আসিফ ইকবাল আরিফ।। প্রবন্ধ।। অতিউৎসাহী মূল্যবোধ, ভ্রান্ত বিপ্লব এবং মানবিক বিপর্যয়ের উপাখ্যান: বাংলাদেশের সামসময়িক চালচিত্র

0

আর্টওয়ার্ক: দিদারুল লিমন।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে যদি কোনো বড় রোগের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে নিঃসন্দেহে সেই রোগের নাম হলো অতিউৎসাহী মূল্যবোধ। এই রোগটি আমাদেরকে এতটাই সংক্রমিত করেছে যে আমরা জাতি হিসেবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এর বিষব্যথা বহন করে চলছি। আমাদের পারিবারিক জীবন, আমাদের কর্মজীবন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, আমাদের বাজার ব্যবস্থা, আমাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চা – সবকিছুতেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। মোটা দাগে বলতে গেলে আমাদের ধর্ম, আমাদের রাজনীতি, আমাদের সামাজিক সংগঠন এবং আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের পরতে পরতে এই রোগ বিষবায়ু হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

অতিউৎসাহী মূল্যবোধের ধারক এবং বাহক যে কেউ হতে পারেন। এটা নিতান্তই কোনো মানুষের ব্যক্তিগত চয়ন। তবে এই ধরনের মূল্যবোধ যখন সংগঠিত হয়ে ভ্রান্ত বিপ্লবের মানসিকতার দিকে ধাবিত হয় তখনই আসলে বিপত্তি বাড়ে। আর শুধু বিপত্তিই বাড়েনা বরং চরম এক মানবিক বিপর্যয়ের দিকে পড়ে সমাজ, সভ্যতা এবং সংস্কৃতির সব উপাদান।  

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রাণী রাজ্যে মানুষ মাত্রই উৎসাহী জীব। প্রকৃতিকে নতুনভাবে জানে, জীবিকার সন্ধান চালায়, প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখার নতুন নতুন পথ খোঁজে – আরও কতো কি! মানুষের মধ্যে এই উৎসাহবোধ না থাকলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। এটির অভাবে মানুষের সৃষ্টিশীলতার পথ বন্ধ হয়ে যায়, দম আটকে কাঁদতে থাকে মানুষের অনুভূতিগুলো। আবার মানুষ মাত্রই মূল্যবোধ সম্পন্ন জীব। মানুষ হিসেবে আমাদের কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয় তা নির্ধারণ করে আমাদের মূল্যবোধ যা আমরা সমাজ থেকে পাই, সংস্কৃতি থেকে পাই। আর এটা সময়, প্রেক্ষাপট এবং সার্বজনীন প্রয়োজনবোধে পরিবর্তিত হয়। তবে এই পরিবর্তনের আছে সামাজিক ভিত্তি। মূল্যবোধ কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়। এটা নিঃসন্দেহে সামাজিক। সমাজ যেমন ভাষার কাঠামোর মতো অর্থজ্ঞাপতা দান করে তেমনি মূল্যবোধও সেইরকমই। মানুষ হিসেবে আমি কি করতে পারবো আর কি করতে পারবো না তা নির্ভর করে আমাদের সামাজিক চুক্তির ওপর।  অর্থাৎ আমার মূল্যবোধ তখনই অর্থবহ হবে যখন আমার সামনে অন্য আরেকজন থাকবে। তবে মূল্যবোধের বিপরীতে যদি অতিউৎসাহবোধ মানুষের মনে দানা বাঁধে এবং দৈনন্দিন ক্রিয়াদিতে তার প্রতিফলন আসে তাহলে এটা যেমন কোনো ব্যক্তিকে বিপদে ফেলতে পারে তেমনী কোনো জাতিগোষ্ঠী, সম্প্রদায় এবং সমগ্র জাতি রাষ্ট্রকেও মানবিক বিপর্যয়ে ফেলতে পারে। আর সব থেকে বড় কথা হলো এই ধরনের মূল্যবোধের ফলশ্রুতিতে দীর্ঘভাবে বন্ধ হয় সামাজিক বিপ্লবের পথ। আর সামাজিক বিপ্লবের পথ বন্ধ হলে যেটা হয় তা হলো শাসক শ্রেণির ক্ষমতায় টিকে থাকার পথ দীর্ঘ হয়। শোষিত শ্রেণি শোষণের শেকল থেকে বের হতে পারে না। সমাজ পরিবর্তন হয় না। এ কথা আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারি না যে বিপ্লব ছাড়া সমাজ পরিবর্তন সম্ভব। সামাজিক পরিবর্তন সামজিক বিপ্লবের মাধ্যমেই হয়। যেমনটি অতীতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে হয়তো।   

আমাদের অতিউৎসাহী অনুভূতিগুলো আমাদেরকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধেছে যে আমরা না পারছি এটা থেকে বের হতে আবার না পারছি এটা গোগ্রাসে গিলে নিতে। আমাদের শাসক শ্রেণি, আমরা যারা শোষিত শ্রেণি, আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজ, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণ – সকলেই এই অতিউৎসাহী ঢেউয়ের তালে নাচতে শুরু করেছেন, নেচে চলেছেন আর নাচিয়ে চলছেন। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের কিছু প্রাণহানিকর ঘটনা যদি আমরা একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখি তাহলে এই ধরনের বিকলাঙ্গ অনুভূতি প্রকাশের নেতিবাচক প্রভাব এবং মানুষ হিসেবে আমাদের মানবিক বিপর্যয়ের দৃশ্যত প্রমাণ পাওয়া যাবে।    

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সবচেয়ে আলোচনার বিষয় হলো ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা’ – এই বিষয় নিয়ে যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ নং ধারায় বর্ণিত আছে।  আমাদের গণমাধ্যম, আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আমাদের দৈনন্দিন আলাপচারিতা এবং আমাদের সভা-সেমিনারে প্রতিনিয়তই উচ্চারিত হচ্ছে এই প্রসঙ্গগুলো নিয়ে। তবে এই বিষয় নিয়ে যে শুধুমাত্র এখন কথা উঠছে তা কিন্তু নয়। আগেও এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা উঠেছে এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই তা উচ্চারিত হয়ে আসছে।  আমাদের সংবিধানের এই ধারাতে বর্ণিত আছে যে প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বহিঃরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক, এবং জনশৃঙ্খলা বিনষ্ট হলে রাষ্ট্র তা আইনদ্বারা বাধানিষেধ করতে পারবে। শুধু তাই নয় – আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনে প্ররোচনা যোগায় – এমন চিন্তা এবং তা প্রকাশে রাষ্ট্র আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের এই ধারাতে কোনো ত্রুটিপূর্ণতা আছে কি নেই তা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। আর এই বিষয় নিয়ে আমার জ্ঞান নিতান্তই কম। তবে আমার কথা রয়েছে সংবিধানের এই ধারাকে কেন্দ্র করে যে অতিউৎসাহী  জনস্রোত সৃষ্টি হয়ে থাকে – সেই ব্যাপার নিয়ে। এমন অতিউৎসাহবোধ যেমন আমাদের শোষিত শ্রেণিকে রুগ্ন অবস্থায় রাখে তেমনী রুগ্ন অবস্থায় রাখে আমাদের শাসক শ্রেণিকেও। চিন্তা ও মত প্রকাশের নামে আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো অশ্রাব্য গালিগালাজে মলমুত্রের ভাগাড় হয়ে যায় যাতে অংশগ্রহণ করে অতিউৎসাহী মানুষজন, অতিবিপ্লব বা অতিজাগরণে বিভোর হয় তারা এবং যার ফলাফল দাঁড়ায় ভ্রান্ত বিপ্লব। আর এমন অবস্থা দেখে আমাদের অতিউৎসাহী শাসক শ্রেণি তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হুমকি ভেবে রাষ্ট্রযন্ত্রের নানাবিধ কলকব্জা দিয়ে শুরু করে দমন-পীড়ন। আর এই দুই অবস্থার মাঝখানে পড়ে ডুকরে কাঁদে মুক্তিকামী জনসাধারণের স্বপ্ন; যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন, যাঁরা আহত হয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার চেতনায় গর্জে ওঠা এক দুঃখিনী বাংলাদেশ যার উত্থানের পেছনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস; বায়ান্নোর ভাষান্দোলন, ছেষট্টির ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।   

ঐতিহাসিককাল থেকেই আমাদের মধ্যে অতিউৎসাহী মনোভাব এবং তা প্রকাশের বীজ প্রোথিত রয়েছে। আমাদের রাজনীতি, আমাদের ধর্ম, দর্শন আর শিল্প-সাহিত্যে এই মনোভাব বিষফোঁড়ার মতো লেগে আছে। যেমন ধরুন ১৯৪৭ সালে রাতের আধারে যে দেশভাগ হয়েছিলো সেখানেও আমাদের অতিউৎসাহের কমতি ছিলো না। ভৌগলিক সীমারেখা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা এবং ভিন্নতার বিষয় মাথায় না রেখেই কেবলমাত্র ধর্মীয় উন্মাদনার ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিলাম আমরা। অপেক্ষা বেড়েছিলো আমাদের স্বাধীনতার। নতুনভাবে সেই সময় সংজ্ঞায়িত হয়েছিলো আমাদের দেশপ্রেম আর মূল্যবোধের ধ্যাণ-ধারণা। এরপরেও যখন ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৫২ এর ভাষান্দোলন আলোর মুখ দেখলো তখনো আমাদের অতিউৎসাহী সাহিত্যপ্রেমীগণ পাকিস্তানপন্থী সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্টপোষকতা আদায় করতে শুরু করলেন। তারা নাকি বাংলা সাহিত্যে এক মহাজাগরণ ঘটিয়েছিলেন যার নাম ছিলো ‘রেঁনেসা’। মূলত এটা ছিলো বাংলা ভূ-খন্ডের কোনো এক বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর রেঁনেসা, বাঙালির রেঁনেসা নয়। ঐ রেঁনেসা ছিলো আমাদের অতিউৎসাহী  সাহিত্যচর্চার ফল যেখানে স্বার্থ ছিলো, পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো। তাঁরা কবি যেমন ছিলেন তেমনি তাদের কবি শব্দের আদিতে একটা করে বিশেষণ থাকতো ‘মুসলমান কবি’ এবং ‘মুসলমান সাহিত্যিক’। আরবি ফার্সিসহ নানা প্রকার অবাংলা শব্দে ভরে থাকতো তাদের সাহিত্যকর্ম যেগুলো পড়লে অনেকটা বিশেষ ধর্মের ধর্মীয় আদলে লিখিত বয়ানই মনে হয়, বাংলা সাহিত্য মনে হয় না। এইগুলো বাংলা সাহিত্য মনে হয় না কেননা এখানে বায়ান্নো থাকেনা, থাকেনা বায়ান্নোর চেতনা। ৫২’র ভাষান্দোলন কোনো বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর আন্দোলন ছিলো না। এটা ছিলো বাংলা ভাষার মুক্তির আন্দোলন, বাঙালির ভাষা মুক্তির আন্দোলন আর এর প্রভাব আমাদের সাহিত্য চর্চাতে একান্ত কাম্যই ছিলো।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আমরা পুরোপুরি বাঙালি হয়ে উঠতে পারিনি। বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় সত্ত্বা – তা নিয়ে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে তৎপর হয়ে কাজ করে চলছে কিছু মানুষের অতিউৎসাহী মনোভাব যার একপ্রান্ত বাংলাদেশকে ‘ভারত ঘেঁষা’ বাংলাদেশ বলতে বেশি সাচ্ছন্দবোধ করে এবং তারা নানানভাবে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করে। অনেক বুদ্ধিজীবীগণ আবার বর্তমান সময়ের বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশ বা বাংলাদেশে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ সুগাঢ়ভাবে লেগে আছে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, করছেন এবং তাদের যদি ভবিষ্যতে বোধদয় না হয় তাহলেও তা করার চেষ্টা করবেন। আর এর অন্যপ্রান্ত জুড়ে রয়েছে ‘পাকপন্থী বাংলাদেশ’। অর্থাৎ এই শ্রেনীর অতিউৎসাহী জনের মনের মধ্যে থেকে তৎকালীন পাকিস্তানপন্থী প্রেম এখনো সরানো যায়নি বা তারা ছাড়তে পারেনি। অথচ তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের শত্রুপক্ষ ছিলো। সেই রাষ্ট্রের নিপীড়নের প্রতিবাদেই আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, নির্বিচারে প্রাণ দিতে হয়েছিলো আমাদের। অন্যদিকে ঐতিহাসিকভাবে ভারত সেই সময় আমাদের পাশে ছিলো, তারা এককোটির মতো বাঙালিকে তাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছিলো, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো, আমাদের অস্ত্র দিয়েছিলো, এমনকি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বেশ ক’য়েক হাজার সৈনিক মৃত্যুবরণও করেছিলো। সেই সুবাদে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের কোনো মহান বন্ধুরাষ্ট্র যদি কেউ থাকে তাহলে অবশ্যই সেখানে ভারতের নামটি আগে আসা বাঞ্চনীয়। এখন কথা হচ্ছে আমাদের একদল অতিউৎসাহী স্বার্থান্বেষী  মহল যে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব ছড়িয়ে আমাদের মধ্যে অস্থিরতার জন্ম দিতে ব্যস্ত থাকে এর পেছনে আসলে কোনো স্বার্থ কাজ করে কি না? তারা কি আবার পাকিস্তানপন্থী বা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে জাগ্রত করতে চায়? এই বিবেচনার দায় আপনাদের। ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতীম পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র আর এই সম্পর্ক আমাদের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌম সম্পর্কের উর্ধ্বে নয়। আমরা স্বাধীন হয়েছি, আমাদের সংবিধান আছে, আছে আমাদের নিজস্ব সরকার ব্যবস্থা, আমাদের আছে নিজেদের পরিচালনার নিজস্ব বিধিবিধানও। এখানে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতকে ডেকে এনে যেমন নাক গলানোর সুযোগ নেই তেমনী ভারতেরও উচিত সেই জায়গাতে সচেতন থাকা। অতি উৎসাহী হয়ে যারা এখনো বাংলাদেশকে ‘ভারত ঘেঁষা বাংলাদেশ’ এবং ‘পাকিস্তানপন্থী মুসলমান বাঙালি’ – এই দুই পন্থাতে বিভক্ত করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসকে ভুল পথে নিতে ব্যতিব্যস্ত রয়েছেন তাদের সাবধান হওয়া উচিত এবং ব্যক্তিস্বার্থ এবং দলগতস্বার্থ ভুলে বাঙালির ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করা উচিত। যদি স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসেও আমাদের মধ্যে এমন ধরণের ‘অতিভারতবাদী’ এবং ‘অতিপাকিস্তানবাদী’ মনোভাবের স্বার্থান্বেষী মহল সক্রিয় থাকে তাহলে সেই ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে। আমাদের রাষ্ট্র যন্ত্র এই দায় এড়াতে পারবেনা। কেননা আমরা অতীতে দেখেছি এই ‘ভারত বিদ্বষী/ভারতপ্রীতি’ এবং ‘পাকিস্তানপন্থী’ মনোভাব বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসার সুযোগ দিয়েছে এবং তারা খুব আনন্দের সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের চেতনা ভুলে রাষ্ট্রীয় তহবিল তছরুপ করেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষ্যে অথিতি হিসেবে এসেছিলেন। এটা বাংলাদেশ সরকারের নিতান্তই কূটনৈতিক ব্যাপার। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যেসকল রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছিল তাদের যে কেউ এই আয়োজনে আসতে পারেন বা আসতে পারতেন। খুব স্পষ্টভাবে বলতে গেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীই এসেছিলেন, কোনো বিশেষ ব্যক্তি নয়। তো ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো! ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশে একদল ধর্মীয় গোষ্ঠী অতিউৎসাহী হয়ে রাস্তায় নেমে পড়লেন এবং তাদের নেতা কর্মীরা রাজপথে নেমে অতিবিপ্লবের ডাক দিলেন। এই অতিবিপ্লবীদের মধ্যে অনেক অবুঝ শিশুও রয়েছেন যাদের মনটা ফুলের মতো, যারা আলোর পথে ফিরতে পারতেন, আলো হয়ে নিজের পরিবার এবং রাষ্ট্রে অবদান রাখতে পারতেন। তাদের মাথায় অতি উৎসাহী ইসলামী বিষবাষ্প ছড়িয়ে নানান ধরণের রাষ্টবিরোধী কর্মকান্ড করিয়েছেন যা জাতি হিসেবে আমাদের কাছে অত্যন্ত লজ্জ্বার ব্যাপার। শুধু তাই নয় তারা বাঙালি জাতির পিতা বঙবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি পর্যন্ত ভাঙচুর করেছে। মোটকথা, তারা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের প্রজ্ঞাপন দিতে লাগলেন; যেখানে ১৩টি দফা রয়েছে যা পুরোদমে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। এদের সাথে আবার যুক্ত হতে দেখেছি একদল স্বার্থান্বেষী অতি উৎসাহী দল যারা মুহূর্তেই সরকার পতন করেতে চায় এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তাদের এমন অতি উৎসাহী কর্মকান্ড দেখে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন উপাদান অতিউৎসাহী হয়ে দমনপীড়ন শুরু করলেন এবং নির্বিচারে ঝরে গেলো সতেরোটি তাজা প্রাণ। এই দায় কার? এই দায় অবশ্যই রাষ্ট্রযন্ত্রের। মহান স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তীর মতো এমন সময়ে রাষ্ট্রের গুলিতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রক্ত ঝরে পড়া অত্যন্ত নিন্দার বিষয়। যদি রাষ্ট্রযন্ত্র সাংবিধানিকভাবে স্বাধীনতাবিরোধী এমন শক্তিকে নিষ্ক্রীয় না করতে পারে তাহলে ব্যর্থতার দিকে পতিত হবে আমাদের মহান স্বাধীনতার চেতনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ।  উল্টো আমাদের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো অতিউৎসাহী হয়ে ক্ষমতার আসনে টিকে থাকার নিমিত্তে এখনো তাদের মদদ যুগিয়ে চলছে। যাক গে ওসব কথা। এইগুলো স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক বিবেচনার ফল, এটা গণচেতনাকে (যার সুত্রপাত একাত্তরে হয়েছিলো) ভূলণ্ঠিত করে, মানবিক বিপর্যয়ে ফেলে রাষ্ট্রকে, জনমানুষকে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে আমাদের কোন দিকে যাওয়া উচিত? আমাদের অতিউৎসাহী ও অতিবিপ্লবী এবং অতিউৎসাহী রাষ্ট্রযন্ত্রের তাণ্ডব লীলা থেকে কি আমাদের মুক্তির পথ নেই? ব্যক্তিস্বার্থ এবং বিশেষ গোষ্ঠীর বিশেষ স্বার্থের রোষানলের দাবানলে কি পড়ে থাকবে মুক্তিকামী বাঙালির স্বপ্ন? অবশ্যই আমরা এমনটি চাইনা।

আমাদের আলোচনার জায়গা থাকতে হবে। যৌক্তিক কথা বলার অধিকার থাকতে হবে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকবেন, সেখানে তা মূল্যায়িত হতে হবে, মূল্যায়িত করতে হবে। যদি গ্রহণযোগ্য হয় তা নীতিনির্ধারণে বাস্তবায়িত হতে হবে। আর যদি তা খারিজযোগ্য হয় সেটারও ব্যাখ্যা থাকতে হবে।

আমাদের ‘ডায়লগ সোসাইটি’ গঠনের সময় এসে গিয়েছে। আমাদের বিবেক এবং বুদ্ধিকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জায়গায় নিয়ে আসা উচিত। আর এই ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই বড় দায়িত্ব নিতে হবে। কোনো বিশেষ দলের প্রতি অন্ধতা দেখিয়ে দলাবদ্ধতার পথ থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিকামী বাঙালিবোধ সম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অপরাজনৈতিক চর্চার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ভুল পথে আছেন আমাদের সম্মানিত শিক্ষকগণ, ভুল পথে যাচ্ছে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যারা আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে শ্রম এবং মেধা দিয়ে। যাদের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশের স্বপ্ন।

আমাদের জ্ঞানচর্চার অন্যতম মাধ্যমগুলোকে, বিশেষ করে আমাদের যত সরকারি/অসরকারি গ্রন্থাগারগুলো রয়েছে সেখানে পাঠের অভ্যাস বাড়াতে হবে, পাঠযোগ্য করে তুলতে হবে। জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে সুনাগরিক গড়ে ওঠার পথকে প্রশস্থ করতে হবে। আমাদের প্রতিটি জেলা, প্রতিটি উপজেলা, প্রতিটি ইউনিয়ন এবং প্রতি গ্রামে গ্রামে পাঠাগার থাকবে। যেখানে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ অবসরে বই পড়বে, মুক্ত চিন্তায় বিকশিত হবে। আর যদি বাংলাদেশের ছাপ্পান্নো হাজার গ্রামেই এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয় নিরক্ষর লোকজনও একটু অবসর পেলেই সেখানে জড় হবে জ্ঞানের আলো নিতে। সুনাগরিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করবে। চেষ্টা করবে মানুষ হিসেবে কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়, তা বুঝে চলতে। আর বড়দাগে একজন বাঙালি হয়ে কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয় – সেই ধারণাও তারা পাবে। আর এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যে খুব কঠিন কিছু হবে তা কিন্তু নয়। আমাদের ধর্মান্ধতা আর আমাদের দলাবতদ্ধতার উর্ধ্বে আমাদের অনেক তরুণ-তরুণী রয়েছে যারা তাদের মূল্যবান সময় থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পাঠাগারগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন, নিরক্ষর মানুষদের মধ্যে আলো ছড়াবেন।  আর রাষ্ট্রেরও বোঝা উচিত এই ধরণের জ্ঞানসৃষ্ট কর্মকান্ডে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন আছে। স্কুল, মাদ্রাসা বা কলেজ নিয়ে আমি এতটা আশাবাদী নই যতোটা আশাবাদী পাঠাগার নিয়ে। স্কুল, কলেজ আর মাদ্রাসা দায় চাপানো শিক্ষা দিতে ব্যস্ত। এই দায় চাপা শিক্ষা দিয়ে কর্মসংস্থান হয়। সমাজ পরিবর্তন হয়না, আসেনা মানুষের মুক্তি। মুক্ত চিন্তার আলো আসবে পাঠাগার থেকে।

একদিন আমাদের রাষ্ট্রনীতির সব দর্শন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আসবে, পাঠাগার থেকে আসবে সুনাগরিকের নাগরিক মতামত, পার্কগুলো হবে উন্মুক্ত প্রকৃতির মতো যেখানে প্রেম থাকবে, থাকবে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত তরুণ-তরুণী আর ছেলে বুড়োরা।

একদিন আমাদেরও বিপ্লব হবে, হবে নবজাগরণ। সেটা যদি অনেক দূরের পথেও হয় সেই জন্য আমাদের অপেক্ষা করা উচিত। আমাদের সামাজিক বিপ্লব হবে। দলাবদ্ধতা আর ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্তির স্বাদে জেগে উঠবো, রক্ষিত হবে রক্তেভেজা পতাকার সম্মান, সম্মানিত হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তের ঋণ।

লেখক: শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন