গল্প : ইতি : রিফাহ রাফিয়া বারী

0

অলংকরণ: ফারিনা আহমেদ

শোঁ শোঁ করে ঘুরছে, ফ্যানটা। পাশের ঘর থেকে আসছে কান্নার আওয়াজ। ফ্যানের শোঁ শোঁ শব্দটা সেই আর্তনাদকে আড়াল করতে পারছে না। ঘরের এককোণে ভয়ার্ত চোখে ইতি তার ছোট্ট শরীরটা টেবিল দিয়ে লুকানোর  প্রাণপণ চেষ্টা করছে। যে ভয়াল থাবা তার মায়ের দিকে প্রায়ই আসে, সেই থাবা কি তার দিকেও এগিয়ে আসবে? ভাবনাগুলো ছোট্ট ইতি’র চোখে ঘুম আসতে দেয় না।    

জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তাটা দেখা যায়। যতদূর চোখ যায় রাস্তার দুইধারে সারি সারি গাছ। গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির বিন্দু টপ টপ করে পড়ছে মাটিতে। বাবার আদর মাখা ডাক, ভালবাসা মেশানো আলতো ছোঁয়া, একফোঁটা স্নেহের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতে করতে ছোট্ট ইতি কিশোরীর দিকে পা বাড়িয়েছে। টপ টপ করে পড়ন্ত শিশির বিন্দুর মতো কি তার অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যাচ্ছে? ভোরের কুয়াশা যেমন বাইরের পরিবেশকে অস্বচ্ছ করেছে তার জীবনে ভালবাসা আর স্নেহের অস্তিত্বও তেমনি ঝাপসা। ভাবনাগুলো ইতির কিশোরী মনে ঝড় তুলল।    

বাবার সিদ্ধান্তে আজ ইতি’র পড়ালেখার সমাপ্তি ঘটতে চলেছে, মাঝপথেই। জীবনের প্রতিটি ক্ষণে গেঁথে যাওয়া স্বপ্নগুলো আজ তার-ই চোখের সামনে মিথ্যে হতে যাচ্ছে। বাগানে ফোঁটা লাল টকটকে গোলাপ ফুলটির মতো তবে কী সে-ও আজ ঝরে পড়ার অপেক্ষা করছে?      

বর্ষা মৌসুম। অঝরে বৃষ্টি হচ্ছে। এইমাত্র নিহান-ইতির  একটু একটু করে বেড়ে ওঠা সম্পর্কটা ভাঙা কাঁচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে গেল। নিহান বিয়ে করতে অস্বীকার করেছে। কদমগুচ্ছ হাতে, জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত হাতে হাত রেখে পথচলার তাদের সেই প্রতিশ্রুতি বর্ষার প্রবল বর্ষণ ধুয়ে মুছে দিচ্ছে। আজ-ই তারা বিপরীত পথে হাঁটতে শুরু করেছে। জানালার গ্রীল গলে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কি ইতি’র চোখ থেকে গড়িয়ে পরা অশ্রুকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে?     

শীতের হিম ঠাণ্ডায় গা জমে যাচ্ছে। সবাই মিলে খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। সেদিকে মনোযোগ নেই ইতি’র। তার যে বিয়ে ঠিক হয়েছে! জ্বলন্ত খড়কুটোর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে সে। আগুন থেকে ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে উপরের দিকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। মানুষও কী এভাবে যখন তখন উধাও হয়ে যেতে পারে?   

শীতের এই অসময়েও  চারদিকে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতির এত কীসের কষ্ট! ভোরের শিশির বিন্দুকে আজ বৃষ্টির পানি থেকে আলাদা করার উপায় নেই। শিশির বিন্দু বৃষ্টির সাথে গড়িয়ে পড়ছে। আজও  ঘরে কান্নার রোল বসেছে। ঘরের ফ্যানটিও আছে, তবে ঝুলন্ত মৃত দেহ নিয়ে!  

চারদিকে ঘোর অন্ধকার, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাগানে ফুঁটে থাকা রক্তজবা টুপ করে ঝড়ে পড়ল। দিনশেষে সবকিছুই ঝরে পড়ে। কেউ সময়ে, কেউবা অসময়ে। অসময়ে ইতির ছোট্ট জীবনের ইতি ঘটল। 

বাইরের বৃষ্টি ঝড়ে পরিণত হয়েছে। জানালা দিয়ে আসা বাতাসের ঝাপটায় ইতির ডায়েরীর পাতাগুলো উড়ছে। 

মানুষ হত্যার শাস্তি আছে;  আর যে স্বপ্নগুলা হত্যা করা হয়, তার শাস্তি নেই?  

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন