কবিতা : একটি কবিতা লিখতে পারিনি : রাসেল আহমেদ মাসুম

1

ছবি:নাহিদুল ইসলাম

অনেকে বলে শিল্পের জন্যই শিল্প
আর মানুষের জন্য মানুষ,
তাই আমি কবিতার জন্য কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম
অদম্য উৎসাহ নিয়ে, নির্ভেজাল দৃষ্টি দিয়েছিলাম
জানালার বাইরে।
যুগের পর যুগ, মাইলের পর মাইল
আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দুর্বার বেগে ছুটতে থাকল;
কত নদী দেখলাম, কত সমুদ্র দেখলাম
কত উত্থান! কত পতন! 
কত দুধের শিশুসহ মাতাকে গুলি করে হত্যা,
সোনালি ধানের ক্ষেতে বাবার রক্তাক্ত শরীর,
বোনের ইজ্জত হননের পৈশাচিক দৃশ্য,
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে
জোয়ান ভাই এর লাশ হয়ে বাড়ি ফেরা
চোখের সামনে চেয়ে চেয়ে দেখলাম,
আমি কবিতার জন্য- একটি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম।
পারিনি।
প্রাসাদের প্রতিটি ইটে মজুরের ঘাম
এবং রক্ত শোষণের গোপন ইতিহাস,
স্বার্থবাদীর বিশ্বাসঘাতকতা আর শাসকের কাপুরুষতা!
কত হরতাল, কত অবরোধ, কত মিথ্যে ভাষণ;
ত্রাণের মাল আত্মসাৎ করা, আমানতের খিয়ানত করা,
ক্ষমতার অপব্যবহার করা, ঘুষ খেয়ে দেশের ইজ্জত লুটে নেয়া, এমন কোনো হীন কাজ নেই যা করেনি তারা
আমি একটি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি!
বুকের ভেতরে সমুদ্র, উত্তাল ঢেউয়ে হুমড়ি খেয়েছি, কবিতা লিখতে পারিনি।
বিছানায় শুয়ে থেকে দেখে নিলাম
 কত যুগযুগান্তরের রক্তাক্ত ইতিহাস -
বোমের আঘাতে মাসুম শিশুর অকাল মৃত্যু,
রাস্তায় রাস্তায় ক্ষুধিতের হাহাকার,
অন্যায় যুদ্ধে নিহত নিষ্পাপ মানুষের লাশ,
পুঁজিবাদীদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে
মানবতার পিঠে নির্মম কষাঘাত;
মা হারাল স্বামী-সন্তানকে,
ছেলে হারাল পিতা-মাতাকে 
আর মানবতাকামীরা হারাল তাদের দেশকে,
তাদের স্বাধীনতাকে,
ক্ষত চিহ্ন! একি ক্ষত চিহ্ন! 
এ যে মানবতার পিঠে হাজার হাজার ক্ষত চিহ্ন।
একটি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম,
শুধু একটি কবিতা!
গ্রীষ্মের দাবদাহে, আমের ছায়ায় শুয়ে থাকার একটি কবিতা,
শিশির ভেজা স্নিগ্ধ সকালে
খালি পায়ে হাঁটার একটি কবিতা,
গোধূলি লগ্নে পদ্মার পাড়ে বসে
পড়ন্ত সূর্যের একটি কবিতা,
চুলার পাশে মায়ের কাছে বসে
চপচপ করে পিঠে খাওয়ার একটি কবিতা,
হাটবারে বাপজানের সাথে হাটে গিয়ে
মিষ্টি দিয়ে পাউরুটি খাওয়ার একটি কবিতা;
এলোকেশী পল্লী বধূর, নদী হতে কলস কাঁখে
খালি পায়ে জল আনার একটি কবিতা,
সন্ধ্যে বেলায় দাদার সাথে শুয়ে থেকে
বাংলার লোককাহিনি, ছড়া শোনার একটি কবিতা
বাঁশ বনের পাশে প্রিয়ার সাথে
চুপি চুপি কথা বলার একটি কবিতা,
সবুজ ধানের ক্ষেতে কৃষকের
গাল ভরা হাসির একটি কবিতা,
মেঠো পথে বাউলের বাতাস মাতানো গানের
একটি কবিতা,
সবুজ পাতার ফাঁকে কোকিলের ডাক নিয়ে একটি কবিতা,
বর্ষার দিনে গামলা ভরা মুড়ি নিয়ে
গল্প জমানোর একটি কবিতা,
গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ,
হাঁড়ি ভরা ভাত নিয়ে একটি কবিতা,
চৈত্রের দুপুরে কাদা গায়ে মাছ নিয়ে
বাড়ি ফেরার একটি কবিতা,
সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশকে নিয়ে
একটি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম।
বিশ্বাস করো, আমি কবিতা লিখতে পারিনি।
কবিতা লিখব বলে যখনই কলম নিয়েছি হাতে,
তখনই মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে
মানবতার পিঠে হাজার হাজার ক্ষত চিহ্নের রক্তাক্ত ইতিহাস।
ক্ষমা করো, আমি কবিতার জন্য কবিতা লিখতে পারিনি।
ক্ষমা করো, আমি তোমাদের কষ্টের জন্য কবিতা লিখতে পারিনি।
ক্ষমা করো, আমি সত্যকে রং দিয়ে
মিথ্যা করে কবিতা লিখতে পারিনি,
পারিনি, পারিনি।

লেখক: কবি ও ছড়াকার, রাজশাহী।

১টি মন্তব্য

  1. ধন্যবাদ আঁকশি’কে কবিতাটি প্রকাশ করার জন্য। আর ভালোবাসা রইল অফুরন্ত। সুন্দর হোক আগামীর পথচলা।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন