আবু সাইদ কামাল।। গল্প।। অগ্রাভিযান

0

ছবি: মার্কনী আরাফাত।

কেন্টিনে বসে পত্রিকা পড়ছে শামসুল আলম। তখন নবী শের খান নামে এক অবাঙালি পুলিশ সদস্য বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অকথ্য ভাষায গালাগাল করতে থাকে। তা সহ্য করতে না পেরে নবী শের খানের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে শামসুল আলম ক্রমাগত কিল-ঘুষি-লাথি মেরে ধরাশায়ী করে ফেলে।

এই ঘটনার জের ধরে রাত দশটার দিকে পুলিশ অফিসার চান মিয়া শামসুল আলমকে গ্রেফতার করতে আসে। সেদিন একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে শাখাওয়াত, নুরনবীসহ অনেকেই তীব্র প্রতিবাদ জানায়। সে সময়ে চানমিয়া বলে, আমার করার কিছুই নাই। তোমরা এসপি সাহেবের কাছে যাও। কিন্তু বাঙালি সদস্যদের কড়া প্রতিবাদের মুখে চানমিয়াকে শেষে ফিরে যেতে হয়।

পচিশ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনী ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালালে ঢাকার বাইরে স্থানে স্থানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। একাত্তরে ময়মনসিংহে প্রতিরোধ যুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকার কথা উঠলেই প্রথমে কে এম শামসুল আলম আলোচনার প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে। শামসুল আলম ১৯৬৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। পুলিশ সদস্য হিসাবেই ডেপুটেশনে ময়মনসিংহ পুলিশলাইন হাইস্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। ১৯৬৬ এর ছয়দফা দাবির প্রতি আগে থেকেই তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। শুধু তাই না, ৬ দফা দাবির পক্ষে জনমত গঠনের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়, সে কমিটির সভাপতি ছিলেন কে এম শামসুল আলম এবং সাধারণ সম্পাদক ছিল শাখাওয়াত হোসেন, আর এক পুলিশের সদস্য ।

২৫ মার্চ রাতেই আক্রান্ত হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনও। ২৬ মার্চ সকাল বেলায় এসপি সিরাজুল ইসলাম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে শামসুল আলমকে বলে, মাস্টার সাহেব! পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব এখন থেকে আপনার কাছে।

সাধারণ সদস্যদের উদ্দেশ করে এসপি বলেন, তোমরা এখন মাস্টার সাহেবের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবে।

অতঃপর তিনি প্রতি বাঙালি পুলিশ সদস্যকে একটি করে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও ৫০ রাউন্ড গুলি বরাদ্দ করেন। পাশাপাশি শামসুল আলমের সাথে পরামর্শ করে জেলার প্রতিটি থানায় কর্মরত অবাঙালি পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে নিয়ে আসেন।

শামসুল আলম ২৬ মার্চে রফিক উদ্দিন ভূঁইয়াসহ আওয়ামীলীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। তখন এডভোকেট হাকিম সাহেবের নেতৃত্বে বাউন্ডারি রোডে একটি কন্ট্রোল রুম পরিচালিত হয়। সেখানে নজরুল ইসলাম দুলাল, সিরাজ, আশরাফ প্রমুখ দায়িত্ব পালন করে। সে সময়ে শামসুল আলমের কক্ষের পাশেই ছিল পুলিশ বিভাগের ওয়্যারলেস সেন্টার। ওখান থেকে সমগ্র বাংলাদেশের খবর সংগ্রহ করা যেতো। ২৬ মার্চ সকালে বাঙালি ওয়্যারলেস অপারেটর আবু আহমেদের কাছে খালেদ মোশারফের একটা বার্তা ধরা পড়ে। বার্তায় যা উল্লেখ করা হয়, তার সারমর্ম হলো এই: বাংলাদেশের যত কর্মকর্তা-কর্মচারি আছেন, সবাই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।

এই বার্তা নিয়ে শামসুল আলম মাস্টার বিকেল ৩টায় খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে গেলেও ভিতরে ঢুকতে পারেনি। আমজনতা ঘেরাও করে রেখেছে ক্যাম্পটি। ফিরে আসার সময় দেখতে পান, একটি জিপ নিয়ে ক্যাম্পের দিকে এগুচ্ছেন সৈয়দ আব্দুস সুলতান এমপিএ এবং আ: রহমান। শামসুল আলম হাতের ইশারায় গাড়ি থামিয়ে ক্যাম্পের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবহিত করেন। ফলে তারা আর সামনে না এগিয়ে শহরে ফিরে আসেন। টাউনহলে গিয়ে মাঠে বসে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনাপর্বে শামসুল আলম তরুণদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহের নিশ্চয়তা দেন। ২৭ তারিখ রাতের বেলায় দু’জন পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হলে চরপাড়া হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা চলে। এ ঘটনায় পুলিশ লাইনে চরম উত্তেজনা ছড়ায়। তখন এসপি সিরাজুল ইসলাম এবং শামসুল আলমের আশ্বাসে উত্তেজনা কমে আসলেও পরিস্থিতি থমথমে থেকে যায়।

গভীর রাত থেকেই যে খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি এবং পাকিস্তানি সদস্যদের মাঝে যুদ্ধ চলছে সে খবর জেলা পুলিশ দপ্তর যথাসময়েই জেনেছে। সেখানকার সবশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য ২৮ মার্চ ভোর চারটায় একদল সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে রেললাইন ধরে খাগডহরের দিকে এগোয় শামসুল আলম। আর একটি দল যায় নদীর কিনার ধরে। তখন খাগডহর ক্যাম্পের গোলাগুলি প্রায় শেষের দিকে। মাঠে অসংখ্য পাক ইপিআর সদ্যস্যের লাশ। শেষ মুহূর্তে একজন পাক ইপিআর সদস্য থেমে থেমে গুলি করে যাচ্ছে। তখন সুবেদার জিয়াউল হক এলএমজির ব্রাশ ফায়ার করে তাকে হত্যা করে।

যুদ্ধ থেমে গেলে অস্ত্রাগার থেকে যে যা পারে অস্ত্র লুট করতে আসে। এ অবস্থা দেখে  শামসুল আলম তার দল নিয়ে আস্ত্রাগার কর্ডন করে ফেলে। সাথে সাথে জননেতা রফিকউদ্দিন ভূঁইয়াকে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নেওয়ার জন্য খবর পাঠান। রফিক উদ্দিন ভূঁয়ার পক্ষে অস্ত্র গ্রহণ করে ডা: হাফিজ উদ্দিন খান, নজরুল ইসলাম দুলাল, সুব্রেনিয়াম শামসুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। অস্ত্রের মাঝে ছিল ৩০০টি থি নট থ্রি রাইফেল, একট্রাক গুলি ও প্রচুর বিস্ফারক। এসব নেওয়ার জন্য পুলিশ লাইনে ফোন করে ট্রাকের ব্যবস্থা করা হয়। অতঃপর ট্রাকে করে সমস্ত অস্ত্র পুলিশ লাইনে পাঠানো হয়।

খাগডহর ইপিআর বিদ্রোহে যদিও বাঙালি ইপিআর সদস্যের ত্যাগ ও ভূমিকাই মূখ্য। তবু ঐ বিদ্রোহের সূচনায় ম. হামিদ, তোতা, লালু ও খাজা মাইনউদ্দীন প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তখন খাগডহরে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য অবস্থান করছিল। তারাও এ যুদ্ধে অংশ নেয়। ফলে বাঙালিদের বিজয় সুনিশ্চিত হয়। শামসুল আলমের সহযোগিতায় পুলিশ লাইনে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

দুই

সে সময় জয়দেবপুরে অবস্থানরত মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট টাঙ্গাইল মুক্তগাছা হয়ে ২৯ মার্চ দুপুরবেলায় ময়মনসিংহে এসে পৌঁছে। তিনি ময়মনসিংহে এসে পুলিশের ওয়ারলেস থেকে অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের যার কাছে যে অস্ত্র আছে তা দিয়ে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং পাকিস্তানিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে আহ্বান জানান। একই দিনে মেজর শফিউল্লাহ পাকহানাদারদের প্রতিরোধ-বিষয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেন। বৈঠকে টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক, এমএনএ, এমপিএ, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারবৃন্দ, সাবেক ইপিআরের বাঙালি জেসিও ও এনসিওবৃন্দ উপস্থিত থাকেন। সভায় মেজর শফিউল্লাহকে যুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

স্থানীয় গণপ্রতিনিধিদের উপর আইন শৃঙ্খলা, খাদ্য ও সিভিল প্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ক্যাপ্টন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ইপিআর সদস্যদের নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।

খাগডহর যুদ্ধে বিজয়ের পর অস্ত্রাগার থেকে যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়, তা মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর কাছে হস্তান্তর করা হয়।

বিকেল ৪ টায় ময়মনসিংহ টাউন হলে ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল সদস্য বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে শপথ গ্রহণ করে। মেজর শফিউল্লাহ শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অতঃপর বিকেলেই স্থানীয় সার্কিট হাউস ময়দানে বিশাল জনসমাবেশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন মেজর শফিউল্লাহ। এ ঘটনায় ময়মনসিংহের মানুষের মাঝে উদ্যম ফিরে আসে। ৩০ মার্চ রাতে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ ঢাকা আক্রমণের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ট্রেনযোগে নরসিংদীর পথে রওয়ানা হন।

২৯ মার্চ ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজে প্রতিরোধ যুদ্ধ সম্পর্কে অনুষ্ঠিত যৌথসভাতেই রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, শামসুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দসহ ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের ওপর ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অফিসারদের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাদের পক্ষ থেকে হালুয়াঘাট সীমান্তের কড়ইতলী বিওপিতে গিয়ে ভারতীয় বিএিসএফ ৮৩ ব্যাটালিয়ান কমান্ডার কর্নেল রাঙ্গাজান, ইনটেলিজেন্সের লে: ক: সিনহা এবং বালজিৎ সিং ত্যাগীর সাথে সাক্ষাৎ করেন একটি প্রতিনিধি দল।

বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা এদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং সামরিক সাহায্য চান। কর্নেল রাঙ্গাজান তাৎক্ষনিকভাবে তাদের ২৭টি এমএমজি এবং প্রচুর হ্যান্ড গ্রেনেড সরবরাহ করেন। কর্নেল রাঙ্গাজান সামগ্রিক সংবাদ দিল্লিতে পাঠান এবং ভষ্যিতে সাহায্যের আশ্বাস দেন।

এই যোগাযোগের পর থেকেই ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং ত্যাগী প্রায়দিনই ছদ্মবেশে মধুপুরের রসুলপুর এবং অন্যান্য প্রতিরোধ যুদ্ধে সাহায্য করতে থাকেন। মধুপুর যুদ্ধের রাতে বালজিৎ সিং ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদল কাজ সেরে ডালুতে ফিরে যেতেন। সেদিনও তাঁর সহযোগিতায় ভারতীয় ডিমোলিশন পার্টি টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কে ব্রিজ উড়ানোর কাজ সম্পন্ন করে রাতেই ডালু ক্যাম্পে ফিরে যায়।

খাগডহর প্রতিরোধ যুদ্ধের পর থেকেই জেলাস্কুলে ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়। জেলা স্কুল ট্রেনিং সেন্টারে শামসুল আলম আরও দু-তিনজন হাবিলদার নিয়ে তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। এখানে স্বল্প প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কিছু ছেলেকে মধুপুর প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ ময়মনসিংহ ছেড়ে যাবার পর শামসুল আলমরা দুটি টহল দল গঠন করেন। একটির দায়িত্বে ছিলেন মুসা এবং অন্যটির দায়িত্বে ছিলেন নায়েক মহিউদ্দিন। ওরা সকাল-বিকাল ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত মোটরবাইকে টহল দিতেন। একদিন সেই টহল দল এসে খবর দেয় যে, পাক বাহিনী এগিয়ে আসছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সম্ভবত দুই কিংবা তিন তারিখে শামসুল আলম মাস্টারের নেতৃত্বে ডা: হাফিজ উদ্দিন, সামসুদ্দিন ও মতিউরসহ ১১০ জনের একটি দল টাঙ্গাইলের কালিহাতি পার হয়ে কমলিতে অবস্থান নেয়। পাক বাহিনী টাঙ্গাইল দখল করতে আসছে এমন খবর পেয়ে তারা পিছু হটে মধুপুর চলে আসে। আগে থেকেই মধুপুরে প্রতিরোধ যোদ্ধারা প্রস্তুত ছিল। সেখানে ওরা ওৎ পেতে থাকে। দুপুরে পাকবাহিনীর ৫-৬টি গাড়ি মধুপুর বাজার এলাকায় আসলে প্রতিরোধ যোদ্ধারা প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। তীব্র ও আকস্মিক আক্রমণে টিকতে না পেরে ওরা পিছু হটে। সে যুদ্ধে পাক বাহিনী পরাস্ত হয়ে দুটি যান বাহন রেখে পলায়ন করে।

রাতে মধুপুর ক্যাম্পের আঙিনায় রাইফেল কাঁধে নিয়ে পায়চারি করছে শামসুল আলম। তখন অপরিচিত একজন লোক হঠাৎ বলে উঠে, তুম কৌন হায়?

অমনি পাক সেনা ভেবে শামসুল আলম যুদ্ধের পজিশনে গিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে। যখন সে রাইফেল তাক করতে যাচ্ছে, তখনই বালজিৎ সিং ত্যাগি তড়িঘড়ি তার পরিচয় তুলে ধরে। এমন নাটকীয়ভাবেই ভারতীয় ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিংয়ের সাথে শামসুল আলমের পরিচয়।

শামসুল আলমের মুখে তখন হাসির ঝিলিক। পজিশন থেকে ফুরফুরে মনে উঠে। তারপর ভারতীয় অফিসারদের সাথে একে একে পরিচিত হয়। অতঃপর কিছুক্ষণের মাঝে তাদের নিয়ে মধুপুর ক্যাম্পের যায়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধপর্ব থেকেই ক্যাপ্টেন বালাজিৎ সিং ত্যাগী সম্পৃক্ত হন। তখন তিনি হালুয়াঘাটের উত্তরে গাছুয়াপাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের কমান্ডিং অফিসার।

সন্ধ্যার পরে ক্যাপ্টেন বালাজিৎ সিং, ক্যাপ্টেন নাগি, ক্যাপ্টেন মুরারী ও ক্যাপ্টেন ভবানীসহ ভারতের বেশ কিছু সামরিক অফিসার ও সাধারণ সৈনিক মধুপুরে আসে। তারা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের উৎসাহ দেয় এবং বিপুল বিস্ফোরক সরবরাহ করে। রাতে ভারতীয় বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ দল মধুপুর ব্রিজ ধ্বংসের জন্য বিস্ফোরক স্থাপন করে। এ সময় ভারতীয় দলের সাথে ছিল শামসুল আলম, ম. হামিদ, ডা: মাহমুদ, আবুল হাশেম, নজরুল ইসলাম দুলাল ও সুবেদার জিয়াউল হক। তারপর আরও কয়েকটি প্রতিরোধ যুদ্ধে শামসুল আলম তার বাহিনী নিয়ে অংশ নেয়।

তিন

প্রতিরোধ মুক্তিযোদ্ধাদের ছিলনা সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র। তাই মধুপুরের যুদ্ধের পরে কালিহাতী যুদ্ধে শামসুল আলমের দল মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ঐ যুদ্ধে সিপাহি রাজ্জাক শহীদ হয় এবং আরও ২৫ জন সদস্য হয় আহত। যুদ্ধে নাজেহাল অবস্থায় পড়ে পুলিশ বাহিনী পরস্পর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনে মাত্র সাতজন সদস্য ফিরে আসে।

পাকবাহিনীর ভারী ও আধুনিক অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। পাক বাহিনীর অগ্রাভিযানের মুখে টিকতে না পেরে এপ্রিলের শেষের দিকে ভারতের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় রইলনা। তখন প্রতিরোধযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী নেতারাও আশ্রয় নিতে থাকে সীমান্ত এলাকায়। এপ্রিলের ২৩ তারিখে ময়মনসিংহের পতনের আগেই শামসুল আলম ভারতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে। সাথীদের নিয়ে ভারত সীমান্তে প্রবেশ করে গাছুয়াপাড়া ক্যাম্পে গিয়ে ওঠে। সেখানে পৌঁছে শামসুল আলম পূর্বপরিচিত বালজিৎ সিং ত্যাগির সাথে যোগাযোগ করে ভারী অস্ত্রের জন্য আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে বালজিৎ সিং তাদের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন এবং এলএমজি বরাদ্দ করেন। ট্রেনিং চলাকালেই প্রায় রাতে আয়নাতলী, কড়ইতলী, তেলিখালি বিওপিতে হিট এন্ড রান পদ্ধতিতে গেরিলা হামলা করে নিরাপদে ফিরে যায় মুক্তিযোদ্ধারা।

আনুষ্ঠানিকভাবে ইয়ুথক্যাম্প চালুর আগে নাজমুল হক তারা ও উইলিয়াম ম্রংয়ের নেতৃত্বে দুটি কোম্পানির প্রশিক্ষণ চলছিল। তাদের সাথে শামসুল আলমকে কোম্পানি কমান্ডার করে আর একটি গ্রুপের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়।

জুনের মাঝামাঝি সময়ে এফজে সেক্টরের কমান্ডার বাবাজী চারজন কোম্পানি কমান্ডারকে সাবসেক্টর কামান্ডার পদে উন্নীত করেন। তাঁরা হলেন পুরাকাসিয়া সাব সেক্টর কমান্ডার শামসুল আলম, ডালু সাবসেক্টর কমান্ডার নাজমুল আহসান, বাঘমারা সাবসেক্টর কমান্ডার তোফাজ্জল হোসেন চুন্নু এবং রংরা সাবসেক্টর কমান্ডার শাহ মো: নাজমুল হক তারা।

চার

ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও ও ভালুকা থানা ছিল ৩ নং সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা, ত্রিশাল, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়ার কিছু যুদ্ধে অংশ নেয়। নাগরপুরে খন্দকার আ: বাতেনের নেতৃত্বে একটি বাহিনী ময়মনসিংহের মুক্তগাছার সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে প্রশংসিত তৎপরতায় ছিল। অন্যদিকে মেজর আফসারের বাহিনীর মূল যুদ্ধ এলাকা ভালুকা হলেও গফরগাঁও, ত্রিশাল ও ফুলবাড়িয়ার কিছু যুদ্ধে ভূমিকা রাখে। এছাড়া সমগ্র ময়মনসিংহ জেলা, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল নিয়ে মুজিনগর সরকারের ১১ নং সেক্টর গঠিত হয়। আবার মিত্রবাহিনীর কাছে তা ১১ নং এফজে সেক্টর বলে পরিগণিত। এ সেক্টরের হেডকোয়াটার ছিল মেঘালয়ে। সেক্টর গঠনকালে এর প্রধান ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। জুলাই মাসে এটি জেড ফোর্স নামে পরিচিত হয়। আগস্ট মাসে মেজর আবু তাহের ১১ নং সেক্টরের দায়িত্ব নেন।

মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের পাদদেশ এলাকার অবস্থান মূলত ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত। যদিও বকশিগঞ্জ, কামালপুর, নকশি বিওপি বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভূক্ত না, তথাপি ময়মনসিংহের জন্য সে এলাকা ছিল সামরিক দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ কৌশল হিসাবে পাকবাহিনী হালুয়াঘাট থেকে পশ্চিমে বকশিগঞ্জ, কামালপুর, নকশি ও বারোমারি প্রভৃতি এলাকায় মরণপণ যুদ্ধ প্রস্তুতি নেয়। এ কারণে হালুয়াঘাট, বকশিগঞ্জ, কামালপুর, নকশি ও বারোমারি এলাকায় মুক্তিবাহিনী চূড়ান্ত আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

৩১ জুলাই জেড ফোর্স প্রথমত কামালপুরে আক্রমণ করে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে কামালপুর বিওপির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেও শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী কামালপুর দখল নিতে পারেনি। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনসহ ২১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন ৬৭ জন।

৪ আগস্টে জেড ফোর্স শেরপুরের নকশি বিওপি আক্রমণ করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের স্বল্প প্রশিক্ষণ, আর্টিলারি সমর্থনের অভাব, লোকবলের স্বল্পতা, পর্যাপ্ত অফিসারের অভাব এবং গোলাবারুদের স্বল্পতার জন্য এ যুদ্ধেও মুক্তিযোদ্ধারা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এ যুদ্ধেও ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধ শহীদ হন।

পাকবাহিনী কামালপুর সীমান্ত ফাঁড়িতে মোটা কংক্রিটের ব্যাংকার তৈরি করেছিল। পাকবাহিনীর কামালপুর ঘাঁটিকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য কামালপুর-বকশগিঞ্জ পর্যন্ত রাস্তায় পাকহানাদারের দুর্ধর্ষ ৩১ বেলুচ বাহিনীকে মোতায়েন রাখা হয়। অথচ কামালপুর থেকে নকশি, বারোমারি, হালুয়াঘাট ও বান্দরকাটাসহ প্রতিটি চেকপোস্ট মুক্তিবাহিনীর জন্য দখল করা জরুরি। কিন্তু মুক্তিবাহিনী বারবার কামালপুর আক্রমণ করেও বিফল হচ্ছিল। ১৪ নভেম্বর ১১ নং সেক্টরের কামান্ডার আবু তাহের স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তারা কামালপুর-বকশীগঞ্জ রাস্তায় অবস্থানকারী ৩১ বেলুচের ওপর আকস্মিক এবং ক্ষিপ্র গতিতে আক্রমণ করে। ফলে পাকবাহিনী রাস্তার অবস্থান ছেড়ে শেরপুর এবং জামালপুর অবস্থান নেয়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ছোড়া শেলের আঘাতে কমান্ডার আবু তাহের আহত হন। সর্বাত্মক এই যুদ্ধে একুশদিন অবরুদ্ধ থাকার পর ৪ ডিসেম্বর তারিখে পাকবাহিনীর সুরক্ষিত এবং গুরুত্বপূর্ণ কামালপুর ঘাঁটির পতন ঘটে। অন্যদিকে ৩ ডিসেম্বর প্রথমে পাকিস্তান এবং পরে ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করলে পাকবাহিনীর দৃঢ় মনোবলে ফাটল ধরে। ওরা বিভিন্ন বিওপির অবস্থান ছেড়ে ময়মনসিংহ শহরের দিকে পিছু হটতে থাকে।

৩ ডিসেম্বর রাত বারটায় ভারত সরকার সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করার সাথে সাথে হাই কমান্ড এই বার্তা মেঘালয় সেক্টরে পাঠিয়ে দেয়। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার হরদেও সিং ক্লিয়ার ভারতীয় বাহিনীর সামরিক অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের নিয়ে বিগ্রেড হেডকোয়াটারে জরুরি বৈঠকে বসেন। তিনি সবার মাঝে যুদ্ধপরিকল্পনা পেশ করেন এবং মানচিত্র দেখান। যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিএসএফ সৈন্যদের নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের নির্দেশ দেন। সমর নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন চৌহান নেত্রকোনা দুর্গাপুর সীমান্তে, ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং হালুয়াঘাট এবং ক্যাপ্টেন মুরারীকে পুর-খাসিয়া হয়ে শেরপুর, আবুল হাশেমকে ডালু থেকে তেলীখালী-হালুয়াঘাট সীমান্ত সড়ক দিয়ে ময়মনসিংয়ে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন।

পাঁচ

বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারে নির্দেশ অনুযায়ী ৬ বিহার রেজিমেন্ট ১৩ রাজপুত রেজিমেন্ট জামালপুর-শেরপুর দিয়ে আক্রমণ করে ঢাকার দিকে অগ্রসর হবে। ৮ম গার্ড রেজিমেন্ট ও মারাঠা রেজিমেন্ট ময়মনসিংহ-মধুপুর হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হবে। ভারতের মাটিতে অবস্থান করা মুক্তিবাহিনীর ৩২টি কোম্পানি মিত্রবাহিনীর সাথে প্রবেশ করবে। বাংলাদেশের ভিতরে যেসব মুক্তিযোদ্ধা আছে, তারা যার যার অবস্থান থেকে মিত্রবাহিনীর সাথে যোগ দেবে।

যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন ডিসেম্বর গভীর রাতে কমান্ডিং অফিসার বিগ্রেডিয়ার সানসিং বাবাজী নিজের রেজিমেন্টের নেতৃত্ব দিয়ে ও ৪টি মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি সাথে নিয়ে অগ্রভিযান শুরু করেন। তিনি গাছুপাড়া থেকে গোবড়াকুড়া হয়ে হালুয়াঘাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। পাশাপাশি আবুল হাশেম, সুবেদার মেজর জিয়াউল হন এবং মেজর মিলন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাঘাইতলী হয়ে হালুয়াঘাটের দিকে অগ্রসর হন। ৪ ডিসেম্বর সকালে কড়ইতলা ক্যাম্পে আক্রমণ করা হয়। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। যৌথ বাহিনীর হেভি মেশিনগান ও মিডিয়াম মেশিনগানের গুলির আওয়াজে হালুয়াঘাটের মাটি কাঁপতে থাকে। ওদিকে মিত্র বাহিনীর চারটি মিগ বিমান পাবিস্তানি সেনাবাহিনীর লক্ষে ক্রমাগত রকেট ছুঁড়তে থাকে। দু’দিনের যুদ্ধেই পাকবাহিনীর ছোট ছোট ক্যাম্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ওরা বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে হালুয়াঘাট জড়ো হতে থাকে।

৪ ডিসেম্বর কামালপুর ঘাঁটির পতন ঘটলে ময়মনসিংহ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের পথ সুগম হয়। এ যুদ্ধে সাধারণ মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্যের হাত বাড়ায়। সুবেদার মেজর জিয়াউল হক যখন ৩৫টি গাড়ি নিয়ে সীমান্ত পথের ভাঙতি পার হতে পারছিলেন না, তখন আমজনতা কোদাল, শুকনো খড়, বাঁশ, মই দিয়ে গাড়িগুলোকে অনেকটা চাংদোলা করে পার করে দিচ্ছিল। জনতাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন জননেতা রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, শামসুল হক এমপিএ, আবুল মনসুর আহমেদ এমপিএ ও অধ্যক্ষ মতিউর রহমান প্রমুখ।

৪ ডিসেম্বর রাতেই কড়ইতলা থেকে পাকবাহিনীকে হটিয়ে দেয় যৌথ বাহিনী। সারারাত হালুয়াঘাট ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সাথে যুদ্ধ চলে। ৫ ডিসেম্বর সকাল সাতটার মাঝে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানি গোলন্দাজ বাহানীকে অকার্যকর ফেলে। ফলে যৌথ বাহিনী আরও সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যায়। হালুয়াঘাটে পাকবাহিনীর কোনো বিমান বিধ্বংসী ব্যবস্থা ছিল না। ফলে মিত্রবাহিনীর ক্রমাগত বিমান হামলায় পাকবাহিনীর ব্যংকারগুলো বিধ্বস্ত হতে থাকে।

৬ ডিসেম্বরে মিত্রবাহিনীর ক্রমাগত হামলায় পাকবাহিনীর অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। সারাদিন রাজাকার ও পাকবাহিনীর সদস্যরা বিক্ষিপ্তভাবে আত্মসমর্পন করতে থাকে। রাত ন’টার পর পাকাবাহিনীর সদস্যরা রাজাকারদের গুলি চালিয়ে যওয়ার নির্দেশ দিয়ে গোপনে হালুয়াঘাট ছেড়ে ফুলপুরে পালিয়ে যায়। রাজাকাররা ওদের চালাকি বুঝতে পেরে অস্ত্র-শস্ত্র ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এভাবে রাত বারোটায় হালুয়াঘাট মুক্ত হয়।

ওদিকে জামালপুল-শেরপুর ও নেত্রকোনা ফ্রন্টেও পাক সেনারা ক্রমাগত পিছু হটতে থাকে। ৭ ডিসেম্বর সকালে যৌথ বাহিনী ফুলপুরের দিকে রওয়ানা হয়। ৮ ডিসেম্বর ফুলপুর থেকে তারাকান্দার দিকে রওয়ানা হয়। তখন খবর পাওয়া যায় যে, পাকবাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনীর কিছু সদস্য গ্রামের ভিতর দিয়ে পালাচ্ছে। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে। অনন্যোপায় হয়ে শত্রুপক্ষের সদস্যরা কোনোরূপ গুলি বিনিময় না করে আত্মসমর্পন করে। তাদের বিএিসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

ওদিকে সাব সেক্টর কামান্ডার তোফাজ্জল হোসেন চুন্নুর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী দুর্গাপুর বিরিশিরি মুক্ত করে তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে। ওরা তখন প্রায় শ্যামগঞ্জ পর্যন্ত চলে আসে। বিএসএফ কমান্ডার মুরারী, ক্যাপ্টেন চৌহান, মেজর প্রীত, কর্নেল রাওসহ যৌথবাহিনীর আর একটি দল কলমাকান্দা, আটপাড়া, নেত্রকোনা হয়ে শ্যামগঞ্জ পর্যন্ত পাকবাহিনীর পিছু ধাওয়া করে।

জামালপুর ফ্রন্টে বিগ্রেডিয়ার হরদেব সিংয়ের নেতৃত্বে যৌথবাহিনী পাকসেনাদের ব্রহ্মপুত্রের ওপারে হটিয়ে দেয়। পুরাখাসিয়া থেকে সাবসেক্টর কমান্ডার কে এম শামসুল আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বীরদর্পে অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে।

৯ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে তারাকান্দা থেকে যৌথবাহিনী শম্ভূগঞ্জের কাছাকাছি চলে আসে। ওদিকে পাকবাহিনী যে কোনো মূল্যে শম্ভূগঞ্জ বাজারের অবস্থান ধরে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। কারণ, এই অবস্থান বজায় রাখতে পারলে হালুয়াঘাট, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা থেকে পিছু হটা পাকসেনা সদস্যরা জড়ো হতে পারে। ফলে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে পালিয়ে আসা পাকসেনাদের জীবনের নিশ্চয়তাও অক্ষুন্ন থাকবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ওদের সে সুযোগ দেয়নি। যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রচ- আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী সরে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ধীরে ধীরে শম্ভূগঞ্জ বাজারে অবস্থান নেয়। পাকবাহিনী গুলি বর্ষণ অব্যাহত রেখে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করতে থাকে। ওদিকে পাকবাহিনীর মেজর খালেক শম্ভূগঞ্জ বাজার থেকে রেললাইন ধরে শম্ভূগঞ্জ রেলসেতুতে অবস্থান নেয়। রাত অনুমান একটার দিকে পাক সেনারা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক প্রয়োগ করে শম্ভূগঞ্জ রেলসেতুর একাংশ ধ্বংস করে দেয়। ৯ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সংগঠকরা ব্রহ্মপুত্র নদের চরের বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান নেয়। গভীর রাতেই পাক সেনারা ময়মনসিংহ ছেড়ে পলায়ন করে। ডিম্বেরের ১০ তারিখ সকালে মুক্ত ময়মনসিংহে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনী। এ সময়ে মিত্রবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার সানসিং বাবাজীর সাথে ছিলেন জননেতা রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, আবুল মনসুর আহমেদ এমপিএ। রফিকউদ্দিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মুক্ত ময়মনসিংহে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেই শুভযোগে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শামসুল আলমরাও।

লেখক: গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন