আফরানুল ইসলাম সিয়াম।। ইতালো কালভিনো’র দু’টি লোককাহিনী অনুবাদ

0

আর্টওয়ার্ক: ফারিনা আহমেদ

শৈবালে ঢাকা মানুষ

একদা এক রাজা ঘোষণা করলেন, তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে খুঁজে নিয়ে আসবে যেই ব্যক্তি, তাকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ দিয়ে সম্মানিত করবেন। কিন্তু এই লোভনীয় ঘোষণাতেও কোনও উপকার হলো না। কারণ, রাজকন্যা কোথায় আছে, তা সবার অজানা। হুট করেই এক রাতে উধাও হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা, পুরো দুনিয়া তোলপাড় করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি আর।

এক জাহাজের ক্যাপ্টেন ভাবল, পুরো দুনিয়া খুঁজলেও বিশাল সমুদ্রে কোনও তল্লাশি হয়নি; তাই জাহাজ নিয়ে রাজকন্যাকে খুঁজতে বের হবে সে যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু সব গোছগাছের পর, যাত্রার সময় কোনও নাবিককেই সাথে পেল না ক্যাপ্টেন! এমন লম্বা এক অভিযান, যেখান থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারবে কিনা তা অজানা, সেখানে যেতে আগ্রহী নয় কেউ।

পোতাশ্রয়ে অপেক্ষা করছে ক্যাপ্টেন, কিন্তু প্রথম পা বাড়ানোর দোষে দায়ী হতে রাজী নয় নাবিকদের কেউ। ঠিক তখন, জেটিতে দাঁড়িয়ে ছিল মাতাল পরিব্রাজক স্যামফায়ার স্টারবোর্ড। কোনও ক্যাপ্টেনই লোকটাকে নিজের জাহাজে তুলতে রাজী হত না। তবে এই জাহাজের ক্যাপ্টেন চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘স্যামফায়ার, আমার সাথে যাবে হে?’

‘অবশ্যই, ক্যাপ্টেন।’

স্যামফায়ারের পিছু-পিছু নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও জাহাজে আরোহণ করল সমস্ত নাবিক। যথাসময়ে যাত্রা শুরু করল জাহাজ। তবে জাহাজের কোনও কাজ করে না স্যামফায়ার, পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু, কল্পনায় ফেলে আসা পানশালার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অন্যান্য নাবিকরা হাত-পা গুটিয়ে বসে রইল না, স্যামফায়ার স্টারবোর্ডের চৌদ্দ-গোষ্ঠী উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। রসদও প্রায় ফুরিয়ে আসার যোগাড়। তাই নিষ্কর্মা মাতালের হাত থেকে নিস্তার পেতে চাইল ক্যাপ্টেন। সমুদ্রের মাঝখানে ভেসে ওঠা এক বিরান দ্বীপের সামনে থামল জাহাজ।

‘দেখো, স্যামফায়ার।’ বলল ক্যাপ্টেন। ‘সামনের দ্বীপটায় নৌকা নিয়ে যাও তুমি। আমরা এখানেই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।’

যথারীতি রওনা হলো মাতাল স্টারবোর্ড, সেই সাথে চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল জাহাজটাও। অসহায় লোকটা দ্বীপে পৌঁছুল। কাছের এক পাহাড়ের গায়ে সুড়ঙ্গ, ভেতরে সুন্দরী এক তরুণীকে খুঁজে পেল সে। মেয়েটাই হারিয়ে যাওয়া সেই রাজকন্যা।

‘কীভাবে আমাকে খুঁজে পেলে তুমি?’ জানতে চাইল বিস্মিত রাজকন্যা।

‘অক্টোপাস শিকারে বের হয়েছিলাম আমি।’

‘আমাকেও এক দানব অক্টোপাস এখানে বন্দি করে রেখেছে।’ বলল রাজকন্যা। ‘বাঁচতে চাইলে পালাও। কিন্তু মনে রেখো, তিন ঘণ্টার জন্য সাধারণ মাছে পরিণত হয় ওটা। তখন দানবটাকে খুন করা সম্ভব। তবে দ্রুত কাজটা শেষ করতে না পারলে সীগাল হয়ে উড়ে যাবে দানব।’

নৌকাটা লুকিয়ে রাখল স্যামফায়ার, অপেক্ষায় রইল অক্টোপাসের জন্য। ভেসে উঠল দানব অক্টোপাস, এই দ্বীপের চেয়েও আকারে বিশাল বড়। মানুষের গন্ধ পেয়েছে ওটা, গা ঝাড়া দিয়ে উঠল তাই। কিন্তু রূপান্তরের সময় সন্নিকটে। রঙিন একটা মাছ হয়ে সমুদ্রের পানিতে ডুবে গেল সেই দানব।  

লাফিয়ে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এল স্যামফায়ার, জাল পেতে দিল সমুদ্রে। একে একে লাল, নীল, হলুদ- নানা জাতের মাছ ধরা দিল জালে। অবশেষে পাওয়া গেল সেই রঙিন মাছটা। খুন করার জন্য হাতের বৈঠা উঁচিয়ে ধরল স্যামফায়ার, ঠিক তখনই সীগালে পরিণত হলো দানব। বৈঠার আঘাতে ডানা ভেঙে গেল ওটার। তড়পাতে তড়পাতে আবারও নিজের স্বরূপ ফিরে পেল অক্টোপাস। তবে গুরুতর আঘাতের কারণে নড়তে-চড়তে অক্ষম, শুঁড় বেয়ে বইছে কালচে রক্তের ধারা। মাথায় পর-পর বেশ কয়েকবার আঘাত করল মাতাল লোকটা, অক্টোপাস মারা গিয়েছে নিশ্চিত হয়ে ফিরে এল। খুশিতে হাতের আংটি স্যামফায়ারকে পরিয়ে দিল রাজকন্যা।

‘চলো, তোমার পিতার কাছে যাই।’ নৌকায় চড়ে রওনা হলো দু’জন। বিস্তীর্ণ পানির মাঝে ছোট একটা বিন্দু যেন এই নৌকা, বৈঠা বাইতে বাইতে অবশেষে বহুদিন পর একটা জাহাজের দেখা পাওয়া গেল। রাজকন্যার গাউন বৈঠাতে বেঁধে জাহাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করল স্যামফায়ার। এগিয়ে এল জাহাজ। লক্ষ্য করল, এই জাহাজে করেই সমুদ্রে যাত্রা করেছিল সে!

রাজকন্যাকে সাথে নিয়ে মাতাল লোকটাকে ফিরে আসতে দেখে মুচকি হেসে উঠল ক্যাপ্টেন, ‘আরে, স্যামফায়ার স্টারফোর্ড! তোমাকে কত খুঁজেছি আমি, ভেবেছিলাম মরেই গেছ হয়তো। কিন্তু এখন দেখি ফিরে এসেছ রাজকন্যাকে সাথে নিয়ে। চলো, আজ উৎসব হোক।’ জাহাজের উৎসব মানেই অঢেল মদ। খুশি হলো স্যামফায়ার, মাসখানেক মদের স্পর্শটাও পায়নি যে! সামনে বোতল পেয়ে আকণ্ঠ পান করল সে, তারপর অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল জাহাজের মেঝেতে। ততক্ষণে রাজ্যের কাছাকাছি ফিরে এসেছে জাহাজ। রাজকন্যাকে সতর্ক করল ক্যাপ্টেন, ‘সাবধান, ভুলেও স্যামফায়ার স্টারফোর্ডের নাম আনবে না মুখে। তোমার বাবা জানতে চাইলে বলবে, আমিই তোমার রক্ষাকর্তা।’

পরিষ্কার করে কিছুই বলল না রাজকন্যা, হেঁয়ালি করে বলল, ‘ঠিক কী বলতে হবে, তা আমার জানা আছে।’

নিজের প্রতি সমর্থন পাকাপোক্ত করতে স্যামফায়ারকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলল ক্যাপ্টেন। পরদিন ভোরেই বন্দরে পৌঁছুল জাহাজ। খবর পেয়ে পুরো রাজসভা নিয়ে এসে ক্যাপ্টেনকে বরণ করার জন্য অপেক্ষা করছেন রাজা। সাথে ব্যান্ডপার্টি তো আছেই।

কন্যাকে ফিরে পেয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন রাজা। বিয়ের দিন, জেটির কাছ থেকে ভেসে ওঠল একটা মানুষ। পুরো শরীর শৈবালে আবৃত লোকটার, পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে বাহারি মাছ। শহরের রাস্তা ধরে হেঁটে চলল অচেনা লোকটা। ঠিক এই রাস্তা ধরেই যাচ্ছিল রাজকন্যার বিয়ের শোভাযাত্রা। শৈবালে ঢাকা লোকটাকে দেখে ধমকে ওঠলেন রাজা, ‘কে তুমি? পথ আটকে দাঁড়িয়েছ কেন? প্রহরী, সরাও একে।’

হাত ওঠাল শৈবাল-মানব, হাতে চকচক করছে দামী হীরা। আংটিটা দেখেই চিনতে পারলেন রাজা, এ যে তার মেয়ের অলংকার। পেছন থেকে বলল রাজকন্যা, ‘এই মানুষটিই আমার আসল রক্ষাকর্তা, একেই বিয়ে করতে চাই আমি।’

ক্যাপ্টেনের সমস্ত অপকর্মের কথা শুনলেন রাজা, সাথে সাথেই বন্দি করলেন। শুভ্র রাজকন্যার পাশে বসল সবুজ স্যামফায়ার, ধুমধামের সাথে বিয়ে হয়ে গেল দু’জনের।

তিনতলা জাহাজ

একদা এক গ্রামে বাস করত এক গরীব পরিবার। এক পুত্রসন্তান ছিল তাদের, কিন্তু তাকে দীক্ষা দানের জন্য কোনও ধর্মপিতা খুঁজে পেল না। গির্জার বাইরে এক আগন্তুককে দেখে অনুরোধ করল দম্পতি, বাচ্চার ধর্মপিতা হতে সম্মত হলো লোকটা। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করল সবাই।

আগন্তুক বলল, ‘বাচ্চাটাকে কিছু উপহার দিতে চাই আমি। এই থলেটা নাও, ছেলেকে মানুষ করবে, পড়ালেখা করাবে। যখন পড়তে শিখবে, এই চিঠিটা দেবে ওকে।’

বিস্মিত হলো দম্পতি, অচেনা লোকটার বদান্যতার কারণ বুঝে উঠতে পারেনি। তবে ধন্যবাদ জানানোর আগেই উধাও হয়ে গেল লোকটা। থলে ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে ছেলেটার লেখাপড়ার খরচ চালাল মা-বাবা। অবশেষে যখন বাচ্চাটা পড়তে শিখল, তখন মা-বাবার কাছ থেকে চিঠিটা বুঝে পেল সে।

চিঠিতে লেখা আছে:

প্রিয় ধর্মপুত্র,

বহু বছর নির্বাসনে থাকার পর, সিংহাসনে পুনরায় আসীন হতে চলেছি আমি। তাই আমার উত্তরাধিকার প্রয়োজন। চিঠিটা পাওয়া মাত্র তোমার ধর্মপিতা, ইংল্যান্ডের রাজার উদ্দেশ্যে রওনা হবে তুমি।

মনে রেখো, পথে একজন ট্যারা ব্যক্তি, এক খোঁড়া লোক এবং একটি টেকো মানুষ থেকে সতর্ক থাকবে।

ছেলেটা বলল, ‘বাবা, মা, বিদায় নিচ্ছি। ধর্মপিতার কাছে যেতে হবে আমাকে।’

কিছুদিন চলার পর, এক অচেনা লোকের সাথে দেখা, ‘কোথায় যাচ্ছ, বাছা?’

‘ইংল্যান্ড।’

‘আরে, আমিও তো ওখানে যাচ্ছি। চলো, একসাথে যাই।’

লোকটার চোখ দেখল ছেলে, ওর সাথে কথা বলছে, অথচ তাকিয়ে আছে অন্যদিকে। বুঝতে পারল, এই লোক সম্পর্কেই সতর্ক করেছেন রাজা। তাই সুযোগ মতো একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে সটকে পড়ল ও। ভিন্ন পথ ধরে অগ্রসর হলো ছেলে। কিছুটা সামনে গিয়ে আবারও একজনের সাথে দেখা। পথিক বসে আছে একটা পাথরের উপর। ‘ইংল্যান্ড চললে নাকি হে?’ উঠে দাঁড়াল লোকটা, হাতে ধরা একটা লাঠি। খোঁড়া লোক। কোনওমতে এই লোকটার হাত থেকে রেহাই পেল সে। আবার অন্য পথে রওনা হলো ছেলে।

তৃতীয় আরেক ব্যক্তির সাথে দেখা হলো এবার, গাঁট্টাগোট্টা সুঠামদেহী এই লোক, মাথায় ঘন কালো চুল, পা-চোখ পুরোপুরি ঠিকঠাক। অচেনা লোকটার সাথে ইংল্যান্ড রওনা হলো সে। রাতে একসাথে সরাইখানায় উঠল দু’জন। আগন্তুকের কাছ থেকে নিজের সম্পদ বাঁচাতে সরাইখানার মালিকের কাছে সবকিছু গচ্ছিত রাখল ছেলে। গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমে নিমজ্জিত, তখন আগন্তুক গেল সরাইখানার মালিকের কাছে। নিজেকে চাকর পরিচয় দিয়ে ছেলেটার জিনিস চেয়ে নিল ও। তারপর ঘোড়া নিয়ে চলে গেল।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল ছেলের, জানতে পারল সেই অচেনা লোকটার কীর্তি। কপর্দকশূন্যে পরিণত হয়েছে ও, রাজার চিঠি আর ঘোড়াটাও সাথে নেই এখন। বাইরে পা রাখল ছেলে, হেঁটেই রওনা হলো। বেশ খানিকক্ষণ পর, নিজের ঘোড়াটিকে গাছের সাথে বাঁধা অবস্থায় খুঁজে পেল সে। যেই না দড়ির বাঁধন খুলতে গেল, ঠিক তখনই আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এল অচেনা লোকটা। হাতের পিস্তল ছেলেটার দিকে তাক করে বলল আগন্তুক, ‘মরতে না চাইলে আমার চাকর বনে যাও, রাজার ধর্মপুত্র হিসাবে আমাকে পরিচিত করে তোলো সবার কাছে।’ কথার ফাঁকেই মাথার পরচুলা খুলে ফেলেছে আগন্তুক, চকচকে টাক বেরিয়ে এল।

রওনা হলো দু’জন, টেকো লোকটা ঘোড়ায় আর ছেলেটা পায়ে হেঁটে। অবশেষে ইংল্যান্ডে পৌঁছুল ওরা। সাদরে টেকো লোকটাকে নিজের ধর্মপুত্র বলে গ্রহণ করে নিলেন রাজা, অন্যদিকে আসল ধর্মপুত্রের স্থান হলো আস্তাবলে। তবে তক্কে তক্কে থাকল টেকো, আসল ধর্মপুত্রকে সরিয়ে পথ পরিষ্কার করতে চাইছে ও।

একদিন ছদ্মবেশী ধর্মপুত্রকে বলল রাজা, ‘আমার মেয়ে বন্দি আছে এক অজানা দ্বীপে, তুমি যদি ওকে মুক্ত করে আনতে পারো, তবে গোটা রাজত্ব তো পাবেই, সাথে আমার মেয়েকেও স্ত্রী হিসাবে পাবে। কিন্তু সমস্যা একটাই, যারা গিয়েছে ওখানে, কেউই আর জীবিত ফিরে আসেনি।’

সুযোগটা কাজে লাগাল টেকো, ‘আমার চাকরকে পাঠিয়ে দিন, অবশ্যই রাজকন্যাকে মুক্ত করে আনবে ও।’

সাথে সাথেই ছেলেটিকে ডেকে আনালেন রাজা, ‘আমার মেয়েকে মুক্ত করতে পারবে তুমি?’

‘অবশ্যই, মহারাজ। শুধু বলুন, কোথায় আছে সে।’

সতর্ক করলেন রাজা, ‘মনে করিয়ে দেই, রাজকন্যাকে ছাড়া ফিরে এলে কিন্তু গর্দান যাবে তোমার।’

চিন্তায় পড়ে গেল ছেলেটা, সমুদ্র তীরের কাছে এসে বসে রইল। জানে না, কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে রাজকন্যাকে। তখনই এক বুড়ো নাবিকের সাথে দেখা, সাদা দাড়ি প্রায় হাঁটু ছাড়িয়েছে তার। সমস্যার সমাধান দিল বুড়ো, ‘তিন তলা একটা জাহাজ চাও।’

রাজার কাছে তিন তলা একটা জাহাজ চাইল ছেলে। দ্রতই একটা তিনতলা জাহাজ তৈরি হলো। বুড়োর কাছে আবার গেল আসল ধর্মপুত্র, জবাব দিল বুড়ো, ‘একতলা পনির, আরেকতলা রুটি এবং শেষ তলা দুর্গন্ধময় পচা মাংস দিয়ে ভরে নাও।’

ঠিক তাই করল ছেলেটা।

‘এখন,’ আবার বলল বুড়ো, ‘রাজা যখন জানতে চাইবে, সাথে করে কাকে কাকে নিয়ে যেতে চাও- তখন শুধু আমার কথা বলবে।’

তারপর, বিদায়ের দিন উপস্থিত। বিশাল বড় তিনতলা জাহাজ এবং সাথে একজন মাত্র বুড়ো নাবিককে নিয়ে যাত্রা শুরু করল চাকররূপী ধর্মপুত্র। এই অদ্ভুত যাত্রা সচক্ষে দেখতে পুরো শহরের সমস্ত মানুষ জড়ো হলো বন্দরে।

টানা তিন মাস জাহাজ চলল, তারপর এক লাইটহাউসের দেখা পেল ওরা। কাছেই একটা জেটি। ছোট ছোট বাড়িঘর দ্বীপজুড়ে, কিছু নড়াচড়াও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অবশেষে একটা আওয়াজ ভেসে এল, ‘কী আছে তোমাদের জাহাজে?’

‘পনির,’ জবাব দিল বুড়ো।

‘বেশ,’ সমস্বরে বলে উঠল কয়েকটি কণ্ঠ। ‘এটাই তো আমাদের প্রয়োজন।’

ইঁদুরের দ্বীপ এটি, বাসিন্দাও এরাই। ‘সমস্ত পনির কিনে নেব আমরা, কিন্তু মূল্য পরিশোধের মতো অর্থ নেই আমাদের কাছে। কিন্তু যখনই প্রয়োজন হবে, শুধু ডাকবে আমাদের- ইঁদুর, ভালো ইঁদুর, সাহায্য করো। দেখবে, সাথে সাথেই হাজির হয়ে যাব আমরা।’

গ্যাংপ্ল্যাংক নামিয়ে দিল নাবিক, দ্রুতই সমস্ত ইঁদুররা এসে নিয়ে গেল পনির।

জাহাজ চলতে শুরু করল আবার, সামনে আরেকটা দ্বীপ। রাতের আঁধারে কোনও অবয়বই নজরে এল না।

সমবেত একটা আওয়াজ ভেসে এল, ‘কী আছে তোমাদের জাহাজে?’

‘রুটি,’ জবাব দিল নাবিক।

‘বেশ,’ সমস্বরে বলে উঠল কণ্ঠ। ‘এটাই আমাদের প্রয়োজন।’

পিপড়ার দ্বীপ এটি, বাসিন্দাও এরাই। ‘সমস্ত রুটি কিনে নেব আমরা, কিন্তু মূল্য পরিশোধের মতো অর্থ নেই আমাদের কাছে। সাহায্য করো। বদলে যখনই প্রয়োজন হবে, শুধু ডাকবে আমাদের- পিপড়া, ভালো পিপড়া, সাহায্য করো। যেখানেই থাকো তোমরা, সাথে সাথেই হাজির হয়ে যাব আমরা সবাই।’

সমস্ত রুটি বয়ে নিয়ে গেল পিপড়ার দল, আবারও যাত্রা শুরু করল জাহাজ।

সামনে আরেকটি পাথুরে দ্বীপ, পাশ দিয়ে যেতেই আওয়াজ ভেসে এল, ‘কী আছে তোমাদের জাহাজে?’

‘পচাগলা মাংস,’ জবাব দিল বুড়ো।

‘বেশ,’ সমস্বরে বলে উঠল কর্কশ কণ্ঠ। ‘এটাই তো আমাদের প্রয়োজন।’

শকুনের দ্বীপ এটি, বাসিন্দাও এরাই।

‘সমস্ত মাংস কিনে নেব আমরা, কিন্তু মূল্য পরিশোধের মতো অর্থ নেই আমাদের কাছে।’ জাহাজ ঘিরে চক্কর দিতে শুরু করল শকুনের দল। ‘কিন্তু যখনই প্রয়োজন হবে, শুধু ডাকবে আমাদের- শকুন, ভালো শকুন, সাহায্য করো। দেখবে, সাথে সাথেই হাজির হয়ে যাব আমরা।’

শকুনদের সমস্ত মাংসের স্তূপ দিয়ে, আবারও ছুটে চলল জাহাজ। এইবার লক্ষ্য- যেখানে বন্দি হয়ে আছে ইংল্যান্ডের রাজকন্যা। তীরে নেমেই বিশাল বড় একটা সুড়ঙ্গে প্রবেশ করল বুড়ো নাবিক এবং ধর্মপুত্র। সুড়ঙ্গ শেষে বিশাল এক প্রাসাদ, চারপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। এগিয়ে এল এক বামন। জানতে চাইল ছেলে, ‘ইংল্যান্ডের রাজকন্যা আছে এখানে?’

‘ভেতরে এস, পরী সিবিয়ানাকে জিজ্ঞাসা করো।’ প্রাসাদে প্রবেশের পথ দেখিয়ে দিল বামন। মেঝেগুলো সোনার, দেয়াল দামী রত্নের তৈরি। মণিরত্নখচিত এক সিংহাসনে বসে আছে পরি সিবিয়ানা।

‘বহু রাজা-রাজকুমার আস্ত সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসেছিল রাজকন্যাকে মুক্ত করতে,’ বলল পরি। ‘এবং তাদের প্রত্যেকেই মারা গিয়েছে। আর তুমি কিনা একাই চলে এসেছ!’

‘সাথে আমার প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর অদম্য সাহসও রয়েছে।’ বলল ছেলেটা।

‘বেশ, তাহলে আমার তিনটা পরীক্ষায় পাশ করতে হবে তোমাকে। যদি ব্যর্থ হও, তবে এখান থেকে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না।’ হেসে বলল সিবিয়ানা। ‘ওই দেখো, পাহাড়টা সূর্যের আলো আটকে রেখেছে। কাল ভোরের মধ্যে এই পাহাড়টাকে কেটে সমান করতে হবে। যেন সকালের মিষ্টি রোদে আমার ঘুম ভাঙে।’

হাতে মাটি খোঁড়ার সরঞ্জাম ধরিয়ে দিল বামন, সেই সাথে পাহাড়ের উপর রেখে এল ছেলেকে। বেলচা দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করল রাজার ধর্মপুত্র, কিন্তু শক্ত মাটিতে লেগে ভেঙে গেল ওটা। এইবার বিপদে পড়ল ও, কীভাবে রাতারাতি এত বড় পাহাড় খুঁড়বে? সাথে সাথে মনে পড়ল ইঁদুরের কথা, হাঁক ছাড়ল সে, ‘ইঁদুর, ভালো ইঁদুর, সাহায্য করো।’

সাথে সাথেই হাজির হলো লাখ লাখ ইঁদুর, পুরো পাহাড় ছেয়ে গেল। সমস্যার কথা বলতেই কাজে নেমে গেল ইঁদুরের দল, মাটি খুঁড়তে শুরু করল।

পরদিন সকালে, নিজের ঘরে সূর্যের আলো দেখে যারপরনাই অবাক হলো পরি সিবিয়ানা। ‘অভিনন্দন,’ ছেলেটাকে বলল সে। ‘তবে তোমার কাজ এখনও বাকি।’ বিশাল এক বাগানে নিয়ে এল, মসুরভর্তি গাছ দিয়ে পুরোটা ভর্তি। রাজার ধর্মপুত্রকে বলল সিবিয়ানা, ‘এক রাত সময় পাবে কেবল, মসুরের গাছ থেকে মসুরের দানাগুলো আলাদা করতে হবে। গাছ এবং দানার আলাদা স্তূপ হবে, একটার সাথে অন্যটা মেশে না যেন।’

মোমবাতি জ্বেলে উধাও হয়ে গেল বামন। একা একা বসে ভাবছে ছেলে, কীভাবে এত বিশাল বড় স্তূপ থেকে গাছ আর দানা আলাদা করবে। কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষেই এই অসাধ্য সাধন করা সম্ভব নয়। ঠিক তখনই পিপড়াদের কথা মনে পড়ল তার। সাথে সাথেই হাঁক ছাড়ল রাজার ধর্মপুত্র, ‘পিপড়া, ভালো পিপড়া। সাহায্য করো।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই পুরো সেলারে গিজগিজ করতে লাগল অগণিত পিপড়া। ছেলেটার কথা শুনে সাথে সাথেই কাজে নেমে গেল পিপড়ার দল। ধীরে ধীরে মসুরের গাছ এবং মসুরের দানার আলাদা দুটি স্তূপ গড়ে উঠল।

‘বাহ! এই কাজটাও দেখি ঠিকঠাক করেছ।’ পরদিন সকালে বলল পরি। ‘তবে এইবারের কাজটা শেষ করতে পারবে বলে মনে হয় না। অনন্ত জীবনের সুধা চাই আমার।’

অনন্ত জীবনের সুধা রয়েছে দূরের একটি প্রায় খাঁড়া পাহাড়ের চূড়ায়, পাহারা দিচ্ছে হিংস্র সব প্রাণী। পাহাড়ের চূড়াতেই উঠা সম্ভব না, সেইখানে চূড়া থেকে পানি…

তবে আশাহত হলো না ছেলে, সাহায্য চাইল শকুনের দলের কাছে। পুরো আকাশ ছেয়ে গেল শকুনের পালে। প্রত্যেকের গলায় ছোট পাত্র বেঁধে দিল সে, নিজে দাঁড়িয়ে রইল পিপা নিয়ে। উড়ে গেল শকুন, নিয়ে এল অনন্ত জীবনের সুধা, ভরে উঠল পিপা। কাজ শেষ হতেই উড়ে এল পরি সিবিয়ানা, সাথে বামন; ওদের লক্ষ্য অনন্ত জীবন সুধার পানি। প্রাসাদের ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল ইংল্যান্ডের রাজকন্যা, ‘অবশেষে মুক্ত হয়েছি আমি!’

প্রতিদিনই জাহাজ ফিরে আসার আশায় তাকিয়ে থাকেন ইংল্যান্ডের রাজা। তাই যখন চাকররূপী ধর্মপুত্রকে ফিরে আসতে দেখলেন, নিজ কন্যাকে ফিরে পাওয়ার খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন তিনি। তবে টেকো লোকটা খুশি হতে পারল না, বরং আসল ধর্মপুত্রকে খুন করার বুদ্ধি আঁটল সে। যখন পুরো রাজ্য রাজকন্যা ফিরে আসায় উৎসবে ব্যস্ত, তখন দুই ডাকাতের মতো লোক গেল ছেলের কাছে। গিয়ে বলল, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে এসেছে, বিষয়টির সাথে জীবন-মৃত্যু জড়িয়ে আছে। আসলে এই লোক দুটো ভাড়া করা খুনি। আড়ালে নিয়ে গিয়েই ধর্মপুত্রের গলা কেটে দিল দুজন। এদিকে ছেলেটার অপেক্ষায় বসে আছে রাজকন্যা। দেরি দেখে উৎসুক হয়ে উঠল ও। নিজেই উদ্ধারকর্তার খোঁজে বের হলো রাজকন্যা, খুঁজে পেল মৃতদেহ। ঠিক তখনই বুড়ো নাবিক উদয় হলো, হাতের পাত্রে অনন্ত জীবন সুধার পানি। ছেলেকে পাত্রে ফেলে দিতেই, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল সে, সেই সাথে আগের চেয়ে আরও সুদর্শন হয়ে উঠল। রাজকন্যা জড়িয়ে ধরল ছেলেকে। দূর থেকে সবই দেখল টেকো লোক, বুড়ো নাবিককে জিজ্ঞাসা করল, ‘পাত্রে কী ছিল?’

‘ফুটন্ত তেল।’

তাই বিশাল পাত্রে তেল গরম বসাল টেকো লোক, হুমকি দিল রাজকন্যাকে, ‘যদি আমাকে ভালো না বাসো, তবে আত্মহত্যা করব আমি।’ নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে পাত্রে ঝাঁপ দিল ও। ফুটন্ত তেলে পড়ার সাথে সাথেই মারা গেল ও। আগুনের তাপে মাথার পরচুলা গলে গেল, বেরিয়ে এল চকচকে টাক।

‘আরে, সেই টেকো লোকটা!’ বিস্মিত হলো রাজা। ‘আমার সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু। তাহলে যুবক, তুমিই আমার আসল ধর্মপুত্র? ঠিক আছে, আমার কন্যা এবং রাজত্ব সব তোমাকে দিলাম।’

এবং তাই হলো।

অনুবাদক: লেখক ও শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম দিন