আমিনা সরকার।। গল্প।। ভগ্ন সোনার বাংলা

0

আর্টওয়ার্ক: নগরবাসী বর্মন

“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।” সেই শিক্ষাজীবনের সূচনা থেকেই কম বেশি আমরা সবাই জাতীয় সঙ্গীতের এই লাইনটির সাথে পরিচিত। আমাদের মতোই আনন্দিতা খান জিনিয়ার যখন মাত্র ছয় বছর বয়সে মায়ের হাত ধরে প্রথম শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়, তখন থেকেই সপ্তাহের ছয়দিন অ্যাসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে উচ্চস্বরে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মাধ্যমেই এই লাইনটির সাথে তার পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। জিনিয়া মাঝে মাঝে ভাবত, এই একই গান রোজ রোজ লাইনে দাঁড়িয়ে এত কষ্ট করে সবাইকে গাইতে হয় কেন?

তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক যখন গানটার বৃহৎ অর্থ অনুধাবন করতে হিমসিম খেত তখন নিজের মত করে ভেবে বলত স্যার ম্যাডামরা হয়ত অন্য কোন গান জানেন না তাই একই গান প্রতিদিন তারা সবাইকে দিয়ে গাওয়ায়। এটা ছিল তার শুরুর দিকের ধারণা। কিন্তু যখন সে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে পদার্পন করে তখন ধীরে ধীরে গানটির মর্মার্থ বুঝতে পারে। এরপর যখন সে মাধ্যমিক পেরিয়ে কলেজে ওঠে তখন দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি তার মনে গভীর মমত্ববোধের উদয় হতে থাকে।

জিনিয়ার বাবা জাহেদ খান ছিলেন হাইস্কুলের গণিতের একজন দক্ষ শিক্ষক। একজন ভালো মানুষ ও একজন ভালো শিক্ষক হিসেবে তার মোটামুটি ভালোই নামডাক। জিনিয়া ছোটবেলা থেকেই লক্ষ করেছে প্রায় ছেলেমেয়েরাই তার বাবার কাছে পড়তে আসতো। তাদের মধ্যে কিছু ছেলেমেয়ে ছিল যাদের প্রাইভেটের খরচ বহন করার সামর্থ ছিলনা। তার বাবা তাদেরকে বিনামূল্যেই পড়িয়ে দিতেন। এমনকি প্রতিবেশিদেরকেও কখনও অর্থ দিয়ে, কখনও বা তাদের পাশে থেকে বিভিন্নভাবে সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করতেন। একদিন জিনিয়ার মাথায় তেল দেওয়ার সময় সে তার মা খালেদা আক্তারকে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা মা! এই যে বাবা কত ছেলেমেয়েকে বিনামূল্যে পড়ায় আবার মানুষকে কতভাবে সাহায্য করে বাবার বিরুদ্ধে এটা নিয়ে কখনও তোমার মনে অভিযোগ জন্মায়নি? তার মা হেসে উত্তর দেয়, ধুর পাগলি! এটা নিয়ে অভিযোগের কি আছে? আমি তো মনে করি তোর বাবার এই গুণটিই আমার সবথেকে গর্বের বিষয়। স্বার্থের এই পৃথিবীতে আজকাল কে কার কথা ভাবে বল? জগতে আজকের দিনে এমন মানুষ পাওয়া খানিকটা হলেও দুর্লভ। আর আমি মন থেকে দোয়া করি তুই যেন ভবিষ্যতে তোর বাবার এই আদর্শ বুকে নিয়েই মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারিস। আল্লাহ যেন তোকে সৎ কর্মের মাধ্যমে সারাজীবন মানুষের পাশে থাকার তৌফিক দান করেন মা! বাবার আদর্শ ও মায়ের অনুপ্রেরণাতেই তার মনে ধীরে ধীরে দেশের জন্য, দেশেরগরীব, অসহায় মানুষদের জন্য ভালো কিছু করার তীর্ব আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয়।

জিনিয়া বর্তমানে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে পড়াশোনা করছে। তাই বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি সম্পর্কে অনেক কিছুই সে জানতে পেরেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সাহিত্যিকদের জীবনী ও রচনা পড়ে দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা যেন তার আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছে। মাঝে মধ্যেই অলস বিকেলে জিনিয়া কফির কাপে চুমুক দিয়ে গুনগুন করে গেয়ে ওঠে তার সবচেয়ে প্রিয় লাইনটি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ তারপর কিছুক্ষন চলে রবী ঠাকুরের উদ্দেশ্যে স্বগতকথন। আপনমনেই বলতে থাকে, কি ভালোবাসা নিয়ে গানটা লিখেছিলে কবিগুরু! না জানি কত শত কোটি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা লুকিয়ে আছে এতে!! এই জন্যই বোধ হয় এটি জাতীয় সঙ্গীত রূপে মর্যাদা পেয়েছে জাতির কাছে। জিনিয়া ভাবে, এই সোনার বাংলাকে যারা ভালোবাসতে পারে না, বাংলার মাটি, মানুষের জন্য যারা ভালো কিছু করতে পারেনা তাদের মতো হতভাগা আর দুটো হয় না। হে আল্লাহ্ আমার নামের সাথে যেন ঐ বিশেষণটা কখনও যুক্ত না হয়, এই গ্লানি বহন করার মত ধৈর্য এবং শক্তি কোনটাই যে আমার নেই!!

আজ রবিবার। জিনিয়ার আজকে ৩০৫ নং কোর্সের শুধু একটা ক্লাসই আছে তিনটায়। তাই রাতেই স্হির করে শুয়েছে নয়টার পরে ঘুম থেকে উঠবে। কিন্ত সাড়ে আটটা নাগাদ তার রুমমেট তুসির নড়াচড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তুসি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পপুলেশন সায়েন্সে সেইম ইয়ারেই পড়ে। বিছানায় উঠে বসে তুসিকে জিজ্ঞাসা করলো কিরে.. এত তাড়াহুড়ো করছিস ক্লাস আছে নাকি? তুসি উত্তর দেয়, কালকে না তোকে বললাম আমার প্রেজেন্টেশন আছে। ভুলে গিয়েছিস? তাইতো, একদম ভুলে গিয়েছিলাম, বলে জিনিয়া ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। ক্লাসের দেরি আছে দেখে নাশতা খেয়ে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেইসবুকে ঢুকতেই চোখে পড়ল একটা বিব্রতকর স্ট্যাটাস ।

নারায়নগঞ্জে ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষনের পরে খুন।এত সুন্দর, সতেজ, প্রাণবন্ত একটা সকাল কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তার কাছে শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠল।মোবাইলটি বিছানার ওপর রেখে পাশেই টেবিল থেকে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ বইটি টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করল। কিন্তু কিছুতেই সে বইতে মনোযোগ দিতে পারল না। বইয়ের পাতায় সেই ফুটফুটে শিশুটির মুখের ছবি বারবার ভেসে উঠে তার বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। বইটা হাতে নিয়ে জিনিয়া ভাবতে লাগল, যে বাংলার বুকে জাতি আজ দাঁড়িয়ে সেটা কি আদৌ সোনার বাংলা আছে? বর্তমানে বাংলার যে অবস্হা তাতে কি একে আর সোনার বাংলা বলা চলে? চারিদিকে এত অন্যায়, অবিচার পাপ, অনাচার, অনাসৃষ্টি তাতে একে ভগ্ন বাংলা বলাটাই অধিক শ্রেয় বলে মনে হয়।টিভির চ্যানেল অন করলেই, খবরের পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে সব অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত নির্মম ঘটনা। ধর্ষন যেন আজকাল নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আবার একে ফ্যাশন বললেও খুব বড় ভুল হবে বলে মনে হয় না। মধ্যবয়স্ক থেকে শুরু করে হাজার হাজার তরুণী এমনকি ছয়-সাত বছরের নিষ্প্রাপ তরতাজা প্রাণগুলোও মানুষরূপী হিংস্র জানোয়ারদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সকাল না হতেই শোনা যায় স্কুল ছাত্রী ধর্ষন, স্বামীকে বেঁধে রেখে তার সামনে স্ত্রীকে ধর্ষন, অমুক জায়গায় গণধর্ষনের পরে খুন, তমুক জায়গায় সাত বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণের পরে খুন।উহ! চারিদিকে শুধু ধর্ষন আর ধর্ষন! কান একেবারে ঝালাপালা হয়ে গেছে। রাতের বেলা তো দূরে থাক দিনের সোনালি উজ্জ্বল আলোতেও নেই আজ নারীদের কোন নিরাপত্তা। এই কোন বিধ্বস্ত সোনার

বাংলা! এই কোন পথভ্রষ্ট জাতি!! কোথায় তুমি জাতির পিতা? দেখ তোমার সোনার বাংলায় আজ নেই নারীদের কোন নিরাপত্তা, নেই কোন স্বাধীনতা! আছে শুধু ধর্ষকদের অবাধ পদচারণা। হে পিতা! সেদিন যেমন স্বাধীনতার ডাক দিয়ে দেশকে শত্রু মুক্ত করেছিলে আজ আবার স্বাধীনতার ডাক দিয়ে নরপিশাচ হায়নাদের লালসার থাবা থেকে মমতাময়ী মা বোনদের সম্ভ্রম বাঁচিয়ে ফিরিয়ে দাও তাদের অবাধে চলার স্বাধীনতা । দেখ পিতা, তোমার এই বাংলার বুকে আজও কত নারী লাঞ্চিত, অবহেলিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত। এখনও যৌতুকের টাকা না দিতে পেরে কত নারীর শরীরে রয়েছে জখমের চিহ্ন। দেখে যাও, স্বামীর হাতে আগুনে পুড়ে মরতে হচ্ছে কতজনকে। সইতে হচ্ছে কত বোনকে শাশুড়ী ননদের গঞ্জনা।

হঠাৎ করেই তুসি প্রেজেন্টেশনের জন্য শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে এসে জিনিয়াকে ডেকে বলল, দেখতো আমাকে কেমন লাগছে? জিনিয়া এতক্ষন কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল তুসির ডাকে তার চেতনফিরল। বাহ্ তোকে খুব সুন্দর লাগছে। আর তোর শাড়িটা দারুণ তো! কবে কিনলি? আরে এটা আপুর শাড়ি। গত সপ্তাহে বাড়ি গিয়েছিলাম তখন প্রেজেন্টেশনের জন্য নিয়ে এসেছি। ওকে টাটা আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে হাতে একটা ফাইল ও সাইড ব্যাগ নিয়ে তুসি বেরিয়ে পড়ল। জিনিয়ার কোন ভাই-বোন নেই।সে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তুসির আপুর কথা শুনে বরাবরের মতো আজকেও তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফেইসবুকে যখনই কোন বন্ধু-বান্ধবীর ভাই-বোনকে নিয়ে ছবি বা স্ট্যাটাস দেওয়া দেখতো অথবা কারো মুখে ভাই-বোনের গল্প শুনতো তখন অটোমপটিক তার মুড অফ হয়ে যেত। ভাবত ভাই-বোন থাকার কত সুবিধা! কত সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করা যায় তাদের সাথে, কত মান-অভিমান, খুনসুটির পালা চলে তাদের সাথে। এমনকি বাবা মায়ের মৃত্যুর পরে এরাই একমাত্র আপনজন যাদের কাছে গিয়ে দুদন্ড বসে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। কিন্ত আমি এমনই দুর্ভাগা যে চিরকাল এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বাবা মায়ের মৃত্যুর পরে আমি বড্ড একা। জগতে যাদের ভাই-বোন আছে তাদের সম্পদ না থাকলেও তারা শ্রেষ্ঠ ধনী বলেই এতদিন ভেবে এসেছে জিনিয়া। কিন্ত হঠাৎ করেই আজকে ভাবছে, ভাই-বোন থেকেই কি? কজনেই বা তার মর্ম বোঝে? যদি বুঝতোই তাহলে সম্পদের জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে নিত্য এত কলহের কথা কি শোনা যেত? শৈশবের এত স্নেহ,মায়া-মমতার কথা ভুলে কি পারতো এক ভাই হয়ে আরেক ভাইয়ের পেটে ছোরা, গুলি চালাতে? আজকাল রক্তের বন্ধন আর নেই। সেখানে স্বার্থ এসে উঁকি দিয়ে সব বন্ধন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। কিন্ত পৃথিবীতে কি স্বার্থ এতটাই মূল্যবান যার কাছে এত দৃঢ় ব্ন্ধনও তুচ্ছ হয়ে যায়? স্বার্থ কি এতই উর্ধ্বে যে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে মানুষ নিজের মায়ের পেটের ভাই-বোনদের ঠকাতে, খুন করতে দ্বিধান্বিত হয়না? সোনার বাংলায় আজ এ কোন স্বার্থান্বেষীদের বিরাজ চলছে!! এই বলে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিনিয়া চোখ বন্ধ করল।

চোখ বন্ধ করলেও তার স্হায়িত্বকাল বেশিক্ষন টিকিয়ে রাখতে পারল না সে। কারণ, তার চোখের সামনে ভেসে উঠল মুখোশধারী কিছু উচ্চপদস্হ চোরের মুখ। যারা সমাজের জনদরদী নেতা বলে পরিচিত। নির্বাচনের আগে এসব নেতারা ড্রাম ভর্তি তেল নিয়ে বের হয় জনগনের পেছনে মারার জন্য। এলাকার উন্নয়ন করবে বলে একেক জনের মুখ থেকে বের হয় যেন অমৃত। অথচ নির্বাচনের পরে জনগণ হয় ‘ভাঙাকুলো’। ছাই ফেলা ছাড়া তাদের আর কোন কাজে লাগে না। তখন জনগণের টাকা না মেরে খেলে তাদের পেট ভরে না।

জিনিয়া সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে থাকতে পড়েছিল–

‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায়

আছে যার ভুরি ভুরি

রাজার হস্ত করে সমস্ত

কাঙ্গালের ধন চুরি।’

আজকে এই কথাটাই তার বারবার মনে পড়তে লাগল। উপরওয়ালা এদেরকে এত কিছু দেওয়া সত্বেও গরীবের মেরে না খেলে এদের পেটের ভাত হজম হয় না। যেখানে সাধারণ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সেখানে উচ্চপদস্থ, নেতা, কর্মচারীরা এদেরই টাকা মেরে খেয়ে ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়।’ এদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ খাটে না, হয় না এদের কোন শাস্তি। কে বলবে এদের বিরুদ্ধে কথা? কার ঘাড়ে বা কটা মাথা আছে? কে করবে এদের বিরুদ্ধে আন্দোলন? আর সে আন্দোলন কি উপরমহল পর্যন্ত পৌঁছাবে? কখায় আছে না ‘জোর যার মুল্লুক তার বাংলার বুকে আজ তাই চলছে। সোনার বাংলা আজ চোরের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। জিনিয়ার আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে নজরুলের সেই৷ চোর-ডাকাত কবিতার লাইনটি-

“চারিদিকে বাজে ডাকাতি ডঙ্কা; চোরেরি রাজ্য চলে!”

সোনার বাংলায় আজ ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় না। একজন কৃষক, দিনমজুর, রিকশাওয়ালা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, তিলতিল করে গায়ের রক্ত পানি করে, নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে তার সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে ঠিকই কিন্ত জায়গা মতো মামা-খালু আর পর্যাপ্ত অর্থ না দিতে পাড়ায় সেই দিনমজুরের সন্তানদের চাকরি হয় না। ফলে হাজারো মধ্যবিত্ত তাদের পরিবারের কাঙ্ক্ষিত আশা পূরণ করতে না পেরে জীবন্ত লাশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আজ বাংলার বুকে। হয়ত দরজার এপারে চলে তাদের হাসি মুখের অভিনয়। কিন্ত দরজার ওপারে মধ্যরাতে বালিশ ভেজানো তাদের চাপাকান্না সকলের অগোচরেই রয়ে যায়।

জিনিয়া আর শুয়ে থাকতে পারছেনা। কেমন যেন বোবা কান্নায় তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাই একটু স্বস্তি পেতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে তাকে মা-বাবাকে ছেড়ে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। মেসের খাবারের মান ভালো না হওয়ায় ক্যাম্পাসের কয়েকজন সিনিয়র জুনিয়র মিলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। সে থাকে তিন তলায়। রাস্তার পাশেই ফ্ল্যাটটি। তাই রিকশা-ভ্যান, বাইক আর মানুষের শব্দে তার অস্বস্তি আরো বাড়তে লাগল। মনের ব্যাপার স্যাপারই অন্যরকম। যখন তখন কারণে-অকারণে হুটহাট করেই সে খারাপ হয়ে যায়। আর ভালোটাও তখন বিস্বাদ লাগে। বারান্দায় আার বেশিক্ষণ থাকা হলো না তার। রুমে এসে মাকে ফোন দিবে বলে হাতে ফোন তুলতেই অপর প্রান্ত থেকে তার মায়েরই ফোন বেজে উঠল। হ্যালো, বলে ফোনটা কানে ধরতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল, হ্যালো জিনিয়া! তোর ফুলি দাদু একটু আগেই মারা গেছে। খবরটা শুনে তার মন আরো ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। এমনিতেই মন খারাপ এরপরে এত বড় একটা দুঃসংবাদ। সে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ল। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তার ফুলি দাদু আর নেই। শৈশবের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বৃদ্ধার সাথে তার। দাদু তাদের বাড়িতে কাজ করত। তিন ছেলে আর দুই মেয়ে ছিল।ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতেই স্বামী মারা যায়। অনেক কষ্টে মানুষের বাসায় কাজ করে মেয়ে দুটোকে বিয়ে আর ছেলেদেরকে বড় করে তোলে। দাদু ভেবেছিল তার কষ্টের দিন শেষ এবার সুখের পালা। কিন্ত, হায় অদৃষ্ট! সুখ যে অতি দুর্লভ বস্তু! এত সহজে কি আর তার দর্শন মেলে? ছেলেরা বিয়ে করে ঘরে এক একটা লক্ষী প্রতিমা আনার পরে যে মা নিজে না খেয়ে মানুষের বাসায় কাজ করে তাদের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছে, সেই মায়ের ভার বহনই তাদের সাধ্যাতীত হয়ে পড়ে। তাই শেষ বয়সেও দাদুকে মানুষের বাসায় কাজ করে জঠর জ্বালা নিবারণ করতে হতো। ইস! কত কষ্টই না করেছে দাদু সারাজীবন। আজ সকল কষ্টের অবসান ঘটল। এসব কথা ভাবতে ভাবতে জিনিয়ার মনে হল কেউ যেন লোহার হাতুড়ি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগল। সে আবার চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্ত হায়, পোড়া ঘুম! সে যে সুখের মতোই দুর্লভ। যখন তখন কি সে ধরা দেয়? জিনিয়া ভাবতে লাগল,ভালোই হয়েছে দাদু মরেছে। এখন তো আর এক মুঠো ভাতের আশায় তাকে মানুষের বাসায় কাজ করতে হবে না। যে মরে সে তো বেঁচেই যায় আর যে বেঁচে থাকে তাকে সহ্য করতে হয় জগতের সব দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রনা।দাদু মরে তো বেঁচেই গিয়েছে।

কিন্ত দাদুর তো আরও কত মানুষ বেঁচে আছে যারা নিজেরা কষ্ট করে না খেয়ে সন্তানের মুখে তুলে দিয়েছে খাবার,নিজেরা ছেড়া কাপড় পড়ে মিটিয়েছে সন্তানদের হাজারো চাহিদা, পূরণ করেছে শত আবদার। কত ত্যাগ স্বীকার করে উচ্চশিক্ষিত করে তুলেছে সন্তানদের। কিন্ত আজ সেই মহান মানবেরা বিবেককে বিলাসিতায় বিসর্জন দিয়ে বউয়ের কথা শুনে নিজেরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে সেই পিতামাতাকে রাখে বিদ্ধাশ্রমে। হায়রে সন্তান! যে মা তোদের দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে পৃথিবীর মুখ দেখালো, যে মায়ের হাত ধরে হাঁটতে শিখলি সেই মায়ের হাত ধরে রেখে আসিস বৃদ্ধাশ্রমে? তোদের মত সন্তানদের প্রতি শত কোটি ধিক্কার! যে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত, যে পিতাকে বলা হয় ‘পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম’ সেই পিতামাতাকে কাঁদিয়ে কোন স্বর্গে, কোন জান্নাতে বাস করছিস রে পাপিষ্ঠ, নরাধমরা! মানবতা আজ কোথায়? আর কোথায় তুমি মানবতার কবি নজরুল? দেখে যাও! মানবতা আজ মনুষ্যত্ব বিবর্জিত অধঃপতিত কলুষিত জাতির পদতলে পড়ে গুমরে গুমরে কাঁদছে। হে দ্রোহের কবি আবার ফিরে এসো! সকল পাপ-তাপ অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ ঘোষনা করো। তোমার কলমের শাণিত খোঁচায় মুছে যাক সব গ্লানি। একদিন তুমি গেয়েছিলে সাম্যের গান। দীপ্তকন্ঠে বলেছিলে-

‘আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোন ভেদাভেদ নাই।’

কিন্ত দেখে যাও সোনার বাংলায় আজও নারী পুরুষের কত ব্যবধান। নারী আজও পরিবারে, সমাজে অবহেলিত। আজও পরিবারে নারীর মতামতের কোন দাম নেই। আজও মুক্তমনে ওড়ার আগেই তার ডানা ছেটে ফেলে দেয়া হয়। আজও তাকে পরিবারের ছেলেদের থেকে কম প্রাধান্য দেয়া হয়। আজও প্রতিটি পদক্ষেপে নারীকে হতে হয় কঠিন বাঁধার সম্মুখীন। আজও নারী তার স্বপ্ন পূরণে পদে পদে বাঁধাগ্রস্থ। ফিরে এসো কবি! আবার লেখো নারীকে নিয়ে এমন কোন কবিতা যেটায় অনুপ্রাণিত হয়ে হাজারো নারী ছিড়ে ফেলতে পারে সমাজের দেওয়া,পুরুষের দেওয়া, পরিবারের দেওয়া সকল লোহার বেড়ী। ভেঙে ফেলতে পারে রুদ্ধ কারাগার,আর পূরণ করতে পারে সকল স্বপ্ন।

যে মাটিতে দাঁড়িয়ে একদিন জাতি নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছে “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।” আজ সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে জাতি লজ্জিত! একদিন বাংলার সৌন্দর্য দেখে জীবনানন্দ বলেছিলেন –“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর!” আজ সেই বাংলার মুখে লেগে গেছে কলঙ্ক। এ কলঙ্ক ঘোচাবে কে?

হঠাৎ করেই জিনিয়ার ক্লাসের কথা মনে পড়তে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দুইটা বাজে। সে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল গোসল করতে। মনটা খুব খারাপ ছিল তাই না খেয়েই রেডি হয়ে ক্লাসের জন্য বেরিয়ে পড়ল। ফ্ল্যাটের নিচে নেমে রাস্তা পার হওয়ার সময় দেখতে পেল এক বৃদ্ধ রিকশা-ভ্যানের ভিড়ে রাস্তা পার হতে পারছে না। জিনিয়া তাকে পার করানোর উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই দেখল ক্যাম্পাসের সিনিয়র তমাল ভাই তার হাত ধরে বলছে, আসুন আমি আপনাকে রাস্তা পার করে দিচ্ছি ।জিনিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তমাল ভাইকে বৃদ্ধের হাত ধরে রাস্তা পার করানো দেখল। বৃদ্ধ তমাল ভাইয়ের মাথায় হাত দিয়ে কি যেন বললো! এপার থেকে জিনিয়া শুনতে না পেলেও অনুমান করতে পারল যে হয়ত আশীর্বাদ দিয়ে বলছে, বেঁচে থাকো বাবা।’ মনের আকাশে যে ঘন কালো মেঘ জমাট বেঁধে ছিল রাস্তায় বেরিয়ে তার অনেকটাই কেটে গেল। রাস্তার এপার থেকেই জিনিয়া দেখতে পেল ওপারে ক্যাম্পাসের গেটের পাশেই একটা নয়-দশ বছরের মেয়ে গোলাপ বিক্রি করছে। ফুলের প্রতি জিনিয়ার ভালোলাগাটা বরাবরই একটু বেশি। আর গোলাপ বলতে তো অজ্ঞান। রাস্তা পার হয়ে দৌঁড়ে গিয়ে মেয়েটার কাছে থেকে তিনটা গোলাপ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কত টাকা হয়েছে? তিনডা তিরিশ টেহা হইছে আফা, মেয়েটি উত্তর দিল। জিনিয়া ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট বের করে মেয়েটির হাতে দিয়ে বললো, বাকি টাকা ফেরত দিতে হবে না। ওটা দিয়ে তুমি কিছু খেয়ে নিও। কথাটি শেষ হতেই মেয়েটির মুখে যে হাসি ফুটে উঠল সেটা দেখে তার ভেতরের সকল দ্বিধা, দ্বন্দ্ব কেটে এক অন্যরকম সুখ অনুভূত হলো। জিনিয়া ভাবতে লাগল, এত সুন্দর হাসি আমি মাত্র বিশ টাকা দিয়ে কিনলাম? এর মূল্য যে কোটি টাকা দিলেও কম মনে হবে।

মানুষ কত বড় বড় রেস্টুরেন্টে গিয়ে কত টাকা টিপস দেয়, কিন্ত তাদের মুখে কি এই হাসি দেখতে পায়? অথচ এরা অল্পতেই কত খুশি! কত জোর ঐ কচি মুখের হাসিটার। সেই সকাল থেকে মনের উপর যে বিষাদ ভর করে ছিল এক মুহূর্তের মধ্যে তা উড়িয়ে দিল। হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাসের ভেতরে ঝাউতলার দিকে যেতেই রংধনু সংগঠনের পাঁচ-ছয় জন ছেলে হাতে বক্স নিয়ে জিনিয়ার সামনে এসে বলল, আপু ফোকলোরের এক শিক্ষার্থী ক্যানসারে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য দশ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। কিন্ত তার পরিবারের এত খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই। তাই আমরা সবার কাছ থেকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা নিয়ে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। আপনার সাধ্যমত কিছু দিলে আমরা উপকৃত হতাম আপু। জিনিয়া পুলকিত হয়ে একশ টাকার একটা নোট ফেলে ডিপার্টমেন্টের দিকে হাঁটতে লাগল। জিনিয়া হাঁটছে আর ভাবছে, আমার ভগ্ন বাংলা একদিন আবার খাঁটি বাংলায় পরিণত হবে। এতকিছুর মাঝে বাংলার বুকে আজও তো দাঁড়িয়ে আছে হাজারো তমাল। যারা মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। আজও তো আছে নবছায়ার মত হাজারো সংগঠন যারা দেশ ও মানুষের কথা ভাবে। এরাই তো আগামীর পথপ্রদর্শক। ভবিষ্যতের আলোর দিশারী। এরাই হয়তো বাংলার বুকে একদিন জাতির পিতা,রবিঠাকুর, নজরুল, জীবনানন্দের রূপে উদিত হবে। হয়ত ঐ ফুলওয়ালী মেয়েটির মুখের হাসিতেই একদিন ধুয়ে মুছে যাবে সকল অন্যায়-অবিচার, পাপ-তাপ, নির্যাতন। গড়ে উঠবে এক নতুন বাংলা। যে বাংলার গায়ে আর কোন কলঙ্ক থাকবে না। একদিন হয়ত এই ভগ্ন বাংলাই হবে খাঁটি সোনার বাংলা। যার বুকে দাঁড়িয়ে জাতি আবার নির্দ্বিধায় বলতে পারবে-

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি

সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।”

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন