে। তাতেই তৃপ্তি।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, জাককানইবি।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন